ভোরের আগে

চিন্তার মাধ্যম যদি হয় ভাষা,তাহলে জহরের তা ছিল না।বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া কিছু নিজস্ব তৈরী ছবি সে ব্যবহার করে চিন্তার মাধ্যম হিসাবে।এইভাবেই সাজায় তার কল্পনা, এলোমেলো ছবিগুলো ক্রমানুসারে সাজাতে অনেকটা সময় সে ব্যয় করে ফেলে,তা হোক তার থেকেই তো সে আনন্দ,দুঃখ,রাগ,জৈবিক উত্তেজনা সব কিছুই অনুভব করে।এত কিছুর কারণ সে জন্মাবধি মুখ ও বধির। তার এই প্রতিবন্ধকতার দুঃখ কখনোই সে বুঝতে পারে না।এর কারণ বোধহয় অন্যান্য ইন্দ্রিয় গুলো স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশী সংবেদনশীল। যদিও তার নাম জহর,কিন্তু ওই নামে ডাকার মতন কোন লোক এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।সকলেই হাবা বলে ডাকে।সকলেরই জন্মের পর নামকরণের একটা প্রচলিত রীতি থাকে,পরর্বতী কালে কারো কারো ক্ষেত্রে সেটা পরির্বতিত হতে হতে এক বিচিত্র রূপ নেয়।জহর তো আর সে রকম পরিবারে জন্মগ্রহন করেনি,যে প্রথম থেকেই নামের স্থায়ী চিহ্নটি বহন করবে।মায়ের অল্পবয়সে চলে যাওয়ায় ওই নামটার অব্যবহার,পাশাপাশি বয়স বাড়ার সাথে সাথে কথা বলার অক্ষমতা প্রকট হওয়ায় হাবা নামটার বহুল ব্যবহার জহর নামটাকে পরিচিতদের মন থেকেও মুঝে দিল।যেহেতু নিজের নাম দিয়ে পরিচয় জ্ঞাপন তার পক্ষে দুঃসাধ্য,তাই এই নামের স্মৃতি ওর মনে কোন রেখাপাত করেনি,বরঞ্চ হাবা ডাকের সাথে সাথে অন্যের ঠোঁটের নড়াচড়া সম্পর্কে সে এত পরিচিত হয়ে গিয়েছিল,যে তার প্রতিক্রিয়া হত তাৎক্ষণিক। জহরের বাবা হীরু ডোম থানার অধীনে অস্বাভাবিক বা অপঘাত মৃত্যুর মৃতদেহ সদর হাসপাতালে লাশকাটা ঘরে ভ্যান রিকশায় পৌঁছে দেয় ময়না তদন্তের জন্যে। সময় অসময়ে থানা থেকে ডাক পড়ত তার।ফলে ছেলের সাথে কোনো আত্মিক যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি।দিনের অধিকাংশ সময়ে চোলাই মদের সাহায্য খিদে তেষ্টা দুটোই জুড়াত।তবুও ওদেরই জাতের মাঝবয়সী বিধবা একটা মেয়ে রান্নাবান্না করে দিত।এক একদিন রাতেও থেকে যেত সে, আর সেদিনই জহরের দুর্ভোগের অন্ত নেই।যেহেতু তাদের ঘর একটা তাই ঘুমন্ত জহরকে লাথি মেরে কি শীত কি বর্ষায় ঘরের বাইরে ফেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করত হীরুডোম।বাবার এই অস্বাভাবিক আচরণের কারণ খুঁজে না পেয়ে রাগ হত সেই মাঝবয়সী বিধবাটার ওপর। ফলস্বরূপ লুকিয়ে থেকে ইট ছুড়ে মেয়েটার কপাল ফাটিয়ে কিছুটা উপশম খোঁজার চেষ্টা করেছিল। তারপর থেকেই আস্তে আস্তে তার বাড়ীতে থাকা অনিয়মিত হয়ে যায়।মাঠে ঘাটে ঘুরে ঘুরে ,পুকুরে মাছ ধরে,শামুকখোল মেরে দিন গুজরান করতে করতে কখন বলতে কখন জহরের কৈশোর অতিক্রম করে গেল বুঝতেই পারল না।