দরজা খোলা থাকায় বেল বাজানোর কোন দরকার হয়নি জয়া’র। সরাসরি বাড়ির ভেতরে চলে এসেছিল ট্রলি সুটকেশ টানতে টানতে। নিজের উপস্থিতি জানান না দিয়ে হঠাৎ বাড়ির ভেতর ঢুকলে সামান্য আওয়াজে যে কেউ কৌতুহলী হবে, এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। প্রতিমা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন মেয়েকে দেখে। বিয়ের পর ধুলো পায়ে জোড়ে যে আসবে সে কথা জানা ছিল, তা’বলে কোন খবর না’দিয়ে আজকেই হঠাৎ করে মেয়ের চলে আসায় অবাক যে হন’নি তা নয়। বৌভাতের রাতে ঘুরে আসার পর মেয়ের সঙ্গে ফোনে আর যোগাযোগ হয়নি, বারে বারেই সুইচ বন্ধের কথা জানাচ্ছিল, বাধ্য হয়েই নীলাঞ্জন’কে ফোন করেছিলেন একবার, যতই হোক নতুন জামাই। সে তখন রাস্তায় ,শুধুমাত্র জয়ার কুশল সংবাদ দেবার পর কথা বাড়তে চায়’নি “পরে কথা বলব বলে লাইন’টা কেটে দেয়। যেহেতু জজসাহেবের বাড়ি সংকোচ বশতঃ আর ফোন করেন’নি প্রতিমা। যতই হোক এখনো তো সম্পর্ক তো এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। বাপ মরা মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে তার সঙ্গে কথা না বলতে পারায় মনের মধ্যে একটা খচখচানি ছিলই। তবু মন’কে প্রবোধ দিচ্ছিলেন- এখন না হয় মোবাইল ফোনের যুগ, ইচ্ছে করলেই যোগযোগ করা সম্ভব , আর তাঁদের সময়ে একটা চিঠির ভরসায় অপেক্ষা করে থাকতে হত দিনের পর দিন। এখন সুযোগ আছে বলেই তো এই ছটফটানি, যাইহোক মেয়েকে দেখার পর সেসব কোথাও উধাও হয়ে গেল এক নিমেষে।
“ কি রে তুই যে আসবি একটা ফোন করে তো জানালি না”- নীলাঞ্জন’কে দেখতে না পেয়ে কিছুটা চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন- “ হ্যাঁরে জামাই কোথায়, তোকে নামিয়ে দিয়ে মিষ্টি টিষ্টি কিনছে নাকি, গাড়ি নিয়ে এসেছে নাকি ট্রেনে এলি”।
এতগুলো প্রশ্নের কোন উত্তর নাদিয়ে সুটকেশ’টা হাতে তুলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে লাগল জয়া। মেয়ের অস্বাভাবিক আচরণে কেমন যেন খটকা লাগল প্রতিমার। মেয়ের পিছু পিছু তিনিও ওপরে উঠে এলেন।নিজের ঘরে ঢুকে সুটকেশ নামিয়ে খাটে বসে জয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেয়ের ভাবভঙ্গী দেখে একটু বিরক্ত হয়েই প্রতিমা এবার সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন- “ কি রে, জবাব দিচ্ছিস না কেন? কি হয়েছে কি? নীলাঞ্জন আসেনি?”
“ না আমি একলাই এসেছি”।
“ সে আবার কি? বিয়ের পর তুই একলা আসবি, জামাই আসবে না, এ আবার কেমন কথা?” নির্বিকার জয়া পা দোলাতে দোলাতে মাকে বলল-“ পাখাটা একটু চালিয়ে দাও না মা, দেখছ না ঘামছি”।
“ সে না হয় দিচ্ছি, কিন্তু জামাই এলো না কেন? ঝগড়া করেছিস?” জয়া জানত এ সমস্ত প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে হতে হবে। সে ঠিক করেই এসেছিল নিজেকে চুপচাপ রেখে যথাসম্ভব প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাবে। সেটা যে সবসময় সম্ভব নয়, সেটাও জানত। তাই ছোটখাট উত্তর দিতেই হচ্ছিল। যে কোন কারণেই হোক সঙ্গত উত্তর দিতে তার ভাল লাগছিল না। এবারেও খুব সংক্ষেপে বলল-“ না”।
“ তাহলে নীলাঞ্জন কি কোন কাজে আটকে গেছে”। এবারও সে মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মেঝেতে রাখা সুটকেশ’টা বিছানায় তুলে সেটা থেকে নাইটি তোয়ালে বার করে পাশের টেবিলের ওপর রেখে মায়ের উপস্থিতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কোন দরকারী জিনিষ খোঁজার বাহানায় সুটকেশ হাতড়াতে লাগল একমনে। এবার প্রতিমা একটু ঝাঁঝিয়েই উঠলেন- “ কথার জবাব দিচ্ছিস না যে, কি হয়েছে কি তোর ? আমি যে এতক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসা করছি কোন ভ্রুক্ষেপই করছিস না”। শেষপর্যন্ত খুব শান্তভাবে মায়ের কৌতুহল মেটাতে চাইল জয়া- “ আমি ওখান থেকে চলে এসেছি মা”।
“সে তো দেখতেই পাচ্ছি, নীলাঞ্জন এলো কেন, আর তোকেই বা তারা একা ছেড়ে দিল কি’করে?”
