টিকটিকি

প্রকাশের ছবিটা এমন ভাবে টাঙনো ছিল সকালে ঘুম ভাঙ্গালেই প্রথমেই জয়তীর চোখে পড়ত, আজকে সেদিকে তাকিয়ে মনে হল ছবিটা যেন একটু বেশী ঝুলে পড়ছে, বালিশে মাথা রেখেই জয়তী ভাবছিল তিন বছরেরও বেশী সময় ধরে ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটা ওখানে টাঙ্গানো রয়েছে, হুকের সঙ্গে বাঁধা দড়ি কোন কারণে আলগা হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। আজ যখনই হোক একবার দেখতে হবে, কোনভাবে ছিঁড়ে পড়ে গেলে শুধু যে কাঁচ’টা ভাঙ্গবে তা নয়, ছবিটার ক্ষতি হতে পারে। প্রকাশের পারলৌকিক কাজের দু’দিন আগে সৌরীন ছবিটা নিয়ে এসে হাতে দিয়ে বলেছিল “ দ্যাখো তো কেমন হয়েছে ছবিটা”। মানুষ’টাই যখন নেই তার ছবি নিয়ে ভাল মন্দ কোন মন্তব্যই করতে চায়’নি জয়তী।
বিছানা ছেড়ে উঠে মশারী খুলে পাট করে রাখতে রাখতে মোবাইল ফোনে মেসেজ আসার শব্দ কানে যেতেই এতক্ষণের ভাবনায় শুধু ছেদ পড়ল তা নয়, মনের বিরক্তি প্রকাশ পেল কপাল কুঁচকে গিয়ে। এ নিশ্চয়ই সৌরীনের গুডমর্নিং মেসেজ। কোনদিন জয়তী যেমন উত্তর দেয়নি সৌরীনেরও ভুল হয়নি নানান ছবি সহযোগে গুড মর্নিং গুড নাইট মেসেজ পাঠাতে।ঝাঁটা দিয়ে বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে মনের বিরক্তি ঝেড়ে ফেলতে চাইছিল জয়তী। তবুও কোথায় যেন তার রেশ’টা থেকেই যাচ্ছিল। লকডাউনের জেরে স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে দু’বছর হতে চলল, সেই থেকেই সৌরীনের আধিখ্যেতা যেন বেড়েই চলেছে, সময় নেই অসময় নেই যখন তখন চলে আসা, তাকে তো কেউ দায়িত্ব দেয়নি জয়তীর দেখভাল করার। মোবাইলে কোন না কোন মেসেজ করে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে নিজের উপস্থিতির কথা জানান দেওয়া । প্রকাশ মারা যাবার পর থেকে জয়তী এই আবাসনের ফ্ল্যাটে একলাই থাকে। আশপাশের বাসিন্দার সঙ্গে সম্পর্কের কোন ঘাটতি হয়নি। কিন্তু সৌরীনের এই অতিরিক্ত আন্তরিকতার অন্য রকম মানে হতে বেশী দেরী হবে না তাদের কাছে।
সৌরীন প্রকাশের দীর্ঘদিনের বন্ধু ছাড়া জয়তীর কাছে আর অন্য কোন পরিচয় নেই তার । বিয়ের আগে থেকেই তাকে চিনত , বিবাহোত্তর কালে ওর আর প্রকাশের একান্ত সান্নিধ্যে কাবাবে হাড্ডির মত মাঝে মাঝে যে সে উপস্থিত থাকত না তা নয়।বিয়ের পর কটা দিনই বা, যদিও অসুস্থ হবার পর প্রকাশ বেশী দিন ভোগেনি, তার সেই সময়ে জয়তী যেন একটু বেশী ভরসা করে ফেলেছিল সৌরীনের ওপর। তারপর প্রকাশের চলে যাওয়ার আকস্মিকতায় ব্রেকফেল হওয়া গাড়ির মত জীবনযাত্রার দিনগুলো এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল সাময়িকভাবে। সেইসময় সৌরীনের সহায়তার মধ্যে কোন অস্বাভাবিত্ব ছিল না। বিষয়’টা তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু সেই সুত্র ধরে প্রায়শঃই বিকাল থেকে সন্ধ্যা পার করে ইচ্ছেহীন