সাবালক হল সেইদিন যেদিন ওর বাবা মদের বিষক্রিয়ায় মারা যাবার পর থানার নির্দেশে ভারী লাশটা ভ্যান রিকশায় উঠিয়ে সদর হাসপাতালে সেই লাশকাটা ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। এখন জহর অনেক কিছুই জেনে গেছে,হাসপাতালে ডাক্তারদের মুখ দেখে জানে কে কোন জন,যারা সবাই ওকে হাবা নামেই চেনে,মড়া রেখে ওয়াডে ওয়াডে ঘুরে বেড়ায়,রোগীদের বেডের তলায় লুকিয়ে থাকা বেড়াল বাচ্ছাগুলোর গেঁটি ধরে বাইরে এনে ফেলে।যদিও তার রোগীর থেকে রোগিনীদের প্রতি আগ্রহ বেশী।প্রায়ই উঁকিঝুঁকি মারে মেটারনিটি ওয়াডে।লালচে লালচে বাচ্ছাগুলোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।অপরিস্কার জনিত বিটকেল গন্ধ নাকে ভেসে আসে তার।ও জানে ওটা ছেলে হবার গন্ধ।তবু সদ্য হওয়া বাচ্ছাগুলোর দিকে এক অপরিসীম কৌতুহলে তাকিয়ে থাকে,যতক্ষণ না কোন সিস্টার তাড়া মারে –“এই হাবা তুই এখানে ঢুকেছি কেন”। হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে জহর আর একটা জিনিষ অর্জন করেছে।তা হল মৃতদেহ সম্পর্কে স্বাভাবিক নিস্পৃহতা।তাই কৌতুহল বা ভয় কোনটাই ওর নেই, যা আছে তা হল,মৃতের আত্নীয় স্বজনদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা পয়সা আদায়ের কূট কৌশল।যদিও এটা কেউ ওকে শিখিয়ে দেয়নি,নিজস্ব অভিজ্ঞতার সাহায্যেই পেশাদার হয়ে উঠেছিল।যেহেতু নৈতিক অনৈকতার বিভেদের ছবি ওর মনে জমা পড়েনি।তাই দায়ে পড়া মানুষগুলো যখন আপনজনের মৃতদেহ পৌঁছে দেবার জন্যে অনুনয় বিনয় করত, জহর তখন নিজস্ব গোঁয়ে অনড় থাকা স্বাভাবিক মনে করত।ফলে নিরুপায় মানুষগুলোকে সার্মথ্যের বাইরে গিয়ে গুনতে হতো চাহিদা মতো টাকাকড়ি। বাবার মৃত্যুর পর পরিপূর্ণ পুরুষ হয়ে উঠতে কথা বলতে না পারা বা কানে শুনতে না পাওয়া কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি ওর ক্ষেত্রে।বয়ঃসন্ধি কাটিয়ে ওঠা জহরের কিছু উড়নচন্ডে বন্ধুরা ওকে নিয়ে চলে আসত নদীর ধারে নিকটবর্তী শশ্মানের মাথাঢাকা চাতালের তলায়। সেখানে বিড়ির ধোঁয়ায় আর গাঁজার কটু গন্ধ থেকে জহর অর্জন করত,নতুন নতুন জ্ঞান। শুধুমাত্র নেশার মধ্যে নিজেদের আটকে না রেখে তার অনুষঙ্গ হিসাবে চটি চটি নিষিদ্ধ পুস্তিকার আমদানী করত তার সঙ্গী সাথীরা,মোমবাতির আলোয় অস্পষ্ট ছবিতে নারীদেহের স্বাভাবিক রহস্য উন্মোচিত না হলেও শরীর জোড়া শিরশিরানির মাধ্যমে যে উত্তেজনা তৈরী হত তাকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে জহর তার সঙ্গী সাথীদের কাছ থেকে একাগ্রচিত্তে গ্রহণ করেছিল আত্মমেহনের পাঠ। সেই আড্ডায় জগু ওরফে জগন্নাথ ছিল পয়লা নম্বরের মাতব্বর। বিভিন্ন অনৈতিক কাজে হাতে খড়ি দেবার গুরুমশাই।তারই কর্মকুশলতায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্জন শ্রেণী কক্ষ মাঝে মাঝেই মুখরিত হয়ে উঠত নীলছবির আলোয়।