আমার জীবন ও নদী

নদীর সঙ্গে সখ্য সেই কোন ছেলেবেলায়। ঠাকুমার হাত ধরে গঙ্গায় ষাঁড়াষাড়ির বান দেখতে গিয়েছিলাম। বান আসার অপেক্ষায় অনেক লোকের উদ্‌গ্রীব প্রতীক্ষা, তার মাঝে আমার নগণ্য উপস্থিতি। পারের সারি দেওয়া নৌকোগুলো সব মাঝ গঙ্গায়, ঠাকুমা দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে বললেন, না হলে বানের দাপটে কোথায় কে যাবে কে জানে। কিছুক্ষণ পরেই সমস্বরে চীৎকার, কে যেন রেফারীর বাঁশি বাজল। তারপরেই ফুট দেড় দুয়েকের একটা ঢেউ হুড় হুড় করে পার হয়ে গেল। শুধু গেলই না এতক্ষণ ধরে কল্পনায় থাকা ষাঁড়াষাঁড়ি বানের ছবি Yarrow Visited এর মত ধূলিসাৎ করে দিয়ে গেল। “এই তোমার ষাঁড়াষাড়ির বান !” উত্তরে ঠাকুমা বলেছিলেন কামান দেগে নাকি ভেঙ্গে দেওয়া হয় ঢেউএর উচ্চতা বানের তীব্রতা কমাতে।শিশুমনে তাদের অবিবেচকই মনে হয়েছিল, কেমন চারদিক ভেসে যেত, তা নয় নদীর বুকে কামান দাগা। এমন আশ্চর্যের কথা পরে অনেকের মুখেই শুনেছি, কিন্তু তার সত্যতা যাচাইএর জন্যে কোন প্রামাণ্য নথি চোখে পড়েনি। ফলে সেই অকুস্থল অনাবিষ্কৃতই থেকে গেছে আজও। কলকাতার কোন এক সিনেমা হলে বানের জলে দর্শকদের চটি ভেসে যাওয়ার গল্প শুনেছি, মনে হয়েছে আহত নদীর এর থেকে আর বেশী আর কি ক্ষমতা হবে চটি ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া। তখন থেকেই নদীর ওপর আমার করুণা। তবে বানে সম্যক রূপ দেখেছিলাম আর একটু বড় হয়ে। সেটা অবশ্য গঙ্গায় নয়।
গিরিডিতে আমাদের বাড়ী উস্রী নদী থেকে খুব কাছেই, মিনিট সাত আটেকের পায়ে হাঁটা দুরত্ব। নদীকে দেখতাম চকচকে টিনের পাতের মত বালিতে শুয়ে থাকতে। পায়ের পাতা ভিজিয়ে লোকের ওপারে চলে যেত। বালি খুঁড়ে বড় গর্তে জল জমিয়ে বালতি করে তুলে স্নান করত মানুষজন। হঠাৎই এক দুপুরবেলা শোনা গেল গর্জন, কিসের আওয়াজ!! লোকজন ছুটছে, নদীতে বান ডেকেছে, আর কি ঘরে থাকা যায়। কিন্তু কোথায় গেল সেই নিঃস্তরঙ্গ নিরীহ নদী, ঘুমন্ত কুমীরের মত শুয়ে থাকত।দুকূল ছাপিয়ে কি তার জলোচ্ছ্বাস, সঙ্গে ত্রাস জাগানো গর্জন। কাছে যায় সাধ্য কার। নদীর পাড়ে শয়ে শয়ে লোক।মাঝে মাঝে জলের শীকর কণায় ভিজে যাচ্ছে মাথার চুল। ভাগ্যে কোন তোপদার ছিল না সেই মুহুর্তে নদীর এই অনাবিল গতিকে রোধ করার জন্যে। তবুও তার মধ্যে কিছু লোক ব্যস্ত মাছ ধরতে, হাতের চেটোর থেকে সামান্য ছোট রুপোর পাতের মত দুধি্যা মাছ, শেষ কয়েকবার শ্বাসবায়ুর আঙ্খাকায় সমস্ত শারীরিক শক্তি একত্রীভূত করে লাফ দিচ্ছে শূণ্যে, তুচ্ছ হয়ে গেল বানভাসি, তার চেয়ে অনেক লোভনীয় মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর ছোটছোট মাছের ছটফটানি। শুরু হয়ে গেল বেচা কেনা, কৌতূহলী নদীর পাড়ে তখন মাছের বাজার, লজ্জায় ঘেন্নায় সময়ের সাথে সাথে নদীও শান্ত হয়ে এল।
তখন থেকেই নদী আমার রক্তে ঢুকে পড়ল, মাঝে মাঝেই সে স্বপ্নে দেখা দিত, এক আধো অন্ধকার পরিবেশে। রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করেই বলতে হয় তার সাথে মিলনের উপায় ছিল না, কিন্তু প্রণয়ের আকর্ষণ ছিল প্রবল। বারে বারেই এই নদীর স্বপ্ন ভেসে আসত ঘুমের মধ্যে, জিজ্ঞাসায় সদুত্তর পাইনি কারো কাছে, একজনই বলেছিল এ পূর্ব জন্মে দেখা নদী।অনেক পরে এই নদীকে কেন্দ্র করেই একটা গল্প লিখেছিলাম “সমুদ্রযাত্রা”। এরপর যেখানেই গেছি নদী আমার সঙ্গে থেকেছে।
