(১)
রাঁচি শহরের সন্নিকটে মোরাবাদী পাহাড়, পাহাড়ের ওপরে একটি বিশাল কোঠা বাড়ী, সানুদেশে তার তিনটি বাংলো। প্রবেশদ্বারে সমীহ জাগানো বিশাল ফটক , যার মাথায় শ্বেত শুভ্র বুদ্ধমুর্ত্তি। ফটকের একপাশে থামে লেখা শান্তি ধাম। যথার্থই, প্রবেশের সাথে সাথে অপার শান্তি যেন অনুভূত হয় । সংলগ্ন উদ্যানবাটিকায় নানাবিধ পুষ্পলতার বর্ণে ও গন্ধে আশ্রমের রূপ নিয়েছে। এখানেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্তমান আবাসস্থল। স্বেচ্ছানির্বাসনে কলকাতার জনজীবন থেকে চলে এসেছেন। মোরাবাদী পাহাড়েই গড়ে তুলেছেন শান্তিধাম। জীবন সায়হ্নে আত্মীয় স্বজনের বিয়োগ ব্যাথা, সাংসারিক টানাপোড়েন শান্তি পাচ্ছিলেন না। তাই বোধহয় জনকোলাহল থেকে অনেক দূরে মোরাবাদী পাহাড়ে প্রত্যহ নিবিড় সন্ধ্যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে দেখা যায় অনেকটা সমাহিত রূপে। চারিদিকে প্রাচীরের মত কালো পাহাড়ের শ্রেণী অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। দিনের আলোর সন্ধ্যার আঁধারের সাথে মিলিয়ে গেলে থেমে যায় কোলাহল । দূর আকশের দিকে তাকিয়ে বসে ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। পাহাড়তলীর মেঠো পথ ধরে বাড়ি ফিরছে কোল মজদুরের দল, তাদের সম্মিলিত অস্পষ্ট সঙ্গীতের সুর আকৃষ্ট করল তাঁকে। মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে রইলেন সেই দিকেই যতক্ষণ ওদের দেখা যায়।
সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হতেই আকাশের তারাগুলি যেন আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল, উপাসনা মন্দিরে ঘণ্টা বেজে উঠল। উঠে দাঁড়ালেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে শুরু করলেন। এই পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গেই উপাসনা মন্দির। ব্রহ্মবাদী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নিরুচ্চারিত প্রেমেই তাঁর আরাধনা। এখান থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্যটি অপূর্ব। উপাসনা মন্দিরটি খুব বড় নয়, চারদিকে চারটি স্তম্ভ। মাথায় ছাতার মতন ছাদ। কিন্তু অনেক অর্থ খরচ করে নির্মাণ করিয়েছেন। সূদূর কাশী থেকে পাথর, মিস্ত্রী আনানো হয়েছিল, এখানে তখন জলের বড় অভাব ছিল, পরে অবশ্য সেই সমস্যা মিটে গিয়েছিল, নিকটের একটি ঝর্ণার সন্ধান জানার পর, ওখান থেকেই জল আনা হত।
উপাসনা শেষ হলেও বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকেন উত্তীর্ণ সন্ধ্যায় সমাগত রাত্রির অপেক্ষায়।এই সময় বড় শান্তি পান উনি। আজ আর সেটা হল না ভৃত্য এসে খবর দিল নীচে দুজন ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন। শান্তিধামে অবারিত দ্বার, কত লোক যে আসে যায় তার ইয়ত্তা নেই। উড়িষ্যার ছোট লাটসাহেব একদিন বাগান দেখে বলে গেলেন “ Babu I envy you”. রাজার জাত’তো নেটিভদের প্রশংসা এই ভাবেই করে থাকেন ।নামতে নামতে বাগানের কাছে এসে কথাটা মনে পড়ল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের। আপন মনেই মৃদু হাসলেন তিনি।
নীচে নেমে দেখলেন দুই ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন, অন্ধকারে আগন্তুকদের চেনা যাচ্ছে না। দুজনেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহুর্ত। আবক্ষ শুভ্র শ্মশ্রু মন্ডিত হলেও দেহের গাত্রবর্ণের ঔজ্জ্বল্য এতটুকু হ্রাস পায়নি। আগন্তুকদের পায়ের ধুলো নেওয়ায় কুন্ঠিত হয়ে সামান্য পিছিয়ে গিয়েছিলেন। মুখের মধ্যে যেন আরো সহৃদয়তা ফুটে উঠল, আগত মানুষ’দুটির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
“ আজ্ঞে আমার নাম বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায়, কর্মসুত্রে এখানে এসেছি, কিছুদিন থাকব, আপনি এখানে আছেন জেনে শুধু দেখা করা নয় সামান্য সান্নিধ্য লাভের ইচ্ছা ছিল, একলা আসব ভেবেছিলাম, শেষপর্যন্ত আমার বন্ধুকে নিয়ে এলাম”।
খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ “ আসুন আসুন আসবেন বৈকি,চলুন ওপরে চলুন”। ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে লাগলেন। সাক্ষাৎকারীরাও অনুসরণ করলেন তাঁকে । ওপরে উঠতে উঠতেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রশ্ন, “ আমাকে আপনারা রবি বলে ভুল করেন’নি তো”।
“না না আমরা জানি আপনি এখানে আছেন, আপনার লেখা পড়েছি, নাটক দেখেছি, দোহাই আপনি আমাদের আপনি বলবেন না”। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৃদু হেসে, অতিথিদের ঘরে বসিয়ে নিজেও বসলেন।
“রবি এখানে আসেনি, অনেক অভিমান তার, কখনো আসবে না বলেই মনে হয়, তুমি তো কলকাতারই বাসিন্দা”।
“হ্যাঁ, আমি ডাক ও তার বিভাগে কাজ করি, বদলী হয়ে এখানে এসেছি, বন্ধুটী এখানকারই বাসিন্দা”। নতুন জায়গায় এসে উভয়েই উদ্গ্রীবভাবেই দেখছিলেন সারা ঘর। দেয়ালে একটি ছবি ছাড়া আর কোন গৃহসজ্জা নেই, সেটি কাদম্বরী দেবীর পোট্রেট্, পেনসিল স্কেচে আঁকা।
বসন্তবাবু জিজ্ঞাসা করলেন- “ এটি তো আপনারই আঁকা বলে মনে হচ্ছে”।
“হ্যাঁ,ওই একটি মাত্র ছবিই নিয়ে এসেছিলাম, প্রায় হাজার দেড়েকের মত পোট্রেট,কবে কার কার এঁকেছিলাম মনেও নেই সে কথা।সারা বাড়ি জুড়ে এদিক সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অনেক খুঁজে এটা বার করি, জোড়াসাঁকো থেকে তেমন কিছু নিয়ে আসিনি নিজের গান বাজনার যন্ত্রগুলি ছাড়া, আর একটা জিনিষ তো খুঁজেই পেলাম না”।
“আপনার আঁকা লালন ফকিরের একটি পোট্রেট দেখেছিলাম, ওটা না থাকলে তো আমরা জানতেই পারতাম না উনি কেমন দেখতে ছিলেন”। বসন্তবাবুর বন্ধুর কথার উত্তরে সৌজন্য বশতঃ সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন।
“ একটা জিনিষ খুঁজে পেলেন না বলছিলেন”। দুঃখ চাপা সামান্য হাসি ফুটে উঠল দাড়ি গোঁফের আড়াল থেকে।
“ না তেমন কিছু নয়, বিহারীলাল চক্রবর্তীর এক খন্ড রচনাবলী, সারদামঙ্গল ও সাধের আসন ওর মধ্যেই ছিল। সারদামঙ্গল পড়ার পর খুবই ভাল লেগেছিল কাদম্বরীর , মুখস্থ বলতে পারত,বই’টি আত্মস্থ করার পর একটি প্রশ্ন ওর মনে এসেছিল। তাই কবিকে একটি আসন বুনে উপহার দিয়েছিল, প্রশ্ন টি তার ওপর লিখে, সীবন শিল্পের কৌশলে আর কি, পিস্ অফ আর্ট বলতে পারো। বিহারীলাল তার উত্তর দিয়েছিলেন তাঁর পরর্বতী কাব্যগ্রন্থ সাধের আসন’এ, কিন্তু তার আগেই কাদম্বরী চলে গেছে, ওই রচনাবলীতে আসনটির একটি কালার ফোটগ্রাফ ছিল। সেইজন্যেই ওই সময় মনে হয়েছিল নিয়ে আসি, এখন আর খুব আগ্রহ নেই, কলকাতায় তো কত চেনা লোকই যাচ্ছে একটা কিনে আনালেন হয়”।
“ আমি যখন কলকাতায় যাব……”
না না, ওর আর দরকার নেই, আজ রাত হয়ে গেল না হলে তোমাদের উপাসনা মন্দির দেখাতে নিয়ে যেতাম”।
“ যদি অভয় দেন তো একটা কথা বলি”-
“আহা আহা সংকোচ করছ কেন বলোই না”। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সম্মতি পেলেও বসন্ত বলতে কুন্ঠা বোধ করছেন- “ এখানে তো এখন বেশ কিছু থাকতে হবে, মাঝে মাঝে আপনার কাছে আসব, আপনার কাছ থেকে শুনব পুরানোদিনের কথা। সেগুলি লিপিবদ্ধ করে যদি আপনার জীবন স্মৃতি রচনা করা যায়”।
কাদম্বরীর কথায় যে বিষাদের ছায়া জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মুখে ছিল, বসন্তর প্রস্তাবে তা মুছে গিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠল- “ ওঃ তুমি লেখালিখি করো, বাঃ বাঃ খুব ভাল কথা। এখনকার বাংলা সাহিত্য খুব উন্নত হয়েছে, সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত, যতীন্দ্র মোহন বাগচি’র কবিতা আমি পড়েছি, ভালই লেগেছে, ভাল ভাল গল্প লেখা হচ্ছে, গল্প লেখা খুব সহজ কাজ নয়”।
“ আপনার লেখালিখি নিয়ে কিছু বলুন”। কথাটা শুনে আপন মনেই ঘাড় নাড়লেন তিনি।
“ যৌবনের সে তেজ আর নেই ক্ষমতাও কমে গেছে। লিখতে খুবই ইচ্ছে করে, সামর্থ্যে কুলায় না, তুমি যখন আগ্রহ প্রকাশ করেছ বলব সেই সব পুরানো কথা, বৃদ্ধ হলে মানুষ অতীত রোমন্থনে বাঁচে। যতটুকু মনে পড়ে সবই বলব”। বসন্ত উঠে গিয়ে আবার প্রণাম করলেন।
“ আমরা তাহলে উঠি”।
“চলে যাবে বেশ, সামনের রবিবার বাল্মীকি প্রতিভার সুর শোনানোর জন্যে অনেকেই অনুরোধ করেছেন, ওই দিন একটু মজলিশের মত হবে এসো’না তোমরা”।
“বাল্মীকি প্রতিভার সুর কি আপনার”। বসন্তর প্রশ্ন শুনে হাসলেন, “ ওই দিন এলেই সব বুঝতে পারবে”।
(২)
কলকাতার রাস্তায় বিরল ঘটনার অভাব ঘটেনি কখনোই। নতুন গড়ে ওঠা শহর নিত্যদিনই কোন না কোন বিস্ময়কর ঘটনা সাক্ষী হয় । ফলে কোন ঘটনাই স্থানীয় অধিবাসীদের মনের মধ্যে স্থায়ীভাবে রেখাপাত করে না । পুরানো ঘটনারই পুনরাবৃত্তি বলেই মনের কুঠুরির নানান ভিড়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আলাদা করে স্মরণ করার মত আর গুরুত্ব থাকে না তার । জীবনযাত্রা যখন অনেক রয়েসয়ে চলত, কলকাতার রাস্তায় হাড় জিরজিরে ঘোড়া কোচয়ানের চাবুক খেতে খেতে শ্যাকরা গাড়ী টানত ধুলো উড়িয়ে। অন্দরে যবনিকার আড়ালে পদে পদে বিধি নিষেধের ঘেরাটোপ অতিক্রম করে বাড়ীর মহিলাদের কদাচিৎ রাস্তায় বার হতে হত অন্ধকারে হাঁপ ধরা দরজা বন্ধ পাল্কীতে। পাশে পাশে পিতলের মুন্ডি লাগানো লাঠি হাতে হাঁটত দরোয়ানজী মালকিনের সম্ভ্রম রক্ষার আর একদফা পরত হিসাবে। সেইসময় কোন এক শেষা ফাল্গুনের অপরাহ্ণে, সূর্য তখন প্রায় অস্তগামী, রৌদ্রতেজে সারাদিনের তপ্ত আবহাওয়া সবেমাত্র শীতল হতে সুরু করেছে,দক্ষিণের মন্দমধুর বসন্ত বাতাসে। তখনও কলকাতার রাস্তায় বেলফুলের মালা বিক্রেতাকে দেখা যায়নি, কুলপিমালাইওয়ালা হাঁড়ি মাথায় চিরাচরিত ডাক ছাড়তে পারেনি।ঠিক তখনই চিৎপুরের রুক্ষ রাস্তা সরগরম হয়ে উঠেছিল দুটি আরবী ঘোড়ার খুরের আওয়াজে। জনবিরল রাস্তায় দু’একজন সচকিত হয়ে তাকাতেই তাদের জ্ঞান হারিয়ে ফেলার যোগাড়। কোন এক অন্যমনস্ক পথচারীর প্রায় পাশ বরাবর দুটি ঘোড়ার দৌড়ে যাওয়ায় সে সচকিত হয়ে প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে এক ছুটে রাস্তার ধারে পথচলতি শিখাধারী ব্রাহ্মণের ঘাড়ে প্রায় পড়ে আর কি । “খুব বেঁচেছি ঠাকুর, উচ্চৈঃশ্রবা পেটে পা তুলে দিয়েছিল আর একটু অসর্তক হলে”।
“তুমি তো বেঁচেছ, মরে ছিলাম তো আমি, ভাগ্য ভাল ছুঁয়ে ফেলোনি, গলায় শালগ্রাম ঝুলছেন, শ্লেষ্মার ধাতে অবেলায় গঙ্গা স্নান করতে হত, তখন আর এক বিপত্তি”।
“ওরা কারা ঠাকুর?”
