মৃগতৃষ্ণিকা

হল্ট স্টেশানের রেললাইনের ধারে ছোট্ট গুমটি ঘরে সকালবেলাটায় মোমবাতি জ্বালিয়ে বাদামভাজার প্যাকেটের মুখ জোড়ে প্রমথ।এটা ওর রোজকারের কাজ,একে বয়স হয়েছে তার ওপর শারীরিক ভাবে খুব সক্ষম নয়।একরকম প্রতিবন্ধীই বলা যায়। বাঁহাতে পাঁচটা আঙ্গুল থাকলেও ডান হাতে মাত্র তিনটে।ভারী কাজ করতে পারে না সেইজন্যে। সকাল সন্ধ্যে দোকানটা আগলানো আর বাদাম ভাজার প্যাকেট তৈরী করা। ছেলেটা ট্রেনে হকারী করে। দোকানে তো তেমন বিক্রী বাটা নেই।একে হল্টস্টেশান,ওঠা নামা করা যাত্রীরা সবই স্থানীয়।কে আর প্রমথর দোকান থেকে জিনিষ পত্র কিনবে।দোকানে থাকার মধ্যে তো সিগারেট,বিড়ি,দেশলাই,বয়ামে সস্তার লঞ্জেস চেনাচুর আর বাদাম ভাজা।আগে চোলাই মদের কিছু প্যাকেট ট্যাকেট রাখত, নতুন ওসি আসার পর থেকে ওসব বন্ধ করে দিয়েছে।নতুন এসে সবাই একটু কাজ দেখায়,বয়াম টয়াম ভেঙ্গে চুরে এক করে দিয়েছিল,কোনক্রমে পালিয়ে বেঁচেছিল প্রমথ। দুটো পয়সা করতে গেলে ঝুঁকি একটু নিতেই হয়, এখন হিজুলীতে মদের দোকান থেকে কয়েকটা বিলিতি মালের বোতল এনে লুকিয়ে রাখে।নষ্ট হবার তো জিনিষ নয়, রাত বিরেতে যখন কারুর দরকার লাগে দেড়া দামে ছেড়ে দেয়। নেহাতই বিশ্বাসযোগ্য না হলে,যার তার কাছে তো এসব খবর দেয় না প্রমথ।কবে বলতে কবে সামান্য ঝুট ঝামেলা হবে,থানায় গিয়ে বলে আসবে,বেইমানের দল।
আটটা সাতচল্লিশের ডাউন লোকালটা ধরবে রতন,এখনো সাত আটটা প্যাকেট বানানো বাকী,তাড়া করতে গিয়ে মোমবাতির আগুনে ছেঁকা লেগে যায় আঙ্গুলে।আপন মনেই মুখ খারাপ করে।
“কি হল সাত সকালে মুখ খারাপ করো কাকে”? প্রমথ মুখ তুলে বলাইয়ের দিকে তাকায়।
“ কাকে আর আমার ভাগ্যকে বল,সাত সকালে চল্লি কোথা”?
“দেশলাই দাও একটা,কলেজে যেতে হবে”।
“সেসব পাঠ তো তোর অনেকদিন চুকে গ্যাছে, আবার কেন”?
“কলেজে ইলেকশন আছে,সকাল সকাল না গেলে হবে না, শুনছি ওরা নাকি বাইরে থেকে লোক হায়ার করে আনছে,আমাদের লোকজনদের ঠিক জায়গায় রাখতে হবে,জিতব ঠিকই,ওদের একটা সীট দিলে চলবে না”।
“আর কেন লেখাপড়া শিখেছিস,ভাল রেজাল্ট করেছিস, চাকরী বাকরী ধান্দা কর।টিউশানি পড়িয়ে আর পাটিবাজি করলে সারাজীবন চলবে না রে বলাই, প্রমথ বিশ্বাসের দেখে এখন কেউ ফিরেও তাকায় না।
“তোমাদের দিনকাল আলাদা ছিল প্রমথ কাকা।এখনকার মতো হলে নিশ্চয়ই একটা হিল্লে হত,তাছাড়া তুমি তো আমাদের দল করলে না, এখনো সময় আছে ”।
“ তুই না হয় এখন মেম্বার আছিস,এরপর প্রধান হবি,আমার তো আর সে ধক নেই,মিছিলের পোঁদে পোঁদে ঠুটো হাত ছুঁড়ে ছুঁড়ে জিন্দাবাদ করা.শেষ কালে চা আর নেড়ো বিস্কুট, হয়ে গেল প্রমথর পাটিবাজি।যাকগে যাক বাদ ওসব কথা কটা বাজল রে, রতনটা তো এখনো এল না”।
“এসে যাবে,এখন মিনিট পাঁচ সাত দেরী আছে,তাছাড়া এ গাড়ীটা রোজই লেট করে”।
দেশলাই নিয়ে বলাই কিছুটা এগিয়ে গেল,ট্রেনের সামনের দিকে উঠবে বলে।কলেজের কিছু ছেলে থাকে ওই কামরাতে, চলন্ত ট্রেনে র গেট থেকে হাতের ইসারায় ডেকে নেবে বলাইকে।
প্রমথ দ্রুত হাতের কাজটা শেষ করতে চায়,এখানকার অধিকাংশ লোকেরই জীবিকা ট্রেনে হকারী।হিসেব করে দেখা গেছে বাদাম ভাজার বিক্রী সবচেয়ে বেশী।পাঁচ টাকার প্যাকেট রোজকার মতন বেশ কিছু তৈরী করতে হয়।ভোর বেলা দোকান খুললেও বিক্রী বাটা তো তেমন নেই,তাই ছোট ছোট পলিথিনের ঠোঙায় বাদাম ভরে মোমবাতির আগুনে মুখ জুড়ে প্যাকেট বানানোই প্রমথর কাজ। প্রমথর সামান্য দখলী জমি আছে। যদিও সেগুলো খুব সরেস নয়,তবু বাদাম চাষ খারাপ হয় না। আগে নিজেই খাটতো,ছোট ছেলেটা সেয়ানা হবার পর থেকে ওই দেখাশুনা করে,শুধু তো বাদাম ফলালেই হল না তারপর বালিতে ভেজে খোসা ছাড়িয়ে বিট লবণ মাখানো।এই কাজগুলো প্রমথর বউই করে।যাক রতন এসে গেছে।
“কিরে দেরী করলি কেন”?
“আর বলো না একদম খুচরো ছিল না,গেলাম ধরণী কাকার মুদির দোকানে,এমন মক্ষিচূষ একটা টাকা বাটা নিয়ে নিল।কত করে বললাম শুনলোই না,আমি তো ভাবলাম ট্রেনটা ফেল হল,কত গুলো বানিয়েছ”?
