দিনের আলোর গভীরে

“ এটা কোথায় অঞ্জনদা?
“শান্তিপুর বাইপাস। এখনো প্রায় আধ ঘন্টা। রাস্তার যা হাল কে বলবে ন্যাশান্যাল হাইওয়ে”।
বিজন চলন্ত গাড়ী থেকে বাইরের দিকে তাকালো। শেষা নভেম্বরের মিঠে রোদ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। সকাল বেলায় কাজের তাড়া থাকায় ঘড়ির কাঁটাও বোধহয় দ্রুতই ছোটে। অথচ এখন ন’টা বেজে গেছে, কারো কোনো তাড়াই নেই, মফস্বল শহর বলেই এমনটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে লোকজনের মধ্যে। রাস্তায় দু’চারটি পথচারী, কখনো কোন সাইকেল আরোহীকে দেখা যাচ্ছে। বিজনের অবশ্য এসব উপভোগ করার মতন অবস্থায় নেই। পাশে বড়জামাইবাবু গাড়ী চালাচ্ছেন, পরিস্থিতি এমনই বেশী কথা বলার মতন মানসিকতা কারুরই নেই।
ল্যান্ডলাইনে ফোনটা এসেছিল ভোর সাড়ে চারটের কিছুটা আগে।রাতের অন্ধকার তখনো ফ্যাকাশে হয়নি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে বাজছিল ফোনটা, অনুরাধাই বিজনকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তোলে। ফোনটা থাকে ড্রয়িংরুমেরে এক কোণায়, ঘুম চোখে প্রায় শেষ মুর্হুতে ফোনটা ধরতে পেরেছিল বিজন।
“হ্যালো”-বলার সাথে সাথে অপর প্রান্তের প্রথম কথাটা শুনেই চমকে উঠেছিল সে। “কৃষ্ণনগর কোতয়ালি থানা থেকে বলছি,এটা কি সরিৎশেখর চৌধুরীর বাড়ী?”
“হ্যাঁ! কেন ?”
“আপনি কে বলছেন ?”
“আমি ওনার ছেলে।“
“শুনুন একটা খারাপ খবর আছে। উনি এখানকার একটা হোটেল রুমে সম্ভবতঃ হার্ট অ্যাটাকে হয়ে মারা গেছেন”।
“কি বলছেন কি”? বুকটা ধড়াস করে ওঠে বিজনের।
“হ্যাঁ। বডি হাসপাতালে আছে, পোষ্টমর্টেম হবে, ওনার মোবাইল ফোন সার্চ করে এই নাম্বারটা পাবার পর খবরটা জানালাম। যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসুন, অনেক ফরম্যালিটিস আছে”।
আকস্মিক আঘাতে অনেক কিছু জানার থাকলেও কোন প্রশ্নই করতে পারেনি বিজন।খবরটা জানানোর পরেই অপর প্রান্তের লাইনটা কেটে দেওয়া হয়েছিল। ধপ করে সোফায় বসে পড়েছিল সে, স্ত্রী অনুরাধাও ততক্ষণে উঠে বাইরে চলে এসেছিল। তাকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে জানতে চেয়েছিল-“কার ফোন”?
প্রশ্নটা শুনেই ডুকরে কেঁদে উঠেছিল বিজন,-“বাবা নেই”।
“নেই মানে”?