“কেন চিনলে না, দেবেন ঠাকুরের সুপুত্র, ব্রাহ্ম ধর্মের ধারক, প্রগতিশীল বৌ’কে ঘোড়া চাপিয়ে হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন”। ছোঁয়া বাঁচিয়ে ব্রাম্ভণের দ্রুত চলার সাথে তাল রাখতে না পেরে দাঁড়িয়ে পড়ে সেই পথচারী, অপস্রিয়মান ঘোড়সওয়ারদ্বয়কে পুনরায় দেখাবার আশায়। একী দিবাস্বপ্ন সে তো মনে মনে দেখা যায়, মানসচক্ষে কেউ কখনো দেখেছে নাকি ।এ যেন ইতিহাসের পাতা থেকে কেউ উঠে এলেন মহাকাব্যের কোন নায়ক নায়িকা।
ঘোড়ার পিঠে ব্রিচেস পরিহিত সাহেবী পোষাকে এক যুবতী, যার মাথার দীর্ঘ চুল ঘোড়ার টগবগানির প্রতি পদক্ষেপে শোলার হ্যাটের আবরণ থেকে মুক্ত হতে চাইছে, তরুণীর গাল ও কাঁধ বেয়ে।চলন্ত ঘোড়ার ওপর সওয়ারির দৃষ্টিনন্দন ছন্দময় শারীরিক আন্দোলন যেন এক অপ্রত্যাশিত চলমান ছবি কলকাতার রুক্ষ রাস্তায়। তবুও তিনি নারীসুলভ লজ্জায় কিছুটা হলেও সংকুচিত। পাশের ঘোড়সওয়ারে এক অনিন্দ্যকান্তি পুরুষ যেন স্বয়ংবর সভা থেকে এমনি একটি নারীরত্নকে করতলগত করে নিয়ে চলেছেন এক অজানা লক্ষ্যে। লক্ষ্যে কিন্তু মোটেই তাঁদের অজানা নয়। সেই চিরন্তন গড়ের মাঠ, এতদিনের গোপন প্রশিক্ষণের পরীক্ষা সেখানেই , গড়ের মাঠের সবুজ ঘাসে ঘোড়দৌড়ে কতখানি সাবলীল তিনি।এবার পথ চলতি উদ্গ্রীব দর্শণার্থীর মধ্যে অনেকেই চিনে ফেলেছেন ঠাকুরবাড়ীর উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে’। পাশে তাঁরই সহধর্মিণী কাদম্বরী দেবী। এসব দৃশ্যের স্থায়িত্ব বড়ই অল্প সময়ের, যে সমস্ত দর্শককূল সাক্ষী থাকলেন এই অভূতপূর্ব ঘটনা্র, তাঁদের আজীবন কাল আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে থাকল সেদিনের অপরাহ্ণবেলা।
সওয়ারিদের অবশ্য এসব দিকে দিকপাত করার কোন অবকাশ নেই। মুহুর্তের মধ্যে তাবৎ দর্শনার্থীদের বুকে হিল্লোল জাগিয়ে এগিয়ে চললেন নিদিষ্ট লক্ষ্যে। বসন্তের বিকালে গড়ের মাঠ মোটেই জনবিরল নয়। বিশেষতঃ ইংরেজ মহিলারা হয় সঙ্গী সহ কিংবা সন্তানদের প্যারামবুলেটারে বসিয়ে অপরাহ্ণবেলাটি উপভোগ করতে চাইচ্ছে নিজের মতন করে। সহসা দুজন অশ্বারোহীর সদম্ভ প্রবেশের ফলে যাবতীয় মনোযোগ তছনছ হয়ে গেল, সচকিত করে তুলল সকলকে। বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল ঘোড়সওয়ারিদের দিকে। এমন দৃশ্য যে তাদের দেশেও বিরল। এবারেও আশপাশের উপস্থিত মানুষজনের প্রতি কোন কৌতুহল নেই এই যুগল অশ্বারোহীদের। তাঁরা একটু জনবিরল স্থান খুঁজচ্ছিলেন, তাই এগিয়ে চললেন আরো কিছুটা দূরে।
স্থান ফাঁকা পাওয়া মাত্রই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ গোড়ালির সামান্য টোকায় আর লাগাম আলগা করে দেওয়ায় শিক্ষিত ঘোড়ার বুঝতে অসুবিধা হল না এবার তাকে চুড়ান্ত গতিতে ছুটতে হবে। । রেকাবে পা রেখে কোমর সামান্য উঠিয়ে শরীরের সামনের অংশ কিছুটা ঝুকিয়ে দিলেন। ঘোড়া দ্রুত ছুটতে সুরু করল হাওয়ার বেগে । পিছনে থাকা কাদম্বরীদেবীর একই ইংগিতে ঘোড়াকে নিয়ে গেলেন এক দ্রুত গতির ছন্দে। বিরাট মাঠে দুবার ঘুরে আসা যে কোন ঘোড়ার পক্ষেও পরিশ্রম সাধ্য। মাঠের মাঝখানে ঘোড়া দাঁড় করানোর সাথে সাথে আগে থেকে উপস্থিত থাকা দুজন সহিস এগিয়ে এল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আগেই নেমে পড়েছিলেন, কাদম্বরী দেবীর নামতে একটু দেরী হচ্ছিল, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পাশে আসতেই দ্রুতই নামতে চাইছিলেন,স্নায়বিক উত্তেজনার ফলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সামান্যই টলে গিয়েছিলেন, অনুমান করে ততক্ষণে ধরে ফেলেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। হেসে বললেন –“ চিন্তা নেই পাস করে গেছ, ডিসটিংশন সহ”। কাদম্বরীর মুখে লাজুক হাসি। এতক্ষণের পথশ্রমে কপালে কানের পাশে ঘাম গড়াচ্ছে। সঙ্গে আনা একটি থলি থেকে ছোট একটা গামছা বার করে দিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। মুখ মোছা মাত্রই গঙ্গার দিকে থেকে আসা ঠান্ডা হাওয়ায় এতক্ষনের ঘোড়দৌড় জনিত পরিশ্রমের ক্লান্তি যেন এক নিমেষে কেটে গেল। সহিসরা ঘোড়াদুটিকে দানাপানি খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চীৎকার করে বললেন, “ ঘোড়া নিয়ে তোমরা ফিরে যাও, জোড়াসাঁকো থেকে গাড়ী ঠিক সময় চলে আসবে ”। এবার কাদম্বরীর দিকে ফিরে বললেন, “ একটু পরেই দিনের আলো চলে যাবে, ঘোড়ায় চড়ে ফিরতে অসুবিধা হবে বিশেষতঃ চিৎপুরের ওখানে খুব ভীড় হয় সন্ধ্যার পর ”। কাদম্বরী তখন গলায় ঘাড়ে ঘাম মুঝে চলেছেন।
“ দেখছ তো কেমন চমৎকার নরম গামছা, আমাদেরই তাঁতে বোনা, এবার থেকে স্বদেশী গামছাই ব্যবহার করব”। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কথায় কাদম্বরী অল্প হাসলেন।
“নীচের ঘর থেকে তাঁত বোনা শব্দ পাই বটে, তবে সেখানে তো জানতাম স্বদেশী ধুতি আর গামছা বোনা হয় কিন্তু , স্বদেশী রুমাল বোনা হয় জানতাম না তো ”। কাদম্বরীর হাতে যেটি দেওয়া হয়েছিল, রঙে এবং বুননে গামছার ক্ষুদ্র একটি সংস্করণ বলে মনে হলেও নির্মাণে পেশাদারিত্বের অভাব সর্বাঙ্গীণ। ফলে কাদম্বরী দেবীর এই ঠাট্টা যথাযথ হলেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একটু ক্ষুন্নই হলেন।
“ দেশের জন্যে লোক কত কি করছে , প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিচ্ছে, সে তুলনায় আমাদের প্রচেষ্টা নেহাতই নগন্য। তাবলে তোমার এই কটূক্তি ঠিক নয়”।
“ ওমা কটূক্তি করলাম কই ? সেতুবন্ধে কাঠবেড়ালীর অবদানও তো কিছু ছিল না। আমি তো সেটাই বোঝাতে চাইলাম। গামছা রুমালে উন্নীত হলে মান বাড়ে বই কমে না। তাছাড়া আমাদের উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে কিনা বলুন সে বিষয়ে তো কোন সন্দেহ নেই”।
“কথাটা তুমি মন্দ বলোনি, গামছার পাশাপাশি, স্বদেশী রুমালও বুনতেই পারি”। কাদম্বরী হাসলেন, তার নিছক ঠাট্টাও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছেন বলে ।সদ্য স্বদেশীয়ানার প্রভাবে নিত্যনতুন ভাবনায় মস্তিষ্ক পুরোপুরি আচ্ছন্ন সেটা অনুমান করে কাদম্বরী বললেন, “ পরিকল্পনার মধ্যে অভিনবত্ব থাকলেও ভবিষ্যৎ মোটেই উজ্জ্বল নয়, দেশীয় লোকজন রুমাল ব্যবহারে তেমন অভ্যস্ত নয়, বরং কাঁধে গামছা রাখতে অনেক স্বছন্দ, সুতরাং স্বদেশী তাঁতে গামছাই বোনা হোক ”।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জানেন কাদম্বরী সুরসিকা। কথার পিঠে কথার বাঁধন এতই সুদৃঢ় শেষ পর্যন্ত পালটা যুক্তি তর্কের কোন অবকাশ থাকে না। মৃদু হেসে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কাদম্বরীকে পাশে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন, ঠাকুরবাড়ী থেকে আসা ঘোড়ার গাড়ী লক্ষ্য করে।
কাদম্বরী নিজেও জানেন ঠাকুরবাড়ীর অধিকাংশেরই অপছন্দ তিনি। তাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বিবাহ দাদা সত্যেন্দ্রনাথ তো একেবারেই মেনে নিতে পারেননি। তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীকে আমেদাবাদ থেকে চিঠিতে লিখেছিলেন “ আমি নতুন হইলে কখনোই এই বিবাহে সম্মত হতাম না”। তখন কাদম্বরী দেবীর কত’ই বা বয়স, আট বছর। পরর্বতীকালে ঠাকুরবাড়ীর পরিবেশেই হোক বা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাহচর্যেই হোক নিজেকে সেইভাবেই তৈরী করে নিয়েছিলেন। তারপরেও অপছন্দের বাতাবরণ কিন্তু কাটেনি। তার ওপর তিনি অপুত্রক। যদিও আজ তিনি রবীন্দ্রনাথের যেকোন লেখার প্রথম শ্রোতা, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটকে নির্ভরযোগ্য অভিনেত্রী, অক্ষয় দত্তের ইংরাজী সাহিত্য নিয়ে আলোচনায় মুখ্য শ্রোতা । আবার বিহারীলালের কাব্যের একজন গুণগ্রাহী পাঠিকা।তবুও কোন আত্মিক টান নেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দিকে থেকে। কাদম্বরী মনে মনে জানেন তাঁকে ঘোড়সওয়ারি হয়ে গড়ের মাঠে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নারী স্বাধীনতা বিরোধী মনোভাব, একসময় কিঞ্চিৎ জলযোগে নাটকে প্রকাশ পেয়েছিল , ফলে সামান্য সমালোচিতও হয়েছিলেন, এখন তাঁদের এই যৌথ ব্যতিক্রমী প্রয়াস যদি পুরানো অপবাদ ঘুচিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে নারী স্বাধীনতার প্রবক্তা হিসাবেই প্রতিষ্ঠিত করে তবেই এই ঘোড়দৌড়ের সার্থকতা ।
