এ যুদ্ধ নয়

স্মৃতি রোমন্থন আমার একধরনের বিলাস বলতে পারেন, যেহেতু অনেকটা সময় কেটে গেছে পুলিশী সাহচর্যে, তাই ঘুরে ফিরে থানা কোর্ট কাছারী, অপরাধী, রাজনৈতিক নেতা কত বিচিত্র মানুষের কথা মনে পড়ে। অনেক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা দুঃস্বপ্নের মত জেগে ওঠে। তবু এই স্মৃতিচারণ বন্ধ হয় না,আমরা  ভুলে যাই কিন্তু অনিচ্ছেতে, অনভ্যাসে, তাই  স্কুল কলেজের  পড়া বেশীরভাগই ভুলে গেছি, কর্মজীবনের সবকথা মনে আছে তা নয়। পুলিশের জীবনে প্রত্যেক দিনই নতুন, গতদিনের অভিজ্ঞতা পরেরদিন  কাজে লাগে না। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলেও পুলিশী ঘটনার পুনরাবৃত্তি নেই বললেই চলে। খুন খারাপী রাহাজানি ছাড়াও তো এমন কিছু ঘটনা আছে যা সত্যতা যাচাই করার উপায় না থাকলেও অবলীলায় মেনে নিতে হয় এ নিছকই খাটি সোনা, একতিল খাদ নেই।

১৯৮৮ সালে আমি কল্যাণী থানায়। কল্যানী একটি এলিট শহর, অধিকাংশ মানুষ শিক্ষিত, স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।কিছু অবসরপ্রাপ্ত মানুষ আছেন কর্মজীবনে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এখনো সেই পদমর্যাদার হ্যাং ওভার কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এঁদের সঙ্গে ব্যবহারে যথেষ্ঠ সতর্কতা বজায় রাখতে হয়। এমনি এক সকালে এক বয়স্ক ভদ্রলোক থানায় এলেন, বয়সের ভারে কিছুটা ঝুঁকে পড়েছেন। একটি রসিদ হাতে দেওয়া মাত্র বুঝতে পারলাম প্রায় বছর দেড়েক আগে উনি ওনার একটি রিভালবার, কিছু গুলি ও  লাইসেন্স সমেত জমা দিয়ে গিয়েছিলেন। বিদেশে ছিলেন ছেলে বা মেয়ের কাছে। সম্প্রতি ফিরেছেন তাই রিভালবারটি ফেরত নিতে এসেছেন।এটা কোন নতুন ঘটনা নয়।  ব্যক্তিগত আগ্নেয় অস্ত্র যাদের কাছে থাকে  বাড়ী ছেড়ে দীর্ঘদিন বাইরে গেলে থানায় জমা দিয়ে যান নিরাপত্তার কারণে। ভদ্রলোকটি বসতে বলে মালখানা অফিসারকে রসিদটি ( থানার পরিভাষায় সি ফর্ম বলা হয়) দিয়ে বললাম রিভালবারটি নিয়ে আসার জন্যে।রিভালবারটি দেখে সত্যিই আশ্চর্য হয়ে গেলাম, এত ছোট রিভালবার আমি এর আগে দেখিনি। এত সুন্দর বহনযোগ্য, হাতের মাপসই, ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোন বাড়তি উদ্যোগ লাগে বলে মনে হল না। বিদেশী রিভালবার বলেই মনে হচ্ছিল, ঠিকই মেড ইন চেকোশ্লোভাকিয়া।  কৌতুহলী অস্ত্রটি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করাতে জানালেন উনি মিলিটারী ডাক্তার ছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধ শেষ হবার পর মেজর পদমর্যাদায় থাকাকালীন চাকরী ছেড়ে দেন। আগ্নেয় অস্ত্রটী আমার খুব পছন্দ হয়েছে দেখে হাসলেন, বললেন, “ ওয়ার ফিল্ডে  ওটা কোন কাজে লাগে না, তবু থাকে আত্মহত্যা করার জন্যে”। চমকে উঠে বলি, “ সেকী?” “ হ্যাঁ, ধরা পড়ার আগে সুযোগ থাকলে আত্মহত্যাই করতে হয়,জার্মানরা যুদ্ধবন্দীদের ওপর যা অত্যাচার করত, তার চেয়ে মরা অনেক ভাল। অস্ত্রটি ফেরত দেবার কিছু ফরমালিটিস্‌ ছিল, ইচ্ছে করেই দেরী করছি। চা খাইয়ে গল্প জুড়লাম, জিজ্ঞাসা করলাম, “ কোথায় যুদ্ধ করেছিলেন?” “ না যুদ্ধ করা যেটাকে বলে তা আমাকে বিশেষ করতে হয়নি, যেহেতু আমি ডাক্তার, ত্রিপোলী থেকে অনেকটাই দূরে একটা অস্থায়ী হাসপাতালের চার্জে ছিলাম”। ইতিমধ্যে অনেকেই এসে উপস্থিত হয়েছে গল্প শোনার লোভে। বললাম, “ত্রিপোলী মানে লিবিয়া? নর্থ আফ্রিকা? ফিল্ড মার্শাল রোমেল…” শেষের কথাটা অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এসেছিল। “হ্যাঁ। ঠিক বলেছেন, রোমেলকে আমি দেখেছি” । চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে পড়েছিলাম, “কি বলছেন কি?”

“কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না? নাউ আই এ্যাম এইটিটু”। সত্যিই কথাটা বিশ্বাস হচ্ছিল না,বললাম-“ তা কি করে সম্ভব? আপনি তো ব্রিটিশ মানে মিত্র বাহিনীর পক্ষে”।

“হ্যাঁ।শুধু দেখিনি দোভাষীর মাধ্যমে, দু’একটা কথা বলেছি, হ্যান্ডসেক করেছি”। বলে হাতটা মেলে ধরলেন। রিভালবারটা সত্যিই ফেরত দিতে ইচ্ছে করছিল না।

“যদি ঘটনাটা একটু বলেন”।

“অনেকদিন আগেরকথা সালটা ঠিক মনে নেই, একচল্লিশ বেয়াল্লিশের আশপাশ হবে। বললাম না আমি তখন অস্থায়ী হাসপাতালের চার্জে। নামেই হাসপাতাল পরিকাঠামো বলে কিছুই নেই, ওষুধ ইঞ্জেকশন কিছুই তেমন পাওয়া যায় না, অধিকাংশ আহতরাই মরে যায়। নেহাত যার পরমায়ু থাকে…যুদ্ধে আহত মানে তো যে সে আহত নয় সিভিয়ার বুলেট ইনজুরি। একদিন দুজন জার্মান সৈন্যকে পাওয়া গেল আহত অবস্থায়। পালিয়ে যাবার মত অবস্থায় নেই। বেশ কটা মেসিনগানের গুলি লেগেছে, একটার অবস্থা খুব খারাপ। অপারেশন করে সীমিত ক্ষমতায় কয়েকটা গুলি বার করা সম্ভব হল। জার্মানদের কড়া জান, তাই যুজছে”।

“শত্রুপক্ষের লোক মেরে ফেললেই তো হত”। থানা তো কেউ না কেউ মন্তব্য করবেই। ভদ্রলোক তার মুখের দিকে তাকালেন, “ যুদ্ধে বেঁচে থাকাই আশ্চর্য, মেরে ফেলা তো যায়ই”।