‘কৃষ্ণনগর থানা থেকে জানালো, ওখানকার একটা হোটেল রুমে বাবা হার্ট এ্যাটাক হয়ে মারা গেছেন”।
অনুরাধা এসে বিজনের পাশে বসেছিল, দু’হাতে মুখ ঢেকে বিজন তখনো কাঁদছিল, পিঠে হাত রেখে অনুরাধা বলেছিল-“চুপ করো। তোমার ওপর এখন অনেক দায়িত্ব, মাকে এক্ষুণি কিছু জানাবার দরকার নেই, অঞ্জনদা কে একটা ফোন করো”।
“তাহলে কি গাড়ী নিয়ে চলে আসতে বলব”। অনুরাধার কথায় পরবর্তী কাজের একটা ইংগিত পেয়েছিল বিজন।
“হ্যাঁ। অঞ্জনদা রাস্তাঘাট চিনবে। অফিসের কাজে প্রায়ই বেথুয়া, পলাশী, বহরমপুর যেতে হয়। দিদিকেও কান্নাকাটি করতে বারণ করো”।
সরিৎশেখর ছিলেন পি ডাবলু ডির ইঞ্জিনিয়ার।বেশ উঁচু পদে থেকেই অবসর নেন।সেও প্রায় দু’বছর হয়ে গেল।শরীর স্বাস্থ্য খারাপ ছিল না কোনোদিনই। বেড়ানোর নেশা ছিল খুব। প্রায়ই একা একা এখানে ওখানে বেরিয়ে পড়তেন। চাকরী থাকাকালীন মাঝে মাঝে ট্যুরে যেতে হত। ফলে আনুষাঙ্গিক জিনিষপত্র সমেত ব্যাগ গোছানোই থাকত। বাড়ী লোকও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। তারাও যে খুব একটা খোঁজ খবর নিত তা নয়। যেটুকু বলে যেতেন, ব্যস ওইটুকুই। স্ত্রী শোভনা বয়সের তুলনায় তাড়াতাড়ি অশক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। বাতের বেদনায় হাঁটু নিয়ে বেশী চলাফেরা করতে পারেন না। দোতলায় নিজের ঘরেই সারাটা দিন কেটে যায়। সরিৎশেখরের সঙ্গে পাল্লা দেবার কথা ভাবতেও পারেন না। ইদানীং সরিৎশেখর প্রায়ই মায়াপুরে ইসকন মন্দিরে যেতেন। এবারেও ওখানেও যাচ্ছেন বলেই বাড়ী থেকে বেরিয়ে ছিলেন।
“অঞ্জনদা, ইসকন মন্দিরটা কি কৃষ্ণনগর থানার মধ্যে পড়ে”?
“সম্ভবতঃ না, যতদূর জানি নবদ্বীপ থানাই হবে, ওঃ হো নবদ্বীপ থানা তো আবার গঙ্গার ওপারে, বলতে পারব না কৃষ্ণনগর থানাও হতে পারে”।

(২)
গাড়ী থেকে নেমে থানায় ঢোকার সময় সকলেই একটু সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল। ডিউটি অফিসারের কাছে নিজেদের পরিচয় দিতে সরাসরি ওদের আই.সির ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আই.সি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই বিজন নিজের পরিচয় দিয়ে বলল-“সরিৎশেখর চৌধুরী আমার বাবা, ইনি আমার বড়জামাই বাবু অঞ্জন রায়”।ফাইল বন্ধ করে আই.সি বললেন-“যাই হোক আপনারা তাড়াতাড়িই এসে গেছেন, অনেক ফরম্যালিটিস আছে, যদিও বডি পেতে পেতে বিকেল হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি এসে একদিকে ভাল হয়েছে আপনার মা ভীষণ লোনলি ফিল করছেন, রাতে তো এত কান্নাকাটি করছিলেন যে রাখা যাচ্ছিল না, যাইহোক ওনাকে আমরা থানায়…”।
“ দাঁড়ান দাঁড়ান কি বলছেন আপনি” ভুরু কুঁচকে আই.সির দিকে তাকায় বিজন।
“আমার মা! নিশ্চয়ই আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে”। অঞ্জনের কপালেও অবিশ্বাসের ভাঁজ পড়েছে, বিজনের মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল সে বোধহয় সামান্য হলেও আশার আলো দেখতে পাচ্ছে, সম্ভবতঃ মৃত ব্যাক্তি সরিৎশেখর নয়।সংশয় অঞ্জনের মনেও, কোথাও একটা গোলমাল আন্দাজ করে সে জিজ্ঞাসা করল,-“বডিটা কি আমরা একটু দেখতে পারি’? “অবশ্যই দেখবেন, কিন্তু বডি তো এখন হসপিট্যাল মর্গে, হ্যাঁ কি ভুল হয়েছে বলছিলেন”?