(৩)
তিন তলার ঘর সংলগ্ন বিশাল ছাদে মাদুর বিছানো, তামার থালায় ভিজে রুমালে ঢাকা রজনীগন্ধা ফুলের সুগন্ধে আমোদিত হয়ে রয়েছে পরিবেশ।আপাততঃ একলা কাদম্বরী একমনে আসন বুনছেন, পাশে নানান রঙের উল ও ক্রচেটের সুতো। প্রায় সমাপ্ত আসনটিকে ত্রুটি মুক্ত করে চলেছেন তিনি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে। বিহারীলালকে উপহার দেবেন, শুধু উপহার বললে কমই বলা হয়, তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ সারদামঙ্গলের যেন এক পাঠ প্রতিক্রিয়া এটি। এক কথায় কাদম্বরী মুগ্ধ, স্মরণ থেকে আবৃত্তি করতে পারেন কাব্যের বিশেষ বিশেষ অংশ।নিজের ভাল লাগা বুঝিয়ে বলতে পারেন’না অন্যকে। যতবার পড়েছেন সারা শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক অণুরণন।
তেতলার ঘর থেকে ভেসে আসছে পিয়ানোর সুর। কাদম্বরী জানেন ওখানে চলেছে এক অদ্ভুত পরীক্ষা নিরীক্ষা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পিয়ানোয় সুর সৃষ্টি করেন, সেই সুরে কথা বসান রবীন্দ্রনাথ ও অক্ষয় চৌধুরী।রবীন্দ্রনাথের ওপর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ভীষণ ভরসা। বিশেষ করে তাঁর সরোজিনী নাটকে জহরব্রতের দৃশ্যে সংলাপের মধ্যেমে নাটকীয়তা আসছিল না কিছুতেই, অথচ ওটাই নাটকের চুড়ান্ত মুহুর্ত। সেটিকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে নাট্যকারের ব্যগ্রতার সীমা ছিল না। এত পরিশ্রমের পরও যদি সেটা মনঃপুত না হয়।দিশাহারা জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে পথ দেখালেন রবীন্দ্রনাথ, “ না জ্যৈদা, এখানে সংলাপ নয় প্রয়োজন একটি গান যার মাধ্যমে নাটকের রমনী চরিত্রের আত্মত্যাগ আলাদা মর্যাদা পাবে, আমাকে একটু সময় দিন”। না বেশী সময় নেননি। নাটকের স্বার্থ তাঁর এই প্রথম কলম ধরা- জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ-/পরান সঁপিবে বিধবা বালা ।/জ্বলুক জ্বলুক চিতার আগুন/ জুড়াবে এখনি প্রানের জ্বালা। দ্বিজেন্দ্রনাথের সামান্য আপত্তি ছিল ভারতী’ই সম্পাদকীয় গোষ্ঠীতে রবীন্দ্রনাথের অন্তর্ভুক্তি করা নিয়ে। দ্বিজেন্দ্রনাথ অগ্রজ হলে কি হবে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য চেতনা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা ছিল না। যতটা জানেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, তাঁরই একক সওয়ালে রবীন্দ্রনাথ এখন ভারতী’র সম্পাদক মন্ডলীর একজন। আর একজন নতুন সদস্য নেওয়া হয়েছে তিনি বিহারীলাল। কাদম্বরী দেবী তো বিহারীলালের কথায় আপ্লুত। রবীন্দ্রনাথের যে কোন লেখার প্রথম শ্রোতা হলেও বিহারীলালের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রবীন্দ্রনাথের কোন লেখাই নাকি সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি এখনো। রবীন্দ্রনাথেরও যে সেই নিয়ে অভিমান নেই তা নয়, কিন্তু মুখে ব্যক্ত করেন না।
গঙ্গার দিক থেকে আসা মৃদুমন্দ বাতাস বারে বারেই কাদম্বরীর আলগা চুল কপালে এনে ফেলছিল। সূচ ধরা হাতে সাবধানে কপাল থেকে চুলের গুজি সরিয়ে নিতে গিয়ে মুখ তুলেছেন, রবীন্দ্রনাথ আসছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ঘর থেকে, চোখাচোখি হতেই মৃদু হাসলেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাদুরের একধারে বসে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ।
“ কি ব্যাপার সুরের কারখানা বন্ধ হয়ে গেল”। কথাটা বলে কাদম্বরী আবার আসনের দিকে মন দিলেন।
“ না আমার ছুটি হয়ে গেল”। রবীন্দ্রনাথের কথায় মুখ তুললেন কাদম্বরী, বললেন –
“ পিয়ানোর আওয়াজ পাচ্ছি যে”।
“অক্ষয়বাবু রয়েছেন এখনো, কসরত চলচ্ছে”।
“ একদিকে ভাল যে উনি ব্যস্ত রয়েছেন, না হলে সেক্সপীয়ার মহাশয়ের কবরের মধ্যেও স্বস্তি পাবার কোন আশা ছিল না ”। কাদম্বরীর কথায় রবীন্দ্রনাথ ঘাড় নাড়লেন, “ না না সেটাও চলছে সমান তালে , এখানে এলেন বলে, তোমার মত ধৈর্যশীলা শ্রোতা আর ক’জন আছে, অক্ষয়বাবু সেটা খুব ভাল করে জানেন”।
“যাকগে যাক, সুরের কারখানায় উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী কিছু নমুনা পেশ করো দেখি, শুনে জীবন সার্থক করি ”।
রবীন্দ্রনাথ ধরলেন” “ তোমার মদন বন্দি চরণ সুধাই মোরা সবাই মিলে”। দ্রুতই থামিয়ে দিলেন কাদম্বরী।
“উঁহু এতো তোমার লেখা নয়”।
“ অক্ষয়বাবুর”। রবীন্দ্রনাথ হাসতে গিয়ে চুপ করে গেলেন, অক্ষয় চৌধুরীর গলা শোনা গেল।
“ এই যে মাস ক্যারেকটার, আম জনতা, জনগনেশ তারাই কিন্তু আসল চালিকা শক্তি শুধু নাটকে নয় দেশেও বটে । কিন্তু তাদের দূরদৃষ্টি নেই, হাতির মত ক্ষুদ্র চোখ, যিনি চালনা করতে পারেন তিনিই শ্রেষ্ঠ। সেটাই সেক্সপীয়ারের নাটকে একটা সম্পদ। জুলিয়ার সিজার কথাই ধরো না কেন, সিজারকে যেখানে মারা হল ব্রুটাসের বক্তৃতার পর জনগন তার পক্ষে কিন্তু পর মুহুর্তে যেই এন্টনী এলেন …………’।
“ ভাই অক্ষয়, সব পথ যেমন রোমের গিয়ে শেষ হয়, তোমার আলোচনাও শেষ পর্যন্ত ওই ইংরাজী সাহিত্যে , আগামীকাল আমাদের বাসায় এক পার্শী ভদ্রলোক আসবেন ইংরাজী সাহিত্যের সুপন্ডিত, তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব, তারপর যত খুশী শেলী কিটস্ বায়রণ আরো যাঁরা আছেন তাঁদের কবরে ঝড় তুলে দিও, দীর্ঘদিন বন্ধ কফিনে শুয়ে শুয়ে তাঁদের হাঁপ ধরে গেছে।
“ ঠাট্টা করছ’?
“ঠাট্টা করব কেন? আমার কথায় বিশ্বাস না হয় কাদম্বরীকে জিজ্ঞাসা করো, এই তুমিই বলো না পার্শী ভদ্রলোকের আসার কথা কিনা”। সূঁচের সুতো দাঁত দিয়ে কেটে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে আবার আসন’এ মন দিলেন।
“ আমি সে কথা বলিনি তোমার বাড়ীতে পন্ডিত মানুষের সমাগম হবে এ খুব স্বাভাবিক, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই, যে বউঠানকে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হতে হবে , আমি বলছি নাটকের কথা, তোমার নাটকে সেই মাস ক্যারেকটারের ভূমিকা কোথায়, পুরুবিক্রম যার পটভূমি খ্রীষ্ট পুর্ব তিনশ বছর আগেকার, পুরু’র বীরত্ব ও তার সাহসিকতা, আর সরোজিনী নাটকে সরোজিনী, নরবলি, বিধবাদের অভিনব সম্ভ্রম রক্ষা। এই তো বিষয়বস্তু। জনগণকে যুক্ত করলে কোথায়”।
রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী কোন কথা না বললেও উভয়ের মধ্যে মাঝে মাঝেই কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় হচ্ছে। ভাবখানা ব্যাপারটা ভালই জমেছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মুখ ধীরে ধীরে রক্তাভ হয়ে উঠছিল অহেতুক সমালোচনায়। কিন্তু অভিন্নহৃদয় বন্ধু কি বা বলবেন।
“তার মানে তুমি বলতে চাইছ নাটকগুলো জনপ্রিয় হয়নি। এমনি এমনি রাতের পর রাত পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে অভিনীত হয়েছে , এখন তুমি যাই বলো না কেন ওই নাটকে নতুন করে মাস ক্যারেকটারের ভূমিকা নিয়ে ভাবব না”।
“ ওঃ! দর্শক সমাগম হলেই নাটকের যাবতীয় সার্থকতা, জনপ্রিয়তাই শেষ কথা নাকি নাটকের? সেক্সপীয়ারের নাটকের মত কালজয়ী হতে হবে তো, জনপ্রিয়তার স্বার্থে সেক্সপীয়ার কিন্তু কপ্রোমাইজ করেন’নি ”।
“ দেখো অক্ষয় তুমি যাই বলো দর্শকে যদি নাটক না কাটে তাহলে সে নাটক পোকায় কাটবে, কোন নাট্যকারই তা চান’না, সেইজন্যে জনপ্রিয় নাটক তো লিখতেই হবে”।
এই চাপান উতোর হয়ত আরো দীর্ঘায়িত হত, কিন্তু ভৃত্য এসে খবর দিল বিহারীলাল এসেছেন, তাঁকে বৈঠকখানায় বসানো হয়েছে।
“বড়দাকে খবর দেওয়া হয়েছে,” ভৃত্য একদিকে ঘাড় নাড়ল। “ আজ তো ভারতীর পরবর্তী সংখ্যা নিয়ে আলোচনা, অক্ষয় তুমিও নাহয় থেকে যাও”।
“বিহারীলাল এসেছেন যখন, আলোচনার আগে ওনার সঙ্গে দেখা হবে না ”। অক্ষয় চৌধুরী উঠে দাঁড়ালেন।
“ দাঁড়ান অক্ষয়বাবু দেখে যান কেমন হল, সারদামঙ্গল পড়ার পর এই প্রশ্নটি স্বয়ং কবির কাছ থেকেই জানতে চাই, তাই এই সামান্য নিবেদন”।
“বাঃ! এ তো অপূর্ব শিল্পকর্ম । মুগ্ধ কন্ঠে জানালেন অক্ষয় চৌধুরী। আসনের জমাট বুননের ওপর সুললিত অক্ষরে লেখা – রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে পড়লেন- “ হে যোগেন্দ্র যোগাসনে/ ঢুলু ঢুলু দু’নয়নে/ বিভোর বিহ্বল মনে কাঁহারে ধেয়াও/। মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ নিজের বুকে চেপে ধরলেন- “এমন উপহার কি আমি কখনো পাবো না”?
