সাশ্রয় শব্দটির সঙ্গে আমার ছোট থেকেই পরিচয় বাবার মাধ্যমে। কতবার বিভিন্ন ব্যাপারে যে সাশ্রয় করা হত, তার ইয়ত্তা ছিল না ফলে শব্দটির অর্থ সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার ধারণা তৈরী হয়ে গিয়েছিল।বাবার আর্থিক স্বচ্ছলতার সীমাবদ্ধতা ছিল বলেই সাশ্রয় খুঁজছেন তিনি সব ব্যাপারে।এই সাশ্রয় করতে গিয়েই বোধহয় আমার বিয়ের যৌতুকের তালিকায় ড্রেসিং টেবিলের সংযোজন অনাবশ্যক মনে করেছিলেন। আমার বাবার বাড়িতেও ড্রেসিং টেবিল ছিল না। মা’যে এই অভাব’টা কোন দিন অনুভব করে ছিলেন বলে মনে হয় না।,চৌকো আয়না দেয়ালে টাঙ্গিয়ে সিঁদুর পরা চুল আঁচড়ানোর কাজ দিব্যি চালিয়ে নিয়ে যেতেন ।আমিও ওতেই অভ্যস্ত ছিলাম বলেই বিয়ের সাজে আমাকে কেমন যে দেখিয়েছিল তা জানা হয়নি। সাশ্রয়ের কারনে বিয়ের কোন ছবি নেই আমার।
বিয়ের পর শ্বশুর শাশুড়ী বা রক্তের সম্পর্কের আর কেউ না থাকায় স্বামীর দু’কামরার ফ্ল্যাটেই দাম্পত্য জীবন শুরু হয়েছিল নেহাতই সাদামাটা ভাবে। স্বামীর ধরাবাঁধা মাসিক রোজগারে বিলাস দ্রব্যের আতিশয্য ছিল না কোনদিনই । নব্য বিবাহিত স্ত্রীর ড্রেসিংটেবল বিলাস সামগ্রী নয় প্রয়োজনীয়, এ বোধ ওর ছিল না বলেই সেখানেও দুই কামরার বাইরের দেয়ালে পেরেকে ঝোলানো ছিল ছোট্ট একটা আয়না, সেটা আবার এমন উচ্চতায় তাতে খালি আমার মুখের আধখানা দেখা যেত। প্রয়োজনের তাগিদে আর একটু নীচে আর একটা পেরেক পুঁতে আয়নাটা ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম যাতে অন্ততঃ মুখটা পুরো দেখা যায়। আমার স্বামী যেহেতু আমার চেয়ে সামান্য লম্বা, তাই তার প্রয়োজনের সময় আয়নাটা আবার আগের জায়গায় ঝুলিয়ে চুল আঁচড়িয়ে নিত সাধারণতঃ স্নানের পর, সারাদিনে একবারই আয়নার প্রয়োজন অনুভব করতে সে । অফিস ছাড়া তো বাইরে বেরুবার খুব একটা দরকার হত না । দোকান বাজার আনুষাঙ্গিক বাইরের যাবতীয় কাজ আমাকেই করতে হত। আমাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া বা কোথায় বেড়াতে যাওয়া এগুলো যে জীবনযাত্রার অঙ্গ, তা কখনো মনে হয়নি ওর, ফলে বাবার ওপর অভিমানে আমিও স্বামীর ওপর কখনো কোন দাবী দাওয়া পেশ করিনি।
সেও এমন উদাসীন, এটাই ন্যায্য বলে ধরে নিয়েছিল। ফলে আট বছরের বিবাহিত জীবনে এর কোন হেরফের হল না, আমিও এই ব্যবস্থাপনার সঙ্গে মানিয়ে নিলাম চমৎকার ভাবে। প্রথম প্রথম অভিমানে চোখে জল আসত,পরে বাবা চলে যাবার পর বুঝেছি সাশ্রয় শব্দটার আর একটা অর্থ হল সমঝোতা যা বোধহয় প্রত্যেক মানুষকেই কমবেশী মেনে চলতে হয় গোটা জীবনে।
,স্কুলে এক ধরনের ছেলেরা থাকে মুখচোরা দুস্টুমি বদমায়সী করে না ভীতু গোছের ,শেষের দিকে বা মাঝের বেঞ্চে বসে, বন্ধু বান্ধব তেমন একটা থাকে না। ছুটি হলে ছুটোছুটি হৈহুল্লোড় না করে গুড় গুড় করে বাড়ী চলে আসে, ।আমার স্বামী ছিলেন অনেকটা ওই ধরনের। সরকারী চাকুরে শুনে বাবা তড়িঘড়ি বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। অফিসে আমার স্বামীর অবস্থান ,ভবিষ্যতে কোন উন্নতির সম্ভবনা আছে কিনা ,আগে যেমন খতিয়ে দেখা হয়নি, পরেও আর জানার কোন উপায় ছিল না। আগেই বলেছি আমার স্বামী ছিল ভীষণ মুখচোরা খুব কম কথা বলত। বাড়ীতে এসে অফিস সম্বন্ধে একটি কথাও কখনো খরচ করতে শুনিনি।