তখনই জহরের স্মরণে থাকা একটা ছবি অর্থবহ হয়ে উঠেছিল। নিতান্ত শৈশবে ফেলারামকে পান বোরজের মধ্যে দেখেছিল সুরো পাগলীর সঙ্গে।ফেলারামের তীব্র শারীরিক আন্দোলন এবং সুরো পাগলীর অস্ফুট শীৎকার যদিও এসব জহরের কানে যায়নি,তবু শিশু মনে শাস্তি দেবার অভিনব পন্থা হিসাবে স্থায়ীভাবে ছাপ ফেলে রেখেছিল এতদিন।এতে শুধু ভ্রান্ত ধারণা দূর হল তা নয়,একটা উদগ্র কামনা যার অস্তিত্ব এতদিন টের পায়নি, সেটা যেন ঘুম ভেঙ্গে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল সহসা। সংস্থানের দিক দিয়ে জহর অনেক বেশী স্বচ্ছল তার সঙ্গী সাথীদের তুলনায়।যা অবশ্যই উষ্মার কারণ জগু এবং অন্যান্যদের। তাই তাকে প্রলুব্ধ করত লুডো বা তাসের মাধ্যমে জুয়া খেলার জন্যে।উদ্দেশ্য ছিল যেন তেন প্রকারেণ জহরের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করা।কিছুদিনের মধ্যে জহর সেটা বুঝতে পারল,এরা সবাই জোটবদ্ধ প্রতিপক্ষ।তার প্রতিবাদ অব্যক্ত রাগে পরিণত হয়ে গলা দিয়ে একটা গোঁত গোঁত শব্দ বার করত। তখনই জগু,বলাই রুহিদাস, জাবেদ “হাবা শুয়োর,হাবা শুয়োর” বলে দাঁত বার করে হাসত।আক্রোশে জহর থুথু ছেটাত।নিরাপদ দুরত্বে থেকে সবাই মজা লুটত।এটাকে কিছুক্ষণ চালিয়ে নিয়ে গিয়ে জহরের উত্তেজনাকে চরম সীমায় পৌঁছানোর জন্যে কেউ কেউ লুঙ্গি তুলে মুখ বিকৃত করে বলত “এইটা খা” কথা গুলো তার কাছে শ্রবনযোগ্য না হলেও বক্তব্যের নিগূঢ় অর্থ বুঝতে একটুও অসুবিধে হত না জহরের।তখনই ক্ষ্যাপা মোষের মতন গোঁ গোঁ আওয়াজ তুলে আধলা ইট নিয়ে তাড়া করত ওদের। উত্তেজনা ও রাগে সেটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হত।ওই বয়সের ছেলেদের তহবিলে যে সমস্ত খিস্তি গালাগাল থাকে,জহরের তা নেই, ফলে আক্রোশে কিছু করতে না পারার আক্ষেপে গাছের গুঁড়িতে গিয়ে মাথা কুটতো, নিজেকে রক্তাক্ত করার পর,সাময়িক ভাবে শান্ত হত তীব্র যন্ত্রণায়। (২) সেদিন অনেকটাই দেরীতেই পৌঁছেছিল জহর।ভ্যান রিকশায় বাঁধা ছিল পূর্নবয়স্ক পুরুষমানুষের মৃতদেহ। সদর হাসপাতালের লাশকাটা ঘরের দরজাটা খোলা থাকলেও লোকজন ছিল না।কেমন যেন খাঁ খাঁ করছিল।ছুটির দিন বলেই কি।জহরের অবশ্য এসব জানার কথা নয়।ভ্যান রিকশা দাঁড় করিয়ে প্রথমেই সে খোঁজ করে রঘুর,ছুরি চালানোর ডোমটার।সেও বোধহয় নিদিষ্ট সময় অপেক্ষা করে স্বেচ্ছাকৃত ছুটি নিয়ে চলে গেছে।কাউকে দেখতে না পেয়ে নিজস্ব ভাষায় হাকডাক শুরু করে দিয়েছিল, ইতিমধ্যে এসকট কনেষ্টবল এসে হাজির।ডাক্তার কে খবর দিতে তিনি গায়ে সাদা অ্যাপ্রন চড়িয়ে রবারের দস্তানা হাতে নিয়ে বিরক্তিভরা মুখে হাঁটতে হাঁটতে আসছিলেন। মৃতের লোকজন না আসায় জহরও যৎপরন্যায় ক্ষুন্ন।