আসনটি রবীন্দ্রনাথের হাত থেকে নিয়ে সুন্দর করে পাট করলেন কাদম্বরী “ এর চেয়ে অনেক বড় উপহার তুমি পাবে”। ক্ষুণ্ন রবীন্দ্রনাথ চলে যাওয়া কাদম্বরীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
(৪)
আজ ঠাকুর বাড়িতে সন্ধ্যেবেলায় মজলিশ, অনেকেরই আসার কথা গান, সাহিত্য পাঠ এসব তো থাকবেই, সঙ্গে এলাহি খাওয়া দাওয়ার আয়োজন। সকাল থেকে আজ কাদম্বরীও নানান কাজ, সাংসারিক কাজ সে হিসেবে তেমন একটা করতে হয়না, অধিকাংশই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ফাই ফরমাস। বিকালেও একটি গোপন কাজের বরাত পেয়েছেন। সেই জন্যে আজ আর গড়ের মাঠে যাওয়া হয়নি। এতদিন যে দুটি আরবী ঘোড়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, হঠাৎই সেই ঘোড়া বাতিল হয়ে গেল। লর্ড মেয়ো মারা যাবার কিছুদিন পরেই তাঁর ঘোড়াগুলি নীলাম হচ্ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেই নীলামে আয়রণ গ্রে রঙের একটি জমকালো ঘোড়া কিনে ফেললেন।কিনে আনার পর কাদম্বরী’কেই প্রথম দেখালেন। এককথায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ উচ্ছ্বসিত, লাটসাহেবের ঘোড়া বলে কথা। কাদম্বরীও ঘোড়াটির গলায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। প্রত্যুত্তরে ঘোড়ারা সাধারণতঃ নাক মুখ দিয়ে একটা শব্দ করে তৃপ্ত হবার। লাটসাহেবের ঘোড়া বলেই হয়ত অল্প সোহাগ তার পছন্দ হল’না । সেই ঘোড়া নিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ গেছেন গড়ের মাঠ, সহিস আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত থাকবে ।
গোপন কর্মটি সারতেই অনেক দেরী হয়ে গেল। আজ সন্ধ্যেবেলায় অনেকেরই আসার কথা। খাবার তৈরী পাঠ সারা হয়ে গেছে। রজনীগন্ধা ফুলের ডাঁটি ফুলদানীতে গুঁজে টেবিলে রাখলেন। সেই সময় নীচ থেকে খবর এলো সহিস ঘোড়া নিয়ে ফেরত এসেছে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঘোড়া থেকে পড়ে জখম হয়েছেন, এখন পাল্কী যাচ্ছে তাঁকে আনার জন্যে।খবর শুনে কাদম্বরী’র মাথা ঘুরে গেল। এবাড়ীর পুরুষমানুষেরা এতই স্বাধীনচেতা, কার কি হল তাই নিয়ে মাথা ঘামানো কারো ধাতে নেই। স্ত্রী’ও যদি তার স্বামীর বিষয়ে উদবেগাক্রান্ত হয়ে সোচ্চার হন, সেটাও নাকি খুব শোভন নয়। যথাসম্ভব স্বাভাবিক থেকে নিজের কাজকর্মগুলি সারতে লাগলেন, মনে মনে দুশ্চিন্তার সঙ্গে অপেক্ষা করতে লাগলেন স্বামীর জন্যে।
ঘণ্টা খানেক পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ফিরলেন, আঘাত গুরুতর নয়, সামান্যই চোট পেয়েছেন। হাত পা অল্পবিস্তর ছড়ে গেছে। কবজীতে চোট লেগেছে।শেরওয়ানীতে কাদা লেগে আছে। কিন্তু তিনি মোটেই অপ্রতিভ নন। অক্ষয় চৌধুরী এসে গিয়েছেন। বন্ধুর পড়ে যাওয়ায় তিনি মোটেই উদ্বিঘ্ন নন। খবর পেয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ, হেমেন্দ্রনাথ, স্বর্ণকুমারী আরো অনেকেই জমা হয়েছেন। বিরাট হল ঘরে লম্বা টেবিলের একধারে বসেছেন অক্ষয় চৌধুরী, এদিক ওদিক ছড়ানো চেয়ারে কেউ কেউ বসলেও দাঁড়িয়ে আছেন অনেকেই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে দেখে বন্ধুবর অক্ষয়বাবুই ঠাট্টার সুরে বললেন –
“তোমার মত পাকা সওয়ারিকে কিনা ঘোড়া ফেলে দিল। তেমন লাগে নি তো”।
“না না সে রকম লাগে নি, বরং সেবার দার্জিলিং’এ ঘোড়া থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলাম তাতে অনেক বেশী চোট পেয়েছিলাম।
“ওঃ তোমার তাহলে ঘোড়া থেকে লাফ দেবার অভিজ্ঞতা অনেক আগে থেকেই আছে বলো” অক্ষয় চৌধুরীর ব্যাঙ্গাক্তিতে কোন রকম প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন-“এটা লাটসাহেবের ঘোড়া কিন্তু এযে অল্পেই ভড়কে যাবে ভাবতে পারিনি”।
“কেন কেন কি হয়েছিল?”
“আরে রোজ যেমন যাই আজও বেরিয়েছি, ঘোড়াটি মাত্রাতিরিক্ত শান্ত, যাওয়াকালীন কোন বিপত্তি হয়নি। ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লায় সাহেবদের ব্যান্ড বাজছিল, অনেকেই ঘোড়া নিয়ে ব্যান্ড স্ট্যান্ড পর্যন্ত গিয়েছে, আমিও ভাবলাম সবাই যখন গেছে আমিও যাই না কেন, ব্যাস ব্যান্ডের আওয়াজ কানে যেতেই ঘোড়াটা প্রবলবেগে লম্ফ ঝম্ফ আরম্ভ করে দিল।রাশ রেকাব ছিঁড়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করল আর আমি ধরাশায়ী”। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কথা শুনে অক্ষয় চৌধুরী হো হো করে হেসে উঠলেন। সমবেত অন্য সকলে নীরব থেকে দুঃখ অপেক্ষা কৌতুক অনুভব করলেন সমাধিক।
“হাসির এখনো হয়েছে কি অক্ষয়, দাঁড়াও সবটা শোনো , আমার দুরবস্থা দেখে কয়েকজন সহৃদয় সাহেব ছুটে এলেন আমাকে সাহায্য করতে, কোনক্রমে উঠে দাঁড়িয়েই চোখ পড়ল সহিসের দিকে, যাবতীয় রাগ তার ওপরে গিয়ে পড়ল, ড্যাম রাস্কেল বলে ঘোড়া খুঁজে আনতে বললাম, সে বেচারা তো আমার আদেশ পালন করতে দৌড়ালো। পরে দেখি ও আমার সহিসই নয়, সাহেবদের কারো হবে”।
“তারপর”।
“তারপর আর কি ভেবেছিলাম ঘোড়ায় চড়েই ফিরব কিন্তু আবার ওই ব্যান্ড স্ট্যান্ডের পাশ দিয়েই যেতে হবে আর ঝুঁকি নিলাম, যাই হোক তুমি একটু বসো বরং বড়দার সঙ্গে একটু কথাবার্তা বল, আমি জামা কাপড় পালটে আসছি”।
সামান্য দূরে দাঁড়িয়েছিলেন কাদম্বরী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আগেই ঘরে ঢুকে এলেন । তাঁকে জামা খুলিয়ে ছড়ে যাওয়া হাতের আঙ্গুলগুলি গভীর ভাবে পরীক্ষা করে শুশ্রূষা সুরু করলেন। গরমজল দিয়ে পরিষ্কার করে ওষুধ লাগাতে লাগাতে বললেন –“ আমাকে একটা বিদ্যা শেখাবেন”।
“বিদ্যা?” হঠাৎ !”
“ওই যে যা নিয়ে আপনি কয়েকটা প্রবন্ধ লিখেছেন ফ্রেনোলজি না কি, মাথার আকৃতি দেখে চরিত্র বিশ্লেষণ করেন না”।
“ ও শিখে তুমি কি করবে”।
“আপনার মাথাটা পরীক্ষা করব, বলুন তো যদি একটা বড় বিপদ হত ঘোড়াকে কি বিশ্বাস আছে ”।
“ঘোড়ার বিশ্বাস যোগ্যতা নিয়ে কত ঐতিহাসিক কাহিনী আছে, আর তুমি বলছ ঘোড়া কে বিশ্বাস করা যায় কিনা”।
“ওই সব ঐতিহাসিক কাহিনীতে যা আছে তা থাকুক না কেন, আমার অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলে, আপনি ভুলে যেতে পারেন আমি তো ভুলিনি, আপনার পুরুবিক্রম নাটকে শরৎ বাবুর ঘোড়া কি করেছিল”।কাদম্বরীর কথায় পুরানো ঘটনা মনে পড়তেই উচ্চঃস্বরে হেসে উঠলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
“ তোমার ঘোড়ার অপকীর্তির কথাই কেবল মনে আছে তোমার , আমার মঞ্চসজ্জার কথা ভুলে গেলে, গহন অরণ্যের দৃশ্যে জীবন্ত জোনাকি পোকা মিটমিট করে জ্বলচ্ছে, নিভচ্ছে, বেচারা ঘোড়ার দোষ কি বলো সে ভেবেছে আসল অরণ্যে ঊপস্থিত হয়েছে”। সেদিন আমাকে প্রতি জোনাকি পিছু দু’আনা খরচ করতে হয়েছিল, মনে আছে নিশ্চয়?”
“ভুলব কেন সবই মনে আছে, ঘোড়ার দোষ হবে কেন, সে তো জন্তু, দোষ তো তোমার অভিনেতা শরৎ বাবুর পুরু’র ভূমিকায় তিনি এতই একাত্ম হয়ে গেছেন, নিজের ঘোড়াটাকে টানতে টানতে মঞ্চে তুললেন, সে বেচারা কিছুতেই যাবে না অত লোক, আলো জ্বলচ্ছে টানা হেঁচড়া করে পিছন থেকে ঠেলা দিয়ে মঞ্চে ঢোকানোর পর যাবার হবার তাই হয়েছে”।
“ যাই বলো নাটক খুব ভাল হয়েছিল, সেই সব বিড়ম্বনার কথা মনে পড়লে আজও হাসি পায়। জখমী স্বামীর সেবার করার সুযোগে অনেকটা সময়ই কাছে পেয়েছেন তাঁকে। আপ্লুত কাদম্বরী, মনে মনে ইচ্ছা এই বিশ্রম্ভালাপ চলুক আরো কিছুক্ষণ-
“সেইজন্যেই তো বলছি আপনার মাথাটা আমার দেখা দরকার”।
“ ফ্রেনোলজি তে সব কিছু ঠিক ঠাক হয় না, আন্দাজ করা যায়, সবক্ষেত্রে তা মেলে না, যাই হোক ওদিকে ব্যবস্থা সব ঠিক আছে তো”।
“কোন চিন্তা নেই”।
“বেশ তুমিও এসো, জমবে ভালই”।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ গিয়ে দেখলেন অক্ষয়বাবু আরো কয়েকজন সঙ্গী জুটিয়েছেন বেনাবনে সেক্সপীয়ার শেলি বায়রণের সৃষ্ট মণিমুক্তো ছড়াচ্ছেন।
“ এই দেখ অক্ষয় তুমি এখানে বসে আছ, সেই পার্শী ভদ্রলোক নীচে তোমার জন্যেই নাকি অপেক্ষা করছেন”।
“ তাহলে কি নীচে যাব?” ততক্ষণে কাদম্বরী চলে এসেছেন- “ না না আপনাকে যেতে হবে না আমিই ডেকে আনছি”। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একটা চেয়ারে বসলেন। অক্ষয়বাবুর মুখের কামাই নেই।
“বড়দা আপনিও এখানে বসুন ।
“ একটা লেখার কাজে ব্যস্ত আছি, বলছ যখন তোমাদের মজলিশ দেখে যাই খানিকটা ”। সেই সময় কাদম্বরী এক পার্শী ভদ্রলোক’ কে নিয়ে ঢুকলেন, পরনে সাদা গলাবন্ধ কোর্ট কালো প্যান্ট মাথায় টুপি, গালে দাড়ি, বয়স ত্রিশের মধ্যে। ওদের আসতে দেখে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ উঠে হাত বাড়িয়ে দিলেন করমর্দন করলেন – “Welcome Mr. Desai, here is my friend from boyhood AKSHOY CHWDHURY, connoisseur of English Literature, very eager to meet you, হ্যাঁ অক্ষয় বাংলা উনি জানেন না, মারাঠীতে সড়গড়, যা বলার ইংরিজিতেই বলো”। অক্ষয়বাবু তাড়াতাড়ি উঠে করমর্দন করার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন- Glad to meet you, please be seated. বলে সামনের চেয়ার দেখিয়ে দিলেন। পার্শী ভদ্রলোক চেয়ারে বসতে বসতে বললেন “I am Binayak Desai, professor of urban college of Bombay, so far heard you are great lover of English literature,I am doing now research work . গলাটা কেমন সানুনাসিক বলে মনে হল, যেন চেনা চেনা লাগছে । কথাটা শেষ করে সেই পার্শী আবৃত্তি শুরু করলেন –“ We look before and after, /And pine for what is not / Our sincerest laughter/ With some pain is fraught;/Oue sweetest songs are those that tell of saddest thought. অক্ষয়বাবু তো মহা খুশী এতদিনে মনের মত সমঝদার পাওয়া গেছে। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলেন, “ To A skylark of Shelly, great poet, his contemporary and friend Lord Byron also. কথাটা শুনে পার্শী ভদ্রলোক কপাল কুঁচকে অক্ষয় বাবুর দিকে তাকালেন – “ May be but he is not beyond criticism, have you read Vision of Judgment, which contains parady of Robert Sourthey . এই বারেই অক্ষয় বাবু তোতলাতে শুরু করেছেন তাঁর প্রিয় কবি সম্পর্কে এসব কথা কি বরদাস্ত করা যায় । ইংরিজির বাগযুদ্ধ হয়ত আরো কিছুক্ষণ চলত, সকলের কাছেই বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠছিল। বাদ সাধলেন তারক নাথ পালিত মহাশয়, তিনি এসেই বিস্ময়ে পার্শী ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়েই বললেন “ আরে এ’কে, রবির একই চেহারা, বলেই রবীন্দ্রনাথের মাথা এক থাপ্পড় মারলেন, মাথার টুপি উড়ে চলে গেল সঙ্গে সঙ্গে খসে পড়ল মাথার পরচুল। রবীন্দ্রনাথ তো এক ছুট মারলেন অন্দরের দিকে। সমবেত সকলেই বিশেষতঃ মহিলারা হাসি সম্বরণ করতে পারেন না। অক্ষয়বাবুর অবস্থা দেখার মত, হেরে যাওয়া খেলোয়াড়ের যাবতীয় গ্লানি তখন চোখে মুখে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে মুখোমুখি বসে বললেন “ অক্ষয় তুমি এতটা সরল আমি জানতাম না, তুমি এম’এ পাস করেছে, ল, পাস করেছে একবারও তোমার মনে এল না আজকের তারিখটা কি?তুমি এতদিন ধরে রবিকে দেখছ তাও চিনতে পারলে না পালিত মশাই তো দেখেই চেনেছেন ” হাসির রেশ তখন চলছে।
জ্ঞানদানন্দিনী সান্ত্বনার সুরে বললেন, “ দুঃখ করবেন না অক্ষয়বাবু, এসব নতুনের যড়যন্ত্র, রবি’কে তালিম দিচ্ছে বেশ ক’দিন ধরে, আজ বিকেল থেকেই কাদম্বরী রবিকে দাড়ি গোঁফ পরিয়ে নীচের ঘরে লুকিয়ে রেখেছিল”।
এতগুলি মহিলার সামনে এপ্রিল ফুল হওয়া মোটেই সুখের কথা নয়। স্বর্ণ কুমারী বললেন – “ যাক,গে যা হবার তা তো হয়েছে, অক্ষয়বাবুর প্রিয় কাটলেট আসতে এত দেরী হচ্ছে কেন”?