‘আমাদের মায়ের কথা বলছিলেন না,তিনি তো বাড়ীতে”।
“হোয়াট”!তাহলে উনি কে?”আই.সি বেল বাজালেন।
“সেই জন্যেই তো বলছি, নিশ্চয় কোথায় ভুল হয়েছে”।
“কি বলছেন কি? ভুল হয়েছে মানে”।একজন হোমগার্ড ঘরে ঢুকতেই আই.সি বললেন “ওই মহিলাকে ডেকে আনো তো, আর কাল হোটেল থেকে যে ব্যাগটা নিয়ে আসা হয়েছে সে্টা নিয়ে এসো”। ঘরের মধ্যে খানিকক্ষনের নীরবতা ভেঙ্গে অঞ্জন বলল “দেখুন স্যার আমার মনে হছে…”। আই.সি হাত তুলে অঞ্জনের কথা মাঝপথে থামিয়ে দিলেন। “দেখুন পুলিশের যে ভুল হয়না সে কথা আমি বলছি না, কারণ সেও তো মানুষ, তবে এক্ষেত্রে ভুল হয়েছে বলে আমার মনে হয়না”।
একজন অফিসার ব্যাগ হাতে আইসির চেম্বারে ঢুকল। “ওই মহিলা একটু বাথরুমে গেছেন”। “ঠিক আছে, একটু পরে ওনাকে পাঠিয়ে দিও”।
ব্যাগটা টেবিলের ওপর রাখতেই বিজনের কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল, কিন্তু মনকে সে তখনও প্রবোধ দিচ্ছে, একইরকম ব্যাগ কি দুজনের হতে পারে না ।

আই.সি একটা একটা জিনিষ বার করে টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বললেন-“দেখুন তো এগুলো চিনতে পারেন কিনা”?
একটা তোয়ালে।, দুটো পাজামা,একটা পাঞ্জাবী দুটো গেঞ্জী টেবিলের ওপর স্তূপীকৃত হচ্ছে, বাবার একান্ত ব্যবহৃত জিনিষগুলি সর্ম্পকে বিজন খুব একটা ওয়াকিবহাল নয়, তাই সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। পরের জিনিষটা দেখেই বিজন একরকম নিঃসন্দেহই হয়ে গেল। কারণ ব্যগ থেকে এ্যান্টিকুইটি মদের বোতল বার করে টেবিলের ওপর রেখেছেন আই.সি। বোতলে তখনও কিছুটা পানীয় রয়ে গেছে।
বিজন চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। “অঞ্জনদা ওঠো, এখানে আমাদের থাকার আর দরকার নেই। কোন এক লুচ্ছা মেয়েছেলে নিয়ে হোটেলে উঠেছিল, অতিরিক্ত মদ খেয়ে মারা গেছে। সবাই জানে মফস্বলের হোটেলগুলোতে এই সবই চলে”।
বসুন, বসুন, অত উত্তেজিত হবেন না, দেখুন তো এই মোবাইল ফোনটা তো আপনার বাবার? এটা থেকেই আপনাদের বাড়ীর নাম্বারটা আমরা পেয়েছিলাম”। আই.সির হাতে মোবাইল ফোনটা দেখে বিজন এবার চুপসে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল।
“কি বলছেন কি আপনি? আমার বাবা একজন নোংরা মেয়েছেলে নিয়ে হোটেলে উঠেছিল!তিনি পি ডবলু ডির ডিভিশন্যাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। সারা জীবন স্ট্যাটাস মেনটেন করে চলেছেন। এটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে, নিশ্চয়ই এর পিছনে কোনো চক্রান্ত আছে”।
এতক্ষন চুপ করেই বসেছিল অঞ্জন, বিজনের কথার সুত্র ধরেই বলল”_হ্যাঁ আই.সি সাহেব আমারও তাই মনে হচ্ছে এটা প্ল্যানটেড ঘটনা। ব্যাপারটা আপনি তদন্ত করুন”।