সনাক্তকারী সিপাইকে দেখতে পেয়ে ডাক্তারবাবু জানতে চাইলেন,-“বডির সঙ্গের লোক কই”? “আসছে স্যার, আগের বাসটা ফেল করছে”।সিপাইএর উত্তরে বিরক্তির মাত্রা আরো বেড়ে গেল,মুখ ভেংচে যাবতীয় ক্ষোভ উজাড় করে দিলেন,-“তবে আর কি। ছুটির দিনে মড়া নিয়ে বসে থাকি।একটা বিয়ে বাড়ী আছে,সকাল সকাল না বেরুলে পৌঁছতে পারব না,তা শালা , এদের জন্যে কি কিছু হবার উপায় আছে”। জহর গামছা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া খাচ্ছিল,তার নিরাসক্ত ভাব দেখে ডাক্তারবাবুর মেজাজ গেল আরো চটে,-“এই বেটা হাবা কোথাও কিছু নেই ,ছুটির দিনে বেলা দুটোর সময় একটা মড়া ঘাড়ে করে নিয়ে এলি,হাঁ করে দেখছিস কি,যা রঘুকে ডেকে আন”। রঘুর খোঁজ তো সে আগেই করেছিল,কারণ রঘুর সঙ্গে তার একটা অন্য সম্পর্ক,সিগারেট বিড়ির আদানপ্রদান,বোতলের হাত বদল ইত্যাদি। ডাক্তারের মুখনিঃসৃত কথাগুলো না শুনতে পেলেও সেগুলো যে মধুর বচন নয়, সেটা ডাক্তারের ভাবভঙ্গী দেখেই মালুম হয়েছিল।রঘুর না থাকার খবরটা তার নিজস্ব কিছু শব্দের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছিল। “এই হাবা কে নিয়ে হয়েছে এক জ্বালা”।এর পর সিপাইকে নির্দেশ দিয়েছিলেন রঘুর খোঁজ করতে।সিপাই যেতে গেলে তার পথ আটকে বিভিন্ন ভাবভঙ্গী বিকৃত কিছু শব্দের সাহায্যে বলতে চাইলছিল রঘুর অনুপস্থিতির কথা।ইতিমধ্যে মৃতের লোকজন এসে পড়ায় জহরের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল,কনেষ্টবলকে ছেড়ে তাদের নিয়েই সে তখন ব্যস্ত । বিরক্ত ডাক্তার বাবু একচোট নিলেন মৃতের লোকজনের ওপর।আনুষাঙ্গিক কাজ তাদেরও কিছু আছে।কনেষ্টবল রঘুর না থাকার খবর নিয়ে আসার পরেই ডাক্তারবাবু বললেন,-“হাবা তাহলে সেই কথাই বলছিল”।বিরক্তি যেন ডাক্তার বাবুকে ছাড়তে চাইছে না। “এই হাবা দাঁড়া , কোথাও যাবি না,দেখ আজ তোর কি করি,যেমন আমায় ফাঁসিয়েছিস, তোকেও ফাঁসাব।তুই আজ মড়া কাটবি”। নির্দেশ মত জহর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।হাতছানি দিয়ে জহরকে কাছে ডাকলেন ডাক্তারবাবু।ইঙ্গিত ইসারা জহর ভালোই বোঝে। পাঁজকোলা করে বডিটা এনে লাশকটা ঘরের লম্বা টেবিলের ওপর শুইয়ে দিল।সুইচবোর্ড দেখিয়ে বড় আলোটা জ্বালিয়ে দিতে বললেন তাকে।এবার হাতে ছুরি ধরিয়ে দিয়ে বললেন-“নে ওটার জামাকাপড় খুলে দে” অর্থ না বুঝে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে জহর। “আরে হতভাগা ওটা কে ন্যাংটো কর। এটাও জহরের কাছে সমান অবোধ্য।নিরুপায় ডাক্তার অ্যাপ্রন সরিয়ে নিজের প্যান্টের বোতাম খোলার ভঙ্গি তে বোঝাতে চাইলেন জহরকে আসলে কি করতে হবে। এতক্ষণে জহরের মনের ভিতরে থাকা কোন এক অভিজ্ঞতার ছবির মাধ্যমে বোধগম্য হল।ছুরি দিয়ে মড়া কাটার সময় মেয়ে পুরুষ যেই হোক না কেন তাকে তো ন্যাংটোই করতে হয়।