আলাপচারীতায় জয়তী যেন হাঁপিয়ে উঠেছে । ফলে দুঃসময়ে পাশে থাকার জন্যে যে কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল, সেটা সরে গিয়ে সেই জায়গায় আস্তে আস্তে দখল করে নিচ্ছে বিরক্তি ও অপছন্দ। যার জন্যে সেদিন স্পষ্টতঃ জানিয়ে দিয়েছিল – “ আচ্ছা সৌরীন’দা আমরা তো মোটামুটি সমসাময়িক, আমাদের কৈশোরে বা তারপরে বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে সাতসকালে গুডমর্নিং বা সুপ্রভাত কিংবা রাতে গুড নাইট জানানোর কোন রেওয়াজ ছিল কি? জয়তীর অপছন্দ’টা বুঝতে পারলেও ব্যাপার’টা হেসে হাল্কা করতে চেয়েছিল সৌরীন। “ তখন তো আর সোস্যাল মিডিয়া ছিল না, যার জন্যে এসব আদান প্রদানের কথা কেঊ ভাবত না”। এই ধরণের যুক্তি যে দেওয়া হবে সেটা জয়তী যে জানত না তা নয়, মনের বিরক্তি চেপে রেখে জানতে চেয়েছিল- “ তাহলে এর মাধ্যমে বন্ধুত্ব নিবিড় হয় এটাই বলতে চাও, আর আগে তা হত না, ভাগ্যে সোস্যাল মিডিয়া ছিল না কি বলো! তোমার কাছে ব্যাপার’টা খুব মেকী ফরম্যাল মনে হয় না”।
“ তুমি এটাকে এত সিরিয়াসলি নিচ্ছ কেন? আমি শুধু তোমাকেই নয় আরো অনেক’কে পাঠাই, আমিও অনেকের কাছ থেকে পাই, নিজেদের মধ্যে একটা যোগসুত্র থেকে যায়, এই যে প্রকাশ নেই, আমি তোমার পাশে আছি তার একটা বার্তা দেওয়া। কোভিডের আবহাওয়া এখনো চলছে, কখন কার কি হয় কিছু বলা যায় না । জয়তীর কাছে আশ্চর্য লাগছে এর পরেও সৌরীন কেন তার অপছন্দ বুঝতে পারছে না , নাকি বুঝেও নানান যুক্তি দিয়ে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। জয়তী আরো খারাপ লেগেছে তোমার পাশে আছি কথাটায়। আজ তিন বছর হয়ে গেছে প্রকাশ নেই তার মানে প্রকাশ না থাকলে কেউ না কেউ এইভাবে পাশে থাকতে চাইবে এরপর আর ভাবতে চাইনি জয়তী। সঙ্গে সঙ্গে জয়তী উঠে চলে গিয়েছিল অন্য কাজের অছিলায়। তারপরেও সৌরিন খানিক’ক্ষণ বসে থেকে চলে যায়। প্রকাশ মারা যাবার পর জয়তী লক্ষ্য করেছে কেউ কেউ যেন একটু বেশী অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করছে।
স্কুলের সেক্রেটারী জ্যোতিপ্রকাশ’বাবু, ভদ্রলোক খুব ছেলেমানুষ নন। শাসকদলের কেউকাটা হিসাবে এলাকায় পরিচিতি আছে। ভালই বয়স হয়েছে। নিজেকে এখনো সুপুরুষ মনে করে আত্মশ্লাঘায় ভোগেন। প্রকাশ মারা যাবার পর প্রায়শঃই কোন না কোন দরকারে স্কুল এসে জয়তীর সঙ্গে দেখা করে সান্ত্বনা জ্ঞাপন করে যেতেন। এর মাধ্যমে নিজের সংবেদনশীলতা প্রকাশ করতেন আর পাঁচ জনের কাছে। জয়তী এটা স্বাভাবিকই ভেবেছিল। কিন্তু তারপরে প্রায়ই হেডমিস্ট্রেসকে ফোন করে জয়তী ’কে ছুটির পরে থাকর কথা বলতেন। প্রথম প্রথম জয়তী কিছু মনে করেনি। স্কুলের কিছু সাংগঠনিক কাজ জয়তীকে দিয়ে দ্রুত করিয়ে নিতে চাইতেন, যদিও সেটা তার আদৌ করার কথা নয়।মুখে কিছু বলত না জয়তী। বরং কথার ছলে হাসতে হাসতে তিনিই বলতেন – “কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম আপনাকে দিয়ে খাটিয়ে নিচ্ছি বলে, নিজেকে যত বেশী কাজের মধ্যে এনগেজ করে রাখবেন তত তাড়াতাড়ি শোক কাটিয়ে নতুন কিছু করার কথা ভাববেন”। কথাটা বেশ ইঙ্গিতবহ। সেটা বুঝেও জয়তী কিছু বলেনি।