“একশ বিশ পঁচিশটা হবে”।
“ঠিক আছে বারোটা তিপান্নর ডাউনে ফিরব,ইঞ্জিনের পরের কামরায় থাকব,যদি আরো কিছু লাগে উঠিয়ে দিও”।
দূরে ট্রেন দেখা যেতেই রতন চলে যায়,প্রমথ আবার প্যাকেট তৈরী শুরু করে।এই ভাবেই চলে প্রমথর দিন গুজরান। তবে এই দোকানে বসেই সে গোটা শরৎনগরের অন্তরাত্মার হদিশ করতে পারে।কখন কে আসে কখন কে যায়,কোথায়ই বা যায়,সব খবরই তার জানা।শরৎনগরের গোড়াপত্তনের সময়কারের বাসিন্দা সে।দেখতে দেখতে কতগুলো বছর পার হয়ে গেল। বাদামের প্যাকেট জুড়তে জুড়তে মাঝে মাঝে হাসি পায় প্রমথর।সেই সত্তর একাত্তর সাল,রাজাকারদের অত্যাচার, পাকিস্তানী মিলিটারীর নির্বিচারে মানুষ খুন,কি না দেখলো প্রমথ, তখন কতই বা বয়স,বছর দশ এগারো হবে,তবে হাসি পায় তার অন্য কারনে।যখন ভিটে মাটি ছেড়ে পালিয়ে ছিল,তখন সকলের লক্ষ্য ছিল এক, কোন ভেদাভেদ ছিল না নিজেদের মধ্যে,কোনোক্রমে একটা মাথাগোঁজার স্থান যোগাড় করা। সেখানে অন্ততঃ অহরহ মৃত্যুভয় থাকবে না,মেয়েদের সম্মানহানির ভয় থাকবে না।কিন্তু এখানে আসার কিছুদিন পর থেকেই তারা যে কোন চক্কোরে পড়ল,মনের দিক থেকে আলাদা হয়ে গেল পরস্পরে।প্রথমে জমি দখল,তারপর কোন রাজনৈতিক দল কাকে কত খানি সুবিধে দিচ্ছে।ভোটের রাজনীতিতে ঘোলা জলে মাছ ধরতে সবাই ব্যস্ত,একাত্তরের পরে এলেও নাগরিকত্ব পেতে অসুবিধে হয়নি।রেশন কার্ড, ভোটের কার্ড সবই হয়ে গেল দেখতে দেখতে।
কেমন করে যে তারা দুটো দলে ভাগ হয়ে গেল সেটাই প্রমথ বুঝতে পারে না। এখন একে অপরকে তেমন একটা পছন্দ করে না বরং শত্রুই মনে করে,রাস্তায় দেখা হলে কথা বলে না,সামাজিক অনুষ্ঠানে একে অপরের বাড়ীতে যায় না। প্রমথ এখন আর কোন দলের নয়,দোকানের সুবাদে সকলের সঙ্গেই ভাব,নাড়ী নক্ষত্রও জানা।
লেখা পড়া তো সে ভাবে শেখা হয়ে ওঠেনি প্রমথর।যেটুকু বিদ্যা তা ওই পূর্ব পাকিস্থানের প্রাইমারী ইস্কুলে,এখানে এসে ওসবের ধারও মাড়ায়নি।উপায়ও ছিল না,দুবেলা দুমুঠো খাবারই যোগাড় হয় না , সেখানে আবার লেখাপড়া শেখা! শুধু কি তাই এখানে আসার কয়েকদিনের মধ্যে প্রমথর বাবা দুম করে মরে গেল।নদী থেকে জল আনতে গিয়েছিল সন্ধ্যের মুখে।কি দেখতে কি দেখেছিল কে জানে,বাঘ বাঘ বলে ছুটতে ছুটতে পালিয়ে আসে, সেই রাত থেকেই ধুম জ্বর,কোথায় বা ডাক্তার,কোথায় হাসপাতাল কিছুই জানা নেই।বিনে চিকিৎসাতে দুদিনেই ফতে হয়ে গেল প্রমথর বাপ।আশ্চর্যের কথা নদীর ধারে তখন সত্যিই ঘন জঙ্গল,কিন্তু বাঘের দেখা আর কেউ পেয়েছে বলে শোনা যায় না। প্রমথর বয়স তখন অল্প, বনে বাদাড়ে ঝোড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত কিন্তু বাঘের সন্ধান পায়নি কখনো।বন বিড়াল,বুনো খরগোস, শেয়াল ভাম,বিষধর সাপ কি ছিল না,কিন্তু বাঘ,…না …না বাপটা যে কি দেখে ভয় পেয়েছিল কে জানে।
আজ আর সেই জঙ্গল নেই বাঘ তো দূরের কথা শিয়ালেরও দেখা মেলে না,কখনো সখনো অনেকদূর থেকে দু’একটার ডাক ভেসে আসে। মানুষ আসার পরেই জন্তু জানোয়ারের দল কোথায় পাততাড়ি গুটিয়েছে কে জানে।
এখন অবশ্য প্রমথর মনে হয় ,কিছুটা লেখাপড়া শিখলে ভাল হত, পাটিতে একটা পাকা জায়গা থাকে,হাঙ্গামা হুজুতি করার লোক,মিছিলে গলা ফাটানো লোক অনেক পাওয়া যায়।তারা তো ওই ভিড় বাড়াবার দলে।
এই যে বলাই যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখে সত্যিই শোনার মত।শালা কোন দিন পূর্ব পাকিস্থান দেখলো না,রাজাকার কি জানলো না,ইজ্জত হারানো মেয়েদের কথা তাদের মুখে শুনলো না,অথচ ভাষণ দেবার সময়,লোকে ভাবে যেন সেইসময়কার ছবি দেখছে। কি হাততালি,পড়াশুনার গুণ এমনি।হাতের আঙ্গুলগুলো বোমায় উড়ে যেতে এখন আর হাততালিও দিতে পারে না ভাল করে।প্রমথ কখনো হাততালি পেয়েছে কিনা মনে করতে পারে না।মনে করার আর আছে কি। পেছনে হাততালি দেবার লোক অনেক আছে।
পূর্ব পাকিস্থান বাংলাদেশ হল বটে,তবে প্রমথদের নিরাপত্তা ছিল না। বাপ কাকার মুখে শুনেছে, মুসলমানরা সরাসরি বলত,তোদের দেশ তো ইন্ডিয়া এখানে পড়ে আছিস কি করতে।এর পরই ডাকাতি,প্রমথর চোদ্দ পনেরো বছরের বোনটাকে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল ,আর খোঁজও পেল না,মুখেই যত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা, সব ফুকো।গলা থেকে কফ টেনে থুক করে গয়ের ফেলল প্রমথ।অক্ষমের আর এ ছাড়া কি বা করার থাকে।
“ও প্রমথ কাকা ফিল্টার উইলিস সিগারেট আছে ?লাইনের ওপার থেকেই রবীন জিজ্ঞাসা করে।
শালা! মা মরে ধান ভেনে ব্যাটা খায় এলাচ কিনে।“ক’ প্যাকেট চাই তোর”?
“দাঁড়াও আসছি”। লাইন টপকে দোকানের দিকে আসতে থাকে রবীন।সঙ্গের ছেলেটা ওপারেই থেকে যায়।ক’দিন থেকেই প্রমথ চোখে পড়ছে,শরৎনগরে একটা নতুন মালের আমদানী হয়েছে।রবীনের সঙ্গে ছোড়াটাকে এখানে ওখানে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে।জামা কাপড়ের বাহার খুব। “ছোঁড়াটা কে রে রবীন”?
“আমাদের ভাড়াটে”।
“ভাড়াটে! তোদের আবার ঘর কোথা”?
“কেন সামনের ঘরটা”।
“দুটো তো মোটে ঘর,তোর বাপ,মা,সোমত্ত বোন,থাকবি কোথা?
“ও তো সারাদিন বাড়ী থাকবে না,রাতে ওর সঙ্গে শুয়ে যাব”।
“খাওয়া দাওয়াও তোদের সঙ্গে করবে নাকি”?
“হ্যাঁ।চার হাজার টাকা দেবে মাসে”।
“বলিস কিরে! করে কি”?
“সল্টলেকের অফিসে কাজ করে”।
“আজ অফিস নেই”?
“ছুটি নিয়েছে”। লাইনের ওপার থেকে ছেলে টা তাড়া দেয়।
“দাঁড়া পুলিন,যাচ্ছি,একশ টাকাটা ভাঙ্গিয়ে নি”।কথা গুলো শুনতে শুনতে প্রমথর কপাল্টা যে কুঁচকে গিয়েছিল এখনো সমান হল না।নিশীথ বাবু আসছেন ,পান নেবেন। পানে চুন লাগাতে লাগাতে প্রমথ মনে মনে বলল ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।
“এই যে স্যার আপনার পান , রেডি করা আছে”। নিশীথবাবু পানটা নিয়ে হাসলেন।একসময় সক্রিয় বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন নতুনরা দলে চলে আসায়,তাদের সঙ্গে খুব একটা মতের মিল হয় না।তাই মনোভাব আগের মত থাকলেও নিজেকে একটু গুটিয়ে নিয়েছেন।ভোটের সময় ঘোরাঘূরি করেন বটে তবে এখন আর মিছিল মিটিং এ দেখা যায় না।
“তা যাবেন ক’দূর?”
“কাছেই নপাড়ার লাইব্রেরীতে, অনেকগুলো খবরের কাগজ আসে সময় কেটে যায় ভাল”।
“দেশের খবর কি বুঝছেন?”
“তোর চিন্তা নেই, রেলের জায়গায় পান বিড়ির দোকান ঠিকই রয়ে যাব”।
“ইস্টিশন হবে শুনছিলাম”।
“সে হতে হতে তোর জীবন কেটে যাব”।
“না স্যার ,দেখতে দেখতে ডি এম ইউ, হয়ে গেল,পেল্টাফরমের মাটি পড়ল বলে”।
“তাই! তবে আর কি , দোকান উঠিয়ে নিয়ে প্যাল্টফর্‌মে বসে যাবি”।
“কি যে বলেন স্যার”।
“ভাল থাকিস”। হাসতে হাসতে নিশীথবাবু হাঁটা দেন।
এই সব লোক এক সময় ছিল বলেই এখনো পাটিটা দাঁড়িয়ে আছে। বলাই আবার বলছিল বুড়ো বয়সে পাটিতে ভিড়তে,হুম্‌ এই ভাল লোকটাকেই তোর পাত্তা দিস না। কিব্যাপার রূপালী আসছে এত সকাল সকাল, এগারোটা চল্লিশের গাড়ীটা তো ধরে। দোকানে তো বড় একটা আসে না, এদিকে আসছে কেন।
“ও প্রমথকাকা যোয়ানের প্যাকেট আছে”।
“শিশি হবে”।
“তাই দাও,কত?”
“দশ টাকা”।
“বাবাঃ! প্যাকেট থাকলে পাঁচ টাকায় হয়ে যেত”।
“এটা যে চলবে ওটার দেড়া দিন,তার বেলায়, যাবি কোথায় এত সেজেছিস”।রূপালী রোজই সাজগোজ করেই বেরও,প্রমথর মনে হল আজ যেন আরো মাঞ্জা মেরেছে।
“বিয়ে বাড়ী আছে,”
“তাই বল, অফিস যাবি না?”