শারিরীক মিলনও ছিল সাবধানতা সহকারে অত্যন্ত যান্ত্রিক, বাড়তি কোন উচ্ছ্বাস বা উদ্যোগ কোনটাই ছিল না। ইস্যু নেবার ব্যাপারে ছিল তীব্র আপত্তি, “না না অনেক খরচার ব্যাপার, এই রোজগারে সেটা সম্ভব নয়”। যতবারই এই প্রসঙ্গ উত্থাপন হয়েছে প্রতিবারই একই কথা, শেষ ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল , চীৎকার চেঁচামেছি যেটা হল একতরফা, খবরের কাগজের ঢালে মুখ ঢেকে আমার যাবতীয় বাক্যবাণ এড়িয়ে গেলেন নীরব কৌশলে। এর পর আমার রাগে অভিমানে চোখের জল ফেলা ছাড়া কোন কিছু করার ছিল না। এতেও তাঁর কোন ভাবান্তর হল না। চোখের জল মুছে চীৎকার করে জানিয়ে দিলাম “অর্থই যখন সমস্যা, এরপর যা করব তাতে সংসারে সাশ্রয়ই হবে কোন বাধা দেওয়া চলবে না। সাশ্রয় কথাটা উচ্চারণের সময় বাবার মুখটা একবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। মনে মনে বলেছিলাম সাশ্রয় মানে সবসময় সমঝোতা নয়,কখনো কখনো তা প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়ায়।
মুখের থেকে খবরের কাগজ সরিয়ে সংশয় ভরা চোখে আমার স্বামী জিজ্ঞাসা করল স্বামীত্ব বজায় রাখতে, “কি করবে কি এরপর? “যখন করব দেখতেই পাবে”-কথাটা বড় মুখ করে বললাম ঠিকই কিন্তু কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম। হায়ার সেকেন্ডারী পাস করে কলেজে ভর্তি হবার পরই বিয়ে হয়ে যায়। এই বিদ্যে নিয়ে চাকরী বাকরী করা বা পাওয়া কোনটাই তেমন সম্ভব নয় যে সংসারে সাশ্রয় হবে।
সময় চলে যেতে লাগল, সেভাবে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হল না।আমার স্বামীরও কোন হেলদোল নেই, থাকার কথাও নয়। ইতিমধ্যে আমাদের ওপরের তলার ভদ্রলোক বদলী হয়ে গেলেন, ফ্ল্যাটে একটা ভাড়াটে বসিয়ে দিয়ে চেন্নাইয়ে চলে গেলেন সপরিবারে । তখনই মনে হল আমাদের একটা ঘরতো ফাঁকাই পড়ে থাকে।সেরকম কোন লোককে তো ভাড়া দেওয়াই যেতে পারে। একজন গৃহবধুর কতটুকুই বা যোগাযোগ। স্টেশনারী দোকানদার, গুড়ো চা’য়ের দোকানের ছেলেটা, মুখচেনা রিকসাওলা, আবাসনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দু’ একটা টোটো চালক, এই তো হল বর্হিজগতে আমার পরিচিত’র গন্ডী।
আবাসনের এইচ ব্লকের ললিতা বৌদি ওনার’স এ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারী, দেখা হওয়া মানে ঝকমারি, নানান প্রশ্ন অহেতুক কৌতুহল। এড়িয়েই চলি, মুখোমুখি হয়ে গেলে ভদ্রতার খাতিরে একটু হাসতেও হয় অনিচ্ছায়। আমার স্বামী কারুর সঙ্গেই মেশেন না, তাই এই সৌজন্যটুকু বজায় রেখে চলতে হয়।
কোন অনুষ্ঠান না থাকলে কেউ কারো ফ্ল্যাটে যাওয়ার রেওয়াজ নেই। হীনমন্যতা বশতঃই আমিও কারুর ফ্ল্যাটে যাই না। ললিতা বৌদিকে দেখে আমিই জিজ্ঞাসা করলাম, “ কি ব্যাপার কোথায় চলেছেন হনহন করে”।
“ আর বলো না, কর্তার অফিসে এক অফিসার বদলী হয়ে এসেছেন ওনার একটা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে, যাচ্ছিলাম ওই এক দালালের টেলিফোন নাম্বার আনতে”।
“ওঃ!”