শেষের দিকে কোন কাজ নয় খেজুরে আলাপচারিতা। এটা যেন একটা রুটিন হয়ে গেল সপ্তাহে এক দু’দিন বিশেষ করে শনিবার। ছুটির পর জয়তীকে থাকতে বলা হত স্কুলে। প্রতিবারেই হেডমিস্ট্রেসকে ফোন করে জানাতেন, সেদিকে ওঁর জ্ঞানের নাড়ি টনটনে, জয়তীর মোবাইলে কখনোই ফোন করেন’নি। স্কুলের ল্যান্ডফোনেই এই সব নির্দেশ আসত, যেন ব্যাপারটা অফিসিয়াল । হেডমিস্ট্রেস ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে জয়তীকে জানিয়ে যেতেন। ভাগ্যে লক ডাউন হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় জয়তীর মোবাইলে ফোনে কোনদিন ফোন করেন’নি বা সৌরেনের মত নিয়মিত কোন মেসেজ পাঠান’নি। সেদিক থেকে রক্ষে। প্রকাশ চলে যাবার পর তিন বছরে একবারের জন্যে জয়তীর মনে হয়নি নতুন করে কোন সম্পর্ক গড়ার কথা।
কলিং বেল বাজল। মালতী এল নিশ্চয়ই। দরজা খুলে মালতীকে দেখে প্রথম কথা “ কিরে দেরী করলি কেন”? ভেতরে ঢুকে মাস্ক খুলে দেয়ালের পেরেকে টাঙ্গিয়ে বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বলল- “বাঁশ দিয়ে ঘিরে কিসব জোন করেছেনা, তাই ওদিকে দিয়ে আসতে দিল না, ঘুরে ঘুরে এলাম”।
“কতদিন যে এসব চলবে কে জানে”।
“চা খেয়েছ নাকি?”
“ না না , চায়ের জল বসাবার আগে দাদাবাবুর ছবিটা একবার নামাতে হবে, দড়িটা বোধহয় নষ্ট হয়ে গেছে, চেয়ারে দাঁড়িয়ে কিছু করতে গেলে আমার পা কাঁপে”।
“তুমি যেন কিরকম হয়ে যাচ্ছে, একটু শরীরের যত্ন নাও না, আয়না দেখছ নিজেকে, চোখের নীচে একটা কালো দাগ পড়ছে, রাতে বোধহয় ঠিকমত ঘুমাও না”। জয়তী কথা জবাব না দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল।

(২)
“দ্যাখ, পারবি কিনা, না হলে আমাকে লোক ডাকতে হবে”
“না না পারব, তুমি চেয়ার’টা একটু ধরে রেখো, হড়কে পড়ে না যায়”। মালতী চেয়ারের উঠে প্রকাশের ছবি’টা হুক থেকে খোলার সময় “ও! মাগো” বলে চীৎকার করে হাত থেকে ছবিটি ফেলে দেওয়া মাত্র ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙ্গার আওয়াজ। জয়তী আর্তনাদ করে উঠল, “ যা;! যে ভয় করেছিলাম, তাই হল। কি করলি বলতো”। খাটের পাশে ছবি’টা কোথায় পড়ল , নীচু হয়ে সেটাই খুঁজতে চাইল।
‘কি করব বৌদি, ওই কালো টিকটিকি’টা ছবির পিছনে ছিল, আমি হাত দেওয়া মাত্রই খরখর করে আমার হাতে উঠে পড়ছে”। জয়তী দেয়ালের দিকে তাকাতেই টিকটিকি’টা ত্রস্ত পায়ে আলমারির পিছনে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেল।
চেয়ার থেকে নামতে নামতে মালতী বলল, “ তুমি ওঠো আমি বার করছি, ভাঙ্গা কাঁচে হাত কেটে যাবে তোমার “।