“আমরা তো মহিলাকে ওনার স্ত্রীই ভেবেছিলাম, তাছাড়া উনি এমন কান্নাকাটি করছিলেন। যারজন্যে সেভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি”। আই.সি বিরক্ত হয়ে বেল টিপলেন, হোমগার্ড ভেতরে আসতেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “কি করছেন কি ওই মহিলা, কখন ডেকেছি”। আইসির আচরনে একটা অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছিল। এবার বিজনদের বললেন “চিন্তা করবেন না, ব্যাপারটা আমি দেখছি,তদন্ত নিশ্চয়ই হবে। এর কিছুক্ষণ পরেই সেই মহিলা দরজা ঠেলে আই.সির চেম্বারে ঢুকল।
প্রথম দর্শনে যে সব মেয়েদের হোটেল থেকে ধরে আনা হয় তা কিন্তু এদের দুজনের কারুরই মনে হল না,এক নজরে মহিলাটিকে দেখে যেটুকু বোঝা যায় পঞ্চাশ অতিক্রান্ত শরীরে বয়স এখনো সেভাবে থাবা বসাতে পারেনি। চোখ মুখ শোকাক্রান্ত হলেও লালিত্যের অভাব নেই। মহিলার পরনে সাদা জমির ওপর সামান্য অলংকরণে শান্তিপুরী তাঁতের শাড়ি।হাতাওয়ালা ব্লাউজ, চোখে চশমা, সব

মিলিয়ে একটা আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব ফুটে বেরুচ্ছিল। সেটা আই.সিরও নজর এড়িয়ে যায়নি। তাই কিছুক্ষণ আগের উত্তেজনাকে যথাসম্ভব সংযত রেখে প্রশ্ন করলেন” আপনার নাম কি?”
“ভাস্বতী পালিত”।
“বাড়ী কোথায়?”
“কলকাতায় গড়পার রোডে”
“আপনি যে সরিৎ বাবুর স্ত্রী নন সে কথা তো কাউকে বলেননি”।
“এর আগে আপনারা তো কেউ আমার পরিচয় জানতে চাননি, আর সে সুযোগই বা হল কোথায়?”
“এরা সরিৎবাবুর ছেলে আর জামাই………।তা কি করেন আপনি”?
“হাই স্কুলে পড়াই”।
“ছিঃ!ছিঃ!ছিঃ!লজ্জাও করছে না বলতে যে স্কুল টিচার”।বিজন আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না।
“লজ্জাই বা করবে কেন, আর এতে ছি ছি করারই বা কি আছে,তোমার মায়ের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েও এরকম ঘটনা ঘটতে পারত না”?
“ বাঃ! বেশ কথা বলছেন তো”। বিজনের কথার রেশ ধরে আই.সি ধমকে উঠলেন, “স্কুলের শিক্ষয়ত্রী হয়ে নোরাংমি করে বেড়াচ্ছেন, আবার সরিৎবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে নিজেকে তুলনা করছেন”।
“কিসের কি নোরাংমি? সামজিক মতে আমাদের বিয়েটাই হয়নি তা ব’লে কি এতদিনের সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই, আমার একমাত্র ছেলের বাবা উনি……”।
“আঃ!” বিজন চিৎকার করে টেবিলে একটা চাপড় মারল।অঞ্জন চেয়ারটা ঘুরিয়ে ভাস্বতীর মুখের দিকে তাকাল ।বিজন উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল “অনেক হয়েছে আই.সি সাহেব, আর আমরা শুনতে চাই না,এর পর উনি হয়ত আরো অনেক কিছু বলবেন। আমি অভিযোগ দিচ্ছি উনি আমার বাবাকে মেরে ফেলেছেন”।