“ কাটলেট ভাজা হচ্ছে বেশী দেরী হবে না, কাউকে ঠকালে তো আগে তাঁকে মিষ্টিমুখ করাতে হয়, কাঁচা ছানার সন্দেশ বেশী নয় আপাততঃ দশটা আছে। আজকের ঘটনার সমস্ত দায়, আমি মাথায় নিয়ে মাপ চেয়ে নিচ্ছি আপনার কাছে”। কাদম্বরী’র কথায় অক্ষয় বাবু তাঁর মৌনতা ভেঙ্গে বললেন, “ না না বৌঠান আপনি কেন মাপ চাইবেন এটা নিছক একটা খেলা”।
“বেশ আমার হাতের তৈরী সন্দেশগুলি সদ্ব্যবহার করুন তাহলেই বুঝব, আর কোন গ্লানি নেই আপনার মনে”। সন্দেশ গুলির দিকে একবার তাকালেন অক্ষয়বাবু, ধবধবে সাদা সন্দেশগুলির ওপর একটা করে গোলাপের পাপড়ি বসানো। অক্ষয়বাবু একটি তুলে মুখে ফেলতেই সকলে হাততালি দিয়ে উঠলেন ।
(৫)
ঠাকুরবাড়ীর মেয়েদের সাংসারিক কাজ যেমন ছিল না, কাজেরও শেষ ছিল না। নিয়ম করে প্রত্যেকেই পড়াশুনা করতে হত।এক বৈষ্ণবী আসতেন মেয়েদের বাংলা পড়াতে।এর কিছুদিন পরে এক খৃষ্টান মিশনারী মেম নিযুক্ত হলেন ইংরিজি পড়াতে, তারপর অয্যোধানাথ পাকড়াশী মহাশয় সংস্কৃত শেখাতে আসতেন। হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সেজদা, বললেন, “ শুধু পড়লেই হবে না আরো অনেক কিছু জানতে হবে”। তিনি পড়াতে শুরু করলেন মেঘনাথ বধ কাব্য। তার সবিস্তার ব্যাখা, ভক্তিরস দূরে সরিয়ে রেখে বীররসের জয়গান। এর ফলে ঠাকুরবাড়ীর মেয়েদের জ্ঞানের স্পৃহা দিনে দিনে বেড়েই চলল। এরপর সত্যেন্দ্রনাথ বিলাত থেকে ফিরে আসার পর তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী’র সাহচর্যে ঠাকুরবাড়ীর সংস্কৃতির খোলনলচে অনেকটাই পাল্টে গেল। আগে যেসব নাটক অভিনীত হত পুরুষরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করত, বিশেষতঃ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নারী চরিত্রের অভিনয়ের তুলনা ছিল না। শুধু অভিনয়ই নয় মেয়েদের পোষাকে এত সুন্দর মানাত, দেখে বোঝার উপায় ছিল না, একবার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নটীর বেশে গ্রীনরুমে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছিলেন, সেদিন আবার হাইকোর্টের তদানীন্তন বিচারপতি সেটন কার নিমন্ত্রিত, এসেছেন অভিনয় দেখতে, তখন নাটক আরম্ভ হয়নি। হারমোনিয়াম ও কন্সার্টের আওয়াজ শুনে বিচারপতি গ্রীন রুমে ঢুকে পড়েছেন, ঢুকেই beg your pardon, beg your pardon জানানা জানানা বলে বেরিয়ে আসেন। পরে ওনাকে বোঝানো হয় ওখানে জানানা বলে কেউ ছিল না। ওনার লজ্জা পাবার কোন কারণ নেই। দিনবদলের সাথে সাথে অনেক কিছুই বদলেছে, মেয়েদের এখন পড়াশোনার পর নাটকের মহলা। কয়েকদিন আগেই অনুষ্ঠিত হল অলীকবাবু নাটকের অভিনয়। রবীন্দ্রনাথ অলীক বাবুর চরিত্রে অভিনয় করেন, হেমাঙ্গিনী চরিত্রে কাদম্বরীদেবী।জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জগদীশের চরিত্রে। সকলেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অভিনয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
‘জোড়াসাঁকো সংবাদ” নামে একটি ট্যাবলয়েড কাগজ রবীন্দ্রনাথ কোথা থেকে যোগাড় করেছেন, সেখানে অলীকবাবু নাটকের একটি আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে। নতুন বৌঠানকে দেখানোর উদ্দেশ্যে ঘরে ঢুকে দেখলেন, বিকালের অঙ্গসজ্জার পর কপালে কুমকুমের ফোঁটা আঁকছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ’কে দেখে একটু আশ্চর্যই হলেন, বিয়ের পর থেকে রবীন্দ্রনাথ বড় একটা আসেন না। যদিও তার সঙ্গত কারণ আছে। সাজসজ্জা শেষ করে বিশাল পালঙ্কের ওপর উঠে বসলেন একটি পাত্র ও রজনীগন্ধা ফুলে ডাঁটি নিয়ে।
“ এই দেখো অলীকবাবু নাটকের আলোচনা করেছেন এক সাংবাদিক, তোমার খুব প্রশংসা করেছেন”।
“ তাই নাকি! পড়ে শোনাও দেখি”। কথাগুলো বললেন বটে, কিন্তু খুব যে আগ্রহ আছে বলে মনে হল না।
“অনেকটাই লেখেছে, আমি কিছু কিছু অংশ পড়ছি- “ মলিয়রের ফরাসী নাটকের সঙ্গে বাংলার দর্শকদের পরিচয় ঘটালেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তিনি বড় লেখক কিন্তু ফরাসী সংস্কৃতি হইতে বাহির হইতে পারেন নাই। কোন বাঙ্গালী রমনী আঁশ বটিহস্তে সর্বসমক্ষে বলিতে পারে না ওই বন্দীই আমার প্রাণেশ্বর, ইহা বাঙ্গালী সংস্কৃতির বহির্ভূত। তবে একথা স্বীকার্য হেমাঙ্গিনী’র চরিত্রে কাদম্বরী দাসীর অভিনয় অতুলনীয়। তিনি চরিত্রটির যথাযথ রূপদান করিয়াছেন , যার জন্যই দর্শককূল হাসির রসদ পাইয়াছে।
“আর কিছু লেখেনি”। লিখিত প্রশংসা ম্রিয়মান কাদম্বরী’র মনে কোন ছাপ ফেললো না।
“ জ্যৈদার অভিনয়ের কথা লিখেছে, বিশেষতঃ চীনেম্যান সেজে অভিনয় অতুলনীয়, আমার কথা এক লাইনে শেষ,
“ তা তুমি কি পাবনা যাচ্ছ নাকি”।কাদম্বরী আশ্চর্য হলেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তো তাঁকে দূরে কোথাও নিয়ে যান’নি আজ পর্যন্ত। বিয়ের পর থেকে বড়জোর চন্দননগর আর মূলাজোড়। তাও সেখানে একলা রেখে চলে যেতেন কলকাতায় মেজদার কাছে।
“পাবনা? আমি”।
“ওখানে মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব হয়েছে, উনি বাঘ শিকারে যাবেন, আমারও ইচ্ছে আছে যাবার”।
“ তোমার দাদাকে বলছিলাম সেদিন মাথার করোটি দেখে কিভাবে লোকের স্বভাব চরিত্র বলা যায় সেটা শেখাতে, এত কিছু যখন শিখছি ওটাও শিখতে পারব”।
“ ফ্রেনোলজির কথা বলছ? জ্যৈদা শুধু ফ্রেনোলজি নয় ফিজিওনমিতেও ওস্তাদ, মুখসামুদ্রিক বিদ্যা, ওসব শিখে তুমি কি করবে?”
“ আমি জানি তোমার দাদা অনেক কিছুতেই পারদর্শী, বাঘের উপদ্রবের কথা এখন তোমার মুখ থেকে শুনছি, কিন্তু এর প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই”। রবীন্দ্রনাথ একটু আশ্চর্যই হলেন –
“ সেকী! তুমি জানো! কই আমি তো জানতাম না”।
“ তুমি জানবে কিকরে, মাঝখানে উনি সাহাজাদপুর গিয়েছিলেন, জানো তো?’