মালতী খাটের তলায় ঢুকে প্রকাশের ছবি বার করার পর জয়তী কিছুটা নিশ্চিন্ত হল- “ যাক শুধু কাঁচই ভেঙ্গেছে , ছবিটা ঠিক আছে”।
“সৌরিন’দা এলে বলো কাঁচ লাগিয়ে নিয়ে আসবে”। মালতীর কথায় যথার্থ বিরক্ত হল জয়তী- “ কেন? সৌরিনদা কেন, আমি পারি না”।
জয়তীর অপছন্দ বুঝতে পেরে মালতী তার কথার যুক্তি দিতে চাইল। “ না মানে এখনো সব স্বাভাবিক হয়নি, কবে কোথায় বন্ধ কবে খোলা , সেজন্যে বলছিলাম”।
“ সে আমি ঠিক দেখে নেবো, তুই ছবিটা খবরের কাগজ মুড়ে আলমারীর মাথায় রাখ”। কথাটা বলেই দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে এলো জয়তী। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কোথাও টিকটিকি’টাকে দেখতে পেল না। মুখ ঘোরাতেই আয়নায় নিজের ছায়া পড়েছে দেখে ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। মালতীর কথাটা মনে হতেই মুখটা আয়নার কাছে নিয়ে গিয়ে চোখের নীচে সত্যিই কোন দাগ আছে কিনা দেখার জন্যে হাত বাড়িয়ে মাথার ওপর লাইটা জ্বালিয়ে দিল। একটা হাল্কা ছোপ যেন সত্যিই মনে হচ্ছে তার। রাতে ঘুম নাহলে এধরণের ছোপ পড়ে নাকি। এখন তো নানান রকমের ক্রীম পাওয়া যায়। ঠিকঠাক পরিচর্যা করলে দাগ’টা নিশ্চয়ই থাকবেনা। প্রকাশ চলে যাবার পর এসব করার ইচ্ছেও হয়না। তারপর প্রায় দু’বছর ধরে যা চলছে।
আয়না থেকে মুখ সরিয়ে তাড়াতাড়ি দরজার দিকে তাকাল, এই অবস্থায় মালতীর চোখে পড়ে যাওয়া ভাল দেখাবে না। খাটে উঠে বসতেই প্রকাশের ছবি যেখানে ছিল সেই ফাঁকা দেয়ালের দিকে চোখ পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল মালতীর কথাটা। একটা বাঁধানো ছবির কাঁচ লাগানোর জন্যে সৌরিন কেই বা বলতে হবে কেন , কিভাবে এরা। প্রকাশের অবর্তমানে আমি কি সৌরিনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। মালতী কি সেটাই মনে করছে। সৌরিনের প্রত্যহ এখানে আসা মোটেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। মুখের ওপর বারণ করে দিতে কোথায় যেন একটা সংকোচ হচ্ছে। সে কি বুঝতে পারছে না আমার অপছন্দ, নাকি বুঝেও বুঝচ্ছে না। কি ভাবছে একদিন না একদিন আমি………… ভাবনায় ছেদ পড়ল মালতী খাবারের থালা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ায়।
“ কি এনেছিস কি, আমার ভাল লাগছে সকালবেলা পরোটা খেতে”।
“তা বলে কিছু খাবে না কটা বাজে দেখছ,ইস্কুল খুলে গেলে এই সময় ভাত খেতে হবে”। প্লেট’টা মালতীর হাত থেকে নিতে নিতে স্কুলের কথা শুনে জ্যোতিপ্রকাশবাবুর মুখটা একবার ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল।
“মালতী আমি যদি এখান থেকে চলে যাই তুই আমার সঙ্গে যাবি?”
“কোথায় যাবে?” মালতীর ব্যগ্রতা থেকে বিস্ময় বেশী। জয়তী কথাটা অত ভেবে বলেনি। যার জন্যে মালতীর প্রশ্নে উত্তর খুঁজতে হচ্ছে।
“ ভাবছি দিদির কাছে চলে যাবো এভাবে একা থাকতে ভাল লাগছে না”।
“সে কোথায়?”