“ওরা ছেড়ে দেয়নি , আমি নিজেই চলে এসেছি ওখানে আর ফিরে যাবো না বলে”।
“ ফিরে যাবি না মানে, এ আবার কি কথা, কি হয়েছে কি ওখানে?”
“ তুমি এখন এখান থেকে যাও মা, আমি এখন চেঞ্জ করব। সেই কখন বেরিয়েছি বলো, এখনো আমার মুখ ধোয়া হয়নি, তাছাড়া আমার খুব খিদে পেয়েছে মা”।
প্রতিমা পাথরের মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। বুঝতে পারছেন ওখানে এমন কোন ঘটনা ঘটেছে জয়ার চলে না এসে কোন উপায় ছিল না, এতক্ষণ যেটা কৌতুহল ছিল সেটা উদ্বেগে পরিণত হয়ে কান্না হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, যথাসম্ভব সেটা নিয়ন্ত্রণ করে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন-“ কি হয়েছে সেটা তো বলবি”।
এবার সত্যিই জয়ার ধৈর্য চ্যূতি ঘটল, রুখে উঠল মায়ের ওপর-“ কেন জানো না তুমি, যখন লুকিয়ে বিয়ে দিয়েছিলে, কেন সব কথা বলনি তাদের কাছে”।
“ আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না জয়ি, কোন কথা?”
“ন্যাকা সেজো না মা। কি বলতে চাইছি তুমি খুব ভালই বুঝতে পারছ”। মেয়ের অপ্রত্যাশিত অভিযোগে প্রতিমা নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে রইলেন শূণ্যদৃষ্টিতে, তারপর প্রায় স্বগতোক্তি মতন বিড়বিড় করে বললেন “ “লুকিয়ে বিয়ে দিয়েছিলাম, এসব কথা বলেছে ওরা”।
“হ্যাঁ হ্যাঁ বলেছে । কেন তুমি জানতে না তোমার মেয়ে ছোট থেকে কোন সমস্যা ভুগছে”। এবার যেন প্রতিমার মনের অন্ধকার আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে, বুঝতে আর অসুবিধে নেই কেন মেয়ের মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল, কেন’ই বা নীলাঞ্জন কথা কথা বলতে চায়নি।
আলমারী খুলে নানান কাপড়জামা খাটের ওপর স্তূপীকৃত করতে লাগল জয়া, ঘাড় ঘুরিয়ে মা’কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যথার্থই বিরক্ত হল- “ দাঁড়িয়ে থেকে কি করবে মা , বললাম না খুব খিদে পেয়েছে, কাল থেকে আমার খাওয়া হয়নি”। জয়া জানে মা যতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে কৌতুহল মেটানোর জন্যে একের পর এক প্রশ্ন করে যাবেন, আর সেটাই জয়ার এই মুহুর্তে সবচেয়ে বিড়ম্বনার কারণ। প্রতিমা চলে যেতে গিয়ে মেয়ে বিরক্ত হবে জেনেও জিজ্ঞাসা করলেন-“ কথাগুলো কি তোর শাশুড়ি বলল”।
“কি হবে মা জেনে, আমার আর ভাল লাগছে না এসব কথার উত্তর দিতে”। মা চলে যেতেই জয়া তার খোলা চুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আঁচড়াতে সুরু করল। ফুলশয্যার পর থেকে কোন পরিচর্চা তো করা হয়নি, ফলে চিরুনীটা আটকে গেল চুলের জটে।অন্যমনস্ক থাকায় জোরেই চিরুনী’টা চালিয়ে ফেলেছিল। চুলের গোড়া ঝনঝন করে ওঠায় অজান্তেই “আঃ” শব্দ’টা মুখ থেকে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে একটা পুরানো কথা মনে পড়ে গেল তার।
মা যখন নিদারুণ আক্ষেপে ও প্রচন্ড রাগে চুলের একপ্রান্ত ধরে গায়ের জোরে জয়ার শরীর’টা ভিজে বিছানার ওপর থেকে উঠিয়ে আনার চেষ্টা করতেন , সঙ্গে সঙ্গে সকালের পরিচ্ছন্ন আবহাওয়া পরিবর্তিত হয়ে যেত এক বিপরীত বাতাবরণে। চুলের গোড়ায় তীব্র যন্ত্রণায় জয়া কেঁদে উঠত, সেদিকে লক্ষ্য না করে মা চীৎকার করতেন “ ওঠ, ওঠ মুখপুড়ী, লজ্জা করে না এতখানি বয়স হল বিছানা ভিজিয়ে শুয়ে আছিস, তোষক’টা নিয়ে গিয়ে রোদে ফেল আগে তারপর অন্য কথা”।
দাওয়ায় বসে থাকা ঠাকুমা বাতলে দিতেন তাঁদের সময়কার অব্যর্থ টোটকা – “ ওসব করার আগে তোষকের ওপর নুন ছড়িয়ে সাতবার চাটাও ওকে দিয়ে , দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে, তোমরা তো শহুরে মেয়ে আমাদের কথায় বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা, সবই অপদেবতার কম্ম। ঘুমের মধ্যে তেনারাই এসব করান, আমার বড় ননদের জায়ের মেয়ের এই রোগ ছিল, বুড়ো বয়স অবধি বিছানা ভেজাত, দুদিনের টোটকায় বাপ বাপ বলে ভূত ছেড়ে পালিয়েছে”।
মাদুলি তাবিজ, জলপোড়া সব বিফলে গেছে। সহ্যের বাঁধ সেদিন ভেঙ্গে গিয়েছিল প্রতিমার। একটা কিছু হেস্তনেস্ত করার উদ্দেশ্যে শাশুড়ির কাছ থেকে পাওয়া মোক্ষম নিদান’ই মনঃপুত হয়েছিল সেদিন”।
“ওঠ, ওঠ, শিগগিরই, তোষকের ওপর নুন ছড়িয়ে দিচ্ছি সাতবার চাটবি তবে তোর রেহাই”।
“ওয়াক”- এতদিন পরেও মাত্রাতিরিক্ত লবণের স্বাদের স্মরণে আজও গা গুলিয়ে উঠেছিল জয়ার। চোখদুটো আজও জলে ভরে উঠল। কানে বাজছিল ঠাকুমার কথাগুলো- “সিংহ বাহিনীর থানের মাটি মুখে দিয়ে জল খেয়ে নে দিদিভাই, আর কোন ভাবনা থাকবে না।
ভাবনা কিন্তু থেকেই গিয়েছিল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অভিজ্ঞতা সতর্ক করত জয়াকে। তবুও সেই আতঙ্ক তাড়া করে ফিরত জয়াকে, কখনো মুহুর্তে অসাবধানতায় ভেসে আসবে নীল আলোর স্বপ্ন। ফুলশয্যার রাতে প্রথম পুরুষের নিবিড় সান্নিধ্যের তৃপ্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই তার । শেষ রাতের স্বপ্নে ছেয়ে ফেলেছিল তাকে নীল আলোয়, সারা শরীর জুড়ে মাকড়সার আটপায়ে চলতে থাকার অস্বস্তি।, তলপেটে প্রচন্ড চাপ, নীল রঙের নির্জন পরিবেশ যেন তাকে সাহায্য করত হাল্কা হতে।
ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল জয়ার, সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে, দ্বিধাগ্রস্থ জয়া শুয়ে থাকে কুকড়ে, স্বল্প পরিচিত পুরুষ,টিকে জাগাতে সাহস হয়নি। কিন্তু এতো কোন সমাধান নয়, প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি তাকে হতেই হয়েছিল, গোপন রাখার তো সম্ভব ছিল না কোনমতে।
প্রথম ঝড়’টা এসেছিল নীলাঞ্জনের কাছ থেকেই- “ ছিঃ ছিঃ! এতবড় কথাটা কখনো বলোনি আমাকে”। বিয়ের আগে টেলিফোনে বা সামান্য দেখাসাক্ষাতে কোন মেয়েই বা বলতে পারে এই গোপন সমস্যার কথা। “ মা বাবাকে কি বলব আমি, তোমার মতো তো লুকিয়ে রাখতে পারব না”।
জয়ার মুখে কোন কথা সরেনি তখন , সরার কথাও নয়। জয়াকে একলা রেখে নীলাঞ্জন বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে কিছুক্ষণ পর কাজের মেয়ে রেবা বিছানার চাদর তোষক বালিশ উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল মুখে একটা অদ্ভুত হাসির রেখা অক্ষুন্ন রেখে। ফুলশয্যার পরদিন উৎসবের আমেজ বাড়ীতে কাটেনি তখনো শুধুমাত্র ফুটন্ত রসে চিনির গাদের মত ভাসছিল এই ঘটনার রেশ।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল জয়া , হাল্কা ঠাণ্ডা বাতাস জানান দিচ্ছে দূরের নদীর অস্তিত্ব। রাস্তার ধারের তেঁতুল গাছে বাঁধা শূণ্য দোলা অল্প হাওয়ায় সামান্য দুলছে, শীতের দুপুরে কখনো দাড়িয়াবান্ধা, কখনো বুড়ি বসন্ত, কখনো কবাডি। দূরের মাঠ চোখে পড়লেও সেখানে কেউ নেই। পশ্চিম আকাশে একটা কালো মেঘ পাক খাচ্ছে। হয়ত বৃষ্টি হবে, তাতে সামগ্রিক অবস্থার কোন হেরফের হবে না জয়ার। কোথাও যেন একটা বিঁধে থাকা কাঁটার খচখচানি অনুভূত হতেই আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে , বুকের ভেতর’টা যেন আরো শুকনো মনে হল।
নীচ থেকে মায়ের গলার আওয়াজ পেতেই চমক ভাঙ্গল তার- “ জয়ি নেমে আয়, খেতে দিয়েছি। কোন সকালে বেরিয়েছিস”।
অনিচ্ছায় ভার শরীর’টাকে টানতে টানতে নীচে নেমে এল জয়া। টেবিলে খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করছিলেন প্রতিমা। চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে নজর পড়ল মায়ের মুখের দিকে। আঁচল চাপা দিয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছেন।
“কাঁদছ কেন মা?”
“তোর বাবার কথা মনে পড়ছে”। ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন জয়প্রকাশবাবু। দূরপাল্লা ট্রেনে গার্ডের কাজ করতেন, বাবাকে খুব আবছাই মনে পড়ে জয়ার।
“আজকে হঠাৎ বাবার কথা কেন মা?”
“ সে তুই বুঝবি না, ওভাবে তোর বাবার চলে যাওয়ায় তখন আমাকে শক্ত থাকতে হতেছিল তোর মুখ চেয়ে, আজ মনে হচ্ছে সে বাঁচে থাকলে আমার মত বড় ঘাটে নৌকো বাঁধতে সে যেতে না। বড় সাধারণ মানুষ ছিল সে । সত্যি তো ওদের সঙ্গে আমাদের কোনদিক দিয়েই মেলে না”।
জয়ার শ্বশুর অবসর প্রাপ্ত জেলা জজ। স্বামী হাইকোর্টের ল’ইয়ার। একমাত্র ননদের বিয়ে হয়েছে কলকাতার এক নামী চিকিৎসকের সঙ্গে।
হঠাৎই খুব জোরে বিষম খেলো জয়া। সঙ্গে সঙ্গে কাশতে শুরু করল।
“ষাট ষাট, জল খা, গলা শুকিয়ে আছে”। মাথায় ফুঁ দিতে দিতে জলের বোতল এগিয়ে দিলেন প্রতিমা। গতকাল এই শুকনো বিষম’টা না খেলে তার সম্বন্ধে কার কি মনোভাব সেটা এত ভালো করে জানতে পারত না জয়া।
বউভাতের পরদিন বিকালে দুটো গাড়ি বোঝাই করে কমবয়সী ছেলে মেয়েরা হৈ চৈ করতে করতে কোথাও বেরিয়ে গিয়েছিল, তাদের আনন্দোচ্ছ্বাসের আওয়াজ ওপরের ঘরে এসে পৌঁছালেও জয়া লজ্জায় ঘর থেকে বেরয়’নি, সারাদিন কেউ উঁকি দিয়ে দেখেও যায়নি কি করছে। কাজের লোকের হাত দিয়ে সকালের জলখাবার, দুপুরের ভাত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে খাবার যেমনকার তেমনি পড়ে আছে। জয়ার ইচ্ছে হয়নি এক কণা তুলে মুখে দিতে। গাড়ি দুটো বেরিয়ে যাবার পর সব চুপচাপ নিঃশব্দ। একা ঘরে বসে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার । কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল, সন্ধ্যেবেলা দোতলার অধিকাংশ ঘরে আলো জ্বলেনি। গোটা বারান্দাটা অন্ধকার। একসময় জয়ার মনে হচ্ছিল, বাড়ি ছেড়ে সকলে কি কোথাও চলে গেল, গোটা বাড়িতে কি সে একা। সেটা জানার জন্যে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছিল আস্তে আস্তে। তখনই ভুল ভাঙ্গল, সিঁড়ির ডানদিকে বিরাট ড্রয়িং রুমে মিটিং বসেছে তাকে ঘিরে। কয়েক’টা সিঁড়ি বাকী থাকতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, আর নামতে সাহস করেনি। সেখানে কারা আছে সেটা দেখতে না পাওয়া গেলেও গলা শুনে বুঝতে পারছিল কয়েকজনকে।
“ দাদা তুমি কি জানতে না , বিয়ের আগে যাবতীয় কথা বার্তা তো তোমার মাধ্যমেই হয়েছিল”। গলাটা জয়ার শাশুড়ির, কথাগুলো জয়ার মামাশ্বশুরের উদ্দেশ্যে। কৌতুহল বাড়তেই জয়া সিঁড়ির আরো কয়েকটা ধাপ নেমে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল,। পাখার বাতাসে দরজার পর্দা সামান্যই উড়ছিল, তার ফাঁক দিয়ে ঘরের অনেকখানিই দেখা যাচ্ছিল।
“ সেইজন্যেই তো নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে সুষমা। জয়শ্রী’র বাবা সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয়, ওকে তো আমি ছোট থেকে দেখছি, ভদ্রলোক ট্রেনের গার্ড ছিলেন, এ্যাসিডেন্টে মারা যান, খুবই দুঃখজনক ঘটনা। তারপর যাওয়া আসা কমে গিয়েছিল, মাঝে মাঝে ফোনে কুশল বিনিময় হত। অনেকবছর পর ওকে আর ওর মাকে ইনভার্সিটির সামনে দেখি, এম এ’তে ভর্তি হতে এসেছিল, রাস্তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেক কথা হল, তখনই মনে হয়েছিল নীলর সঙ্গে সম্বন্ধ করলে কেমন হয়, যতই হোক আমাদের পালটি ঘর তো”।
“ তার মানে কথাটা তোমার কাছে গোপনই করে গিয়েছিল ওর মা”। শাশুড়ীর কথা’টা আদিত্যনারায়ণ ঠিক মেনে নিতে পারলেন না।
“এটা তুমি কি বলছ? বয়স্ক মেয়ে রাতের বেলায় বিছানা ভেজায় কিনা এ নিয়ে কোন মেট্রিমোনিয়াল নিগোশিয়েশনে আলোচনা হয়। দাদাকে দোষ দিচ্ছ কেন?”
“দোষ তো দিই’নি, কথা যে ওরা গোপন করেছে সেই কথাই বলছি। সেইজন্যেই আমাদের পক্ষে এই বিয়েটা মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না”।
“হ্যাঁ জামাইবাবু, দিদি ঠিক কথাই বলেছে, একটা অসুস্থ মেয়েকে নীল কেন’ই সারা জীবন বয়ে বেড়াবে”। মাসিশাশুড়ির সঙ্গে সেভাবে পরিচিত না হলেও জয়ার বুঝতে অসুবিধে হয়নি গলাটা তার মাসিশাশুড়ির।
কথাটা আদিত্যনারায়নের পছন্দ হয়নি- “ না না নীলিমা এখনই এই সিদ্ধান্ত নেবার সময় আসেনি, অভীকের সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভাল হত, ও তো আবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল, যতই হোক ডাক্তার তো। যতদূর জানি ঠিকমত চিকিৎসা করলে এসব রোগ সেরে যায়”।
“বাঃ! বেশ কথা বলছ তো তুমি, অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসা এখন আমরাই করাবো? নীলই বা রাজি হবে কেন”।
“নীল তো এখানে রয়েছে, তার সঙ্গে কথা বলে দেখ”। জয়া বুঝতে পারেনি নীলাঞ্জন ওখানে আছে। তখনই খিল খিল করে কে যেন হেসে উঠল- “ দাদাভাই , তুই এক কাজ কর এক প্যাকেট ডায়াপারারের অর্ডার দে , তার আগে বৌদি’মণির মাপ’টা নিতে ভুলিস না”। ছোট ননদের কথা শুনে একটা হাসির হাল্কা রেশ বয়ে গেল ঘরের মধ্যে।
ঠিক সেইসময়েই শুকনো বিষম খেয়েছিল জয়া। মুখের লালা শুকনো শ্বাসনালীতে চলে যাওয়ায় এই বিপত্তি। তীব্র কাশির আক্ষেপ ঘরের মধ্যে বসে থাকা সকল’কে জানিয়ে দিয়েছিল জয়ার গোপন উপস্থিতি। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ফিরে যাবার আগেই কয়েকজন মহিলা রে রে করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। সবার আগে ছিলেন নীলাঞ্জনের মা। জয়াকে ওই জায়গায় দেখতে পেয়েই সকাল থেকে জমে থাকা ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন সাথে সাথে।