“ সে তো মাঝে মাঝেই যেতে হয়”।
“তখন থেকেই শিকারের নেশা মাথায় ঢুকেছে, বসো না, চলে তো যাবেই ”। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নানান বিষয়ে আগ্রহের কথা নতুন নয়, রবীন্দ্রনাথ জানেন তা, সেবার সাহাজাদপুর যাবার সময় বন্দুক নিয়ে গিয়েছিলেন সেটা মনে পড়ল এই কারণে তারও ক’দিন আগে জ্যৈদাকে স্বয়ং দেখেছিলেন বন্দুক’টি যত্নসহকারে পরিচর্চা করতে। শিকারের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের অনীহা চিরদিনের। শৈশবে শিকার করা পাখিটিকে দেখে বড়ই বুকে বেজেছিল তাঁর। এইসব সংসর্গ এড়িয়েই চলেন। পাবনা যাওয়ার মুখ্য উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথের কাছে বাঘ শিকার নয়, শিলাইদহ ও সাহাজাদপুর ঘুরে আসা। কলকাতার জনকোলাহল থেকে নির্জন প্রকৃতির সান্নিধ্য অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য তাঁর কাছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ বসলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের শিকারের প্রস্তুতির কথা শোনার জন্য।
“ ওখানে আমাদের জমিদারীতে কোন হাতি নেই, জানো বোধহয়”।
“ জানি, হাতির প্রয়োজন হয়নি কখনো”।
“এবারে হয়েছে পাশের জমিদারের কাছ থেকে হাতি ভাড়া করে শুধু ঘুরে বেড়ানো নয় তাকে প্রশিক্ষিত করতে চেয়েছেন শিকারের জন্যে উপযুক্ত করে তোলার জন্যে, তাই হাতির পিঠে বসে বন্দুক থেকে ফাঁকা আওয়াজ করেছেন যাতে সে সড়গড় হয়, উলটে এক বিপত্তি, বন্দুকের আওয়াজ শুনে হাতি এমন দৌড়োদৌড়ি লাফালাফি শুরু করল, মাহুত কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, শেষে তোমার দাদা বেগতিক দেখে হাতির লেজ ধরে কোনক্রমে নেমে পালিয়ে বেঁচেছেন”। রবীন্দ্রনাথ হাসতে হাসতে বললেন, “ এত খবর তুমি জানলে কোথা থেকে”। সে কথার উত্তর না দিয়ে কাদম্বরী বললেন, “ আবার এক নতুন নেশা মাথা চেপেছে জাহাজের খোল কিনেছেন”।
“ তা জানি, তবে জাহাজ তৈরীর বরাত কেউ নিতে চাইছেন না, জাহাজ তৈরী হলেই জলে ভাসবে, সেবার নীল চাষে বিস্তর লাভ হয়েছিল সেই টাকা’টাই বিনিয়োগ করতে চান”। কাদম্বরী’র যে এসব বিষয়ে কৌতুহল আছে বলে মনে হয় না, প্রথম থেকেই আনমনা দেখাচ্ছে তাঁকে, রজনীগন্ধা ফুলগুলি ডাঁটি ছাড়িয়ে একজায়গায় জড় করছেন মালা গাঁথবেন বলে, রবীন্দ্রনাথের দিকে না তাকিয়েই বললেন,- “ এখন আর নীল চাষ হয় না?”
“না জার্মানীতে নীলের বিকল্প আবিষ্কার হওয়ার পর ইউরোপে আর নীলের চাহিদা নেই”।
“ আমার খবরাখবর জানার সুত্র হল তোমরাই, তোমার দাদা না জানালেও কিছু কিছু কথা কানে তো আসেই ”। কাদম্বরী সূঁচে সুতো পরিয়ে মালা গাঁথা শুরু করলেন খাটের ওপর বসে , কিছুক্ষণের নীরবতার পর রবীন্দ্রনাথ বললেন, “ আমি তাহলে উঠি”।
“ উঠবে কেন বসো না, তেমন কোন কাজ আছে কি”
“ না সেরকম কোন কাজ নেই অনেকক্ষণ ধরে একটা শব্দমালা মাথায় ঘুরছে, তাই আর কি”।
“ তবে আর কি, এসো তাহলে, যাবার আগে একটা কথা বলে যাও তো, তুমি তোমার দাদার সরোজিনী নাটক দেখছ”।
“বোর্ডের থিয়েটারে দেখিনি, এখানে যখন হয়েছিল তখনই দেখেছি”।
“ দর্শক সমাগম হয়?”
“ কি বলছ, রমরম করে চলছে জ্যৈদার খুব নাম হয়েছে থিয়েটার মহলে। ”।
“ আমাকে একদিন নিয়ে যাবে”।
“ ওমা সেকি কথা, তুমি যাবে কি, ওখানে সব বারবনিতারা অভিনয় করেন”।
“সরোজিনী’র চরিত্রে কে অভিনয় করেন জানো”।
“শুনেছি বিনোদিনী দাসী”।
“ঊহু”!
“ কি হল?” রবীন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়িয়েছেন ব্যগ্র হয়ে।
“ তেমন কিছু নয় সূচটা আঙ্গুলে ফুঁটে গেল”। চূনীর দানার মত একফোঁটা রক্ত ফূটে উঠেছে তর্জনীর ডগায়। রবীন্দ্রনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন কাদম্বরী, দৃষ্টির মধ্যে কেমন যেন একটা শূণ্যতা। “ ব্যস্ত হয়ো না, অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম”- বাঁহাত দিয়ে আঙ্গুলটা একটু টিপে ধরতেই আরো একটু রক্ত বেরিয়ে এলো তখনই আঙ্গুলটা মুখের মধ্যে নিয়ে রক্ত বন্ধ করতে চাইলেন । রবীন্দ্রনাথও ধীর পায়ে ঘর থেকে চলে এলেন”।
(৬)
কলকাতায় যখন হাফ আখড়াই’ এর রমরমা, কে সেখানে জমায়েত না হচ্ছে।ইস্কুলের ছেলে থেকে টমটমে চড়া বাবু , কালীঘাটের দেহপসারিণী, হুইস্কি সোডা আর মুর্গী মটনে ইয়ং বেঙ্গলও মশগুল। এরই মধ্যে কানাগুসা শোনা যাচ্ছে বাংলা রঙ্গমঞ্চে এক নক্ষত্রের আবির্ভাব ঘটেছে, তিনি গিরীশ ঘোষ, এমনই তাঁর প্রতিভা একাধারে তিনি অভিনেতা, একই সঙ্গে মঞ্চাধ্যক্ষ, অন্যদিকে তিনি নাট্যকার, সেই সঙ্গে গীতিকার ও সুরস্রষ্টা। এমন প্রভিতা বাঙ্গালী আগে দেখেনি। এতদিন নারীর ভূমিকায় পুরুষেরা অভিনয় করেছে, গিরীশ ঘোষের এক অভিনব প্রচেষ্টা, চৈতন্য মহাপ্রভু’র চরিত্রে নির্বাচন করলেন বিনোদিনী দাসী’কে। মাধাই’ এর চরিত্রে তিনি নিজে। গরল গলাধঃকরণ করে গালি দিচ্ছেন উচ্চস্বরে, আবার খোলের বোলের সঙ্গে তাল দিচ্ছেন পায়ে। একজন নটের শরীরের দুটি অংশ আলাদা ভঙ্গিতে কথা বলছে। হাফ আখড়াই এর গোড়া গিরীশ ঘোষ তাঁর প্রতিভার কুড়ুল দিয়ে একেবারে দোফালা করে দিয়েছেন। দলে দলে লোক আসছে স্টার থিয়েটারে।এমন’কি শ্রীরামকৃষ্ণদেব এলেন নাটক দেখতে , অভিনয়ের শেষে বিনোদিনীর মাথায় হাত রেখে বললেন, “ তোমার চৈতন্য হোক। এ যে আসল নকল একাকার হয়ে গেল গো ”। চৈতন্য কি খালি বিনোদিনীরই হল!নাকি উন্নাসিক বিরোধীদেরও। যারা বারবনিতা নিয়ে নাটক’কে ঘৃণার চোখে দেখে এসেছে এতদিন, ঠাকুর যখনই তিনি নাটকে লোক শিক্ষার কথা বললেন আর তো বলার মত মুখ রইল না তাদের।
গিরীশ ঘোষ প্রায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছেন মঞ্চের এক ধারে, মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কিসব বলছেন। “ তিরস্কার পুরস্কার কলঙ্ক কন্ঠের হার তথাপি এ পথে পদ করেছি অর্পন রঙ্গভূমি ভালবাসি হৃদে সাধ রাশি রাশি আশায় নেশায় করি জীবন যাপন। হঠাৎ চীৎকার করে উঠলেন, – “ অমৃত অমৃত কোথা গেল?”
“ আছি গুরুদেব”।
“ জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই… ঠাকুর কি চলে গেছেন?”
“ হ্যাঁ, তুমিই তো টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলে দিলে”।
“ কাজটা ভালো হল’না বলো”। রসরাজ চুপ করে রইলেন, গিরীশ ঘোষ’কে কমদিন দেখছন না, সবাই প্রায় চলে গেছে, রসরাজ বসে আছেন, গিরীশ ঘোষ’কে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তবে তাঁর ছুটি।
“কি হল চুপ করে করে আছো কেন বলো কিছু”।
“ঠিকই। কাজটা তো ভাল হল না গুরুদেব”।
“বেশ এখনি চলো দক্ষিণেশ্বর, বলব ঠাকুর তুমি এতো লোককে ক্ষমা করে দিতে পারো আমাকে পারো না, আমি আকন্ঠ মদ খেয়েছি, “বেশ করেছিস আমিও মদ খেয়েছিস” , শুনতে পারছ অমৃত, ঠাকুর কি বলছেন, ঠাকুরও মদ খেয়েছে”। হা হা করে হেসে উঠলেন গিরীশ ঘোষ, তারপরেই গান ধরলেন-“ সুরা পান করিলে আমি সুধা খাই জয় কালী বলে, মন মাতালে মাতাল বলে না না মদ মাতালে মাতাল বলে”, হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। জাপটে ধরে অমৃতলাল তোলার চেষ্টা করলেন “ চলো গুরুদেব অনেক রাত হয়েছে”। টলতে টলতে হল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন গিরীশ ঘোষ, বিড়বিড় করে বলছেন-“ Heard melodies are sweet but those unheard is sweeter…… কে তুমি?
“ আমি শিষ্য গুরুদেব”।
“ অনুগামী? কিন্তু সহগামী কই, এতদিন নাটক করছি সহগামী কেউ হল না, সবাই অনুগামী । বুকে বড় জ্বালা অমৃত, আরো মদ না খেলে এ জ্বালা জুড়াবে না, চলো বিনি’র বাড়িতে যাই”।
“ এতো রাতে?”
“ এমনকি রাত, বিনির বাড়ি তো রাতেই যাব. কি ঠিক বলিনি, চলো “ চলো’লো সজনী সরোজ কাননে যাই সুশীতল সরোবরে…। কি বলে দাও না’।
“সুশীতল সমীরণে জীবন জুড়াই”।
“ আর বলতে হবে সুশীতল সমীরণে জীবন জুড়াই ………”
রাতের কলকাতার নির্জন রাস্তা এখন দুই প্রবাদপ্রতিম অভিনেতার শাসনাধীন, নিয়ন্ত্রণহীন স্থলিত পায়ে এগিয়ে চলেছেন দুজনে, মুখে অসংলগ্ন কথার পৌনঃপুনিক আস্ফালন। গিরীশ ঘোষের একটি হাত অমৃতলালের কাঁধের ওপরে, অমৃতলাল তাঁর একটি হাত বেড় দিয়ে গিরীশ ঘোষের কোমর ধরে রেখেছেন , প্রতি পদক্ষেপে তাঁর পতন সম্ভবনাকে রোধ করার জন্যেই এই সাবধানতা। উঁচু নিচু রাস্তায় হোচট খেয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন গিরীশ ঘোষ। “ গুরুদেব সাবধানে চলো, নাহল কখন বলতে কখন পড়ে যাবে”।
“If thou beest he but O, how fallen! How changed from him who in the happy realms of light”. পড়ে যাব বলছিলে না, কে ফেলবে আমাকে। আর কত দূর অমৃত, পথ হারাও’নিতো।
“না গুরুদেব আমরা এসে গেছি দেখা যাচ্ছে”।
বিনোদিনী দাসীর দোতলা বাড়ি। বন্ধ দরজায় তখন আর করাঘাত নয়, উপর্য্যুপরি আক্রমণ। নিস্তঃব্দ রাতের সুষুপ্তি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলেও বিরাম নেই। দাসী দরজা সামান্য ফাঁক করে চিনতে পারল না, রাত যতই হোক না কেন সে আশ্চর্য হল না, এরকম মাতালের উপদ্রব লেগেই থাকে। “ কারা তোমরা? এখন দেখা হবে না ঘরে লোক রয়েছে, দেখছ না গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে”। বলেই দুম করে দরজা বন্ধ করে দিল। মাতালদের বিশ্বাস নেই ঠেলা দিয়ে ঢুকে যেতে পারে। “ কি বললে অমৃত বিনোদিনীর ঘরে কে রয়েছে?
“ প্রেমাষ্পদ” । অমৃতলাল আশপাশ তাকিয়ে দেখলেন, অন্ধকারে কোন গাড়ি নজরে এল না।
“ঝি মাগী বললে একথা ?’