আর বলে দিতে হয় না তাকে।শোয়ানো মড়াটার জামার,প্যান্টের বোতাম খুলে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে,অধৈর্য ডাক্তার বাবু চেঁচিয়ে ওঠেন-“ওরে থাম থাম,ওভাবে হবে না ছুরিটা দিয়ে কেটে ফেল”।পরক্ষণেই বুঝতে পারলেন শুধু কথা নয় ভঙ্গিমাটা দরকার।এর পর জহর দ্রুত হাতে কাজটা শেষ করে ফেলেছিল। উজ্জ্বল আলোয় লাশটা যেন অন্য কথা বলছিল, গোটা শরীর জুড়ে রোমের আধিক্য,নিষ্প্রাণ দেহে রসহীন শুষ্কতা,ঘন কালো কেশের মধ্যে ভারহীন পুরুষাঙ্গ, অর্ধনীমিলিত স্থির চোখ। মুখগহ্ববরে থমকে যাওয়া আক্ষেপ বহন করছিল মৃত্যুর নিঃস্পন্দতা।ভ্যান রিকশার পিছনে দড়ি দিয়ে বাঁধা লাশটাকে এভাবে দেখা হয়নি কখনো।এত কাছ থেকে উলঙ্গ মৃতদেহ দেখার অভিজ্ঞতা জহরকে হতভম্ব করে রেখেছিল বেশ খানিকক্ষণ। “হাঁ করে দেখছিস কি, নে এটা পরে নে”,রবারের গ্লাভসটা জহরের হাতে ধরিয়ে দিলেন ডাক্তারবাবু। “কলম দিয়ে দাগ টেনে দিচ্ছি গলা থেকে একদম নীচ পর্যন্ত,টান টান করে ছুরি চালিয়ে যা”।ঘোর কাটেনি জহরের,গ্লাভস পরে নিলে কি হবে ,ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে থাকে সে। ডাক্তার বাবু সিগারেট ধরানেল। “কি রে হাবা দাঁড়িয়ে রইলি কেন,শুরু কর, এত দিন মড়া আনছিস , দেখিসনি রঘু কি করে”। “না তোর দ্বারা কিসসু হবে না”।জহরের ছুরি ধরা হাতের ওপর চেপে ধরেন ডাক্তারবাবু।অবলীলায় মৃতদেহের গলায় ঢুকিয়ে দেন ছুরির ফলা। খানিকটা কাটার পর হাত আলগা করে বাদবাকী কাজটা জহরের ওপর ছেড়ে দেন,আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, দাগ দেওয়া লাইন-“এই বরাবর কেটে যা”।ধারালো ছুরি কাগজ কাটার মত চামড়া কাটতে কাটতে নীচের দিকে নামতে থাকে। অনভ্যস্ত হাতে যাবতীয় শক্তি সঞ্চয় করে জহর ছুরিটাকে নিয়ে যেতে চায় নিদিষ্ট লক্ষে।একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে ডাক্তারবাবু বললেন-“ থাক থাক ঢের হয়েছে ,এর থকে বেশী আর তোকে দিয়ে হবে না”।সিগারেট টা ফেলে বুট দিয়ে চেপে গ্লাভসটা পরতে পরতে এগিয়ে গিয়ে জহরের কাছ থেকে ছুরিটা নিয়ে পেশাদারী দক্ষতায় কাটা চামড়া দুপাশে সরিয়ে উন্মুক্ত করে দিলেন মৃতদেহে অভ্যন্তর ভাগ। ছাল ছাড়ানো খাসির মতন সরে যাওয়া কালো চামড়ার তলায় গোলাপি মাংসালো বুক, পাঁজর, পেট উজ্জ্বল আলোয় যেন ঝলসে উঠল।সঙ্গে সঙ্গে একটা দমকা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল ঘরময়। এ অনুভূতি জহরের ছিল না। কারণ সে লাশকাটা ঘরে ঢুকতই না কখনো।এর ফলে তার পেট থেকে একটা অব্যক্ত আওয়াজ উঠে এল, বমির ব্যর্থ প্রচেষ্টা নিয়ে। মুখ ভর্তি হয়ে গেল টক জলে।ঠোঁট থেকে ঝুলতে লাগল সুতোর মত লালা,চোখ ভর্তি জলে দৃষ্টি ঝাপসা।