“ সমস্যা অনেক উনি আবার ফ্যামিলি আনবেন না, ছেলে মেয়েরা পড়াশুনা করছে দিল্লীতে। ওনার স্ত্রীও ওখানে কি একটা চাকরী করেন”।
কথাটা বলা উচিত হবে কিনা ভাবছিলাম। দ্বিধা সংকোচের সঙ্গে বলেই ফেললাম, “ আমাদের তো একটা ঘর খালিই পড়ে থাকে। যদি……”
“ ওঃ! তোমরা ঘর ভাড়া দেবে তা আগে বলোনি কেন, তাহলে আর কোথাও যাচ্ছি না, বিকালেই ওনার সঙ্গে কথা বলছি”। উত্তেজনায় বুকটা ধড়ফড় করছিল। কর্তা কে না জানিয়ে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।
এমনিতেই অফিস থেকে ফিরে বড় একটা কথা বলে না, খানিকক্ষণ খবরের কাগজে মুখ ঢেকে বসে থাকে তারপর টিভি চালিয়ে বস্তাপচা সিরিয়াল, টিভির দিকে তাকিয়ে থাকলেও সেটাও যে মন দিয়ে দেখছে বলে আমার মনে হয় না।
সেদিন অফিস থেকে ফেরার পর রোজকার মতন চা জলখাবার দিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম। অন্যদিকে তাকিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন আমার উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে। সাহস সঞ্চয় করে কথাটা বলেই ফেললাম, “ পাশের ঘরটা ভাড়া দেব”। টিভি চলার দরুণই হোক আর অবিশ্বাস জনিত কারণেই হোক কপাল কুঁচকে আমার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন, “ কী?”
“আমাদের পাশের ঘরটা ভাড়া দেব”। চায়ের কাপটা বিছানার ওপর রাখতে গিয়ে কিছুটা চা বিছানার চাদরে উলটে পড়ল। “ না না তা কি করে সম্ভব”।
“সম্ভব নয় কেন”? আমার মনের মধ্যে তখন একটা আলাদা জোর এসে গেছে, “ তোমাকে তো বলেই ছিলাম আমি যেটা করব সেটাতে বাধা দেওয়া চলবে না, এতে সংসারের সাশ্রয় হবে”।
“বাধা দেওয়া চলবে না মানে বাড়িটা তো আমার”। বুঝলাম এতদিনের চাপা পড়া অধিকার বোধ জাগ্রত হয়ে উঠেছে।
“কাগজপত্রের বিচারে তোমার হলেও আমারও সমান অধিকার আছে, অতএব যা বলছি তাই হবে”। আমার কাছ থেকে এই কথা গুলো ও আশা করেনি। ফলে কি বলবে বুঝতে পারছিল না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন –“ তুমি যা ইচ্ছে তাই করবে আমাকে মেনে নিতে হবে”। আমি সেদিন একরকম মরিয়া একটা এস্পার ওস্পার করতে চাইছিলাম।
“ কেন কথায় কথায় খরচের কথা বলো না? যা রোজগার করো তা নাকি যথেষ্ঠ নয়, আমি জানতেও চাইনি তোমার রোজগার কত, সংসার চালানোর জন্যে প্রয়োজনীয় জিনিষ কেনা কাটার ব্যাপারে তোমাকে কৈফিয়ৎ দিতে হয়। প্রতিটি খরচের পাই টু পাই হিসেব দিতে হয়, একটা বাড়তি পয়সাও আমার হাতে থাকেনা,” এতগুলো কথা একনাগাড়ে বলতে গিয়ে চোখে জল এসে গিয়েছিল, দীর্ঘদিনের ক্ষোভ চাপা দিয়ে রেখেছিলাম। তারই বহিঃপ্রকাশ হয়ত এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেত না , যদি না কলিং বেলটা বেজে উঠত। আমাদের বাড়িতে সাধারণতঃ কেউ আসেনা সুতরাং কলিং বাজাটা একটু আশ্চর্যের। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে দালানের আলো জ্বালিয়ে ভেতর থেকে জিজ্ঞাসা করলাম’ “কে?”