“ছুটি নিয়েছি”।রূপালীর অফিস নিয়ে শরৎনগরের লোকজনের সন্দেহ থেকেই গেছে। ও সাধারণতঃ এগারোটা সাড়ে এগারোটায় বেরও,ফিরতে ফিরতে রাত হয় কখনো ক্কখনো লাস্ট ট্রেন।সবাই আড়ালে ফিস ফাস করে রূপালী নাকি কলকাতায় খদ্দের ধরতে যায়।প্রমথ অবশ্য এর জন্যে কিছু মনে করে না, বাড়ীতে বুড়ো বাপ হেঁপো রুগী, পেচ্ছাপের অসুখ নিয়ে বিছানায় পড়ে আছে,ভাইটা ছোট, মা লোকের বাড়ী রান্না করে।এরপর যদি খদ্দের ধরতে যায় দোষটা কোথায়,যারা এসব কথা বলে তারা তো বাড়ী বয়ে টাকা পৌঁছে দেবে না।আছে খালি মাগনা মারার তালে ,নোলা সক্‌সক্‌ করছে।
“এই রূপালী, দুটো টাকা নিয়ে যা, কেনা দামে দিয়ে দিলাম”। কয়েনটা ব্যগে ভরে হেসে চলে যায়।

(২)

এই যে রেল লাইনটা পশ্চিম থেকে পূবের দিকে গেছে,এক সময় এটার ওপর দিয়ে ঢাকা মেল চলত, এখন ডিএমইউ লোকাল ট্রেনগুলো চলে।শরৎনগর হল্ট হলে হবে কি সব ট্রেনই দাঁড়ায়।শরৎনগরের মানুষজনের সাথে রেল লাইন আর ট্রেনের নিকট সম্পর্ক।শীতকালের দুপুরে মাঝবয়সী মেয়েরা রেল লাইনে বসেই রোদ পোহায়,কেউ আবার উল বোনে। রেল লাইনের মাঝখানে কুলোর ওপর সাদা কাপড়ে সদ্য দেওয়া বড়ি, আচারের বয়াম,লাল লঙ্কা,আরো কত কি রাখা থাকে, দুপুরের রোদে।বাচ্ছারা হামা দিয়ে রেললাইনের পাশে নুড়ি পাথর নিয়ে খেলা করে।কেউ কেউ লুডো বিছিয়ে জুয়া খেলে, তবে কিছুটা দূরে, লোক চক্ষুর একটু আড়ালে। দূর থেকে ট্রেন আসা দেখামাত্রই হুটো পাটা পড়ে যায়।যে যার জিনিষ সরিয়ে লাইনের পাশে এসে দাঁড়ায়।ট্রেনের ড্রাইভারের এসব জানা, অনেক দূর থেকেই হুইসিলের তীব্র আওয়াজে সকলকে সজাগ করতে করতে এগিয়ে আসে মন্থর গতিতে শরৎনগর হল্ট স্টেশানের দিকে। সত্যিই কোন অপঘাতের কথা শোনা যায়নি কখনো।এখন তো আর এই লাইন দিয়ে মেল এক্সপ্রেস চলে না।বছরে একবার বাংলাদেশের থেকে উরস্‌ তীর্থযাত্রীদের নিয়ে একটা স্পেশাল ট্রেন আসে,আগাম ঘোষণা থাকে, দু চারটে খাঁকি পোষাকের পুলিশ ডিউটি করে। সেটা অবশ্য শরৎনগরে দাঁড়ায় না।গতবছর সিগন্যাল না পেয়ে বেশ কিছুক্ষণের জন্যে দাঁড়িয়েছিল ট্রেনটা।ছেলে বুড়ো মেয়েদের সেকি উৎসাহ, হুল্লোড় লেগে গিয়েছিল শরৎনগর স্টেশান চত্বরে।কেউ কেউ ট্রেন থেকে নেমেছিল, কেউ আবার কথা বার্তা বলছিল স্থানীয় লোকজনের সাথে।বহুদিন পর্যন্ত শরৎনগরে উরস্‌ উৎসবের ট্রেন দাঁড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা রোজকারের একঘেয়ে জীবনে এক অভিনব বিনোদন। কতদিন সেই বার বার শোনা একই গল্প উঠে এসেছে তাদের আয়েসী আড্ডায়। মেয়েদের মধ্যে এখনো কি হাসাহাসি, সেই বুড়ো এক মুসলমান লুঙ্গির ওপর এমনই বিশাল ঝুলের এক পাঞ্জাবী পরে ট্রেন থেকে নেমেছিল জল খেতে, মনেই হচ্ছিল না লোকটা লুঙ্গী পরে আছে।হাসাহাসির কারণ কিছুদিন আগে নতুন বিয়ে হয়ে আসা বনানী,বয়স্ক মহিলাদের মধ্যে ওই সবচেয়ে কমবয়সী,বলেছিল বুড়োর লুঙ্গী পরার দরকার কি।তা শুনে মনুর মা এক অশ্লীল ইংগিত করেছিল লুঙ্গী না পরলে কি হতে পারে সেই নিয়ে।ঘুরে ফিরে সেই কথা হলেই এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে হাসতে হাসতে। কেউ কেউ সেইসময় বাদামভাজা, তিলের তক্তি, সাবুর পাঁপড় দেড়া দামে বিক্রী করেছিল। সেসব গল্প এক বছর হয়ে গেলেও লোকের মুখে মুখে ফেরে।শরৎনগরে তো প্ল্যাটফরম নেই, ট্রেনের পাদানি বেয়ে ওঠা নামা করতে হয়।বয়স্কদের পক্ষে খুবই কষ্ট, তবু তারা এইটুকু মুখ বুজে মেনে নিয়েছিল সবকিছু, বাপ ঠাকুরদা অনেক কষ্ট সয়ে লড়াই করে জীবন কাটিয়ে দিল সে তুলনায় এতো কিছুই নয়। রেললাইন আর ট্রেন এখনকার মানুষজনের জীবন জীবিকার প্রধান অঙ্গ।বাংলাদেশ থেকে আসার পর যে যার মতন জবর দখল করে বসে পড়েছিল।আজ পর্যন্ত বসতবাড়ী কোন মালিকানা সত্ত্ব নেই।শোনা যায় অনেক কাল আগে এসব জমি জায়গা ছিল ভট্টাচার্যিদের। তাদেরই পূর্বপুরুষ শরৎ ভট্টাচার্যির নামেই শরৎনগর।তাঁর নাতি বা তাদের ছেলে পুলেরা বিদেশে প্রতিষ্ঠিত।এসব জমি জায়গার ওপর তাদের কোন টানও নেই লোভও নেই। তারা আর এদেশে আসে না।বিস্তীর্ণ জমি ভেষ্ট হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই।প্রথম প্রথম এখানকার বাসিন্দাদের উচ্ছেদের ভয় ছিল।এখন আর ততটা নেই, কারণ সবার সঙ্গে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল আছে।সেই ভরসাতে বাস করলেও মালিক হবার ইচ্ছে যে একেবারে নেই তা নয়। প্রতিবারই ভোটের আগে নানান প্রতিশ্রুতির মধ্যে দখলী জমির পাট্টা পাওয়ার কথা থাকত।ভোট হয়ে যায়, তারপর তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত হয়ে ওঠে হার জিত নিয়ে। বার হয় বিজয় মিছিল, হারা পার্টীকে আরো বুঝিয়ে দেওয়ার দরকার হয় জেতা পার্টির শক্তি কতখানি। এসবের মাঝখানে দখলী জমির আইনতঃ মালিক হয়ে উঠার কথা মনে থাকে না কারুর। তবে স্থানীয় লোকজনেরও এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যাথা নেই।ভোটের প্রতিশ্রুতি শেষেমেষে কি হয় তা সকলেরই কম বেশী জানা।এক দু বছর অন্তর অন্তরই কোন না কোন ভোট আসতে দেরী হয় না। সকাল সকাল নাগরিক অধিকার প্রয়োগেরই তৎপরতা দেখা যায় আবার এদেরই মধ্যে। কারণ রাজনৈতিক টানপোড়েনই এদের জীবনে এখন অন্যতম বৈচিত্র্য।অথচ প্রানের দায়ে নিজেদের দেশ ছেড়ে এখানে আসা পর্যন্ত সকলেই কিন্তু এক ছিল।তখন তো বেআইনী অনুপ্রবেশকে আইনী মান্যতা দিতে তখন সব রাজনৈতিক দলই তৎপর হয়ে উঠেছিল। ফলে কারুর না কারুর হাত ধরে রেশন কার্ড,পরে ভোটার লিস্টে নাম উঠিয়ে নাগরিকের বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। যেহেতু সেই সময় কোন না কোন রাজনৈতিক দলের সহায়তার কারণে এক হয়ে আসা মানুষগুলি নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক হিসাবে। তৈরী হল প্রতিপক্ষ, জারী থাকল যুযুধান লড়াই।অবশ্য এই রাজনীতি ছিল পুরোপুরি আঞ্চলিক, এর ফলে শত্রুতার একটা চোরা স্রোত বইত উভয় পক্ষের মনে। সেবার পঞ্চায়েতের ক্ষমতা দখল করল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিরোধী পক্ষ ।প্রধান অনন্ত ভদ্র শিল্পী মানুষ, মনের দিক দিয়েও নরম প্রকৃতির। রাজনীতির ময়দানে এসব মানুষ খুব একটা সুবিধে করতে পারে না, সেটা সে নিজেও জানেন , তবুও পাঁচজনের অনুরোধে আবদারে প্রধান হয়ে বসলেও নিজের শিল্পী সত্বা ত্যাগ করতে পারেননি। প্রতি সন্ধ্যায় চলে যাত্রার রিহ্যার্শাল, এবারের পালা নটী বিনোদিনী। এই নিয়ে অপর পক্ষের রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের ঠাট্টা বিদ্রুপের অন্ত নেই। এর মূল হোতা তারই পঞ্চায়েতের মেম্বার বলাই। এর কারণ ওদের দল জিতলে বলাই’ই হয়তো প্রধান হত এই পঞ্চায়েতের, মনে মনে ক্ষোভ তো একটা আছে। যে কোন কারণে হেনস্তা করতে ছাড়ে না। অনন্ত ভদ্র অবশ্য বলাইকে পচ্ছন্দই করেন, লেখাপড়ায় ভালো, শিক্ষিত ছেলে, আজ না হয় কাল একটা ভাল চাকরী নিশ্চয়ই পেয়ে যাবে। মা মরা ভাগনীটাকে ভাল ছেলের হাতে পাত্রস্থ করতে পারলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। যতই হোক ছোট থেকে মানুষ করেছেন, দেখতে শুনতে খারাপ নয়। বলাই হল চেনা জানার মধ্যে,মেয়েটাও নজরে থাকত। আজকাল নানান ঘটনা কানে আসে, মেয়েদের বিয়ে দিয়ে সব সময়ই ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় কখন কি ঘটে।এখানে অন্ততঃ সেসব ভয় নেই।প্রধানের এই নরম মনোভাব নিজের দলেরই অনেকের পচ্ছন্দ নয়। বলাইএর ওপর তাঁর দুর্বলতার কথা অনেকেরই জানা, হয়তো কখনো কথা প্রসঙ্গে নিজেই বলে ফেলেছেন সেসব। সেইজন্যেই তারা ঠারে ঠারে কথা শোনায়, “ অনন্তদা তুমি এখনো ওদের চিনলে না, তমোহর নস্কর, রবীন গুজাইতকে টপকে বলাই তোমার ভাগনীকে বিয়ে করার মত দেবে? তাহলেই হয়েছে, তুমি পচ্ছন্দ করলে কি হবে, বলাই তোমাকে কেমন হ্যাটা করে দেখোনি ”। কথাটা মিথ্যে নয়। প্রধান হবার পর চেয়েছিলেন সকলের সহযোগিতা, তাতে মূল উদ্দেশ্যটা ব্যহত না হয়। যেহেতু তারা রাজ্যে ক্ষমতাসীন দল,তাই তাদের শক্তি প্রদর্শণটাই মুখ্য, কিভাবে সব কিছু বানচাল করে দেওয়া যায় সবসময় সেই চেষ্টা। মাঝে মাঝে তাঁর মনে হয় দি সব ছেড়ে ছুড়ে। পরে মনে হয়েছে এতে ওদেরই সুবিধা হবে।রিহ্যার্শাল চলছিল জোর কদমে, বিনোদিনী যে মেয়েটি করবে, বাইরে থেকে এসেছে, অফিস ক্লাব, যাত্রা, গ্রুপ থিয়েটার সবই করে। পেশাদার অভিনেত্রী, গানের গলাটিও ভাল তবে বিনোদিনীর চরিত্রে আগে অভিনয় করেনি। তাই গানগুলি তোলানো হচ্ছিল। অনন্ত ভদ্র নিজেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গুলি শেখাচ্ছিলেন। শেখর আজকে আসেনি বলেই অনন্তকে এই কাজটা করতে হচ্ছে, মেয়েটা এসে শুধুশুধু ফিরে যাবে। শেখর রাখালের চরিত্রটা করবে, ওর আবার গানের টিউশানি আছে।তাই বোধহয় আসতে পারেনি।হঠাৎই প্রচন্ড শব্দে গান বাজনা থেকে গেল, পর পর দুটি বোমের আওয়াজ, সঙ্গে ইনকেলাব জিন্দাবাদ, সকলেই আশ্চর্য, কি আবার হল এখন, হঠাৎ স্লোগান কিসের। ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াতেই ব্যাপারটা বোধগম্য হল। বলাই এর সঙ্গে সাত আটটা ওদেরই দলের ছেলে। বোম ফাটিয়ে নাচতে নাচতে আসছে , সকলেরই গায়ে মাথায় আবীর,সামনে বলাই। অনুপম তাড়াতাড়ি অনন্তকে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেল, চাপা গলায় জানালো,-“ আজ বিন্দুবাসিনী কলেজে ইলেকশন ছিল, সেখানে জিতে রাজ্য জয় করে ফিরছে”।‘যাকগে যাক। বাদ দে ওসব। সকলকে ভেতরে ডাক, এখনো দুটো গান বাকী”।“আর হয়েছে ওসব। দেখো না কানের পোকা বার করে দেবে বোমা পটকা আওয়াজে, জিতেছে জানান দিতে হবে না”।

(৩)

বর্তমানে সব রাজনৈতিক দলই মনে করে কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচন তাদের স্থানীয় নেতাদের সম্মান রক্ষার অগ্নি পরীক্ষা। সকাল থেকেই বিন্দুবাসিনী কলেজের সামনের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু লোকজন। আপাতদৃষ্টিতে কৌতুহলী দর্শক মনে হবে, আসলে কিন্তু তা নয়। কাগজে প্রায়ই দেখা যায়, কলেজে ইউনিভার্সিটিতে বহিরাগতদের কথা , এরা সেই বহিরাগত, রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশে এখানে জমা হয়েছে। একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারী থাকলেও ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে অবিন্যস্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে এখানে ওখানে। এই কলেজে জি এস প্রদীপ বাগচি। বছর উনিশ কুড়ি বছরের স্বাস্থ্যবান যুবক। যেহেতু ভাল ফুটবল খেলোয়াড় তাই রাজনৈতিক ময়দানেও খেলোয়াড়ী মনোভাব বজায় রাখতে চায়। এর ফলে কলেজে সে ভীষণ জনপ্রিয়। যে কোন সমস্যায় রাজনৈতিক ভেদাভেদের উর্ধে গিয়ে সমাধানের চেষ্টা করে। স্থানীয় নেতারা প্রদীপের এই জনপ্রিয়তা খুব একটা পছন্দ করেন না। তাদের বক্তব্য এতে নাকি দুর্বলতা প্রকাশ পায়। বিরোধীদের সঙ্গে বন্ধু মনোভাবাপন্ন সম্পর্ক রাখা রাজনৈতিক উন্নতির পরিপন্থী।
আজকের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রদীপ যতই আত্মবিশ্বাসী হোক না কেন স্থানীয় নেতারা তার ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না। সদ্য কলেজ ছেড়ে যাওয়া একসময়ের দাপুটে জি এস বলাইকে ভার দেওয়া হয়েছে আজকের নির্বাচন পরিচালনা করার জন্যে। বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় জনা ত্রিশ পঁয়ত্রিশ ছেলে নিয়ে বলাই হাজির, এদের প্রত্যেকের সঙ্গে উইকেট, হকিস্টিক, লাঠি ইত্যাদি, সঙ্গে ছোট একটা ব্যাগে বোমাও আছে হয়ত। প্রচুর পুলিশ মোতায়েন হলেও বলাই ওসব গ্রাহ্যের মধ্যে আনলো না। সে জানে তাদের কাছ থেকে এসব বাজেয়াপ্ত করে নিরপেক্ষ হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার মত সাহস পুলিশের নেই, কারণ বলাই পতাকা হাতে যে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করছে সেই দলই তো সরকার চালাচ্ছে । প্রদীপ বলাইকে দেখে এগিয়ে এল।
“ যাক বলাইদা আপনি এসে গেছেন খুব ভাল হয়েছে, আপনি বরং আমাদের টেন্টে গিয়ে বসুন। চা জল খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি, ক’জন আছে আপনার সঙ্গে”।
“কাকে কি বলছিস? আমি দুশো মিটার দূরে টেন্টে গিয়ে বসে থাকব, সেইজন্যে এসেছি আমি। ওদের ক্যাম্পটা ভেঙ্গে দিসনি কেন?”
“ ভেঙ্গে দেব কেন? আমরা তো জিতবই। শুধু শুধু অশান্তি করতে যাব কেন”?
