জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা দুটি এক জিনিষ নয়, প্রথমটি সংগ্রহীত হয় দ্বিতীয়টির সঙ্গে সম্মুখীন হতে হয়,তখনই জ্ঞান অভিজ্ঞতায় পরিবর্তিত হয়। একথা সকলেরই জানা আইন পুলিশকে কিছু ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে, অন্যান্য আইনগুলি বলবৎ করারা জন্যে। এই কাজগুলি করতে গিয়ে পুলিশ কিছু অদৃশ্য ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যায় আপনা আপনি। কেউ কেউ এই ক্ষমতার সীমারেখার মধ্যেই থেকে যান, আবার কেউ কেউ অতিরিক্ত পাবার আশায় সেই সীমারেখা অতিক্রম করে যান অনায়াসে। সামগ্রিকভাবে পুলিশের জীবন খুব সুখের নয়, বেশ করুণ। বিশেষতঃ থানায় কর্মরত মানুষগুলি একটি নিদিষ্ট গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকেন। তার বাইরে যাবার হুকুম থাকে না, তবে যান না তা নয়, সেটা বেআইনি ভাবে। রবিনশন ক্রশোও জঙ্গলের জীবনটাকে উপভোগ করতে চেয়েছিলেন নানান কাজের মাধ্যমে মূলতঃ বাঁচার তাগিদে। পুলিশও তো সামাজিক জীব, সেও থানার এই বৈচিত্র্যহীন জীবনটাকে উপভোগ করতে চায়। এর ফলে কোনটাই আর অনৈতিক বলে মনে হয়। একটা কথা আমরা সবাই জানি কোন দুষ্কর্ম যেমন গোপন থাকে না, আবার সেই ব্যক্তির সামনে তা নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে আলোচনা করে না। সেই ব্যক্তি যদি সেটা মনে না আনে তাহলে ব্যবহারিক জীবনে তেমন ছাপ পড়ে না , হাসিমুখে তিনি সকলের সাথে মিশতে পারেন।
চাকরী পাবার আগে বিভিন্ন বই পুস্তকের মাধ্যমে পরকীয়া শব্দ সমন্ধে সামান্য জ্ঞান অর্জন করেছিলাম। অভিজ্ঞতা হল অনেক পরে। চাকরীর প্রথমেই আমাকে নদীয়া জেলার করিমপুর থানায় যেতে হয়েছিল প্রথমাবস্থায় হাতে কলমে কাজ শেখার জন্যে। কৃষ্ণনগর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূর, বাস ছাড়া কোন যানবাহন নেই। প্রথম দিন আমি আবার যে বাসে উঠেছিলাম সেটি আবার প্রায় ১৮/২০ দূরে মুরুটিয়া নামে একটি গ্রাম ঘুরে যায়। ফলে আমাকে মোটামুটি একশ কিলোমিটার অতিক্রম করতে হয়েছিল, প্রথম কর্মস্থলে যোগদান করার দিনে। স্বভাবতঃ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম,এর আগে কখনো এমন অসুখকর বাস যাত্রার অভিজ্ঞতা হয়নি। {আমার উপন্যাস অভৌগলিক এ এর যথাযথ বিবরণ দেওয়া আছে} সুতরাং বাদ দেওয়া যাক সেইসব তুচ্ছতা। থানার ওসির একটি দায়িত্ব বা সৌজন্যের মধ্যে পড়ে প্রবেশনারের থাকার একটা ব্যবস্থা করা। একে মফস্বল থানা, অফিসার মেস বা ওই ধরণের ব্যবস্থা নেই।সর্বত্রে ঠাঁই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী, গুটি কতক জরাজীর্ণ কোয়ার্টার আছে, হয় তাতে সপরিবারে কেউ বাস করছেন অথবা চার পাঁচ জন মিলে একটি কোয়াটার নিয়ে থাকেন, আর কারুর স্থান সেখানে সংকুলান হবে না। তবে একজন সাব-ইন্সপেক্টর নিজে পরিবার ছাড়া একটি কোয়ার্টার নিয়ে থাকেন। এর পর যখন তাঁকে ডেকে অনুরোধ জানানো হল, তীব্র কন্ঠে আপত্তি জানালেন নানান যুক্তি দেখিয়ে, প্রায়ই তাঁর স্ত্রী আসেন। অন্য কেউ থাকলে অসুবিধা। কে কেমন হবে, জানা নেই এই অবস্থায় কাউকে থাকতে দেওয়ার পক্ষপাতী নন তিনি, তাছাড়া একটি কোয়ার্টারে তিনি একলা থাকেন বলে হাউস রেন্ট পান না। এইসব কথোপকথন ওসির ঘরের বাইরে থেকে সবই শুনতে পাচ্ছি আর নিজের সৌভাগ্যের কথা ভাবছি কর্মস্থলের প্রথম দিনে । বড়বাবুও ছাড়ার পাত্র নয়, শেষ পর্যন্ত বললেন ‘ ঠিক আছে, ওকে বলে দেব আপনাকে অর্ধেক হাউসরেন্ট দেবার জন্যে, আর আপনার স্ত্রী এলে ঘর ছেড়ে দেব”। মনে মনে ভাবছিলাম এই লোকের সাথে একই