হাঁসখালিতে আমার ঘরের পাশ দিয়েই বয়ে যেত চূর্ণী নদী। ফেরি পার হয়ে আমার দুই মেয়ে ওপারের স্কুলে যেত। দুপুরের নদীতে গা ডুবিয়ে ভেসে থাকত গোরু মোষ। স্থানীয় লোকের মুখে শুনেছি একসময় নদীতে নাকি প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। খয়রা, চ্যালা, বেলে, পুটি আরো কত কি, বাংলাদেশে দর্শণা সুগার মিলে চিনির গাদ নদীতে ফেলায় সেই সুদিন আর নেই। এই নদীর পাড়ে একটি কুড়ে ঘরে এক আদিবাসী মহিলা তার আট’ন বছরের একটি মেয়েকে নিয়ে থাকত। মেয়েটির নাম করুণা, সত্যিই করুণা হবার কথা ওই বয়সেই তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। মেটে সিঁদুর আর শাড়ী পরে সে আমার মেয়েদের সঙ্গে থানার মাঠে খেলতে আসত। দূর দূর গ্রামে যাত্রীদের যাওয়া আসার মাধ্যম ছিল ভুটভুটি নৌকো। বেশ কয়েকবার সওয়ার হয়েছি তাতে। একদিকে মামাজোয়ান, অন্য দিকে ভৈরবচন্দ্রপুর। এই নদীতেই দেখেছি, জানি না কারা কোন বিশ্বাসে বালিশ,বিছানা, মশারী খাটিয়ে কলার ভেলায় নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে অল্প বয়সী একটি ছেলের মৃতদেহ হয়ত ইন্দ্রের সভার উদ্দেশ্যে, কিন্তু কোথায় বেহুলা সে না থাকলে ছিন্ন খঞ্জনার মত কেই বা নেচে ফিরিয়ে আনবে ছেলেটির প্রাণ ।পাড়ে এসে আটকে গিয়েছিল সেই কলার ভেলা , কয়েক জন মহিলা, টাকা পয়সা ছুঁড়ে দিল মশারী চালে, পারানি কড়ির অভাবেই নাকি এই দূর্দৈব, বাঁশের ঠেলায় আবার মাঝ নদীতে পাঠিয়ে দেওয়া হল, ভেসে গেল অনিদিষ্ট লক্ষ্যে। এতো ইচ্ছা পূরণের গল্প নয় তাই অজ্ঞাত রয়ে গেল সেই যাত্রার পরিনতি।
অনেকের কথাই বলা হল না ,কত নদীর যে সঙ্গে সহবাস হল,সেই সব নদীর কূলে দাঁড়িয়ে আমি কইতাম মনের কথা দুই পারেরই সাথে আধেক কথা দিনের বেলা আধেক কথা রাতে। তবে পৌরুষ দেখেছিলাম ব্রম্ভপুত্রের, উমানন্দের মন্দিরে যাওয়া কালীন।বিশাল নদীর এমন সৌন্দর্য, এই পুরুষালী ব্যক্তিত্বের কছে আত্মসমর্পণ করব না, তাই কখনো হয়, জলে হাত ঠেকিয়ে মাথায় ছোঁয়ালাম। সমকামী হবার নিষিদ্ধ আনন্দ উপলব্দি করলাম মন প্রাণ ভরে।
শুরু করেছিলাম গঙ্গাকে নিয়ে, সেই গঙ্গা কে চিনলাম আমার পূর্ণ যৌবনে তখন আমার চব্বিশ বছর বয়স, হরিদ্বার গেছি বাবা মায়ের সঙ্গে,নদীর এমন প্রানোচ্ছ্বল রূপ এর আগে কখনো দেখিনি । কুলকুল শব্দে বলতে চাইছে দূরে আরো দূরে যেখানে তার রহস্যময় রূপের ঠিকানা, তারই অন্বেষনে কেন বার বার মানুষ ছূটে গেছে জানি না। কিন্তু আমি যে এই ঝাঁকি দর্শনেই মুগ্ধ। হর’কি পেয়ারী ছেড়ে গঙ্গার পাড় ধরে একলা একলা ঘুরে বেড়াচ্ছি, উদ্দেশ্য নানান ধরনের নুড়ি পাথর সংগ্রহ। সেখানেও কিছু মানুষ স্নান করছে দূরে দূরে। দুটি অল্পবয়সী মেয়ে পাড়ে দাঁড়িয়েছিল সম্ভবতঃ পাঞ্জাবী, তাদের প্রায় কাছে চলে গিয়েছিলাম,আমার উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে তার মধ্যে একটি মেয়ে তার সমস্ত পোষাক খুলতে শুরু করল। আর কি দাঁড়ানো যায়। কিন্তু কৌতুহল যাবে কোথায়, কিছুটা দূরে গিয়ে সমস্ত সৌজন্য বিসর্জন দিয়ে ঘুরে তাকালাম মেয়েটি তখন উন্মুক্ত নিটোল শরীরে জলে নেমে যাচ্ছে।জ্ঞানতঃ সেই প্রথম নগ্ন নারী দর্শণ। শরীর জোড়া এক অদ্ভুত উত্তেজনা, মনে হচ্ছিল বোধহয় জ্বর আসবে।হয়ত চোখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছিল সেই ভাব নাহলে, গঙ্গা উঠে আসা সাধুটি আমাকে দেখে হাসবে কেন। সহজ হতে গিয়ে তাকেই প্রশ্ন করে ফেলেছিলাম, “ ইন লেড়কীও কা কৈ শরম নেহি হ্যায় কেয়া”। চলতে চলতেই উত্তর দিয়ে ছিলেন, “ মা’কা গোদ মে শরম কা কৈ বাত নেহী বেটা”। গঙ্গা মা, তাঁর কোলে সন্তানের কোন লজ্জা থাকতে নেই। এই সহজ সত্যিটা বোঝার মত মানসিকতা তখন আমার নেই। নিজেকেকেমন যেন পাপী মনে হছিল।উদাসীন গঙ্গা বয়ে চলছিল আপন ছন্দে, তারই ঠান্ডা জলে চোখ মুখ থেকে ধুয়ে ফেলেতে চাইছিলাম সেই বোধ। কিন্তু সব কিছু অতিক্রম করে এক নিষিদ্ধ আনন্দ উঁকি দিচ্ছিল বার বার। ভয় হচ্ছিল হোটেলে ফিরে মায়ের কাছে ধরা না পড়ে যাই।
গঙ্গা এখন অতি নিকটে, ওপারে নৈহাটি এপারে চুঁচুড়া,দুই শহরের নাগরিক জীবনে যাবতীয় ক্লেদাক্ত বিষ প্রতিনয়ত ঢেলে দিচ্ছি সেই নদীর বুকে। যার এক গন্ডুষ জল মৃত্যু পথযাত্রীর শুষ্ক কন্ঠ একমাত্র শান্তি, যার জলে পিতৃপুরুষের তর্পণ করি।সেই জলেই একদিন আমার অস্থি নিমজ্জিত হবে।