এখন বলাই বুঝতে পারছে স্থানীয় নেতারা কেন প্রদীপের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। একটু বিরক্ত হয়েই বলল, “ তমোহরদা কি বলেছে জানিস এদের একটা সিটও দেওয়া চলবে না”।
“ সেটা আমি বলতে পারব না। এটা গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, ফেয়ার ইলেকশন হবে, আমরা যা কাজ করেছি, ছাত্রদের সঙ্গে আমাদের যা সম্পর্ক তাতে আমরা হারতে পারিনা, যদিও বা ওরা সীট পায় ক্ষতি কি, গনতন্ত্রে বিরোধীতা থাকবেই”।
“ওসব কেতাবী কথা আমাকে শোনাতে আসবি না। যা বলছি শুনতে হবে, তমোহরদা আরো বলেছেন…।।“
“তমোহরদা এর মধ্যে আসছেন কোথা থেকে, তিনি তো কলেজের কেউ নন, আমাদের ইলেকশন আমাদের মত করে করব, আমি চাই না কেউ আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলুক প্রদীপ বাগচি সন্ত্রাস করে ভোটে জিতেছে”।
দুজনের গলার স্বর কিছুটা উচ্চগ্রামে উঠে গিয়েছিল, বলাই লক্ষ্য করল প্রদীপের পিছনেও বেশ কিছু ছেলে এসে জমা হয়েছে। যেহেতু বলাই পার্টি থেকে নিযুক্ত হয়েছিল তাই তার মেজাজ স্বভাবতঃই একটু চড়ে ছিল। প্রদীপের গোয়ারর্তুমি বরদাস্ত করার কথা নয় তার। তবু পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিজেকে একটু সংযত রাখার চেষ্টা করছিল সে । সেই কারণেই একটু চাপা গলায় প্রদীপকে জানাতে বাধ্য হল-“ তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস প্রদীপ, মনে রাখিস এটা পার্টির হুইপ”।
এটা শোনার পরও প্রদীপের কোন ভাবান্তর হল বলে মনে হল না।বরং কিছুটা আশ্চর্য হয়ে বলাইএর মুখের দিকে তাকিয়ে তাকল কিছুক্ষণ- অবিশ্বাসের সঙ্গে বলল,-“এটা পার্টির হুইপ, কিবলছ কি? সন্ত্রাস করে ভোটে জিততে হবে। তাহলে শুনে রাখো আমি এই হুইপ মানছি না, আমি আমার ছেলেদের নিয়ে টেন্টে গিয়ে বসে থাকছি। তোমাকে যখন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তুমি সেই ভাবে ভোট করো”।
প্রদীপ দলবল নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলে বলাই আটকালো, “ শোন শোন প্রদীপ যাচ্ছিস কোথা? আমি জানি তুই চলে গেলে তোর ছেলেরা কেউ ভোট দেবে না, এটা সাবোটেজ্‌ ছাড়া কিছুই নয়, বেশ আমিই চলে যাচ্ছি”।
“সেকথা তো তোমাকে আগেই বললাম বলাইদা, তোমার বসে থাকাটাই আমার কাছে যথেষ্ঠ”। সদল বলে বেরিয়ে যাবার আগে প্রদীপকে জানিয়ে দিতে ভুলল না –“ মনে রাখিস এর কৈফিয়ত কিন্তু পার্টির কাছে তোকে দিতে হবে”।
গ্রামে ফিরে এসেও কথাগুলো ভুলতে পারছিল না বলাই। সমর্থকরা যতই বোমা পটকা ফাটক না কেন, জেতার আনন্দে ওদের সঙ্গে এক হতে পারছিল না বলাই। কিছুটা দূরে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। আজকের অপমানটা মন থেকে মেনে নিতে পারছে কিছুতেই। কলেজ থেকেই তমোহরদাকে ফোন করেছিল সমস্ত ঘটনা জানিয়ে। নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করতে বারণ করছিল তমোহরদা। ভোটের ফলাফলের দিকে নজর রাখতে বলেছিলেন। তারপর প্রদীপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেটা আর এখন সম্ভব নয়। একটা সিটও বিপক্ষ দল পায়নি, এরপর প্রদীপের বিরুদ্ধে কি বলার থাকতে পারে, বলাইএর রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল মৃণাল সমাদ্দারের হাত ধরে, তখনই তিনি একটা কথা বলাইকে বলেছিলেন রাজনীতি করতে হলে মাথাটা বরফের মত ঠান্ডা রাখতে হয় । মাথা গরম করে কোন কাজ হবে না। “বুঝলি বলাই যে সয় সে রয়, অনেক ঝড় ঝাপটা আসবে, যে সহ্য করতে পারবে সেই থাকবে।
তবুও আজকে যেন তার অধৈর্য লাগছে, কলেজে অতগুলো ছেলের সামনে। যাবার সময় প্রমথর মুখ দেখে যাওয়াটাই কাল হয়েছে তার।
“কি হল বলাইদা খাওয়া দাওয়া কখন হবে”?
“কেন কলেজে খাসনি?”
“সে তো ভোটের খাওয়া জেতার পর খাওয়া দাওয়া হবে না”। মনটা এমনিতেই বিরক্তিতে ভরা ছিল এসব কথার উত্তর দিতেও ইচ্ছে করছিল না বলাইএর।
“চল বিস্টুর দোকানে চা বিস্কুট খেয়ে চলে যাবি”। এতে যে কাজ হবে না বলাই জানে, প্রমথ কাকার ওখানে গিয়ে দেখা যাক কিছু পাওয়া যায় কিনা। দু’তিনটে বোতল ধরিয়ে দিলে ছেলে গুলো অন্ততঃ কবজায় থাকবে।
(৪)
শিপ্রা নাকি ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। মাঝে মাঝেই একটা দুটো কথা বলে ফেলে, আশ্চর্যজনক ভাবে মিলে যায়, বলটা নিয়ে সারা মাঠ জুড়ে ড্রিবিলিং প্র্যাকটিশ করতে করতে প্রদীপ এই কথাটাই ভাবছিল। একসময় তার কাছেই পড়ত মেয়েটা, এখন সেকেন্ড ইয়ার। পড়াশুনায় চৌখসের থেকেও বড় কথা পরিশ্রমী। প্রদীপ মনে করে শুধু পড়াশোনাতেই নয় সব ব্যাপারেই পরিশ্রমী হওয়াটাই জরুরী। অনেকদিন আগে পিকে ব্যানার্জি একটা অনুষ্ঠানে চীফ গেষ্ট হয়ে এসেছিলেন। বক্তব্য রাখার সময় বলেছিলেন যে কোন খেলায় উন্নতি করার প্রাথমিক সর্ত প্র্যাকটিশ ফাস্ট, প্র্যাকটিশ সেকেন্ড, প্র্যাকটিশ থার্ড। কোথায় যেন প্রদীপ পড়েছিল গাভাসকার যখন ভারতের অধিনায়ক তখন রানিং বিটুইন উইকেট প্র্যাকটিশ করার জন্যে রোজ ভোর বেলায় ব্র্যাবোর্ণ স্টেডিয়ামে গ্যালারীতে দৌড়ে ওঠা নামা প্র্যাকটিশ করতেন।
গতকাল কলেজে ইলেকশন শেষ হয়ে যাবার পর ইউনিয়ান রুমে বসে ছিল, সন্ধ্যে হয় হয়, শিপ্রা এসে ডাকল, অনেকেই ছিল সেখানে সেইজন্যেই বোধহয় প্রদীপকে বাইরে আসতে বলল। বাইরে এসে শিপ্রার কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল- “ আজ তুমি বলাইদার সঙ্গে যেটা করলে তার মূল্য কিন্তু তোমায় দিতে হবে”। শিপ্রার ওপর রাগ করার তো কোন প্রশ্ন নেই হেসে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। “এটা কি তোর ভবিষ্যদ্‌বাণী নাকি আমার সিদ্ধান্ত তোর পছন্দ হয়নি”।
“এর বেশি আমি আর কিছু বলব না প্রদীপদা তবে তুমি সাবধানে থেকো”। শিপ্রা আর দাঁড়ায় নি। আজ প্র্যাকটিশ করতে করতে কথাটা মনে হল। রাজনীতি করতে হলে সে তার মতো করেই করবে, নাহলে ছেড়ে দেবে। গুন্ডামি আর রাজনীতি এক জিনিষ নয়। সাধারণ মানুষের কাছে স্বচ্ছ ভাবমূর্ত্তি না থাকলে নেতা হওয়া যায় না। দিনকালের কেমন যেন পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষতঃ পার্টির বয়স্ক নেতারা তাঁরাই উৎসাহিত করছেন কম বয়সীদের সন্ত্রাস মস্তানী করে একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরী করতে।মাস্‌ল পাওয়ার দেখাতে। তাঁদের বক্তব্য হল সাধারণ নিরপেক্ষ মানুষ অন্ততঃ ভয়ে ভক্তি করবে। বিরুদ্ধাচারণ করতে সাহস পাবে না। এরসঙ্গে প্রদীপ কখনোই এক মত নয়। প্রাথমিক অবস্থায় ফল পাওয়া গেলেও এর একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। রবীন্দ্রনাথ এমনি এমনি বলেনি, শাসনে যতই ঘেরো আছে বল দুর্বলেরও বোঝা তোর ভারি হলে ডুববে তরীখান”।
“প্রদীপদা”
“কিরে সুমন প্র্যাকটিশে এলি না কেন, কিহয়েছে আজ সকলের”?
“শোননি গতরাতে অরবিন্দবাবুর বাড়ীতে বিরাট চুরি হয়ে গেছে”।
“শিপ্রাদের বাড়ী?”