ছাদের নীচে কি করে বাস করব। কিন্তু ঘরে ঢোকার সাথে সাথে তাঁর ব্যবহার এমন পালটে গেল যা আশাতীত। এমন সহৃদয় মানুষ আমি জীবনে দেখিনি,আমাকে বেডিং খুলতে বারণ করে ওনারই খাটে আজকের মত শোবার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলেন, রাতে ওনার থানায় ডিউটি আছে। । খুবই হাসিখুশি ভদ্রলোক। সত্যিই তো ভুলই ভাবছিলাম অজ্ঞাত কূলশীলকে কেনই বা জায়গা দেবেন। ওনার সঙ্গেই খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল। একটী মেয়ে সকালে বিকালে দুবেলা আসে । ঘর দোর পরিষ্কার করে,বাসন মাজে, রান্না করে। রান্নার হাতটি সত্যিই ভাল। বছর ত্রিশেক বয়স, বিবাহিত , কাছাকাছির কোন গ্রাম থেকে আসা যাওয়া করে।
ঘর ভাগ হয়ে গেল, কোয়াটারে দুটি দরজা, ফলে তালা চাবি আলাদা করতে অসুবিধা হল না। মেয়েটির সঙ্গে ওই সাব-ইন্সপেক্টরই কথাবার্তা বলে নিলেন, কিছু টাকার বিনিময়ে আমার ঘর ঝাঁট দেওয়া , জামা কাপড় কাচে দেবে। খাওয়া দাওয়া তো আছেই একসাথে।
আগস্ট মাস , বর্ষাকাল, সারাদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। কোয়ার্টারের উঠানটি বাঁধানো নয়।উঠান পেরিয়ে বাথরুম পাইখানায় যেতে হয়। সেখানে আবার একটি বড় নিমগাছ। থানা থেকে বেশ দূরেই, চারদিক নির্জন। রাতেও বৃষ্টি বেড়েছে বই কমেনি। রাত প্রায় আড়াইটে তিনটে হবে। রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেছে, প্রকৃতির ডাকের তাগিদে। দরজা খুলে ভেতরের দিকে দাওয়ায় বেরিয়েছি, গোটা উঠানে হাঁটুর ওপরে জমা জল,তিন চারটে ব্যাঙ সেখানে ডাকছে। বৃষ্টি তখন অল্পবিস্তর পড়ছে। ওই জল ভেঙ্গে বাথরুমে যাওয়া একপ্রকার অসম্ভব, বিশেষতঃ মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে। অতএব হাল্কা হতে শুরু করেছি। মনে হল নিমগাছের দিক থেকে মেয়েলী গলায় চাপা হাসি ভেসে এল ব্যাঙের ডাক ছাপিয়ে। চমকে যাওয়া বললে কম হবে, গোটা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে, হাল্কাও হতে পারিনি ভাল করে। তাড়তাড়ি করে কখন ঘরে ঢুকে যাব তাই ভাবছি।এরই মধ্যে আবার ফিস ফিস করে কেউ কথা বলছে, সঙ্গে আবার হাসি। তবে এবার পরিষ্কার নিমগাছের দিক থেকে নয়, ওই সাব-ইন্সপেক্টরের বন্ধ ঘর থেকেই ভেসে আসছে, সেই আধিভৌতিক সংলাপ। ভাল করে বোঝার জন্যে অসৌজন্য হলেও দরজায় কান পাতলাম। না ভুল নয়, মাঝরাতে নরনারীর নিবিড় কথোপকথনের উৎস স্থল , ওই বন্ধ ঘর। ভয় চলে গিয়ে তখন শূন্যস্থানে দুর্ভাবনা এসে ঢুকেছে । নিশ্চয় অনেক রাতে সাব-ইন্সপেক্টরের স্ত্রী এসেছেন। যার অর্থ পরদিন প্রভাতেই বন্দরের কাল হবে শেষ। লটবহর গুটিয়ে নিয়ে অনিকেত যাত্রা।বিছানায় শুয়ে ছিলাম বটে এই দুশ্চিন্তায় ঘুম আসছিল না। ইতিমধ্যে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে, পাখী ডাকছে, বৃষ্টি ছেড়েছে।সেই সাব-ইন্সপেক্টরের ঘরে ঘড়াং করে বাইরের দরজার খিল খোলার আওয়াজ। তারপরে পরেই দরজা বন্ধের শব্দ পেলাম, বাইরে ঘাসের মধ্যে জমাজলে কেউ ছপ্ছপ্ করে পায়ে হেঁটে আসছে। হাত বাড়িয়ে বন্ধ জানলা সামান্য খুলে দিলাম, একি! যে মেয়েটি রান্না করে সেইই শাড়ী গুটিয়ে অতি সন্তর্পনে ধীর পায়ে পার হয়ে যাচ্ছে।
পরকীয়া বিষয়ক অভিজ্ঞতা অর্জনের সাথে সাথে ঘর ছেড়ে যাবার দুর্ভাবনা তখনকার মত চলে গেল। এরপর দুখেপে বছর খানেক ওখানে ছিলাম ভদ্রলোকের স্ত্রী কখনো আসেননি, পরর্বতী কালে সেই সাব-ইন্সপেক্টরের পরকীয়া নিয়ে যে গোপনীয়তা থাকা উচিত ছিল তা অনেক আলগা করে ফেলেছিলেন আমার কাছে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে।