বন্দীপুরের জঙ্গলে

তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, পড়া বইগুলির মধ্যে দুটির কথা খুব মনে পড়ে। আমাদের সময় বই-ই তো ছিল একমাত্র বিনোদন, তখন যা পেতাম গোগ্রাসে পড়ে ফেলতাম। সব যে ভাল লাগত তা নয়, তবে যে দুটি বই এর কথা বলছি সেদুটির লেখকের নাম মনে নেই, একটি ছিল আফ্রিকার জঙ্গলে, অন্যটি সুন্দরবনে আর্জান সর্দার। এই বই দুটি পড়ার পর থেকেই আমার বন জঙ্গল সম্বন্ধে কৌতুহল। কিন্তু সেই সময় বন জঙ্গলে বেড়াতে যেতে কাউকে শুনতাম না বা যাবার পরিকল্পনা করত না, পরর্বতীকালে আমার যে জঙ্গল প্রীতি দেখা দিল সেটি তিনটি মানুষের সৌজন্যে। প্রথম জন বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, দ্বিতীয় জন জিম করবেট, তৃতীয় জনের লেখা অবশ্য বেশ বড় হয়েই পড়ে ছিলাম, তিনি হলেন বুদ্ধদেব গুহ। তবে জঙ্গলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় হয়েছিল অনেক পরে, কর্মসুত্রে কুচবিহারে বদলী হবার পর। সময় সুযোগ পেলেই হয় গোরুমারা, নয় চাপড়ামারি, কিংবা জলদাপাড়া ঘুরতে চলে যেতাম। আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে ওখানে যেত, সেবার গোরুমারা বেড়াতে নিয়ে যাবার কথায় একটু অসন্তোষ প্রকাশ করল। তার মত হল জঙ্গলে দেখার কি আছে , তাছাড়া জন্তু জানোয়ারের থেকে বিপদ আপদের সম্ভবনা। ওর ধারনা ছিল না জঙ্গলের আবহাওয়া সময়ের সাথে সাথে পালটে যায়। তাছাড়া ঝিঁঝিঁ’পোকার মত কোন এক অজানা পতঙ্গের এক টানা ডাক জঙ্গলের চরিত্রকে আরো রহস্যময় করে তোলে। ছয় সাত ঘন্টা জঙ্গলে কাটিয়ে আসার পর সে এখন একান্ত ভাবে জঙ্গল প্রেমী।

অনেকের ধারনা বন জঙ্গল মানেই বন্য জন্তুর সমাহার, নিরাপদ দুরত্বে থেকে ক্যামেরায় বন্দী করে, ফলাও প্রচার করাই বোধহয় জঙ্গল ঘুরতে যাবার যাবতীয় সার্থকতা। কিন্তু নীরব গাছপালা যে কখন বাঙময় ওঠে সেটা বোঝা খুব জরুরী। সেখানে কোন হৈ-হট্টগোল নয়, এমন কি নীচু গলায় বাক্যালাপও নয়, তারা দাবী করে অখন্ড নীরবতা, তবেই অনুভব করা যায় তার অন্তর্নিহিত রহস্য। সেই অনুভূতি বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ব্যক্ত করেছেন তাঁর ভাষায়, “সেটা হইতেছে একটা রহস্যময় অসীমতার দুরধিগম্যতার বিরাটত্বের ভয়াল গা ছম্‌ ছম্‌ করানোর দিকটা”।

যাইহোক, এবার আর ধারে কাছে নয়; লক্ষ্য অনেক দূর , কর্ণাটকের বন্দীপুর ন্যাশান্যাল পার্ক। মহীশূর থেকে উটি যাবার পথে ৮৭৪ বর্গ কিলো মিটার জুড়ে বিশাল জঙ্গল, এরই বিস্তীর্ণ অংশ যা তামিলনাডুর মধ্যে, সেটি মধুমালাই ন্যাশান্যাল পার্ক। একটি নাম বললেই এখন সকলেই নড়ে চড়ে বসবেন, একসময় এই দুটি জঙ্গলের অলিখিত অধিপতি ছিলেন, চন্দন দস্যু বীরাপ্পান। চন্দন কাঠ ও হাতির দাঁত ছিল তার মূলতঃ লুন্ঠন সামগ্রী, যার ফলে বেশ কিছু বছর ধরে চলেছিল তার বিশাল সাম্রাজ্য। অবশেষে ৩০শে জুন মাইসোর এক্সপ্রেসে রওনা দেব হাওড়া থেকে। আমার সারা জীবনে ভন্ডুল রাম নামে এক অপদেবতা অলক্ষে কখন যে কতবার কল কাঠি নাড়িয়েছেন বুঝতে পারিনা। জানা ছিল না ৩০শে জুন আদিবাসিরা পালন করেন হুল দিবস।হুল দিবস কে সামনে রেখে অস্তিত্বের সংকট রক্ষার্থে সওয়ার হন একদিনের প্রতীকি আন্দোলনে।সকাল থেকে মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় ট্রেন অবরোধ চলতে থেকে, তার সঙ্গে অলচিকি ভাষার স্বীকৃতি। সভ্য মানুষের আগ্রাসী নীতিতে অনেক আগেই তারা হারিয়েছে অরণ্যের অধিকার, এখন ঝাড়খন্ড সরকারের ড্রাকোনিয়ান কালা কানুনের উদ্যোগ নেওয়া তাতে হয়ত নিজেদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হতে হবে ভূমি হাঙ্গর দের আগ্রাসনে। যাই হোক তাদের আন্দোলন নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষের কি কোন যাত্রী পরিষেবার কোন দায় নেই?

বিকাল চারটে দশে ২৩ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে মাইসোর এক্সপ্রেস ছাড়ার কথা, তিনটে নাগাদ হাওড়া স্টেশন পৌঁছে খবর পেলাম ট্রেন অবরোধের কারণে অনেক গুলি ট্রেন বাতিল হয়েছে, আমাদের কপালে কি আছে জানি না। ভরসা এনকোয়ারী, হায়রে! সেখানের অবস্থা হুসেন শাহের রাজত্বকালের আগের বাংলার মত। সেই অরাজকতার কথা জানা ছিল না। এনকোয়ারীর অবস্থা দেখে কিছুটা অনুমান করা গেল। মাত্র দুটি লোক কাউন্টারে বসে আছেন। কারো কারো কথার জবাব দিচ্ছেন নয়তো মৌনী অবতার। অনেক কষ্টে আমাদের ট্রেনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করাতে কি ভাগ্য আমাদের সদয় হয়ে জবাব দিলে ২৩ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে চারটে দশ মিনিটে ছাড়বে। উৎসাহের আতিশয্যে তড়িঘড়ি মাল পত্র নিয়ে হাজির হলাম তেইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। কিন্তু হায় আমার আগে বহু যাত্রীই এই খবর পেয়ে গেছেন, ফলে বসার মত কোন জায়গা নেই। মনে মনে করলাম সাড়ে তিনটে বাজছে মিনিট দশ পনেরো মধ্যে নিশ্চয় ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে যাবে। কিন্তু কোথায় কি। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলল, অধৈর্য্য হয়ে উদ্দেশ্যবিহীন ঘোরাঘুরি। কেউ কেউ পরিবারবর্গ নিয়ে মাটিতেই বসে পড়েছেন। মাইকে অবিরাম ঘোষণা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমার কাছে মোটেই শ্রবনযোগ্য নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির ভোটে গাড়ীতে বোম চার্জ হওয়ায় বাঁ’কানটি অনেক দিন আগেই তার কার্যক্রম থেকে চিরদিনের মত ছুটি নিয়েছে। কানে একটি ছোট্ট মেশিন লাগানো থাকলেও শোনার ক্ষেত্রে খুব সুবিধা হয় না। এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি এনাউন্স হচ্ছে”। তিনিও আঙ্গুল দিয়ে নিজের কান দেখিয়ে ইসারায় বোঝাতে চাইলেন উনি কিছু শুনতে পারছেন না। আবার জিজ্ঞাসা করি, “যাবেন কোথায়?” এবার উত্তর দিলেন “কাটপাত্তি”। আলাপ জমাতে হলেও আরো খানিকটা কথা বলতেই হয়, “ভেলোরে? ওখানকার হাসপাতালে?’ ভদ্রলোক ঘাড় নাড়লেন। ওপর পড়া হয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “কানের জন্যে যাচ্ছেন?” যেহেতু আমি নিজে কানে কম শুনি না তাই মনে হয়েছিল, “ইউ আর অন দ্য সেম বোট ব্রাদারস্‌” এইবার ভদ্রলোক খেঁকিয়ে উঠলেন, “দূর মশাই কানের জন্যে যাব কেন”? তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি সামাল দি, “ না মানে আমি কানে ভাল শুনি না, কি এনাউন্স হচ্ছে, ট্রেনের কোন খবর হল কিনা, তাই জানতে চাইছিলাম, তা আপনিও কানে হাত দিয়ে দেখালেন …”। “আরে বাবা কানে গেলেই কি সব কিছু শোনা যায়? এমন বিশ্রী ঘড়ঘড়ে আওয়াজ কিছু বুঝতে পারছি নাকি, আর কাউকে জিজ্ঞাসা করুন না কেউ বুঝতে পারছে কিনা”। যাক নিশ্চিন্ত হলাম, হেসে বললাম’ “তাহলে কিছুই মিস করিনি বলুন”। এবার ভদ্রলোক হাসলেন। ট্রেন ছাড়লো দুঘন্টার ওপর লেটে।

ধীরে ধীরে সেই লেট গিয়ে দাঁড়াল পাঁচ ঘন্টার ওপর, দুপুরের খাবার দেবার কথা ছিল বিজয়ওয়াড়া স্টেশনে বেলা সাড়ে এগারোটায়, বিজয়ওয়াড়া পৌঁছল বিকাল সাড়ে চারটে, সেই সময় লাঞ্চ সারলে তো ডিনারের প্রয়োজন হয় না।সঙ্গে করে নিয়ে আসা মুড়ি শসা পেঁয়াজ কাঁচা লংকা দিয়ে ক্ষুনিবৃত্তি নিবৃত্তি করে শুয়ে পড়লাম দুজনে, পরদিন সকালে মাইসোর কখন আসে সেই অপেক্ষায়। ভোর সাড়ে পাঁচটায় পৌঁছনোর কথা থাকলেও সাড়ে দশটা পার করে আউটারে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল প্রায় কুড়ি মিনিট। যাই হোক গাড়ী বলা ছিল। বর্তমানে মোবাইল ফোনের কল্যানে ড্রাইভার রবিকে খুঁজে পেতে বিলম্ব হয়নি।

মহীশূর স্টেশন থেকে বন্দীপুর রিজার্ভ ফরেস্টের দুরত্ব প্রায় পঁচাশি কিলোমিটার। ফোর লেন রাস্তা উপভোগ করতে করতে কখন পৌঁছে গেলাম টের পেলাম না। জঙ্গলের এক অপার্থিব গন্ধ নাকে আসতেই ট্রেন যাত্রার বিরক্তি এক নিমেষে হাওয়া হয়ে গেল। রির্সটটা ছিল জঙ্গলের ভেতরে, পাহাড়ের কোলে। চর্তুদিকে তারকাঁটার বেড়া। রির্সটের কর্মীদের সহায়তায় মূল অফিস থেকে বেশ কিছুটা হেঁটে রুমে ঢুকলাম। পাশাপাশি বেশ কয়েকটা ঘর অন্যান্য বোর্ডারদের জন্যে।সামনে সবুজ লন। ঘর থেকে বেরিয়ে আশপাশ দেখতে দেখতেই চোখে পড়ল লনের শেষে তারকাঁটার বেড়ার ওদিকে প্রচুর চিতল হরিণ চরে বেড়াচ্ছে। লন পেরিয়ে একেবারে বেড়ার ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। মোবাইল বার করে বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম।কয়েকটি হরিণ মুখ তুলে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে এক অদ্ভুত কৌতুহলে।

বন্যেরা বনে সুন্দর

ছবি তোলার পরই মোবাইল ফোনের দিকে চোখ যেতেই সর্বনাশ দুটো সিম কার্ডের কোনটারই সিগন্যাল নেই। মেয়ে দুটো চিন্তা করবে ফোনে নিশ্চয়ই পাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে পিছন দিকে চলে গেলাম। তারকাঁটার ওধারে সরু পায়ে চলার রাস্তা, তার গা থেকে বিশাল পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে ঘন জঙ্গল। লনে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ একটি জায়গায় দেখলাম ফোনের সিগন্যাল আসছে। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানালাম সিগন্যালের দীনতার কথা। লনের এই জায়গা থেকেই ফোন করলে তবেই পাওয়া সম্ভব। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর দুদিনের ট্রেন যাত্রার ক্লান্তি, উপরন্তু শিরঘূর্ণনের (vertigo) উপলব্ধি সুতরাং আজকের দিনটা কেটে গেল বিশ্রা্মেই।

আজ জঙ্গল সাফারী যাবার কথা, বিকালের স্লটই বেছে নিলাম, রির্সটএর লোকজনের কথা মতো।কারণ বন্য জন্তুর সাক্ষাৎ এর উপযুক্ত সময় সন্ধ্যের মুখোমুখি, যদিও আমাদের সাফারী শুরু হবার কথা বিকাল তিনটে থেকে, ছ’টা পর্যন্ত গভীর অরণ্যে মানে কোর এরিয়ায়। এখন ছটার সময় যথেষ্ট আলো থাকে। তা হোক বন্য জন্তু দেখতে পাওয়াটাই বড় কথা নয়, গভীর জঙ্গলে যে রহস্যময় পরিবেশ প্রাণ ভরে উপলব্দি করাই আসল।

সকালের দিকে আমাদের রুমের সামনের লনের সেই নিদিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে মোবাইলে বাড়ীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি, রিস্‌টেরই এক কর্মী এগিয়ে এলেন। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, এখানে তিন চারটে জায়গা আছে, যেখান থেকে মোবাইলের সিগন্যাল পাওয়া যায়। ভাল কথা, কিন্তু তাঁর পরের কথা গুলো আর ভাল মনে হল না। সাবধান করে দিলেন বিশেষতঃ রাতের বেলা যেন এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলার চেষ্টা না করি। আমাদের রুমের পিছনে বেড়ার ওপারে যে পাহাড়, তারই জঙ্গলে একটা লেপার্ড এসে আশ্রয় নিয়েছে। কয়েকজন দেখেওছে তাকে। সুতরাং রাতের বেলায় তার নেমে আসা মোটেই বিচিত্র নয়।

আমাদের পাশের রুমে একটি গুজরাটি পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তারাও আমার দেখাদেখি ওখান থেকে ফোন করত, গুজরাটি মেয়েটির সঙ্গে আমার স্ত্রীর খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল, অথচ দুজনের কেউই হিন্দীতে মোটেই সড়গড় নয়। ফিরে আসতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম “কি এত কথা বলছিলে?” হেসে উত্তর দিল “ওর স্বামীর হার্ট এ্যাটাকের সময় কিভাবে তড়িঘড়ি হাসপাতালে ভর্তি করে বাইপাস সার্জারী হয়ে ছিল সেই সব গল্প, এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ”। “সব কথা বুঝতে পারছিলে, ওরা তো হিন্দীর সঙ্গে গুজরাটী মিশিয়ে কথা বলে”। “কেন পারব না”। মেয়েদের পক্ষে সবই সম্ভব।মনে হল “ওলো সই ওলো সই আমার ইচ্ছে করে তোদের মতন মনে কথা কই”।

জঙ্গলে ঢোকার সাথে সাথে পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া কেমন যেন পালটে যায়। শরীর জুড়ে রিনরিনে ভাব। চারপাশ খোলা একটি একটি বড় ভ্যান। প্রায় বারো জন বসতে পারে, তবে আজকের অভিযানে আমাদের নিয়ে ড্রাইভার সমেত আট জন। ভ্যানের সিটগুলি গ্যালারী মত একে অপরের থেকে উঁচুতে। একেবারে পিছনে আমাদের জায়গা হয়েছে। খুব জোরে নয় একেবারেই মাঝারি গতিতে গাড়ী চলছিল। মাঝে মাঝেই দাঁড়চ্ছে কোন জায়গায়। কখনো হরিণের দঙ্গল, কখনো গাউরের পাল। ভারতে বাইসন নেই, অনেকেই গাউরকে বাইসন বলে ভুল করেন। গাউরের গায়ের রঙ কালো হলেও পা’গুলি সাদা, মনে হয় মোজা পরে আছে। কেউ কৌতুহলী দৃষ্টিতে আমাদের দিকে দেখছে , কিন্তু কোন গ্রাহ্যও করছে না। ভ্যান যে খুব দূরে দাঁড়াচ্ছে তা নয়, মনে হয় এরা এগুলি দেখতে অভ্যস্ত।

অরণ্য আমার

এই জঙ্গলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কম, তবে লেপার্ড আছে বেশ কিছু। এগুলিকেও অনেকে চিতা বলে ভুল করে। ভারতের জঙ্গলে চিতা নেই, পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী চিতার চোখের দুপাশের কালো দাগ যেন অশ্রুপাত রেখা বলে ভুল হয়। লেপার্ডের গায়ে দাগ চিতার মত নয়, রঙও অত হলুদ নয়, কিছুটা ধুসর গোছের।

গাড়ীটা দাঁড়িয়ে পড়ল,তখনই তীক্ষ্ম একটা আওয়াজ, ড্রাইভার ডান দিকের জঙ্গলের মধ্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করালেন, ময়ুরের ডাক, কেকা। গাছের একটা উঁচু ডালে বিশাল একটা ময়ুর বসে আছে।লম্বা পেখম ঝোলানো। কি অসাধারণ রূপ, ক্যামেরায় বন্দী করে ফেললাম তাড়াতাড়ি। এরপর আরো কয়েকবার কেকার ধ্বনি কানে এল। বড়ই কর্কশ।তবু জঙ্গলে মানানসই।

জঙ্গল অপরূপা

আবার গাড়ী চলতে শুরু করল, আরো গভীর জঙ্গলে আমরা ঢুকে পড়েছি, হঠাৎই ডানদিকের জঙ্গলের মধ্যে ভারী কিছু গড়িয়ে আসার আওয়াজ। সর্তক ড্রাইভার নিরাপদ দুরত্বে গাড়ী দাঁড় করিয়ে দিল। তৎক্ষণাৎই ডানদিক থেকে কালো রোড রোলারের গতিতে বিশাল গজরাজ জঙ্গল কাঁপানো বৃংহণে রাস্তা পার হয়ে বাঁদিকের জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল। সম্বিৎ ফিরতে সময় নিল কিছুটা। অনেক পরে অজানা পাখীর কলকাকলীতে মুখর হয়ে উঠল চারদিক।

গজেন্দ্র গমনে

দিনের আলো কমে আসছে, পালটে যাচ্ছে জঙ্গলের চেহারা। গাছপালার ঘনত্ব ছাড়িয়ে এসে অনেকটাই ফাঁকা জায়গা। ডানদিকে ফাঁকা জমির পর ছোটখাট একটা জলাশয়। ধীর গতির গাড়ী একেবারেই থেমে গেল সেখানে। মনে হল সমস্ত বাতাস বন্ধ, অখন্ড নীরবতা বিরাজ করছে,তারই মধ্যে ধূসর রঙের একটা খড়গোশ রাস্তা পার হয়ে ফাঁকাজমির একধারে জমে থাকা শুকনো পাতায় গা মিশিয়ে বসে রইল, নেহাতই আমরা দেখেছি না হলে বোঝার উপায় নেই কোন জীবিত প্রাণীর অবস্থান আছে জড়ো হয়ে থাকা মরা গাছের ডালপালা শুকনো পাতার মাঝখানে। ড্রাইভার জানালো প্রায়ই এই সময় বাঘ নাকি জল খেতে আসে। তার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমার স্ত্রী কিছুটা ভয়জনিত গলায় জানালো “ চিড়িয়াখানায় বাঘের খাঁচার কাছে যেরকম গন্ধ এক ঝলক অনেকটা সেরকম গন্ধ নাকে এল”। ড্রাইভার সাথে সাথে জানালো “আশপাশ মে শের জরুর হ্যায়”। দিনের আলো তখন আরো কমে এসেছে।সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, অনেক অতীত থেকে উঠে আসা একলা থাকার ভয় না বেদনা জানান দিতে লাগল সারা শরীর জুড়ে। মনে হল কোন বন্য জন্তু দেখতে তো আমি আসিনি, জঙ্গলের রঙ, রূপ,রস, গন্ধ প্রাণভরে উপভোগ করতে এসেছি। থাক না সে তার গোপন আস্তনায়। তবু কেন জানি তারই মধ্যে মনে হচ্ছিল,যদি রাজ দর্শণের সৌভাগ্য হয়, হয়ত আরো কিছুটা অপেক্ষা করা হত, কিন্তু এক বিশাল দাঁতালকে গজেন্দ্রগমনে সপরিবারে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। ড্রাইভার জানালো আর বাঘ দেখার আশা নেই। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। ফিরলাম পরিপূর্ণতা নিয়ে। রিসটের গাছপালায় তখনও সম্মিলিত পাখীর কলধ্বনি।

This Post Has One Comment

  1. প্রণব ঘোষ।

    সুব্রত বসুর ছবিসহ বন্দীপুরের জঙ্গলে পড়ে বেশ ভালো লাগলো। বাঘ না দেখা গেলেও হরিণ, ময়ূর, খরগোশ, হাতি এবং হাতির দল একে একে সুন্দর বর্ণনা করেছেন। একটা কথা বলেছেন, জঙ্গলে নীরব থাকতে হয়। আর একটা কথা ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। সত্যি জঙ্গলের যেমন সৌন্দর্য আছে, তেমনি একটা গন্ধও আছে। আমি ১৯৮১,৮২,৮৩ সালে কর্মসূত্রে আলপুরদুয়ারে থাকাকালীন অনেকবার বক্সা, জয়ন্তী, জলদাপাড়া,গরুমারা, চিলতাপাতা এবং মথুরা টি এস্টেটে গেছি। সেই সব স্মৃতি আপনার ভ্রমণ কাহিনী থেকে উঠে এল। ধন্যবাদ আপনাকে।

Leave a Reply