বাইরে থেকেই ললিতা বৌদি সাড়া দিলেন, “আমি”। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেখি ললিতা বৌদির সঙ্গে প্রায় সাড়ে ছ’ফুট হাইটের এক সুদর্শন ভদ্রলোক। সর্বনাশ এই ভদ্রলোকের কথাই তাহলে ললিতা বৌদি বলেছিল। কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ‘আসুন আসুন’ করে ডেকে নিয়ে গিয়ে ভদ্রলোকটির দিকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিলাম।
“তোমার সঙ্গে কথা হবার পর তাপসকে ফোনে সব কথা জানাই, টিফিন আওয়ার্সে তাপস জানালো সমীরণ বাবু রাজী আছেন আজই ঘরটা দেখবেন, তোমাকে আর জানাবার সুযোগ হয়নি, একেবারে সমীরণবাবুকে নিয়ে চলে এলাম”।
“আমার স্বামী”। সমীরণবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানালেন।
“ অফিস থেকে সরাসরি এসেছেন, বসুন একটু চা বসাই”। ললিতা বৌদিই বাধা দিল-“ না না কেয়া, চা বসাতে হবে’না , ওনাকে নিয়ে বাসায় যাব, আমাদের ওখানেই ডিনার করবেন”।
ঘরটা ঝাড়পোছ করা হয়নি, আসবাবপত্র তেমন কিছু নেই ওখানে, ডিভানের মত একটা ছোট খাট, আমার স্বামীর উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত, বিয়ের আগে ওটাতেই শুত আর একটা আলনা। ঘরটা দেখে মনে হল না ভদ্রলোকের অপছন্দ হয়েছে। কি ভাগ্যি ঘরটা যখন দেখানো হচ্ছিল আমার স্বামী বিছানা থেকে উঠে এসে সবার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল। সমীরণবাবুই প্রথম কথা বললেন-“ না আমার একলার পক্ষে ঘর ঠিকই আছে, তবে শুধু তো থাকলেই হবে না আমি যদি পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকি তাহলে কি আপত্তি আছে”। আমার স্বামী বোধহয় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই আমি উত্তর দিলাম _ “ না না অসুবিধে কিসের, তবে আমাদের সাধারণ খাওয়া দাওয়া”। সমীরণ বাবু হেসে উত্তর দিলেন , “বাড়িতে তো অসামান্য খাওয়া দাওয়া করি না”। আমাকে কত দিতে হবে”। কি বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না এই ধরনের কথাবার্তায় আমি একদমই অভ্যস্ত নই। যাইহোক ললিতা বৌদির মধ্যস্থটায় ঠিক হল সাড়ে পাঁচহাজার টাকা। ভদ্রলোক এককথায় রাজি হয়ে গেলেন।
“আমি তাহলে কালকেই হোটেল থেকে চেক আউট করে সরাসরি চলে আসব, কাল আমার অফিস নেই আপনারা থাকবেন তো”। কিছু বলার আগেই আমার স্বামী বলে উঠল- “ছুটি থাকলেও কাল আমাকে অফিস যেতে হবে।আমি জানি ওটা ওর বাহানা, এইভাবে যদি আমার এই প্রয়াস’টাকে বাতিল করে দেওয়া যায়। সমীরণবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তাড়াতাড়ি আমি সামাল দিলাম, “ হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি আপনার মালপত্র নিয়ে চলে আসুন আমি থাকব”।
(২)
একটা ঢাউস সুটকেশ ছাড়া এমন কিছু মালপত্র নেই সমীরণবাবুর, চোখে পড়ার মতন খালি একটা বেবি সরোদ। “ আপনি সরোদ বাজান”, উত্তর না দিয়ে খালি একটু হেসে ছিলেন। গান বোধহয় বিয়ের বাজারে যোগ্যতা নির্ণনের মাপকাঠি, বাবা তাই মনে করেছিলেন সেইজন্যেই আমাকে গান শিখিয়ে যোগ্য করে তোলার ব্যাপারেও, তাতে যে সাশ্রয় করতে হবে সেটা বোধহয় মনে করেন’নি। তাই গান খুব খারাপ গাইতাম না। তবে এখানকার হালচাল দেখার পর হারমোনিয়াম তবলা তানপুরা কিছুই নিয়ে আসিনি। অবসরেও কখনো গুনগুন করতে ইচ্ছে হয়নি তা নয় । হঠাৎই ইচ্ছেটা চাগাড় দিয়ে উঠল,তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে এলাম । কবেকার শেখা সেই বন্দিশটা দিব্যি মনে পড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে দমন করলাম সুর ভাঁজা থেকে। আমার গান জানার কথাটা কি সমীরণবাবুকে এইভাবে জানানোর দরকার আছে নাকি । ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা, কি মনে করতেন ভদ্রলোক কে জানে । এইসব ভাবনার মধ্যে ঘরের ভেতরের দালান থেকে ‘বৌদি” ডাক শুনেই ধড়মড় করে সেদিকে গেছি।
“ দেখুন আমি কিন্তু ম্যাডাম, বা মিসেস অমুক বলে ডাকতে পারব না, একই বাড়ি যখন থাকব প্রয়োজনে বৌদি বলেই ডাকব, একটা পেরেক দিতে পারেন”।
“পেরেক?”