“ওঃ! তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের কথা শুনছিলে, এই লেখাপড়া শেখার নমূনা।লজ্জা করে না তোমার”।
অচেনা এক মহিলা যেন আরো সোচ্চার- “ ছিঃ! ছিঃ! ছি! আড়িপাতার শিক্ষা পেয়ে বড় হয়েছ। অন্য কিছু আশাই বা করব কি করে। এতবড় ঘটনা যারা লুকিয়ে বিয়ে দিতে পারে তাদের কাছে এটা খুবই স্বাভাবিক”।উপর্যুপরি আক্রমনে মুখে তার কথা সরেনি। কোন কিছু উত্তর দেবার মত প্রস্তুতি ছিল না জয়ার। নিশ্চল মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিল। সম্বিৎ ফিরল শাশুড়ি মায়ের কথায়- “ কোন মুখে দাঁড়িয়ে আছো, বলার মত কোন কথা আছে কি তোমার?”
সত্যিই নেই, চেপে রাখা কান্না আর কোন মতে বাধা মানতে চায়নি। অপমানে জর্জরিত হয়ে তাড়া খাওয়া মুরগীর মত দ্রুত পায়ে ওপরে উঠতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছিল আর একটু হলে। যে করেই হোক নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এসেছিল বুকের মধ্যে হাপরের ধড়ফড়ানি নিয়ে। তার এই অসংবৃত অবস্থা চাক্ষুষ করার পরও নীচের কোলাহল থেমে যায়নি। নিজের ঘর থেকে সেগুলো ভালভাবে শোনা না গেলেও জয়ার কাছে তার অর্থ একদম পরিষ্কার। মেঝেতে একটা কার্পেটে কোনক্রমে বসে অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছিল জয়া। নিজের ভাগ্য’কে ছাড়া কাকেই বা দোষ দেবে। বুকের মধ্যে একটা ফোঁপানি গলার কাছে এসে আটকে গেল হেঁচকির মত শব্দ করে। উঠে দাঁড়াল জয়া, টেবিলের ওপর জগ থেকে দু’ঢোক জল খেলো। দু’চোখ ফেটে যেন আগুন বেরুচ্ছে। হাতে জল নিয়ে চোখে মুখে ঝাপটা দিল। নীচে কোলাহল থেমে গেলেও আলোচনা তখনো চলছিল, সেটা বেশ উচ্চগ্রামে। সে নিজে অনুভব করছিল তার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসছে। যার জন্যে তার সিদ্ধান্ত নিতে দেরী হল না – এখানে সে আর থাকবে না এই অপমান সহ্য করে।
নীচের আলোচনার শব্দ যাতে না আসে দরজা’টা ভেজিয়ে দিল। খুব দ্রুতই নিজের সুটকেশ ব্যগ গুছিয়ে নিয়েছিল। বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে কার্পেটের ওপর শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরেই দরজায় টোকা, তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। কাজের মেয়েটা রাতের খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দোরগোড়ায়। পত্রপাঠ তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল অদ্ভুত একটা দৃঢ়তার সঙ্গে। মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল নীলাঞ্জন এলে কি বলবে। কিন্তু নীলাঞ্জন আসেনি। পরে মনে হয়েছিল এটাই তো স্বাভাবিক ওদের পক্ষে। হোয়াটস্ এ্যাপে নীলাঞ্জন’কে জানিয়ে দিয়েছিল এতক্ষণ ধরে ভেবে রাখা কথাগুলো। সে রাতে আর ঘুম আসেনি জয়ার। ভোরের অপেক্ষা বাদবাকী রাতটুকু বসে বসেই কাটিয়ে দিয়েছিল।