This Post Has 5 Comments

  1. Nityaranjan Debnath.

    খুব ভালো লাগলো।

  2. বন্যাধারা রায়।

    ভালো লাগল এই আত্মবীক্ষা ব্লগ ‘আমার জীবন ও নদী’ তে।

  3. Namami BasuRudra

    অনেক সময় মন খারাপ হওয়ার মধ্যে অন্যরকমের ভালোলাগা থাকে। এটা হয়তো এক ধরণের বিলাসিতা। এই স্মৃতিচারণায় সেই ধরণের বিলাসিতা জড়িয়ে রয়েছে। প্রকৃতি সবার জীবনকেই লালন করেছে কোনো না কোনো ভাবে। কিন্তু সবাই তা উপলব্ধি করতে পারিনা। অপূর্ব।

  4. রুমকি রায় দত্ত

    ভালো লেখা। পড়ে ভালো লাগল।

  5. ভয় পাচ্ছিলাম নামটা দেখে! নদী জিনিসটা এমন ব্যাপক এত শাশ্বত, কেমন যেন হারিয়ে যায় নিবিড় কথাগুলো! তারপরে দেখলাম বেশ পঠনের সুড়িপথ বেয়ে হেঁটে চলা কথাগুলি জীবনেরই বেশ , সহজ মনজয়কারী ! কবিতা না হয়ে গদ্য হওয়ার এই দিকটা পজিটিভ বৈ কী!

Leave a Reply