“হ্যাঁ, পেরেক বা হুক, আমি লম্বা মানুষ আয়নাটা আর একটু ওপরে লাগাতে হবে, নাহলে মুখ দেখা যাবে না, আপনাদেরটা আয়নাটা রেখে দিন আপাততঃ। আমারটায় কাজ চলে যাবে, শুধু ব্যবহারের সময় পেরেকটা চেঞ্জ করে নেবেন”। সমীরণবাবুর হাসির সঙ্গে আমি কিন্তু হাসতে পারলাম না। একটা শক্তপোক্ত ছোট সাইজের হুকের সাথে হামাল দিস্তের ডান্ডাটা সমীরণবাবুর দিকে এগিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আয়না ঝোলানো হয়ে গেল। দামী আয়না কাঁচ দেখেই বোঝা যায়। তফাতে সরে এসে দেখছিলাম, চকচক করছিল ওনার ফরসা মুখটা, ক্লিন শেভড্ গাল থেকে একটা নীলচে আভা বার হচ্ছিল, এপাশে ওপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিলেন, হাতের আঙ্গুলগুলো চুলের মধ্যে চালিয়ে যথাসম্ভব পরিপাটি করতে চাইছিলেন । যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে আয়নায় আমার ছায়া পড়বেনা। তাই আমার এই চুরি করে দেখাটা ওনার চোখে পড়বেনা জানি, কিন্তু যদি না হঠাৎ করে মুখ ফেরান, তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বলি , “আপনি চা খাবেন তো”।
(৩)
এরপর আমি নিজেই বুঝতে পারছি আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন এসে গেছে। রোজ বিকালে গা ধুয়ে, মুখ পরিস্কার করে ছোট্ট একটা টিপ পরতাম, কোথাও তো যাওয়া নেই, যে ক’খানা শাড়ি আছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরতাম সুন্দর করে।অপেক্ষা করতাম কখন সমীরণবাবু ফিরবেন। আমার স্বামী বুঝতে পারলেও মুখে কিছু বলত না। আমার কেমন যেন মনে হত বিরক্তিকর বোলতার মত তার দৃষ্টি আমার পিছনে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কয়েক মাসের মধ্যেই কিন্তু সংসারের সাশ্রয় দেখা যাচ্ছিল। ইএমআই মাধ্যমে একটা ফ্রিজ কিনেছি, আজকালের মধ্যেই ডাইনিং টেবিল আর চারটে চেয়ার এসে যাবে। সমীরণবাবুর কথা মত আয়নার ওপরের দেয়ালে একটা এল ই ডি বালব্ লাগানো হয়েছে, ব্যবহারের সময় সেটা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম প্রথম সমীরণবাবু অফিস থেকে ফিরে চা জলখাবার খেতে আমাদের ঘরেই আসতেন আমার স্বামীর সঙ্গে গল্প করবেন বলে। ও তো গল্প করত না তবলায় অনিচ্ছায় ঠেকা দেওয়ার মতন হ্যাঁ, হু করত। বরং আমি সেখানে অন্য কোন প্রসঙ্গ উত্থাপন করে এই আলাপচারিতা আরো এগিয়ে নিয়ে গেলে সেটা যে আমার স্বামীর অপছন্দ বোঝা গেল একদিনের মন্তব্যে- “ তুমি বসে গল্প করছ, সমীরণবাবু খাবেন তো”। আমার উঠে যাওয়ার সাথে সাথে তিনিও উঠে গিয়েছিলেন। তারপর থেকে সরোদ বাজাতেন নিজের ঘরে। তাতেও আমার স্বামীর আপত্তি ছিল। অকারণেই টিভির সাউন্ড বাড়িয়ে দিয়ে তাকিয়ে থাকত শূণ্য দৃষ্টিতে। এরই মধ্যে রান্নাঘর থেকে , সরোদের সুর শুনে রাগ’টা চেনার চেষ্টা করতাম। খুব ইচ্ছে করত একবার গিয়ে জিজ্ঞাসা করে আসি’না, আমি ঠিকমত চিনেছি কিনা, আগে তবু রাতের খাবার সমীরণবাবুর ঘরে দিয়ে আসতাম, তখন দু’একটা দরকারী কথা হত, রান্না ঠিক আছে কিনা, খেতে কোন অসুবিধে হচ্ছে কিনা, এখন তো ডাইনিং টেবিলেই খাবার দেওয়া হয় আমার স্বামীর সাথে। ফলে কোন কথা বলার সুযোগ থাকে না।