“হ্যাঁ, পুলিশ এসেছে অনেক লোক জমা হয়েছে”।
“ঠিক আছে আমি যাচ্ছি”। না আজ আর কিছু হবে না। চুরি ডাকাতির ব্যাপারে প্রদীপ চিরদিনই সোচ্চার, কয়েক পুরুষের বাসিন্দা ওরা। যারা এইসব কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের ভাল করেই চেনে। আর একটা অসুবিধা হল, বর্ডার কাছে হওয়ায় স্মাগলিংকে পেশা হিসাবে মনে করে কিছু মানুষ। যখনই বর্ডারে কড়াকড়ি চুরি চামারী বাড়ে। প্রদীপ নিজের চেষ্টায় অনেকেই মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনেছে, পঞ্চায়েতে বিভিন্ন কাজ কর্মে যুক্ত করে। সেখানের কাজ বেশির ভাগই ডে-লেবারের। এছাড়া তাদের যোগ্যতাই বা কি আছে। কিন্তু সে কাজ তো আর সারা বছর থাকে না। কাজ না থাকলেই পুরানো পেশায় ফিরে যেতে চায়।কত আর চোখে চোখে রাখা যায়। এদিকে আবার পুলিশ ধরলে থানায় গিয়ে তদবির করতে হয়। কিন্তু আজকের ঘটনা সত্যিই চিন্তার। যে করে হোক কিনারা করতেই হবে।
প্রদীপ যখন শিপ্রাদের বাড়ী পৌঁছাল, তখন পুলিশ চলে গেছে। একদিকে ভালই হয়েছে। চেনা জানা কোন অফিসার থাকলে প্রদীপকে দু’চার কথা শুনিয়ে দিত ধরাপড়া লোকজনের জন্যে তদবির করে বলে।
জানলার গ্রীল ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকেছিল, ভারী বা বড় জিনিষ কিছুই নেয়নি। টাকা পয়সা সামান্য গয়না গাঁটি, মোবাইল ফোন কয়েকটা হাতঘড়ি। শিপ্রা প্রদীপকে দেখতে পেয়েই মাকে ডাকল, “মা প্রদীপদা এসেছে”। অরবিন্দবাবু থানায় গেছেন একটা লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে।
“বসতে বল, আমি যাচ্ছি”। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে চারপাশটা দেখছিল প্রদীপ। বাড়ীতে লোকজন থাকা সত্ত্বেও কিভাবে চুরিটা হল। ঘুমিয়ে থাকলেও কেউ কিচ্ছু টের পেল না।
“প্রদীপদা আমি কিন্তু বলেছিলাম আমাদের বাড়ীতে চুরি হবে”।
“এত কিছুই যখন বলেছিলি, কে চুরি করল সেটা বলতে পারছিস না”? শিপ্রা হাসল।
“ঠাট্টা করতেই পারো তবে যেটা বলব সেটা গুরুত্ব দিও”। ইতিমধ্যে শিপ্রার মা এসে দাঁড়ালেন।
“রাতে লোক ঢুকে এত কান্ড করল কিছুই টের পেলেন না”।
“না পেয়ে একদিকে ভাল হয়েছে, নীচের তলায় একটা বড় মুগুর রেখে গেছে”।
“পুলিশ নিয়ে যায়নি ওটা”
“ না না নাম কা বাস্তে ঘুরে ফিরে দু’চারটে কথা জিজ্ঞাসা করে চলে গেল কোন কিনারা হবে বলে মনে হয় না, উনি তো গেলেন থানায় অভিযোগ দিতে।“
“তবে এ কোন সাধারণ চোরের কাজ নয় মাসীমা, পাকা ক্রিমিন্যাল”।
“ঠিকই বলেছ বাবা ঘরের মধ্যে কোন ওষুধ টষুধ ছড়িয়ে ছিল, আটটা বেজে যাচ্ছে কারুর ঘুম ভাঙ্গচ্ছে না”।
“সেই জন্যেই তো বলছি মাসীমা, আগে থেকে তাদের জানা ছিল কোথায় আলমারীর চাবি থাকে, পালাবার সময় নিচের গেটের তালাও খুলেছে”।
“ কে আসবে বাবা, বাইরে লোক তো আমাদের বাড়ীতে আসে না”।
“তবু ভাল করে মনে করে দেখুন, নাহলে এটা সম্ভব নয়”। শিপ্রা তাড়াতাড়ি বলে ওঠে – “ গত মাসে একজন কাঠমিস্ত্রি আমাদের বাড়ীতে কাজ করেছিল”।
“চেনা জানা?”
“না না শংকরদা কোথা থেকে জুটিয়ে এনেছিল, লোকটার নাম ধাম জানো?”
“বাবা জানে, নাহলে শংকরদাকে জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারবে”।
“হ্যাঁরে শিপ্রা, প্রদীপকে একটু চা করে দে ”।
“না মাসীমা চা খাব কি, আপনাদের বাড়ীতে চুরি হয়ে গেছে”।
“তা বলে কি আমাদের বাড়ীতে খাওয়া দাওয়া বন্ধ থাকবে তুমি শিপ্রার সঙ্গে কথা বলো আমিই না হয় চা করে আনছি”।
শিপ্রার মা চলে যেতেই ফোনটা বার করল প্রদীপ, নামটা বার করে কানে চেপে ধরতেই শিপ্রা বলল, “কাকে ফোন করছ”? “ তুই চিনবি না”।বলেই ফোনে কথা শুরু করল – “ সৈদুল শোন, আঃ! যা বলছি মন দিয়ে শোন না অরবিন্দ বাবুকে তুই চিনবি না সহায়রামপুরে, কোল্ড স্টোরেজের কাছে একটাই পাকা বাড়ী………হ্যাঁ হ্যাঁ সারের দোকানের উলটো দিকে …… কাল রাতে চুরি হয়ে গেছে……… না, না জানলার গ্রীল ভেঙ্গে, আমি কালকের মধ্যে খবর চাই………………… ঠিক আছে”। ফোনটা রাখা মাত্রই শিপ্রা বলল “পাবে না”। “তোর ভবিষ্যদ্‌ বাণী থামাবি”।
“ সে না হয় থামালাম তবে এ চুরির কোন কিনারা হবে না”।
“মাঝে মাঝে তোর কি হয় বলতো আগে তো এরকম ছিলি না, কালকে কলেজে ওই কথা বললি কেন, আমাকে কি বলাইদাকে ভয় করতে হবে”।
“তা কেন। তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও, ফুটবল নিয়ে থাকো, আমার কথা না শুনতে পারো তবে শেষ পর্যন্ত কিন্তু তোমাকে তাই করতে হবে”।
“মাসীমার যদি চা না হয়ে গিয়ে থাকে বারণ কর, আমি উঠব, তোর কাছ থেকে উপদেশ শোনার সময় আমার নেই”।
“দু’মিনিট বসো আমি চা নিয়ে আসছি”।

(৫)
ব্যাটারীর আলো জ্বেলে প্রমথ দোকানে বসে আছে, সবাই বলে আলোটা না জ্বালেও চলে, অন্ধকারে প্রমথর চোখ নাকি বেড়াল কুকুরের মত জ্বলে। কোথায় কি হচ্ছে সবই নাকি দেখতে পায়। মনে মনে হাসে প্রমথ, আসল এসব কিছুই নয় অন্ধকারে তাকাতে তাকাতে একটা অভ্যেস হয়ে গেছে তার, দূর থেকেই চলাফেরা চালচলন দেখলে বুঝতে পারে। এখানে তো আর নতুন লোক নেই, দুবেলা দিনের আলোয় দেখতে দেখতে চোখ দুটো এমনি সয়ে গেছে অন্ধকারে বা ছিঁটেফোটা আলো বুঝতে অসুবিধে হয় না কে এল, আর কে গেল। ট্রেনের আসা যাওয়ায় সময়ের একটা আন্দাজ হয়েই যায়, আর সেই ট্রেনে কে গেল আর ফিরতি ট্রেনে কেই বা ফিরে এল। চারদিকে অন্ধকারে দোকানের সাদাটে ব্যাটারীর আলোয় বসে বুঝতে অসুবিধে হয় না।
সন্ধ্যের পর দোকানে তেমন একটা বেচা কেনা থাকে না।হাতে তেমন কোন কাজ কে না। নুলো মানুষ কি কাজই বা করবে। দোকান সাজাতেও ভরসা হয়না, দুটো তালার ওপর ভরসা, রাতদুপুরে ভাঙ্গতে আর কতক্ষণ। লুকিয়ে চুরিয়ে কয়েকটা মদের বোতল, দিশি, বিলিতী সবরকমই বিক্রী বাটা হয় বটে তবে খুব চেনা জানা না থাকলে ওসব বার করে না। এই দিন দশেক আগে বলাই এল , সঙ্গে কয়েকটা ছেলে , কলেজে ভোটে জেতার আনন্দে স্ফূতি হবে। তিনটে বাংলা মালের বোতলের দাম আজ অবধি দেয়নি। চাইলেই বলে আরে চিন্তা করো কেন প্রমথকাকা, ভাইপোর কাছে টাকাটা থাকা মানে তোমার ঘরেই আছে। শালা! তোর কাকা হতে আমার বয়ে গেছে , ধান্দাবাজ, এরপর কোনদিন না বলে বসে ওটা পার্টি ফান্ডে দিয়েছে ধরে নাও।বেআইনি মদ বিক্রির টাকা নিয়ে তো হৈ হুজ্জুতি চলে না। কিছুটা মন যুগিয়ে চলতে হয়, পার্টি করা লোকগুলোকে বিশ্বাস করতে নেই । ঠেকে শিখেছে প্রমথ।
রাত হয়ে গেল এবার দোকান বন্ধ করে বাড়ী যাবে। আর একটা ট্রেন আসা বাকী আছে, তেমন একটা লোক নামে না, তবুও সিগারেট বিড়ি কটা যদি বিক্রী হয়। কাঠের বাক্সের ড্রয়ারে রাখা খুচরো পয়সা গুনতে শুরু করল। অনন্ত ভদ্রের যাত্রার রিহ্যার্সাল চলছে, নিশুতি হয়ে যাওয়ায় হারমোনিয়ামের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আছে বেশ, তবে এই করেই কি প্রধানগিরি বজায় রাখতে পারবে। খচ্চর লোক না হলে এখনকার জমানায় রাজনীতি করা চলে না।একসঙ্গে কিছু লোকের কথাবার্তার শুনে প্রমথ মুখ তুলে সামনের দিকে তাকালো, বেশ কয়েকজন লাইন টপকে তার দোকানের দিকেই আসছে। একজনকে তার বলাই বলেই মনে হল। পিছনে তারক। আজ আর কোন মতেই মালের বোতল বার করবে না, এত রাতে আবার কি হল। ঝামেলা হুজ্জুতি লাগিয়ে রেখেছে, তা বাবা প্রমথর কাছে কেন। সে সাতেও থাকে না পাঁচেও থাকে না।
অনুমান ভুল নয়, বলাই’ই বটে। সঙ্গে এত লোকই বা কেন। ভাবার বেশী সময় পেলনা প্রমথ। দূর থেকেই বলাইএর গলা পাওয়া গেল, “প্রমথ কাকা দোকান বন্ধ করে আমাদের সঙ্গে চলো কাজ আছে”।
“এত রাতে কিসের কি কাজ রে, আমি এখন বাড়ী যাব, কোথাও যেতে পারব না।
“অমন করো কেন, এসো আমাদের সঙ্গে”।
“কোথায় যাব বলবি তো”।
“মোক্তারকে ঘেরা দিয়েছি, দীপালি চক্রবর্তীর বাড়ীতে , থানায় লোক গেছে বড়বাবু এলেন বলে”।
“এত রাতে মোক্তার ওখানে গেছে কি করতে”?
