কদিন ধরেই আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা, আষাঢ়স্য প্রথম দিবসেই সগৌরবে হাজির। সঙ্গে ঝোড়ো বাতাস। ওপরের ঘরে একলাই শোয় পৃথা, টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে, মনের মধ্যে একটা সুর গুনগুনিয়ে উঠছিল, “রিমিঝিম রিমিঝিম”, কাল কি এই গান’টা গাইবে। না না তা কি’করে আজ তো সবে আষাঢ়ের প্রথম দিন, ওখানে তো “শ্রাবণ বর্ষণ” না না ওটা তো শ্রাবণ মাসের গান। তবে কি আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল- না না, প্রথমদিনই যে মেয়েকে তারা দেখতে আসছে, তার গলায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার গান শোনে তো হয়ে গেল। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে পৃথা ঘুমিয়ে পড়েছিল ছিল নিজেও তা জানে না। আজ ঘুম ভেঙ্গেছেও অনেক ভোরে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীচের দিকে চোখ যেতেই মনটা আনন্দে ভরে গেল- ইসঃ গোটা উঠানে জলে জলময়, এত বৃষ্টি হয়েছে নাকি রাতে, পুকুরটা কি অবস্থা কে জানে, কই মাছগুলো যদি পুকুর থেকে উঠে উঠানে চলে আসে, কি মজাই না হয়। এতক্ষণে সঠিক পছন্দ হয়েছে গান’টা, গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল , নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আজ নাহিরে।ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে” “ হ্যাঁরে পাগলী , যাসনে ঘরের বাহিরে!! আজ আমার ইন্টারভিউ”। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল রজত।
“সেকিরে দাদাভাই, কত নম্বর?
“তেরো”।
“সেকিরে আমারো যে তেরো, আজ বিকালে আমায় দেখতে আসছে”।
“পাগল হয়েছিস এই জল বৃষ্টি মাথায় করে’।
“ নারে দাদাভাই, কাল রাতেই বাবা ফোন করেছিল, ইনোভা হাঁকিয়ে আসবে, সে না হয় ওরা আসবে কিন্তু তুই কি করে যাবি বলতো, তোর তো হাঁকাতে গেলে সেই লঝড়ে সাইকেল”।
“ধুর! তা আবার হয় নাকি, যেতে তো হবেই। রজত একটু গম্ভীর হয়ে গেল, “হল তো অনেকদিনই রে”।
“নারে দাদাভাই সব ঠিক হয়ে যাবে” দীর্ঘশ্বাস ফেলে রজত-
“ বাদ দে তো ওসব, আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে, সেটাই এনজয় করি’। মা’কে বল খিচুড়ি আর ডিম ভাজা করতে ”।
“দাদা”!!
“কি হল”?
“তুই কি আমাকে মার খাওয়াবি, আজ তোর ইন্টারভিউ,তার ওপর খিচুড়ি আর ডিম ভাজা খেতে চাইছিস। জানিস না, দুটোই সমান অপয়া। খবরদার দাদাভাই মুখেও আনিস না ওকথা ।
রজত হো হো করে হেসে উঠল- “ একদম মনে ছিল না, চেপে যা”।
“রেন কোট নিবি তো ?”
“পাগল,জানিস না তো ওটা ট্রাঙ্ক থেকে বার করলে চেরাপুঞ্জীতে বৃষ্টি থেমে যায় ”। রজত চলে গেলে পৃথা কাগজ কেটে নৌকো বানান শুরু করল, উঠানের জলে নৌকা ভাসাবে। বৃষ্টি হলে ওর ভারী আনন্দ, গান কবিতা ভূতের গল্প কত কি , কোথা দিয়ে যে দিন’টা কেটে যায় নানান নানান ছেলেখেলায়। তবে আজকে মনের মধ্যে একটা উদ্বেগ রয়েই গেছে। নৌকো বানাতে বানাতে গুনগুন করে ওঠে “হেলা ফেলা সারা বেলা একি খেলা আপন সনে”।
“হ্যাঁরে তোর কি কোন কাজ নেই , দুদিন বাদে নিজের সংসার হবে, তা নয় জল কাদায় নেমে নৌকো ভাসাচ্ছিস”। মায়ের কথায় উত্তর না দিয়ে হাসতে হাসতে আবৃত্তি সুরু করে- “ ছুটি হলে রোজ ভাসাই জলে কাগজ নৌকা খানি লিখে রাখি তাতে আপনার নাম”………।
“ মা আমাদের একটা কুলো ছিল না?”
“ছিল তো, কিন্তু কুলো নিয়ে কি করবি”?
“পিঠে বাঁধব,একে তেরো নম্বর তায় আনলাকি”।
“ যা বলেছিস তার ওপর এত বৃষ্টি, বলে না বসে বাদুলে ”।
সারাদিন পৃথার রূপের পরিচর্চা হোক না হোক কুলোর পরিচর্চা হয়েছে যথাযথ, ভালো করে ধুয়ে হলুদ মাখিয়ে সিঁদুর দিয়ে চোখ মুখ এঁকে পরানো হয়েছে টগর ফুলের মালা। দোতলায় বারান্দায় টেবিলে সুসজ্জিতভাবে শোভা পাচ্ছে।
“ একী করেছিস?”
“কেন তুই ভুলে গেছিস দাদাভাই, ইস্কুলে পড়ার সময় কুলোর মাথায় কাঁচি গেঁথে তুই একদিকে ধরতিস আর এ আমি একদিকে জিজ্ঞাসা করতাম কুলোদেবতা এবারের পরীক্ষায় পাস করব তো, কুলো যদি ঘুরে যেত ব্যস আর কোন ভাবনা থাকত না। আজ তোর পরীক্ষা শেষ, নে ধর কাঁচির একদিক”।
“ক্ষেপে গেলি” অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাঁচির হাতলটা আঙ্গুলের মাথার ওপর রাখে রজত।
“ নে ভক্তিভরে প্রণাম কর। কুলোদেবতা আমার দাদাভাই কি এবারে চাকরী পাবে তো। ঘুরে যাবার আগেই সহসা একটা ঝোড়ো বাতাস কুলোটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল।
বুঝেছি কি হবে এবারও, নে এবার তোর’টা দেখি”।
না দাদাভাই, দেখতে হবে’না ওরা আসবে, খানিক আগে জানিয়েছে ওদের ছেলের বিয়ের ঠিক হয় গেছে ”।