সেদিন ছিল রবিবার, সাধারণতঃ শনি রবিবার উনি থাকতেন না। সেদিন শনিবার রাতেই ফিরে এলেন। রবিবার বেশ সকালেই পাজামা পাঞ্জাবী পরে বেরিয়ে গেলেন, ফিরতে খুব দেরী হল না। মাংস কিনে এনেছেন, আমাকে বললেন, “জমিয়ে রান্না করুন তো অনেকদিন খাসির মাংস খাওয়া হয়নি। দামের কথা চিন্তা করেই আমাদের সংসারে খাসির মাংস হত না। মাংসটা নেবার সময় ভদ্রতার খাতিরেই বললাম, “ আপনাকে তো বলেছিলাম যদি কিছু খাবার ইচ্ছা হয় বলবেন”।
“না না সেজন্যে নয়, মনে হল তাই নিয়ে এলামঃ। আমার স্বামী খবরের কাগজ পড়লেও সব কথাই শুনেছে, আমি ঘরে ঢুকতেই চোখের ইসারায় কাছে ডাকল আমাকে, চাপা গলায় বলল, “মাসের শেষে মাংসের দামের টাকা”টা বোধহয় বাদ’দিয়ে দেবে ”।
“ দেয় তো আর কি করার আছে যা দেবে সেটাই হাত পেতে নিতে হবে। এতদিন এসেছেন আমরা তো মাংস খাওয়ায়’নি একদিনও”। কথাটা শোনার পর আমারও যেন কেমন মনে হতে লাগল, তাই যদি হয় সেটা তো অন্যায় নয়।
সকাল থেকেই উনি বাজনা নিয়ে বসেছেন, চা দিতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করায় বললেন, পরীক্ষা আছে তাই রবিবার আর কোথাও না গিয়ে রেওয়াজ করবেন। কথাটা আমার স্বামী শুনলে হয়।
পরদিন সোমবার, দুপুরবেলা আমার স্বামীর অফিস থেকে ফোন এল, ও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি হয়েছে। কথাটা শুনে মাথাটা ঘুরে গেল, সমীরণবাবুকে একটা ফোন করে চাবিটা ললিতা বৌদির ফ্ল্যাটে রেখে দিয়ে হাসপাতালে চলে গেলাম। হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারলাম, বুকে ব্যাথা হওয়ায় অফিস থেকে গাড়ী করে সরাসরি হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছে। যে ডাক্তারবাবুর অধীনে উনি ভর্তি হয়েছেন তিনি আবার সন্ধ্যেবেলা আসবেন, সিস্টারের কাছ থেকে জানা গেল, অবস্থা স্থিতিশীল চিন্তার কারণ নেই। তবু আমি যেন ডাক্তারবাবুর সাথে দেখা করে যাই।
আমার স্বামী বিছানায় শুয়ে থাকলেও জেগেই ছিলেন, আমাকে দেখেই অনুযোগ করলেন-“ কালকে মাংস খেয়েই আমার এই অবস্থা হয়েছে, সমীরণবাবুকে বারণ করে দেবে হুটপাট এরকম মাংস নিয়ে যেন না আসে”।
আমি চুপ করে আছি দেখে আবার বললেন, “ আমি এখানে থাকব না, বন্ড দিয়ে নিয়ে যাবে”।
কারণটা খুব সহজেই বুঝতে পারলাম, “ সন্ধ্যে বেলায় ডাক্তার বাবু এলে জিজ্ঞাসা করে দেখব উনি কি বলেন, তুমি এত চিন্তা করছে কেন , এতে অসুস্থতা বেড়ে যেতে পারে”।