“মহিষাদল, জামাইবাবু ওখানকার স্কুলে পড়ান”।
“ আমি কিকরে যাবো তোমার সঙ্গে, আমার ঘর সংসার নেই”।
“ঠিকই তো তোকে বলাই ভুল হয়েছে, এই ফ্ল্যাট’টা বড় খাঁ খাঁ করে। সারাক্ষণই একই কথা মনে হয়। দেখ না তোর দাদাবাবুর ছবিটা পড়ে ভেঙ্গে গেল, এত মন খারাপ হয়ে আছে”।
“কি করব বলো টিকটিকি’টা এমন ভাবে হাতের ওপর ঊঠে এল”।
“না না তোর কি দোষ, …………দিদি বার বার বলে, ওখানে গেলে এই সব চিন্তা থেকে অন্ততঃ মুক্তি পাব। দিদির মেয়েটা ক্লাস সিক্স, ছেলেটা ফোর , ওদের পড়ানোর তো একটা লোক দরকার। এই ফ্ল্যাট’টা বিক্রী করে দিয়ে যে কটা টাকা জমেছে, পোস্টাফিসে রেখেদিলে , ওদেরও একটা আয়”।
“তুমি কি মনস্থ করে ফেলেছো? এরই মধ্যে মালতী চোখে মুখে যেন একটা বিচ্ছেদ বেদনার ছাপ।জয়তী বুঝতে পেরে সামান্য হেসে বলল, “ নারে না সে হলেও কি এত তাড়াতাড়ি হবে নাকি, দেখছিস তো, কি চলছে চারদিকে, মানুষ বাঁচবে কি করে কে জানে। আসল কথা কি জানিস মালতী, মেয়েমানুষের একজন সঙ্গীর দরকার হয় অভিভাবকের মত”।
কথাটা না বুঝেই মালতী হেসে ফেলল, “ তোমার আর এমন’কি বয়স হয়েছে,যে এর মধ্যে বিবাগী হয়ে যাবে”।
“ নারে সে আর হয়”। কথাটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে বুকের ভেতর থেকে।
(৩)
প্রকাশের ছবিটা ভেঙ্গে যাওয়ায় মনটা খারাপ হয়ে আছে জয়তীর। লক ডাঊন আগের তুলনায় শিথিল হয়েছে ঠিকই, মালতীকে জিজ্ঞাসা করতে হবে ছবি বাঁধানোর দোকানটা খুলছে কিনা। কিন্তু মালতীকে জিজ্ঞাসা করলে আবার যদি সৌরিনের কথা তোলে। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর শুয়ে কিছুতেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারল না জয়তী। দেখতে দেখতে চারটে বেজে গেল , এরপর শুয়ে থাকা ভালো দেখাবে না। বিছানায় বসেই বারান্দার দরজা খোলা থাকলে আবাসনের রাস্তাটা চোখে পড়ে, এই সময় কেউ তাদের বাচ্ছাদের নিয়ে বেরিয়েছেন, কেউ হাঁটাহাঁটি করে। দু’এক দিন বেরিয়ে খারাপ লাগেনি জয়তীর। তবে আজ একদম ইচ্ছে করছে না। কৃষ্ণচূড়ার পাতাগুলো অল্প অল্প নড়ছে, তার মানে বাইরে হাওয়া আছে। একরকম জোর করেই উঠে পড়ল জয়তী, নাইটি ছেড়ে শাড়ি পরে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই চোখের নিচে অস্পষ্ট দাগ’টাই প্রথমে চোখে পড়ল। হাল্কা ক্রীম বুলিয়ে ,চুল আঁচড়িয়ে বারান্দার দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে দেখল সাইকেল নিয়ে সৌরিন আসছে। চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেল জয়তীর। দরজা বন্ধ করে খাটে এসে বসল। চাপা রাগের উপলব্ধি সারা শরীর জুড়ে। এরই মধ্যে কলিং বাজল। ঠিক করে রেখেছে দরজা খুলবে না। নিদিষ্ট সময়ান্তে আবার বাজল। এবার তো সৌরিন ফোন করবে, কতটা উদবিগ্ন সেটা বোঝানোর জন্যে। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত বদলালো জয়তী। দরজা খুলে দিতেই সৌরিন ভেতরে ঢুকে এল “ কি ব্যাপার কোথায় বেরুচ্ছিলে নাকি? সে কথার কোন উত্তর দিল না জয়তী। মুখের মাস্ক একটা পেরেকে ঝুলিয়ে সৌরিন হাতে লিকুইড সাবান নিয়ে বেসিনের কল খুলতে জল পড়ল না। “ জল নেই নাকি?” এবার জয়তী উত্তর দিল- “ নীচে যাচ্ছি পাম্প চালাতে”। এই পরিস্থিতি থেকে বার হবার একটা অদ্ভুত সমাধান পেয়ে গেল সে । তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল জয়তী। “ থাকুক একলা ঘরে বসে আমি এখন ফিরিছি না”। কথা গুলো উচ্চারণ না করলেও নিজের মনকে শুনিয়ে মোটর পাম্পের সুইচ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল জয়তী খোলা