হড়পা বানের মতন সারা শরীর জুড়ে স্নায়বিক আলোড়ন। মাটিতে বসে পড়ে জহর,হাঁপাতে থাকে। “ না তোর দ্বারা এসব হবে না ,যা বাইরে যা”।ডাক্তারবাবুর কথা কানে না গেলেও অনুমানে বুঝতে অসুবিধে হয়নি তার নির্দেশ মাত্র এক মুহুর্ত অপেক্ষা করেনি জহর,কোনোক্রমে হাতের দস্তানা দুটো খুলে এক ছুটেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল সে। খোলা আকাশের নীচে মুক্ত হাওয়ায় স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে কিছুটা প্রকৃতিস্থ হতে চাইল সে,কিন্তু এই অভিজ্ঞতা বারে বারেই বাধা দিচ্ছিল সহজ হতে। (৩) মুক বধিরের এই এক সমস্যা, দেহের বাকী অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্বাভাবিক,শুধু কথা বলার ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিবন্ধকতা,তাই আজকের অভিজ্ঞতা যে কাউকে বাটোয়ারা করে হাল্কা হবে সে উপায় তার নেই। সে জানে একই শব্দের পৌনঃপুনিক ব্যবহার এবং একই ইসারায় সেটা সম্ভবপর নয়। চুপ করে বসে ছিল প্রাইমারী স্কুলের চত্বরে।সন্ধ্যের মুখোমুখি যথারীতি হাজির হয়েছিল জগু,বলাই, মুন্নার দল। বাক্য বিনিময় শুরু হয়েছিল এই ভাবেই। “ কিরে হাবা মাগী বাড়ি যাবি নাকি”। জহর বা জগুর দলবলের এখনো সে অভিজ্ঞতা হয়নি, এসব কথা বলার অর্থ জহরের কাছ থেকে কিছু পয়সাকড়ি হাতিয়ে নেবার ধান্দা। জহরও বুঝল না ওদের কথার অর্থ। শুধু আঁউ আঁউ করে আজকের ঘটনাটা বোঝাতে চেয়েছিল নিজের মতন করে।অপরপক্ষের কাছে তা বোধগম্য হয়নি।তাই জহরের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে জগু তার হাত ধরে টান দিয়ে বলে,- “চল হাবা ঘুরে আসি”। তীব্রভাবে মাথা নেড়ে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। একটা বিড়ি এগিয়ে দেয় বলাই,জাভেদ দেশলাই জ্বেলে সেটা ধরিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করে,-“ কিরে কি হয়েছে তোর এত মনমরা কেন? নানান আওয়াজ করে উত্তর দেবার চেষ্টা করে,সফল নাহয়ে নিজেই চোখ বুজে মড়া সাজে মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে। নিজের বুকে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়, কোথায় সে ছুরি চালিয়েছে।চামড়া উলটে দেবার পর সেই তীব্র গন্ধ, নাক চাপে বমির ভাব করে বোঝাবার চেষ্টা করে। জগু বলে ওঠে,-বুঝেছি বুঝেছি, পচা গলা মড়া ঘেটে এসেছিস, সেইজন্যে তোর মন ভাল নেই”। জগুর কথায় সায় দেয় বলাই ,-“শোন হাবা বেশী নয় একশটা টাকা ছাড়,বুলু ফিলমের ডিস নিয়ে আসি মন একেবারে বিন্দাস হয়ে যাবে। কথাগুলো জহর বুঝতে পারে না।বোঝার কথাও নয় তাই ঘাড় নাড়তে থাকে।কিন্তু একশোটা টাকা তো কম নয়।জহরের কাছ থেকে সেটা নিতে হবে যেভাবেই হোক। গররাজি জহরকে বোঝানোর ক্ষেত্রে বলাই অনেক বেশী পারর্দশী। বাঁ হাতের তর্জনী আর মধ্যমার সাহায্যে স্ত্রী অংগের প্রতীকি তৈরী করে ডান হাতের তর্জনী বাঁ হাতের দুই আঙ্গুলের ফাঁকে ঢুকিয়ে যৌন ক্রিয়া বোঝাতে চাইল। টিভির পর্দায় যেভাবে দেখা যায় কোমরের বারংবার আন্দোলনে নিজের বক্তব্য অনেকটাই প্রাঞ্জল করে তুলল জহরের কাছে।এর পর তার কাছ থেকে একশো টাকা হাতাতে অসুবিধে হয়নি। মুন্নার বাড়ীতে কেউ না থাকায় সবাই জুটল সেখানে।প্রায়শঃ এই জাতীয় ডিস্ক দেওয়া নেওয়া করার ফলে জগুদের সঙ্গে দোকানীর যে খাতির তৈরী হয়েছিল, সেইসুত্রেই অনেক কম পয়সা এইসব লেনদেন হত। জহরের দেওয়া টাকার অনেকটাই বেঁচে গিয়েছিল।তাতে চোলাই মদে গলা ভিজিয়ে নেবার কথা ভেবে আশ্বস্ত ছিল সকলে। শরীরের মধ্যে একটা আদিম উত্তেজনা নিয়ে একটু রাত করেই বাড়ী ফিরেছিল জহর।বাড়ী ফিরেই জানতে পেরেছিল থানা থেকে ডাক এসেছে।অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভ্যান রিকশা নিয়ে যেতে হয়েছিল।অনেকটাই দূর নদীর ঘাটে। দারোগাবাবুর নির্দেশে নদীর জলে উপুড় হয়ে ভাসা এক পনেরো ষোল বছরের কিশোরীর দেহ কাঁধে করে তুলে এনেছিল।মাটিতে শোয়ানোর পরও কোন ভাবান্তর হয়নি।যেইমাত্র দারোগাবাবুর টর্চের আলো মৃতদেহের ওপর পড়তেই জহরের বিস্ফোরিত চোখের মধ্যে দিয়ে মস্তিকে পৌঁছে গিয়েছিল এক তড়িৎ প্রবাহ।বিশ্বাস করতে কষ্টই হচ্ছিল জহরের এই কামনা জাগানো উলঙ্গ দেহটা কাঁধে করে তুলে এনেছে।কিছুক্ষণ আগে দেখে আসা নীল ছবির চরিত্রের সঙ্গে কি অদ্ভুত মিল। সংগৃহীত সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে নারী শরীরের বিভিন্ন উঁচু নীচু খাঁজ মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল একদৃষ্টে চেয়ে।ঘোর ভাঙ্গল দারোগাবাবুর টর্চের গুঁতোয়। “এই হাবা ভোম মেরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মড়া কখনো দেখিসনি? নে বডিটা ওঠা।বৃষ্টি আসলো বলে। চট দিয়ে মুড়ে মৃতদেহটা ভ্যান রিকশায় উঠিয়ে রওনা দিল জহর।ঝিরঝিরে বৃষ্টি ঝমঝমে পরিণত হচ্ছে ধীরে ধীরে।এসব ক্ষেত্রে তরল পানীয়র মাত্রা খানিকটা বাড়িয়ে নিতে হয়। কিন্তু জৈবিক তাড়না দেহ ছেড়ে যাচ্ছে না কিছুতেই। সেটা যেন মনে মনে উপভোগ করছে সে।থানার রকে গামছা পেতে শুয়ে ছিল ভোরের কিছুটা আগেই সদর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে বলে। কিন্তু চোখ বুজলেই কিশোরীর খোলা শরীরটা ভাসছিল।ঘুম আসছিল না কিছুতেই। থানার পেটা ঘড়িতে শব্দ কানে না গেলেও সান্ত্রী বদলের সাথে সাথে বুঝতে পারে রাতের গভীরতা। এক সময় ঝেড়ে ঝুড়ে উঠে পড়ে, ভ্যান রিকশায় শোয়ানো দেহ টা যেন টানছিল তাকে। রাতভোর বৃষ্টির রেশ কিছুটা কমের দিকে।জহরের কাছে এসব ধর্তব্যের বিষয় নয়।রিকশার হ্যান্ডেলে ঝোলানো ব্যাগের মধ্যে রাখা খানিকটা উগ্র পানীয় গলায় ঢেলে নেয়।