“ বললে বৈকি, দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে, চলো দেখা যখন হবেই না ”।
“ চলো তাহলে গঙ্গার ধারে যাই…। সুশীতল সমীরণে”।
“ জীবন জুড়াই”। চলো গুরুদেব তোমায় বাড়ি পৌঁছে দি, দেখছো না একটা কুকুর আগে আগে যাচ্ছে”।
“তাই, চলো নরক দর্শণ তো হয়েই গেল, এবার যুধিষ্টিরের মতন স্বর্গের রাস্তা ধরি, আমাকে স্টারে নিয়ে চলো নাটক লেখা শেষ হয়নি, নসীরাম আজই শেষ করতে হবে”।
গ্যাসের ক্ষীণ আলোয় পথঘাট তেমন আলোকিত নয়। তার মধ্যে দিয়ে বাংলা রঙ্গমঞ্চের দুই দিকপাল হেঁটে চলেছেন, নিয়ন্ত্রণহীন পায়ে।লক্ষ্য এখনো অনিদিষ্ট, তবু চলেছেন, অসংলগ্ন বাক্যব্যায়ের মধ্যে দিয়ে। হঠাৎই পিছন থেকে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শোনা গেল। রাস্তার মাঝখানে দুজনকে দেখে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। খোলা গাড়িতে একলাই বসে ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। কোচওয়ান’কে জিজ্ঞাসা করলেন “ কি হল থামালে কেন”?
“দো সোরাবী কে লিয়ে রুক গিয়া”। তখনই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কানে এলো – “ কে বাবা এত রাতে জুড়ি গাড়ি হাঁকিয়ে ফিরছ’।ভাবগতিক তো ভাল ঠেকছে না, মনে হচ্ছে একই পথের পথিক, কি’ বাওবা চুপ করে রইলে কেন?” রাস্তার ক্ষীণ আলো জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মুখে পড়েছে, অমৃতলাল চিনতে পেরেছেন , Oh idea of Greek beauty, ব্রুটাস তুমিও” । রাস্তার মাঝখান ছেড়ে ঘোড়ার গাড়ির ধারে চলে এসেছেন দুজনে, এবার জ্যোতিরিন্দ্রনাথও চিনতে পারছেন গ্রীক বিউটি বলে ডাকার লোক তো কলকাতায় একজনই, অমৃতলালের পাশে নিশ্চয়ই গিরীশ ঘোষ, কোন সন্দেহ নেই “আপনারা”!
“হ্যাঁ বাওবা আমরা, চিনতে পেরেছ তাহলে, নটগুরুকে কি না চিনে কোন উপায় আছে,” অমৃতলাল নৃত্যের ভঙ্গীতে গিরীশ ঘোষের একটা হাত নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। জড়ানো গলায়-“ আমি আর গুরুদেব যুগল ইয়ার বিনির বাড়িতে যাই খাইতে বিয়ার”। আর দাঁড়ালেন না জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
“কোচওয়ান গাড়ি হাঁকাও”। ঘোড়ার খুর আর ঘণ্টার আওয়াজে রাতের নিঃস্তব্দতা ভেঙ্গে গাড়ি এগিয়ে চলল, পিছনে পড়ে রইলেন নাট্যাচার্য গিরীশ ঘোষ আর তাঁর অনুগামী রসরাজ অমৃতলাল। নাট্যরচনা ও তার গুণগত মানের বিচারে গিরীশ ঘোষের সঙ্গে পাল্লা দেবার সামর্থ্য তাঁর আর নেই, জীবন চর্চা যাই হোক না কেন নাট্যসাম্রাজ্যে একছত্র ভাবে রাজত্ব করবেন অনেকদিন। অতএব আর নয়, নাটক লেখা থেকে চিরদিনের মত ছুটি নিতে চাইছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
(৭)
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের এখন হাওড়ায় নিত্য যাওয়া আসা, সাত হাজার টাকা দিয়ে জাহাজের খোল (chassis) কিনেছেন নিলামে , কিনলেই তো হল না, পরিপূর্ণ জাহাজ বানিয়ে চলাচল উপযোগী করতে বিস্তর ঝামেলা। নীল চাষে অনেক টাকা লাভ হবার খুলনা থেকে বরিশাল পর্যন্ত জাহাজ চালাতে পারলে লাভের টাকা যথার্থ বিনিয়োগ হবে। ট্রেন যখন খুলনা পর্যন্ত চলছেই, বরিশাল যাবার সুব্যবস্থা করতে পারলে সাধারণ মানুষের অনেক সুবিধা হবে। কিন্তু হাওড়া যাওয়া আসা করাই সার হল। হাওড়া বড় বড় জাহাজ তৈরীর কোম্পানীগুলির হাতে প্রচুর কাজ, নতুন কোন বরাত নিতে রাজি নয়। শেষ পর্যন্ত কেলসো স্টেয়ার্ট রাজি হল, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজেও জানতেন তাদের কাজকর্ম খুব ভাল নয়, কিন্তু নিরুপায়, যে সময় জাহাজ তৈরী হয়ে যাবার কথা তার থেকে অনেক দেরী করে ফেলল, জাহাজের নাম দিলেন সরোজিনী। কদিন পরীক্ষামূলক চলাচল করার পরই বোঝ গেল জাহাজটি মোটেই মজবুত হয়নি, নিত্যই এটা না ওটা খারাপ হতে থাকে। দেশীয় মিস্তিরি’রা অনভিজ্ঞ, অপরিমিত অর্থব্যয় হয় কিন্তু, সমস্যা মেটে না। শেষ পর্যন্ত একজন ফরাসী মেকানিক’ কে পাওয়া গেল।
তাকেই কমান্ডার বানিয়ে দেওয়া হল। রাতদিন একলাই খাটা খাটুনি করে ত্রুটিমুক্ত করে ফেলল। বাণিজ্যিক ভাবে চলাচলের আর কোন বাধা থাকল, মেকানিকটির দোষের মধ্যে ভয়ঙ্কর মদ্যপ, মদ খেলে দু’একদিন তার কোন জ্ঞান থাকে না। জিনিষপত্রে অযথা অপচয় করে ।
উদ্বোধনের দিন জাহাজঘাটায় লোকে লোকারণ্য, ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রায় সকলেই এসেছেন, আসেন’নি খালি কাদম্বরী। অথচ ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য মেয়েরা গেছেন জাহাজ দেখতে, খাওয়া দাওয়ার এলাহি আয়োজন করা হয়েছিল।সকাল থেকে নহবতের সুরে জাহাজঘাটা সরগরম। তুমুল হর্ষ আর তোপধ্বনি’র মধ্যে জাহাজের শুভযাত্রার সূচনা হয়েছিল।এর মধ্যে একদিনও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাড়িতে আসারই সুযোগ পাননি। কাদম্বরী একেবারে একা, মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথ এসে দেখা সাক্ষাৎ করে যেতেন , নানান কথাবার্তা হত। এখন তাও বন্ধ। কাদম্বরী’র ঘরে রবীন্দ্রনাথের আসা যাওয়া নিয়ে ঠাকুরবাড়িরই মহিলা মহলে কানাকানির অন্ত ছিল না। ইসঃ কি লজ্জা। তাই বোধহয় তড়িঘড়ি করে রবীন্দ্রনাথের বিয়ে দেওয়া হল। বিয়ের পর কাদম্বরী যখন এই ঠাকুর বাড়ীতে পা রাখেছিলেন ,তখন তার বয়স মাত্র নয়। সঙ্গী বলতে একমাত্র সাত বছরের রবীন্দ্রনাথ। বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা কি স্বাভাবিক ছিল না? সেটা নিয়ে এই কুৎসা।ভয়ে সমীহে অন্যদের থেকে দূরে দূরেই থেকেছেন কাদম্বরী। আজকেও এইসব গুঞ্জনের পিছনে প্রথমদিন থেকে সেই অপছন্দই মুখ্য। আপনাআপনিই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে আসে কাদম্বরীর।
এর’ই মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একদিন এসেছিলেন, কাদম্বরী যে জাহাজঘাটায় যেতে পারেন’নি সরোজিনী জাহাজ যে তাঁর দেখা হয়নি তা নিয়ে একটা কথাও বলেন’নি। তাঁর অভিমান বোঝার মত তো কেউ নেই এই ঠাকুর বাড়িতে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নানান কাজের ব্যস্ততার মধ্যে তুচ্ছ ব্যাপারে দৃষ্টি দেবার কোন অবকাশ নেই। সেদিন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আরো এসেছিলেন কাদম্বরীকে জানাতে এবার থেকে তিনি জাহাজেই থাকবেন। পরিচালন ব্যবস্থা তাঁকেই দেখতে হবে। গোপনে তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন, জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে।
ইতিমধ্যে ফ্লোটিলা নামে এক ইংরেজ কোম্পানী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কিছুদিন আগে থেকে খুলনা থেকে বরিশালে জাহাজ চালানো মনস্থ করেছে। সরোজিনী যদি কিছুদিন আগে প্রস্তুত হত তাহলে এই সমস্যা তৈরী হত না। একই রাস্তায় দুটি জাহাজ একই উদ্দেশ্যে চলাচল করলে অনৈতিক প্রতিযোগিতা অবশ্যম্ভাবী।তাতে যে উভয়পক্ষই জড়িয়ে পড়বে সে কথা বলা বাহুল্য। এদিকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ স্বদেশী, ভারত, বঙ্গলক্ষ্মী,ও রিপন নামে আরো চারখানি জাহাজ কিনে ফেললেন। ফ্লোটিলা বড় কোম্পানী তাদের খরচও প্রচুর। তবু ক্ষতি স্বীকার করে জাহাজ চালাতে লাগল। কিছু উমেদার স্কুলের ছাত্র ঠিক করে রাখা হয়েছে , যারা যাত্রীদের বাঙ্গালীর জাহাজে যাবার জন্যে উদ্বুদ্ধ করত। সাত সকালে সে এক চমৎকার দৃশ্য-সত্যপ্রিয়, নবীন, সদানন্দ আরো অনেকের সমবেত চীৎকার “ আসুন আসুন এই জাহাজে আসুন, আপনার অর্থ সাহেব কোম্পানীকে দেবেন কেন, তাছাড়া এই জাহাজে খাওয়া দাওয়া বাঙ্গলীর রুচি মাফিক। যা বিলাতি জাহাজে মোটেই পাবেন না”। জাহাজঘাটা সরগরম হয়ে থাকত সকাল থেকে। ফ্লোটিলা কোম্পানীও কম যায় না, তারাও নৌকো ভাড়া করে জাহাজ ঘাটায় যাত্রীদের না নিয়ে এসে নদীপথে উল্টো দিক দিয়ে জাহাজে তুলতে লাগল। সেই খবর পেয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উমেদার’রাও নৌকো ভাড়া করে নেমে পড়ল জলে, সাহেবী নৌকোতে আসা যাত্রীদের বাংলায় বোঝাতে লাগল। কাজ হল সাথে সাথে, ফ্লোটিলা কোম্পানীর নৌকোয় এসে তারা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জাহাজে উঠেলেন মৌখিক বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে। ফলে ওপর পক্ষ থেকে অশ্রাব্য গালাগালি, শেষ পর্যন্ত হাতাহাতি হবার উপক্রম। ইংরেজ’রা বেনিয়ার জাত, তারা কি অত সহজে ছেড়ে দেব সব কিছু। জাহাজের ভাড়া কমিয়ে দিল, ফলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ’কেও ভাড়া কমাতে হল। আগে যে লাভ হচ্ছিল তার পরিবর্তে ক্ষতি হতে শুরু করল। পাঁচটি জাহাজের ব্যয়ভার তো কম নয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর বাড়ী আসেন না। এতগুলি জাহাজের সময়সূচী, টাকাপয়সার হিসাবপত্র, যে সমস্ত লোকজনকে নিযুক্ত করা হয়েছে, ঠিক মত কাজ করছে কিনা। প্রত্যেক জাহাজের জন্যে পৃথক ম্যানেজার, তাদের খুলনা পাঠানো, যে সব মালামাল ওঠানো নামানো, তার যথাযথ হিসাব রাখা। ফলে দীর্ঘদিন ঠাকুরবাড়িতে ফেরা হয়’নি। এর মধ্যে তারকনাথ পালিত, অক্ষয় চৌধুরী, বিজয় মজুমদার নবগোপাল মিত্র প্রমুখ অনেকেই এই বিপুল কর্মকান্ড দেখার জন্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। সব কিছু দেখার পর সকলেই সন্তোষ প্রকাশই করলেন, যাবার সময় পালিত মহাশয় বললেন –“ জ্যোতি এক কাজ করো জাহাজের ব্যবসা ভালই জমে উঠেছে। এবার এর সঙ্গে স্বদেশীয়ানা’কে জুড়ে দাও, দেশের’র কাজ স্বদেশীয়ানার ছুতোয় যাত্রীও জুটবে ভাল ফলে তোমার ব্যবসাও হবে” । জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কথাটা মনে ধরল। স্থানীয় ব্যবসায়ী, দোকানদার, উকিল, বিশিষ্ট একজন হাকিম , স্কুল কলেজের ছাত্রদের জানান হল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ঐকান্তিক ইচ্ছার কথা। তারা শুধু রাজি হল না, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ’কে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে তারাই একটি মহতী সভার আয়োজন করতে চায়, বিখ্যাত জমিদার বরদাকান্ত রায়’কে ওই সভায় সভাপতিত্ব করার অনুরোধ করায় তিনিও সানন্দে রাজি হলেন।সভার দিন ক্ষণও নির্ধারিত হয়ে গেল।