“বেঁচে থাকতে যার কাছ থেকে এতো কিছু পেয়েছি, মেরে ফেলে কি তার থেকে বেশী কিছু পাব”? গোপনীয়তা ভেঙ্গে যাবার পর ভাস্বতী অনেক বেশী সোচ্চার, “উনি মারা যাবার পরই আমার মনে হয়েছে এরকম পরিস্থিতিতে আমাকে পড়তে হবে,সেই জন্যেই মানসিকভাবে প্রস্তুত হচ্ছিলাম।আমি জানি আমাদের এই এত দিনের সম্পর্ক সেটা একান্ত ভাবে আমাদেরই ছিল।অন্যদের কাছে তার কিসেরই বা মূল্য”।
কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা ভেঙ্গে আই.সি বললেন “অভিযোগ আপনারা দিতেই পারেন, আমার কোন আপত্তি নেই, তবে আমার মনে হয় পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেয়ে অভিযোগ দিলে ভাল”।
অঞ্জন অনেকক্ষন চুপ করে বসে ছিল, চেয়ার ঘুরিয়ে আই.সির মুখোমুখি হয়ে বলল “ওনাকে বাইরে যেতে বলুন, আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে”।আই.সি বেল বাজাতেই হোমগার্ড ঘরে ঢুকতেই,বললেন “ওনাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসাও”।
ভাস্বতী ঘরের বাইরে চলে যেতেই অঞ্জন বলল “ওনাকে ছেড়ে দিন আই.সি সাহেব আমাদের কোন অভিযোগ নেই”।
“কি বলছ কি অঞ্জনদা”? বিজন প্রায় আর্তনাদ করে উঠল।
“আমি অনেক ভেবেই বলছি বিজন, আর যাই হোক উনি বাবাকে মেরে ফেলেন নি। আই.সি সাহেব ওনাকে ছেড়ে দিন এখন বলুন বডিটা আমরা কখন পেতে পারি আর একটা অনুরোধ এই ব্যাপারটা যেন সম্পূর্ণ গোপন থাকে”।
“সেকি অঞ্জনদা, একদম ছেড়ে দেবে সব কিছু”। ঠিক সেই সময়ে আই.সির মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল, স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আই.সি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন,
“আপনারা কথা বলুন আমি আসছি”।
“এ ছাড়া কি আর অন্য কোনো উপায় আছে বিজন”।
‘তা ব’লে এত বড় ঘটনা”!
“মানছি এত বড় ঘটনা, আমি কিন্তু ভেবেই বলছি বিজন, এটা নিয়ে আর কিছু করা ঠিক হবে না’।
‘আমর গা রিরি করছে অঞ্জনদা”।
“সামান্য একটু জেনেছ তাতেই তোমার এই অবস্থা,এরপর যখন এটা কোর্টে উঠবে, ক্রশ একজামিনের সময় বাবার নামে কেচ্ছা রটাবে উকিলরা,আমার অভিজ্ঞতা আছে বলেই বলছি,উইটনেশ বক্সে দাঁড়িয়ে সহ্য করতে পারবে তো”।
“সত্যি বলছি অঞ্জনদা,আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না বাবা এটা করতে পারে”। বিজন হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। “এরপর মা যদি জানতে পারে…”।

‘সেইজন্যেই তো বলছি ব্যাপারটা এখানেই শেষ করে দিতে,কাউকে কিছু জানাবার দরকার নেই”।
“শুনলে তো, বাবার নাকি আর একটা ছেলে আছে, এরপর যদি সম্পত্তির দাবী করে”।
“আমার মনে হয় না সে রকম কিছু হবে। ভদ্রমহিলা যথেষ্ট শিক্ষিতা সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ, উনিও চাইবেন না আর জলঘোলা করতে”।
“তুমি এত নিশ্চিন্ত হচ্ছো কি করে অঞ্জনদা, এসব মহিলা কে বিশ্বাস আছে…?