সেটাও তার অস্তিত্ব জানান দিতে দিতে বুক থেকে পেটে নামতে থাকে।শরীরটা গরম হয়ে ওঠে জহরের।সিটে উঠে প্যাডেলে চাপ দিয়ে বৃষ্টিভেজা নির্জন পথ ধরল রাতের অন্ধকারে। ঘুমের ঘোর কেটে যাওয়ার সাথে সাথে ফিরে আসছে সেই জৈবিক তাড়না।সেটাই বোধহয় তাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করছে।রাতের অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। হঠাৎ নিজেকে হাল্কা করার প্রয়োজন অনুভব করল। পুব আকাশে ভোরের পূর্বাভাস। জহর ভ্যান রিকশাটাকে টেনে রাস্তা থেকে নামিয়ে একটা গাছ তলায় দাঁড় করিয়ে ভোরের মৃদু আলোতে দেখতে চাইল মৃতদেহটা আর একবার।সদ্য প্রস্ফুটিত বক্ষ সম্পদের ভার ছেঁড়া চটের পক্ষে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। এতক্ষণ যে তাড়না সে দমন করে আসছিল এখন সেটাই ছড়িয়ে পড়ল তার সারা শরীরে অদমনীয়ভাবে। দড়ি খুলে চটের আবরণ সরিয়ে ফেলল সে।ভোরের আলোয় আলোকিত নদীর অসমতল বালুচরের মতন হলদেটে দেহটার দিকে তাকিয়ে রইল । নিস্তেজ স্তন তখন জাগিয়ে রেখেছে উপত্যকার উচ্চতা,ঢালু উদরদেশের পেলবতা ছুঁয়ে রয়েছে উরুসন্ধির তৃণাঞ্চল। জহর স্তির থাকতে পারল না, নিজেকে উম্মুক্ত করে ফেলল।যে জান্তব কামনায় সে এতক্ষণ ছিল জেরবার স্মৃতিভান্ডারে জমা থাকা নীল ছবির জমাট অভিজ্ঞতার সাহায্য নেয় সেটাকে ফলপ্রসূ করতে।সাড়হীন দেহটাকে নিবিড় আলিঙ্গনে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চায় সে এক তীব্র আশ্লেষে।বিফল শারীরিক আন্দোলনের একরাশ হতাশা তাকে বাঁধন ছাড়া করে তোলে।মুখ ভর্তি লালায় ভেজাতে চায় মৃতার শুষ্ক ঠোঁট।সাড়াহীন ঠোঁটে আঁশটে গন্ধের মধ্যেই সন্ধান করে পরিপূর্ণ তৃপ্তির।আশপাশ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ চেতনা রহিত জহর তখন উদ্দাম পুরুষের ভূমিকায় মৃতার ওপর উপগত। জহরের দেহটা যখন চুলের মুঠি ধরে মৃতদেহের ওপর থেকে নিচে ফেলা হল,কয়েকজন লোক সম্ভবতঃ মাঠে যাচ্ছিল চাষের কাজে, তাদের দেখেও ঘোর কাটে না জহরের।উপর্য্যুপরি কয়েকটা লাথি সঙ্গে তীব্র চিৎকার ও গালাগাল তার শোনার ক্ষেত্রে জন্মগত অন্তরায় ঘোচাতে না পারলেও অর্থ বুঝতে দেরী হল না জহরের। সে উঠে বসতে চাইল।সঙ্গে সঙ্গে মুখে একটা প্রচন্ড লাথি। “শালা শুয়ারের বাচ্ছা, জানোয়ার মড়ার ঘাড়ে উঠেছিস,এত ধক তোর,শেষ করে দেব” এলোপাতাড়ি চড় কিল লাথিতে গণরোষ যেন শেষ হচ্ছে না।আশপাশ থেকে আরো কিছু লোক জমা হতে শুরু করেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ একতরফা মারের হাত থেকে জহরকে বাঁচাতে সরিয়ে নিতে চাইল। ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরছে, কিন্তু জহরের নাকে তখনো লেগে আছে মৃতা কিশোরীর ঠোঁটের আঁশটে গন্ধ।

Leave a Reply