“সেটাই তো কথা, মোক্তারের সঙ্গে তোমার ভাল খাতির গিয়ে খালি জিজ্ঞাসা করবে এত রাতে বিধবার ঘরে ঢুকেছিস কেন?”
“দীপালি তো তোরও বৌদি তাকে কেন জিজ্ঞাসা করছিস না”।
“ সে মাগীকেই ছাড়ব নাকি, আগে মোক্তারের ব্যবস্থা হোক”।
“বলাই এটা তুই ঠিক করলি না , ওপর দিকে থুতু ছুঁড়লে নিজের গায়েই পড়বে”।
“ওসব জ্ঞানের কথা বাদ দাও দিকি, পুলিশ আসলে কিছু নিরপেক্ষ লোক থাকা দরকার”।
প্রমথ খানিকক্ষণ চিন্তা করল, এখন না গেলে মদের বাদবাকী দামটা কোনদিনই পাবে না। গেলেও ঝামেলা পুলিশ সাক্ষী মানবে, এককালে নানান ঝুট ঝামেলায় জড়িয়েছে এখন আর ওসব ভাল লাগে না।
“ চল তবে, পুলিশ কিছু জিজ্ঞাসা করলে আমি কিন্তু তোদের শেখানো কথা বলতে পারব না”।
“ তুমি যা দেখবে তাই বলবে, মোক্তারকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো না এত রাতে তুই কেন এখানে ঢুকেছিস”।
“তোর কিন্তু প্রধানকে একটা খবর দেওয়া উচিত ছিল”।
“তুমি কাকা রাজনীতির কিচ্ছু বোঝোনা, ওদের কেউ ডাকে? দিপালি বৌদি একটা সাদা কাগজে সই করে দিয়েছে, নরেনকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছি, শ্লীলতাহানির অভিযোগ”।
“কাজ তো পাকা করে রেখেছিস”- কথাটা বলে দোকান বন্ধ করে প্রমথ বলাইদের সঙ্গে হাঁটা দিল, বলাইটা দিন দিন শয়তানের গুরুমশাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পঞ্চায়েতটা হাতছাড়া হবার পর থেকে মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রমথ এখন বুঝতে পারছে , গোটা ব্যাপারটা সাজানো।তবে মোক্তারের মেয়েছেলের দোষ আছে। না হলে রাত বিরেতে বিধবা সোমত্ত মেয়েমানুষের ঘরে ঢুকবেই বা কেন। শরৎনগরে তো এসব নতুন নয়, কে কার ঘরে ধরা পড়ছে। কোন মেয়ে কার ঘরে উঠে পড়ছে। বেশীর ভাগ মেয়েই বিয়ের পর এঘর থেকে ওঘরে।দূরে কারুর বিয়েই হয়না। তারপরে কি নষ্টামি বন্ধ আছে। নোংরামির চুড়ান্ত। শালা এর নাম রাজনীতি। ঝাঁটা মার।
দীপালি চক্রর্বতীর ঘরে আলো জ্বলছিল, দরজা খোলা। তিন চারটে ছেলে ঘরের সামনের রাস্তায় পায়চারী করছে, আসলে মোক্তারকে ঘরে আটকিয়ে পাহারা দিচ্ছে। প্রমথ হন হন করে এসে ঘরে ঢুকে গেল, পিছলে বলাই। মোক্তার একটা চেয়ারে বসে আছে। তক্তপোষের এক কোণায় দীপালি মুখে শাড়ীর আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। “ঢং” মুখে না বললেও সেই ভাব বজায় রেখে প্রমথ সরাসরি মোক্তারকে জিজ্ঞাসা করল, “ এত রাতে তুই এখানে এসেছিস কেন রে”।
“বৌদি ডেকেছিল, অফিসে খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পেরেছে লোনের দরখাস্তে কি ভুল আছে তাই”।
“তুই বোকাচোঁদা আর সময় পেলি না। এলি যদি কাউকে সঙ্গে নিয়ে এলি না কেন ?”
“বিকালে বৌদি বলেছিল একবার দেখা করার জন্যে”। সঙ্গে সঙ্গে বলাই চেঁচিয়ে উঠল-“বাজে কথা বলো না মোক্তারদা, তাহলে বৌদি তোমার নামে আর এই অভিযোগ করত না, আর চিৎকার করে লোক ডাকত না”।
“ এসব তো তোদের শিখিয়ে দেওয়া”।
“দেখো মোক্তারদা, ফালতু কথা বলো না। আমি ছিলাম বলে তাই, তোমার গায়ে একটা কাঁটার আঁচড় লাগেনি, আশপাশের মানুষ এমন ক্ষেপেছে, শুধু আমি তাদের ঠান্ডা করে রেখেছি। আইন আমরা হাতে তুলে নেব না। কেউ কেউ তো সাম্প্রদায়িক রঙ চড়াতে চাইছে, ভাবতে পারছ সেটা হলে কি হবে তোমার?’