সন্ধ্যেবেলা ডাক্তারবাবুর সাথে দেখা করলাম, উনি আজকের রাতটা অব্জারভেশনে রাখতে চাইছেন। যেহেতু কোন ওষুধ খান না তাই চিন্তার ব্যাপার। প্রেসার সামান্য বেশী আছে। এরপর আমি কিকরে বলব, বণ্ড দেবার কথা তবু বললাম, “ উনি তো থাকতে চাইছেন না”।
ডাক্তারবাবু হেসে উত্তর দিলেন, “ পেসেন্ট একটু ভাল বোধ করলেই সে বাড়িই যেতে চায়, আপনি চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে”। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হবার সামান্য আগেই চলে আসব বলে দেখা করতে গিয়েছিলাম, দেখলাম উনি ঘুমাচ্ছেন। ভালই হল, নাহলে বন্ড দিয়ে বাড়ী নিয়ে যাবার জন্যে জোরাজুরি করতেন।
হাসপাতাল থেকে বেরুবার মুখে দেখি সমীরণবাবু এসেছেন, সব কথা ওনাকে বললাম। এখন আর দেখা না করাই ভাল। মনে মনে জানি সমীরণবাবুকে দেখলে বাড়ী ফিরে আসার জন্যে ব্যগ্রতা আরো বাড়বে। ফেরার সময় সমীরণবাবুই ট্যাক্সি করলেন। মনের মধ্যে একটা উত্তেজনা তৈরী হচ্ছিল, কেমন একটা শিহরণ। আমার স্বামীর অসুস্থতা কারণে কোন দুঃচিন্তা হচ্ছিল না আমার, বারে বারেই মনে হচ্ছিল আজকের রাতে আমি একা, পাশের ঘরে সমীরণবাবু।অথচ ওনার কথাবার্তা একেবারেই স্বাভাবিক, আমার উত্তেজনার লেশ টুকুও নেই ওর মধ্যে নেই । শুধু ফেরার সময় বললেন আজ আর রান্না করার দরকার নেই, খাবার আনিয়ে নিলেই হবে।
সেদিন প্রথম সমীরণবাবুর সাথে এক টেবিলে খেতে বসলাম। কিন্তু আশ্চর্য একটা কথাও বলতে পারছিলাম না, একমনে মাথা নিচু করে খেয়ে যাবার ভান করছিলাম । অথচ একসময় কত ভেবেছি, ওনার বাড়ির কথা, ওনার পরিবারের কথা, জিজ্ঞাসা করব। আমিও যে গান জানি তাই বাজনা সম্বন্ধে কৌতুহল দেখাব, কথা প্রসঙ্গে গান জানার কথা শুনলেই স্বভাবতঃ কারণে অনুরোধ করবেন গান শোনানোর জন্যে, কোনটা শোনাব সেটাও গুনগুন করতাম। ।এসব ছিল আমার অলস মুহুর্তে ভাবনা । অন্য সময় আমার স্বামীর চাউনিটাই ছিল আমার কাছে লক্ষ্মণ রেখা, সেইটুকু পার হতে কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকত।জানি এমনি তে ভীতু মানুষ, মুখে কিছু বলার সাহস নেই, দৃষ্টির মধ্যে অভিভাবকত্ব আরোপের ক্ষমতা ছিল, সেটা কোন কারণে অস্বীকার করতে পারতাম না।
খেতে খেতে সমীরণবাবু বললেন, “ আপনি বোধহয় খুব দুঃশ্চিন্তা করছেন, সেটা খুবই স্বাভাবিক, আমি বলছি দেখুন সেরকম কিছু হয়নি ওনার”। কি করে বোঝাব ওর জন্যে এতটুকু দুঃশ্চিন্তা করছি না। ওনার সঙ্গে বসে খেতেও পারছিলাম না, চেয়ার ছেড়ে ঊঠে দাঁড়ালাম, “ না না সেরকম কিছু নয়, আপনি খেয়ে নিন”।
“আপনি তো কিছুই খেলেন না।“