বিকাল পাঁচটায় সভা সুরু হবার কথা, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একটি স্বদেশী সংগীত রচনা করেছেন, সভার শেষে নগর পরিক্রমা হবে। ওই দিন সকালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছে এক লস্কর কাছে খবর পেলেন , স্বদেশী নামক জাহাজটী খুলনা থেকে মাল বোঝাই করে যখন ফিরছিল, হাওড়ার ব্রিজে ধাক্কা লেগে জলে তলিয়ে গেছে। কোন মাল উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এতবড় দুর্ঘটনায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একেবারে দিশাহারা। শুধু যে একটি মালবোঝাই জাহাজ ডুবে গেল তা নয়, মালের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এখন যা আর্থিক অবস্থা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়, প্রচুর টাকা দেনা করতে হবে। সারাদিন দুশ্চিন্তায় মন ভীষণ খারাপ হয়ে রইল। এত কিছু সত্ত্বেও সভায় হাজির হলেন যথাসময়ে, বারে বারেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছেন। যথাযোগ্য মর্যাদা সহকারে তাঁকে অভ্যর্থনা দেওয়া হল। নিজের বক্তব্য যথাযথভাবে রাখতে পারলেন না। বারে বারে মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন এই ক্ষতি তিনি নিশ্চয়ই সামলে উঠবেন। সভা শেষ হল।, ছাত্রদল গান শুরু করল, নিজেই সুর দিয়েছেন, ক’দিন ধরে এই গান শেখানো হয়েছে। বিমর্ষ মুখে হাসি ফুটিয়ে তাদের বিদায় জানালেন। তারা চলে গেল নগর পরিক্রমায়। সূর্য অস্ত গেছে অনেকক্ষণ, তার রক্তিম আভা এখন আকাশে, গঙ্গার জলে কম্পমান। সেইদিকেই তাকিয়ে ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সৌন্দর্য যে উপভোগ করছেন তা নয়,সকালের ঘটনা ক্রমশ, ভারাক্রান্ত করে তুলছে তাঁকে। তার মধ্যেই মনে হল কে যেন ডাকল তাঁকে- অন্ধকার নেমে যাওয়ায় তার মুখটা ভাল করে দেখতে পাচ্ছিলেন না, লোকটি দূরে দাঁড়িয়ে আছে। নিকটেই কোন এক জাহাজের ভোঁ বেজেই চলেছে,আর একটি জাহাজে মাল ওঠানো নামানো হচ্ছে, ফলে চীৎকার চেঁচামেচি, তারই মধ্যে সংবাদদাতা শুধু এইটুকুই জানালো তাঁকে এখুনি জোড়াসাঁকো যেতে হবে, মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে সেখানে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উপস্থিত থাকা একান্ত জরুরী।
(৮)
“ওঃ! তুমি চলে যাবে! তা তো বটেই তুমি তো এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা নয়, আমার মত নির্বাসনেরও সাধ নেই তোমার, কর্মসুত্রে এসেছিলে আবার ফিরে যাচ্ছ, এতো ভালই, এতদিন প্রবাসী ছিলে, জানো তো যুধিষ্টির ধর্ম’কে বলেছিলেন, অপ্রবাসী অঋণী এই পৃথিবীতে সুখী মানুষ”। কতদিনেরই বা পরিচয়,আন্তরিকভাবে মুখে ভাল বললেও কন্ঠস্বরে বিষাদের সুর যা বসন্ত’কে ছুঁয়ে গেল।এতদিন প্রাণখুলে এসব কথা তো কারুর সঙ্গে আলোচনা করেন’নি।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ব্যাথা অনুভব করেই বসন্ত বললেন, “ আরো কিছুদিন থাকলে তো আমারই ভাল হত, আপনার অমূল্য সান্নিধ্যে কত নতুন তথ্য জানতে পারলাম, তবে যে উপকরণ পেয়েছি তা নিশ্চয় কাজে লাগবে আপনার জীবনকথা রচনার সময়। সেটি যেন সার্থক হয়ে ওঠে সেই আশীর্বাদই করুন”।
“তোমার আন্তরিকতার প্রশংসা নাকরে পারি না বসন্ত, তুমি অবশ্যই পারবে”। এইটুকু বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।অল্পেই এখন হাঁপিয়ে যান। “জানো বসন্ত তোমার সঙ্গ আমাকেও যে কি পরিমাণ আনন্দ দিতেছে তা হয়ত মুখ ফুটে পারব না। তোমার হাত ধরে আমি আবার জোড়াসাঁকো ঘুরে এলাম। সেইসব পুরানো দিনগুলো চোখের সামনে ছবির মত ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছিল”। আবার চুপ করলেন তিনি। “ যৌবনে এসব কথা কাউকে বলতেই পারিনি । তখন তো অতীত বলে কিছু ছিল না, শুধু বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। বৃদ্ধ বয়সে স্মৃতিচারণের রোমন্থনই একমাত্র বিলাস। তাই সঙ্গী পেলেই হল” ।
“জানো বসন্ত এখন তো আর কারো খবর পাই না, চিঠি বা টেলিগ্রাম আসেনা । না আসা একদিক দিয়ে মঙ্গল, ওসব আসা মানেই দুঃসংবাদ বয়ে আনা। জানো কিনা জানি না এতদূরে চলে আসা অনেকটা এই কারণেই, একের পর এক কেউ না কেউ চলে যাচ্ছেন আর সহ্য করতে পারি না, তার চেয়ে ভালো আমিই বরং বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাই”। এতক্ষণ কথা বলে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে দম নিলেন।
, আকাশে আষাঢ়ের মেঘের আসা যাওয়া। খোলা আকাশের নীচে পাথরের ওপর বসে আছেন দুজনে। মাঝে মাঝে মেঘ সরে গিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাসমান মেঘ সূর্যকে আড়াল করছে, তখন আর রৌদ্রজনিত উত্তাপ গায়ে লাগছে না, একটা প্রশান্তি অনুভব করা যাচ্ছে। পুরানো দিন বা ফেলে আসা আত্মীয় স্বজনদের যতই দূরে রাখতে চান না কেন, স্মৃতির সরণী বেয়ে তারা বারবার দুয়ারে কড়া নাড়চ্ছে।
বসন্ত জিজ্ঞাসা করলেন-“ জোড়াসাঁকো থেকে এখানে কেউ আসেনি কখনো”?
“মেজদা এসেছিলেন, বেশ কয়েকটা দিন থেকেও গিয়েছিলেন, খুবই ভাল লেগেছিল তাঁর। তবে রবি কখনো আসেনি সেকথা তোমাদের আগেই বলেছি। ওর জ্যৈদা’কে ও অনেক আগেই দূরে সরিয়ে দিয়েছে। যার জন্যে কোন খবরাখবর নেয় না। মনটা মাঝে মাঝেই ব্যাকুল হয়”। বসন্ত বুঝতে পারছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এতটাই কাতর হয়ে পড়েছেন, নিজের দুর্বলতাটুকু প্রকাশ করে ফেলছেন অক্লেশে।
“যতদূর জানি ওনার তো ইউরোপ যাবার কথা ছিল, কিন্তু অর্শের বেদনায় শারিরীকভাবে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছেন, ইউরোপ যাত্রা স্থগিত রাখতে হয়েছে। ডাক্তার পরিপুর্ণ বিশ্রাম নিতে বলেছেন”। কথাগুলি শোনার সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ভ্রাতৃপ্রেমে চোখ মুখ উদ্বেগাক্রান্ত হয়ে উঠল, এই দুর্বলতা যদি বসন্তের চোখে ধরা পড়ে যায়, তাই দৃষ্টির সঙ্গে মুখও ঘুরিয়ে নিলেন অন্যদিকে, স্বাভাবিক হবার জন্যে। কিন্তু বুকের মধ্যে জমাট বাতাস দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এলো তা কিন্তু রোধ করতে পারলেন না।
“ জানো বসন্ত আমার এই শান্তি ধামে আরো দুটি প্রাণী ছিল, তাদের তুমি দেখোনি মনে হয়?”
“প্রাণী বলতে কোন জীব জন্তু”? এতক্ষণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অন্য দিকে তাকিয়েই ছিলেন, এবার মুখ ফেরালেন’
“ হ্যাঁ। একটি কুকুর অপরটি একটি বানর, না না বানরী, নাম রূপী, কুকুরটির নাম ছিল গঞ্জু, একটি বাচ্ছা প্রসব করে মারা যায়। রূপী কিন্তু বন্ধ্যা। সেই’ই সদ্য জন্মানো কুকুর টিকে বুকে তুলে নিল”।
“ সেকী কুকুরের সঙ্গে বানরের তো বনে না শুনেছি”।
“ আমিও তাই জানতাম, সেই কুকুর বাচ্ছাটিকে নিজের স্তন পান করাতো, মাতৃত্বের এমনই আকাঙ্খা বন্ধ্যা বানরের স্তনে দুধের সঞ্চার হল। সেই কুকুর বাচ্ছা বানরটির বুক আঁচড়ে কামড়ে রক্তারক্তি করে দিত, তবু কিছু বলত না, কেউ কুকুর বাচ্ছাটি কাড়তে গেলে ক্ষিপ্ত শ্বাপদের মত ঝাঁপিয়ে পড়ত, কুকুরটা একটু বড় হতেই কোথায় চলে গেছে, আহার নিদ্রা ত্যাগ করে সারা পাহাড় তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে রূপী। মাতৃত্বের কি মহিমা, কি তার ব্যাকুলতা, আমরা পুরুষ মানুষ কি আর বুঝব বলো”। হয়ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একটু ভাবপ্রবণ হয়ে পড়েছেন। শুধুই কি অন্য প্রসঙ্গে যাবার জন্যেই এই ঘটনার অবতারণা, নাকি অন্য কিছু। এই প্রশ্ন বসন্তের মনে মধ্যে এলেও প্রতিপ্রশ্ন না করে কৌতুহল দমন করে গেলেন। এই দরাজ হৃদয় মানুষটির অন্তর কর্ষণ করে আর কিছুর সন্ধান করতে চাইলেন না তিনি, যা জানার তা জানা হয়ে গেছে।
“ এবার যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি উঠব, এতটাই স্নেহের প্রশয় পেয়েছি, তাই একটা আবদার ছিল, সেদিন বাল্মিকী প্রতিভা নাটকে বাল্মিকীর ভূমিকায় যে আদি কবিতার স্তোত্রটি পাঠ করছিলেন, মনে হচ্ছিল স্বয়ং বাল্মিকী পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন, সেটি যদি পুনরায় একবার শোনান”। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হাসলেন, চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর সুললিত কন্ঠে উচ্চারিত হল-“ মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বম অগমঃ শাশ্বতী সমাঃ যত্ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধী কামমোহিতম্। বন্ধ চোখ দিয়ে অবিরত জলধারা গড়িয়ে চলেছে। বসন্ত উঠে এসে প্রণাম করলেন, ডান হাত তুলে অভয়মুদ্রায় নীরব হয়ে রইলেন তিনি। মোরাবাদী পাহাড় ছেড়ে বসন্ত’র চলে যাওয়া প্রত্যক্ষ করতে চাইলেন’না জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। অনেকক্ষণ পরে চোখ খুললেন, শীতল ছায়া ঘনাচ্ছে গোটা পাহাড় জুড়ে। মুখ তুলে আকশের দিকে চাইলেন, জলভরা মেঘ বাতাস বাহিত হয়ে ভেসে যাচ্ছে পূর্বদিকে।কিন্তু কারো কাছে কোন বার্তা পাঠানোর নেই তাঁর । অশান্ত মনকে কেন্দ্রীভূত করতে চাইছেন বেদ মন্ত্রের দ্বারা_ “ ওঁ পিতা নোহসি, পিতা নো বোধি, নমস্তেহস্ত। মা মা হিংসীঃ। বিশ্বানি দেব সবিতর্দুরিতানি পরাসুব।
ভালই লাগল।গল্পে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং কাদম্বরীর স্কেচ যথাযথ ভাবে বর্ণিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপস্থিতি মনে রেখাপাত করেছে। আরো কয়েক ফর্মা লেখা হলেই বোঝা যাবেগল্পের অভিমুখ কোনদিকে ঝুঁকবে। …
গল্পের ভাষা, শব্দ চয়ন যথাযথ ।