“তুমি ভুল করছ কেন বিজন, ওই মহিলা বাবার প্রেমিকা ছিলেন,সামাজিকভাবে স্ত্রীর স্বীকৃতি দিতে পারেননি,তবু গোপনে বাবাও সেই ভালবাসার মর্যাদা দিয়ে আসছিলেন দীর্ঘ দিন ধরে। মহিলা বলছিলেন না আমাদের অনেক দিনের সর্ম্পক।এই দুর্ঘটনাটা না ঘটলে আমরা কেউই জানতে পারতাম না। একটু ভেবে দেখতো এর মধ্যে কারুর কি কোনো অন্যায় আছে, বাবা যে তোমাদের প্রতি, মায়ের প্রতি কোন দায়িত্ব পালন করেননি,তা নয়।তাঁরও তো একটা ব্যক্তিগত জীবন ছিল,মামলা মোকদ্দমা করে সেটা নাই বা আমরা সকলকে জানলাম”।বিজন মাথা নিছু করে বসে আছে,দেয়াল ঘড়িটার সেকেন্ডের কাঁটা স্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে সামান্য একটা শব্দ হচ্ছে।দুজনের মুখে বেশ কিছুক্ষণ কথা নেই, বিজন মুখ তুলে অঞ্জনের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় আই.সি চেম্বারে ঢুকলেন-“কি ঠিক করলেন বলুন”?
“না আই.সি সাহেব আমাদের কোনো অভিযোগ নেই, বডিটা যাতে তাড়াতাড়ি পেতে পারি সেই ব্যবস্থা করে দিন”।
“ঠিক আছে আপনারা অসীমবাবুর সঙ্গে দেখা ক’রে যাবতীয় সইসাবুদ করে নিন।বডি পেতে পেতে দুটো আড়াইটে বেজে যাবে, তার আগে হবে বলে মনে হয় না”।
(৩)

অঞ্জন একটা সিগারেট ধরাল,মর্গের কটূ গন্ধটা এখানেও ভেসে আসছে,একটু আগেই মৃতদেহ সনাক্তকরণের নামে এক বীভৎস প্রক্রিয়া পার করতে হয়েছে, গা-টা গুলোচ্ছিল অঞ্জনের। মানুষ মারা যাবার পরও তার আত্মীয় স্বজনকে এই সমস্ত বিচিত্র ব্যবস্থা সম্মুখীন হতে হয় আইনের স্বার্থে।একান্ত প্রিয়জন এবং গুরুজনকে নগ্ন অবস্থায় দেখে সনাক্তকরণ যে কি দুর্বিসহ তা কাউকে বোঝানো যাবে না।হাসপাতাল চত্বরে সবাই ব্যস্ত,সেই ব্যস্ততা শারীরিক অপেক্ষা মানসিকই বেশী ।সকলেই অপেক্ষা করে আছে,কারণ রোগীর বা মৃতর আত্নীয় স্বজনের কারুর কিছু করার নেই, হাসপাতালের ওপর নির্ভর করা ছাড়া। অঞ্জনের মনে হল শ্বশুরমশাইকে দেখে তার তো কখনো মনে হয়নি তাঁর মধ্যে এক প্রেমিক স্বত্তা লুকানো আছে। সদালাপী মানুষ ছিলেন। নানান বিষয়ে গল্পগুজব করতেন। হয়ত কোনো বাল্যপ্রেমকে মর্যাদা দিতে গোপনে লালন করে এসেছেন এই সর্ম্পক। আকস্মিক মৃত্যু সমস্ত গোপনীয়তা ভেঙ্গে প্রকাশ্যে এনে দিল। বিজনের চোখে তার বাবা হয়ত ছোট হয়ে গেল। কিন্তু করাই বা যাবে কি,ওকে এখন বোঝাতে যাওয়া অনর্থক।তা ছাড়া এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করাও যাবে না। যে গোপনীয়তা এতদিন তিনি রক্ষা করে আসছিলেন, এখন সেই ভার ওদের দুজনের ওপর। নিজেদের স্বার্থেই সবকিছু গোপন রাখতে হবে।
বিজন গিয়েছিল শববহনকারী গাড়ীর ব্যবস্থা করতে। সে ঢুকল বোধহয়, অঞ্জন গেটের দিকে এগিয়ে গেল। ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে বিজন উত্তেজিত ভাবে নামল।
“আমি বলে ছিলাম না অঞ্জনদা, আইনতঃ ব্যবস্থা নিতে,ওই মহিলা এখানেও এসেছে,এখন যদি ডেড্ বডি ক্লেম করে,তাহলে একটা সিন ক্রিয়েট হবে”।
“অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? চলো আমি দেখছি, কোথায় উনি”?