মনের মধ্যে একটা সংশয় ছিল, কাকভোরে সদর দরজা খোলা পাবে কিনা। সুটকেশ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার পর আর তা থাকল না। বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা ঘুম থেকে না উঠলেও খোলা দরজা দিয়ে বার হওয়া মাত্রই চোখে পড়ল ছড়ি হাতে শ্বশুরমশাই বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হয়ত বাগানের বিভিন্ন গাছ গাছালির নিত্য পরিবর্তন, ও সঠিক পরিচর্চার লক্ষণগুলি নিজের চোখে দেখার উদ্দেশ্য যুক্ত হয়েছে রুটিন প্রাতঃভ্রমণের সঙ্গে। বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল জয়ার।গতরাত থেকে যে মানসিক দৃঢ়তা তৈরী করেছিল, আচমকাই তা যেন আঘাত খেলো। তাসত্ত্বেও তাঁকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা না করে শ্বশুর মশাই’এর মুখোমুখি হতে চেয়েছিল অত্যন্ত সচেতনভাবে। কারণ হিসাবে তার মনে হয়েছিল এটারও প্রয়োজন আছে। সরাসরি একটা প্রণামের মাধ্যমে জানাতে চেয়েছিল তার সিদ্ধান্তের কথা। গভীর মনোযোগের সঙ্গে বিভিন্ন গাছের ফুলগুলি দেখচ্ছিলেন। জয়াকে লক্ষ্য করেন’নি। তাই জয়ার হাত পায়ে পড়া মাত্রই চমকেই কয়েক পা পিছিয়ে গিয়েছিলেন। বিস্ময়ে জয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন কিছু সময়। তারপর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় প্রশ্ন করেছিলেন-“ কি ব্যাপার তুমি? কোথাও যাচ্ছ এত সকালে? আদিত্যনারায়ণের ব্যক্তিত্বের সামনে স্থির করে রাখা কথাটা বলতে গিয়ে কিছুটা সময় নিয়ে ফেলল। চোখের দৃষ্টি মাটির দিকে নামিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিয়েছিল-“ আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি বাবা”।
“সেকি! নীল আই মিন নীলাঞ্জন জানে”?
“কাল থেকে ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি, তবে হোয়াটস্ এ্যাপের মাধ্যমে আমি সব কিছু জানিয়েছি”।
“দাঁড়াও ওকে ডাকছি আমি”।
“ না আর কাউকে ডাকবেন না”। জয়ার কথাটা শোনার পর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলেছিলেন –“ ওঃ! ঠিক আছে , ড্রাইভারকে বলছি তোমাকে স্টেশনে ছেড়ে দেবে”।
“ব্যস্ত হবেন না বাবা, আমি যা হোক কিছু একটা পেয়ে যাব। ভোরবেলা রাস্তা ফাঁকা, সামান্য লাগেজ নিয়ে বাসে উঠতেও আমার অসুবিধে হলে ট্যাক্সি বা ক্যাব ভাড়া করে নেব। এরপর জয়া আর অপেক্ষা করতে চায়নি। নিজে বুঝতে পারছিল বেশীক্ষণ তার এই দৃঢ় অবস্থান বজায় রাখতে পারবে না। একবার ভেঙ্গে পড়লে স্থির করে রাখা পরিকল্পনা যে শুধু ভেস্তেই যাবে তা নয়, অপমানের বোঝা আরো ভারী হয়ে উঠবে তখন।
ধীর পায়ে শ্বশুর মশাই’এর সামনে থেকে সরে গিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। আদিত্যনারায়ণ আর বাধা দেন’নি। তবে জয়ার মনে হয়েছিল কোন কিছু একটা বলতে গিয়ে বলতে পারলেন না তিনি। একদিকে জয়ার পক্ষে সেটা ভালই হয়েছিল। কতক্ষণ নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারত সে বিষয়ে নিজেরই সন্দেহ ছিল।
(২)
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর বালিশে মাথা ঠেকাতেই যাবতীয় ক্লান্তি যা এতক্ষণ জয়া শুধুমাত্র তার মনের জোরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল আর সেটা সম্ভব হল না । আপনা আপনি দু’ চোখের পাতা জুড়ে এল। দু’দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে নিজেকে যতই চিন্তা মুক্ত রাখতে চেষ্টা করুক না কেন সিনেমার ছবির মত বন্ধ চোখের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছিল, সকাল বেলা ঘটনা জানার পর নীলাঞ্জনের ঘৃণাভরে