আকাশের নীচে । এখনো তেমন কোন লোকজন নেই, ডি ব্লকের অরুণিমা ছেলে হাত ধরে হেঁটে আসছে। তাকে দেখে মনে মনে চমকে উঠল। জয়তী –‘ এইরে মাস্ক পরে আসা হয়নি, দূরে তো তাহলে কোথায় যেতে পারবে না। অরুণিমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই নিজেই কথা শুরু করল- “ জল ছিল না তাই পাম্প চালাতে এলাম”। অরুণিমা সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে চলে গেল। জয়তী এতক্ষণ ফ্ল্যাটের বেরুবার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার বাঁদিকে সরে গেল। কারণ ডানদিকে সৌরিনের সাইকেল স্ট্যান্ড করা রয়েছে। একতলার ফ্ল্যাটের দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে রইল, এখান থেকে পাম্প চলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, অথচ জয়তী চট করে কারুর চোখে পড়বে না। ফাঁকা ঘরে একলা সৌরিন কি করছে ভেবে একটা প্রশান্তি অনুভব করছে, মুখে না বললেও বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে তার অপছন্দ। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা খুব অস্বস্তিকরও বটে। যেকোন সময় কারুর মুখোমুখি হওয়া বিচিত্র নয়। তারপর নানান প্রশ্ন। মালতীর আসার সময় হয়ে গেছে , তাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে কিংবা যদি নাই দেখতে পায়, ওপরে গিয়ে যদি সৌরিনকে বসে থাকতে দ্যাখে। একটা দোলাচলের মধ্যে রয়েছে জয়তী, কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে এর পর কি করবে। পাম্প অনেকক্ষণ চলছে , একটা সময় বন্ধ করে ওপরে যেতেই হবে, তখনও সৌরিন যদি বসেই থাকে তাহলে একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে। মনে মনে একটা প্রস্তুতি নেয় জয়তী। আজ প্রকাশ বেঁচে থাকলে এরকম একটা পরিস্থিতি সম্মুখীন হতে হত না। অজান্তে চোখে জল এসে গেল তার।
হঠাৎই বাঁদিকে ঘাড় ঘোরাতে দেখল, সৌরিন সাইকেল উঠে চলে যাচ্ছে।জয়তীকে দেখতে পায়নি। একটা পাষাণভার নেমে গেল বুক থেকে। আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকে পাম্প বন্ধ করে ওপরে ঊঠে এল জয়তী। মনের মধ্যে যে ভার জমা হয়েছিল ধীরে ধীরে তা হাল্কা হয়ে যাচ্ছে।
বিকালের আলো মরে আসছে, সন্ধ্যা হতে দেরী আছে, তবু ঘরের আলো জ্বেলে দিল জয়তী। এরপর মালতী আসবে, চা করার পর সে জোর করবে কিছু খাবার জন্যে। জয়তী খেতে চাইবে না। সাপ্তাহিক পত্রিকাটা নিয়ে পাতা ওল্টাবে বিশেষ কিছু পড়া হবে না। একসময় রুটি তরকারী করে মালতী বাড়ি চলে যাবে। আনমনে টিভির সুইচ অন করে খানিকক্ষণ বসে থাকা, এই চ্যানেল সেই চ্যানেল সার্ফ করে করে একঘেয়ে মনে হবে। বাধ্য হয়েই টিভি বন্ধ করে দিতে হবে। অভ্যাস বশতঃ রাতের খাবার খেতে হয়। আজকেও কোন কিছুর অন্যথা হল এসবের । বারে বারে বিকালের ঘটনা মনে এলেও সেটাকে প্রশয় দিতে চাইল না। কিন্তু নতুন কোন ভাবনা সেই জায়গাটা দখল করছে না। একরকম জোর করেই মনটা কে এক জায়গায় আটকে রেখেছে সে। শুতে যাবার আগে নাইট ক্রীম লাগাতে গিয়ে চোখের নীচে অস্পষ্ট দাগ’টা যেন স্পষ্ট মনে হল আরো। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার কাছে সরে গিয়ে পরখ করতে চাইল জয়তী তার ভাবনা সত্যি কিনা। ঠিক তখনই মোবাইল ফোনে টিং শব্দে মেসেজ আসার সংকেত। বিছানার ওপর থেকে ফোন’টা তুলে নিয়ে দেখল সৌরিনের গুড নাইট মেসেজ। কপাল কুঁচকে মুখ তুলতেই চোখে পড়ল সেই কালো টিকটিকি’টা দেয়ালে প্রকাশের ছবিটা যেখানে ছিল সেখানে ওত পেতে বসে আছে শিকার ধরার অপেক্ষায়।

Leave a Reply