ওই তো গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে”। অঞ্জন এগিয়ে যায়, পিছনে বিজন। অঞ্জনদের কিন্তু ভাস্বতী দেখতে পায়নি। একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল শববহনকারী গাড়ীটার দিকে। অঞ্জন সরাসরি প্রশ্ন করল-“ কি ব্যাপার আপনি এখানে?”
ভাস্বতী একটু চমকে অঞ্জনদের দিকে তাকল,-“ভিড়ের মধ্যে তোমাদেরই খুঁজছিলাম,একটু দরকার ছিল”।
“কি দরকার”?
“থানায় তো সব কথা বলা যায় না, আমি একটা জিনিষ ফেরত দিতে এসেছি”।ভাস্বতী তার ব্যাগের চেন খুলে একটা কাগজের কভারে মোড়া কিছু একটা এগিয়ে দিল”।
“কি ওটা? অঞ্জন নিতে একটু দ্বিধা করছিল।
“ব্যাংকের পাশবই, আমার আর ওনার নামে একটা জয়েন্ট এ্যাকাউন্ট ছিল, ওনার পেনসেন থেকে আট হাজার টাকা প্রতি মাসে এই এ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হত, বারণ করেছিলাম উনি শোনেন নি।ওর ভেতর একটা এটিএম কার্ডও আছে”।
অঞ্জন তাড়াতাড়ি কভারটা সরিয়ে পাশবইটা বার করতেই এটিএম কার্ডটা মাটিতে পড়ে গেল, বিজন নিচু হয়ে সেটা কুড়িয়ে নেয়।পাশবই উলটে পালটে অঞ্জন বলল-“এতে এখনো অনেক টাকা রয়েছে”।
“হ্যাঁ। আমার খুব একটা দরকার হত না, মানুষটাই যখন চলে গেল টাকা নিয়ে আর কি করব”। অঞ্জন পাসবইটা হাতে নিয়ে ভাস্বতীর দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুটা মুগ্ধ বিস্ময়ে। সত্যিই তো এই মহিলার ওপর দিয়ে তো একটা বিরাট ঝড় বয়ে গেছে, অথচ ওরা তো কেউ তার প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারছে না। তাই বোধহয় এই প্রস্তাব দিয়ে ফেলল-
“আপনি তো কলকাতাতেই ফিরবেন, আমাদের সঙ্গে গাড়ী ছিল”।
“না না, আমি ট্রেনেই চলে যাব, তোমাদের সঙ্গে আমার ফেরা চলে না, আমিও চাই না এ ব্যাপারটা আর কেউ জানুক, তাতে ওনারই অসম্মান হবে, গাড়ীতে ওনাকে তোলার পর শেষবারের মতন প্রনাম করে চলে যাব”।
“ঠিক আছে, ওদিকে দেখি আর কতক্ষণ দেরী হবে”। ভাস্বতী সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল।
পাশবইটা ওল্টাতে ওল্টাতে অফিসের দিকে ফিরতে থাকে অঞ্জন, কখন বডি পাওয়া যাবে জানার জন্যে।হঠাৎই অঞ্জন দাঁড়িয়ে পড়ে,পাশবই এর শেষ পাতায় সরিৎ শেখর আর ভাস্বতীর জয়েন্ট ফোটো। পাশ থেকে বিজন বলে উঠল-“পাতাটা ছিঁড়ে ফেলে দাও অঞ্জনদা”।
“না, ওটা আমার কাছেই থাক”।
——————

Leave a Reply