জয়ার মুখের দিকে চেয়ে থাকা, শাশুড়ীর বিকৃত মুখে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসা, ননদের উচ্চকিত হাসির সঙ্গে তীব্র ব্যঙ্গ, সম্মিলিত মহিলাদের একযোগে আক্রমণ। এর’ই মধ্যে কোথায় যেন মিল খাচ্ছিল না আদিত্যনারায়ণের অসহায় মুখে কিছু বলতে গিয়ে বলতে না পারা, তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাবার সময় হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবার অনুষঙ্গ ফিরে এল তন্দ্রাবেশ মুহুর্তে। তখনই জয়ার সারা শরীর চমকে উঠল, চোখ খুলে তাকাতেই দেখতে পায় দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডার পাখার হাওয়ায় অল্প দুলছে, বোধিবৃক্ষের তলায় ধ্যানমগ্ন বুদ্ধদেব, অদূরে পরমান্নের পাত্র হাতে শুভ্র বসনে সুজাতা। পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে জয়া। কখন যে চোখ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে জানতে পারেনি।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে নিজেও জানে না । স্বপ্নের মধ্যে অনুভব করল সেই নীল আলো তাকে ঢেকে ফেলছে। আট পায়ের মাকড়সা যেন সারা শরীর জুড়ে চলতে শুরু করেছে, দূর থেকে ভেসে আসছে ক্ষীণ শব্দে ট্রেনের হুইসিল। নির্জন অরণ্যে জয়া একা,পরণে সাদা শাড়ী, তলপেটে প্রচন্ড চাপ, নিজেকে হাল্কা করার মুহুর্তে চোখে পড়ে বিশাল গাছের তলায় ধ্যানমগ্ন কে একজন। এ তো আদিত্যনারায়ণ।
যেন এক আকস্মিক ধাক্কায় ঘুম ভেঙ্গে যায় জয়ার। নাকে ভেসে এলো ধূপের হাল্কা গন্ধ, ডিমলাইট’টা জ্বলছে।বাইরে সন্ধ্যের আবছা অন্ধকার, মা ঠাকুরের ছবিতে ধূপ দেখাচ্ছেন।
“উঠে পড় জয়ি সন্ধ্যে হয়ে গেছে”। তাড়াতাড়ি নিজের পরনের পোষাকে বিছানার চাদরে সঙ্গোপনে হাত বুলিয়ে বুঝতে চাইছে কোন অঘটন ঘটেছে কিনা। না আশংকা তার অমূলক। নিশ্চিন্ত বোধ হওয়ায় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে । ধূপের গন্ধের রেশ তখনো রয়েছে । হাত তুলে প্রণাম করে ক্যালেন্ডারের ছবির উদ্দেশ্যে। আর দেরী করে না তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে টয়লেটের দিকে পা বাড়ায়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই টয়লেটের বন্ধ দরজায় দুম দুম ধাক্কা, মায়ের গলার স্বরের অপরিসীম ব্যগ্রতা- “ জয়ি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আয় তোর শ্বশুর ফোন করেছেন, ধরতে বলেছি , শিগ্গিরি আয়”। জয়া কিন্তু অনেকটা সময় নেয়, ইচ্ছে করেই । দরজা খুলে বেরিয়ে আসে, প্রতিমা মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তোয়ালে মুখ মুছতে মুছতে ঘরের দিকে এগোতে থাকে, কোন ব্যস্ততা যেন তার নেই। পিছনে প্রতিমা অতিমাত্রায় শশব্যস্ত। একরকম জোর করেই জয়ার হাতে ফোন’টা ধরিয়ে দেন। স্ক্রিনের দিকে জয়া তাকিয়ে থাকে,সেকেন্ডের নম্বর পরিবর্তন নির্দেশ করছে পার হয়ে যাওয়া সময়। জয়া তখনো তাকিয়ে আছে যেন এক দীর্ঘ প্রতীক্ষায়। সময় চলে যাচ্ছে । আস্তে আস্তে কানে চেপে ধরে ফোন’টা, চোখের সামনে হাওয়ায় দুলতে থাকা ক্যালেন্ডারে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের ছবি, অনুচ্চ স্বরে প্রথমবার সন্ধোধন করে “বাবা”! চোখ বন্ধ হয়ে আসে জয়ার।