রিভালবারটা সাইড ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন, “ আপনাদের সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে দেরী হয়ে গেল, যা বলছিলাম, এর দিন দুয়েকের মাথায় বেশ   সকালবেলা দুটো কনভয় এসে দাঁড়াল, স্বস্তিক চিহ্ন দেখে বুঝলাম, জার্মান কনভয়, হুড়মুড় করে বেশ কিছু জার্মান সোলজার নেমে পড়ল। ভয়ে তখন প্রাণপাখী উড়ে গেছে। প্রতিরোধ করার মত ফোর্স হাসপাতালে থাকে না। যার আছে তাদের এ্যার্লাট থাকবে বললাম, হাসপাতাল আক্রমণ করবে বিশ্বাস করতে পারছিনা। সোলজাররা এ্যালাইমেন্ট দাঁড়িয়ে গেল, তিনজন জার্মান আস্তে আস্তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, কিছুটা এসে, নিজেদের ওয়েপন মাটিতে শুইয়ে দুই হাত উঁচু করে আমার সামনে এসে দাঁড়ল, একজন বেশ লম্বা। সামনে আসতে বুঝতে পারলাম এরা জার্মান বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসার। আমার সঙ্গে আরো দু’তিন জন অফিসার রয়েছেন। ওদের মধ্যে একজন ইংরিজিতে লম্বা লোকটিকে দেখিয়ে  বলল, “ ইনি ফিল্ডমার্শাল রোমেল”।মনে হল ভুমিকম্প হল,ইতিমধ্যে উনি হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন  হ্যান্ডসেক করার জন্যে। কোনক্রমে হাত বাড়িয়েছি, দুবার ঝাঁকানি দিয়ে জার্মান ভাষায় কিছু বলে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্য জন ইংরিজিতে বলতে শুরু করল, “ উনি খবর পেয়েছেন দুজন জার্মান সোলজার আহত হয়ে এখানে ভর্তি আছে,উনি তাদের সঙ্গে দেখা করতে চান”।বুঝলাম এ ইন্টা্রপ্রিটার,ইংরাজী জানে।  কিন্তু  এটা কখনোই সম্ভব নয়, এটা জানানো মাত্রই, আবার জার্মান ভাষায় কিছু বলে গেলেন, যার অর্থ- ওয়ারলেসের মাধ্যমে আমরা যেন মন্টেগোমারীর কাছে ম্যাসেজ করি,  ফিল্ড মার্শাল রোমেল তাঁর কাছে এই ফেভারটুকু চাইছেন। কথা বলার দৃঢ়তা দেখে মনে হল যে কাজে এসেছেন তা শেষ না করে যাবেন না। ব্যাপারটা সময়সাপেক্ষ বসতে অনুরোধ করলাম, রাজী হলেন না। প্রায় মিনিট চল্লিশ পর খবর এল, ওনাকে এ্যালাউ করার জন্যে। ভেতরে ঢোকার আগে আমাকে বললেন তোমাদের কোন ইন্টারপ্রিটার আছে, আমি ওদের সঙ্গে কি কথা বলব তোমাদের জানা দরকার। মানুষটা ভদ্রতা ও সাহস দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। সামান্য দুজন সোলজারের জন্যে এতখানি ঝুঁকি নিয়ে শত্রুপক্ষের হাসপাতালে এসেছেন। আমাদের কোন জার্মান জানা লোক ছিল না। ওনার ইন্টার প্রিটার কেই বললেন, কি কথা হচ্ছে যেন সে আমাদের বুঝিয়ে বলে। একজনের কথা বলার মত অবস্থায় ছিলনা,  অন্যজনের সঙ্গে মিনিট পাঁচেক কথা বললেন।মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।  যাবার সময় বলে গেলেন আহত সৈনিকটী তাঁকে জানিয়েছে  এখানে সে  যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছে।আবার আমার সঙ্গে হ্যান্ডসেক করে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে গেলেন”। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম, অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল, পরে মনে হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধে জার্মানীর ঘৃণ্য ভূমিকা তো ভোলার নয়, তারই মধ্যে,ফিল্ড মার্শাল রোমেলের জন্যে কেন আলাদা সমীহ, কেন তাঁর বীরত্ব মিথ’এ পর্যবসিত, বোধহয় এই জন্যেই।

Leave a Reply