“রাতের দিকে আমি কমই খাই”। তাড়াতাড়ি মশারী খাটিয়ে শুয়ে পড়লাম, সমীরণবাবুর ঘরের আলো ভেতরকার দালানে এসে পড়েছে। তার মানে দরজা খোলা আছে, মাঝে মাঝে টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছে, উনি যন্ত্রটা বাঁধছেন। এর পরেই বাজনা শুরু হবে,তখন কি উঠে গিয়ে ওনার ঘরে বসব। কি আর হবে, এখন তো বাড়িতে কেউ নেই। আচ্ছা উনি যদি কিছু মনে করেন , বলে বসেন আপনার স্বামী বাড়ি নেই আপনার এখানে আসাটা ঠিক হয়নি। হয়ত কিছু বললেন না, মনে মনে ভাববেন , স্বামী অসুস্থ আর উনি বাজনা শোনার অছিলায় এই ঘরে এসেছেন । এসব কোনটাই হল না , ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুম ভাঙ্গতেই মনে হল পাশের ঘরে সরোদ বাজচ্ছে। ধড়মড় করে উঠে বসেছি, দালান অন্ধকার, কোন আলো নেই, নিঃস্তব্দ কোন আওয়াজ নেই । তাহলে কি ভুল শুনলাম না স্বপ্ন দেখলাম।
ঠিক তখনই কলিংবেলের টিংটং আওয়াজ, এত রাতে কে এল, ভুল শুনিনি তো। না আবার, তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুললাম, -“ একী তুমি”। আমার স্বামীকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠেছি।
“হ্যাঁ, আমি হাসপাতাল থেকে চলে এলাম”।
“চলে এলাম মানে”। ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে এসেছেন আমার স্বামী।
“ তোমাকে তো বলেছিলাম বন্ড দিয়ে নিয়ে আসতে, সে যে তুমি আনবে তা আমি জানতাম”।
“ডাক্তারবাবুই বললেন অব্জারভেশনে রাখবেন , আগামী কাল কতকগুলো টেস্ট হবার কথা”।
“ অনেক খরচ ওসবের, ”। পাশের ঘরে আলো জ্বলে উঠল, সমীরণবাবু দালানের দিকের দরজায় এসে দাঁড়ালেন- “ একী আপনি চলে এসেছেন?”
“হ্যাঁ হাসপাতালে থাকার কোন দরকার নেই, আপনারা কি ঘুমাননি?” কথাটা বলেই আমার দিকে ইঙ্গিতপূর্ন ভাবে তাকাল আমার স্বামী। সমীরণবাবুও আস্তে আস্তে নিজের ঘরে চলে গেলেন। মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠেছিল রাগে বিশেষতঃ আপনারা কথাটা শুনে,- “ঘুমব না কেন বেল বাজতেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে, মরে তো আর যায়নি, নাও জল খেয়ে শুয়ে পড়ো কাল অনেক কাজ আছে থানা পুলিশের কেলেঙ্কারী যদি এড়ানো যায়।”
“থানা পুলিশ হবে কিসের জন্যে”? রাগে চাপা গলায়, যতটা সম্ভব ক্ষোভ উগরে দেওয়া যায়, সেইভাবেই বললাম-
“ হাসপাতাল থেকে পালালে ওরা থানাতেই খবর দেবে, তখন বলতে হবে উনি চৌকি দিয়ে ওনার স্ত্রীর সতীত্ব রক্ষে করবেন বলে পালিয়ে এসেছিলেন’। বেড সুইচটা টিপে অন্ধকার করে দিলাম।
পরদিন সমীরণ বাবু জানিয়ে দিলেন উনি অফিসের কাছে সিংগল রুম ফ্ল্যাট পেয়ে গেছেন, চারদিন বাকী থাকতে পুরো মাসের টাকাটা হাতে দিয়ে চলে গেলেন। পরে দেখলাম উনি আয়নাটা নিয়ে যেতে ভুলে গেছেন। ওটা আমার কাছে রেখে দিয়েছি, আমার স্বামী অফিস চলে গেলে সবচেয়ে উঁচু পেরেকে ওটা লাগিয়ে তাকিয়ে থাকতাম দূর থেকে যেখান থেকে আমার ছায়া না পড়ে তাতে।