চাপান উতোর হয়ত আরো কিছুক্ষণ চলত, জিপ গাড়ী আলো দেখা মাত্র প্রমথ, বলাই ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
থানার বড়বাবু, গাড়ী থেকে নেমে ঘরের সামনে জমা লোকজনের ভিড় সরিয়ে দিলেন। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা নাকরে ঘরের মধ্যে ঢুকে এদিক ওদিক তাকিয়ে দিপালী চক্রবর্তীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি হয়েছে এখানে “।
ধীরে ধীরে মুখ তুলে বলতে শুরু করেছিল-“ সন্ধ্যে থেকে মাথা ব্যাথা করছিল, তাই ছোট আলো জ্বালিয়ে দরজা ভেজিয়ে শুয়ে ছিলাম, হঠাৎ আমার বিছানার ওপর…”। তাড়াতাড়ি বলাই ঘরে ঢুকে কাগজে লেখা অভিযোগ পত্র বড়বাবুর হাতে ধরিয়ে দিল, -“এতেই সব লেখা আছে বড়বাবু সব কথা সবার সামনে বলতে পারছে না, আমি লোকজন সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি আপনি ভাল করে জিজ্ঞাসাবাদ করুণ”।তখনই দীপালি আর এক দফা কাঁদতে শুরু করল।লিখিত অভিযোগে একবার চোখ বুলিয়েই বড়বাবু আর দেরী করলেন না। “উপ-প্রধান সাহেব গাড়ীতে উঠুন থানায় যেতে হবে”।
“মোক্তারও দেখল এর চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় আপাততঃ আর নেই, সুড় সুড় করে জিপের পিছনে ঊঠে বসল। সঙ্গে সঙ্গে বড়বাবুও জিপের সামনে উঠে বসলেন। বলাই ছুটে গিয়ে জিপ ছাড়ার আগেই বড়বাবুর পাশে গিয়ে দাঁড়াল, যেন কত জরুরী কথা বাকী থেকে গেছে , গলা নিচু করে বলল , “সাক্ষীরা সব এখানেই হাজির ছিল বড়বাবু”। বলাই চাইছিল নাটকটা আরো কিছুক্ষণ চলুক। বলাইএর ইচ্ছেয় জল ডেলে দিয়ে বললেন -“ওসব পরে হবে, এখন তদন্ত করার সময় নেই”। আসামীকে নিয়ে চলে যাওয়াই আশু কর্তব্য মনে করে রওনা হয়ে গেলেন। বিপক্ষ দল হাজির হয়ে গেলে গন্ডগোল অনিবার্য।
বলাই এর চোখে মুখে বিজয়োল্লাস, উপপ্রধানকে গ্রেপ্তার করিয়ে দিয়েছে। দল পাকিয়ে হাসি ঠাট্টা হচ্ছে।এটা চলবে বেশ খানিকক্ষণ। এরপর একটা মিছিল বার করবে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। বলাইএর এই পরিকল্পনা প্রথম থেকেই ভাল লাগেনি প্রমথর। রাত হয়ে গেছে এখানে দাঁড়িয়ে থেকেও লাভ নেই। দীপালি তার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। বলাইকে উদ্দেশ্য করেই প্রমথ বলল, “শুধু শুধু আমাকে ডেকে আনলি”।
“শুধু শুধু কি বলছ প্রমথ কাকা, তুমি তো আর আমাদের দলের নয়, বড়বাবু দেখে গেল নিরপেক্ষ লোক কিছু আছে, এরপর পুলিশ যেদিন তদন্ত করতে আসবে, তুমি সাক্ষী দেবে, মোক্তার তোমার সামনে বলেছে ও দীপালি বৌদির ঘরে ঢুকেছিল”।
“ তদন্ত আর করতে হবে না বড়বাবু বুঝতেই পেরেছে কোথা থেকে কি হয়েছে,”। প্রমথ আর দাঁড়ালো না, ফেরার পথে মনে মনে ঠিক করল রিহ্যার্সালের ঘরটা একবার ঘুরে যাবে। এখনো ওরা খবর পায়নি মোক্তারকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তাই বাড়ীর রাস্তা না ধরে বাঁদিকে মোড় নিল প্রমথ।

(৬)
মাজদিয়া আদর্শ সংঘের মাঠে আজ ফাইন্যাল খেলা। স্থানীয় দল জয়দেব স্মৃতি সংঘের সঙ্গে প্রদীপ বিশ্বাসের দল বাস্তুহারা স্পোটিং ক্লাব, এরা খেলতে এসেছে, এর আগে পাঁচটা ম্যাচ জিতে ফাইন্যালে উঠেছে। এত দূরে খেলতে আসার উদ্দেশ্য শীল্ডের সঙ্গে পঁচিশ হাজার টাকা ক্যাস প্রাইজ, এছাড়াও ম্যান অফ দ্য ম্যাচের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা। প্রদীপ একাধারে কোচ, খেলোয়াড়, অধিনায়ক সব কিছু। নিজের হাতে গড়া প্রত্যেকটি ছেলে। মনে মনে একটু আত্মশ্লাঘা অনুভব করে এর জন্যে। আজ মাঠে এসে শুনল বিপক্ষ দল কলকাতা থেকে বেশ কিছু খেলোয়াড় হায়ার করে নিয়ে এসেছে। তারা কেমন খেলে সেটা জানার থেকে বড় কথা হল এই খবরটা ছড়িয়ে দিয়ে বিপক্ষ দলের মনবলের ওপর আঘাত করা হয়। প্রদীপ এটা জানে, সহঃখেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে বলল, “শোন এতে ঘাবড়াবার কিছু নেই, কলকাতা মানেই যে ওরা তোদের থেকে ভাল খেলোয়াড় তার কোন মনে নেই। ওরা কলকাতায় খেলার সুযোগ পেয়েছে তোরা পাসনি গ্রামে আছিস বলে। হীনমন্যতায় ভুগবি না নিজেদের সেরাটা দেবার চেষ্টা করবি। এতগুলো টাকা পেতে হলে লড়াই করতে হবে”। সব শুনে হাবুল বলল, “ স্থানীয় দল, রেফারী ওদের টেনে তো খেলাবেই”। “ ওটা সব টুর্ণামেন্টেই হয়ে থাকে, লোকাল দলের ওপর পক্ষপাতিত্ব থাকবে, তবে প্রদীপদা ঠিক কথাই বলেছে , ওসব মাথায় না রেখে আমাদের নিজস্ব খেলাটা খেলতে হবে”। ওসমান একটু সাহসী খেলোয়াড়, ওর মুখে এই কথা মানায়। ওইই প্রদীপের টিমে মেন স্ট্রাইকার। গোলটা খুব ভাল চেনে। বিদ্যুৎ বলল, “পুলিশ এসেছে, গন্ডগোল হতে পারে”। বুটের লেস বাঁধতে বাঁধতে একবার মুখ তুলে দেখে নিল।
কয়েকজন পুলিশ চেষ্টা করছিল যারা খেলা দেখতে এসেছে সাইড লাইন ছেড়ে খানিকটা জায়গা রেখে যেন বসে। সামনের লোক বসলেও পিছনের দর্শকরা দাঁড়িয়েই থাকল। দর্শকদের প্রায় সকলেই জয়দেব স্মৃতি সংঘের সমর্থক। তবে কিছু বয়স্ক লোক আছে যাঁরা খেলা দেখতে দেখতে খেলোয়াড়ের গুণে সেই দলের সমর্থক হয়ে যান। এই কথাটাই প্রদীপ সেদিন বলছিল।এর আগে পাঁচটা ম্যাচ জিতে ফাইন্যালে উঠেছে, সেইসময় দর্শকরা ওদের খেলার প্রশংসাই।আজকে দর্শক সমাগম মন্দ নয়। যেহেতু স্থানীয় দল ফাইন্যালে খেলছে , সেই সাপোর্ট তো পাবেই।
ফুটবল খেলার একটা অলিখিত নিয়ম উভয়পক্ষই মাঠে নেমে যে কোন একটা দিক বেছে নেয় আর ফাঁকা গোলে একটা শর্ট করে। তারপর তো গোলকীপারকে প্র্যাকটিশ দেয়, বিভিন্ন ভাবে গোলে শর্ট নিয়ে, এইভাবেই দুপক্ষ খেলার আগে গা গরম করে নেয়। প্রদীপদের গোলকীপার নিখিল কম বয়সী ছেলে, ভীষণ এনার্জি। সারাক্ষণই লাফাচ্ছে। এটা কিছুটা নার্ভানেস কাটাবার প্রচেষ্টা। যতই হোক ফাইন্যাল ম্যাচ বুকের মধ্যে একটা গুরগুরুনি থাকে। বলটা গ্রিপ করার পর কখনো ছুঁড়ে, কখনো শর্ট মেরে সহ খেলোয়াড়ের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎই নিখিলের শর্ট মেরে ফেরত দেওয়া বল, খেলোয়াড়ের মাথা টপকে ড্রপ খেয়ে দর্শকের মাঝে চলে গেল। কিন্তু বলটা মাটিতে পড়ার আগেই গেরুয়া ধুতি পরা একটা লোক বাঁপায়ে বলটাকে নিয়ন্ত্রণে এনে ডান পায়ে ঘুরে গিয়ে ভলি করল। আশ্চর্যের কথা অতদূর থেকে বলটা উঁচু হয়ে বার পোস্টের প্রায় কোণ দিয়ে গোলে ঢুকে গেল নিখিলের কিছু বোঝার আগেই। দর্শককূল আনন্দে চিৎকার করে উঠল “গোল” বলে, সঙ্গে হাততালি থামতেই চায় না। ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক চোখে তাকাল প্রদীপ, গেরুয়া পোষাকে শরীর ঢাকা লোকটি তখন হাসছে। লম্বায় প্রায় ছ’ফুট, মাথায় হাল্কা কোঁড়ানো সোনালী চুল, গায়ের রঙ তামাটে। সন্ন্যাসীটি যে বিদেশী তা একনজরেই বোঝা যায়। পাশে আর একজন মাথায় একটু খাটো, তবে এদেশীয় বলেই মনে হয়, সেও হাসছিল।
কিছুক্ষণের মধ্যে খেলা শুরু হল বটে, কিন্তু কৌতুহল এমন জিনিষ প্রদীপ কিছুটেই তার স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারছে না। গোটা দলটাই কেমন যেন কুঁকড়ে রয়েছে। একটা বল নিয়েও সেন্টার লাইন ক্রস করতে পারেনি, ফাইন্যাল খেলার টেনসান, তা কেন এই ধরনের ম্যাচ তো ওরা আগেও খেলেছে, তাহলে। কিন্তু প্রদীপ নিজেই বা কি করছে, কিন্তু কে এই বিদেশী, কোথা থেকেই বা এল। যার একটা শর্টে দলের সবাই আচ্ছন্ন হয়ে গেল। রীতিমত অভ্যস্থ না হলে কি সম্ভব। মনটা এমন বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে, কৌতুহলের কারণে খেলায় মন দিতে পারছে না। এই দোনোমোনোর মাঝখানেই বাস্তুহারা স্পোটিং ক্লাব একটা গোল খেয়ে গেল। রক্ষণ ভাগ যেন দাঁড়িয়ে দেখল গোল হওয়াটা। গোটা মাঠ জুড়ে উল্লাস। বিপক্ষদলও নেচে মাঠে গড়াগড়ি খেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। এগুলো বিপক্ষদলের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। অনেক দিন ফুটবল খেলছে প্রদীপ জানে ওসব, তাই সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে সব খেলোয়াড়দের ডেকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যেটুকু বলার বলে নিল। অনেকবারই এরকম পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে, তাই ঘাবড়ালো না। পূর্ণ উদ্যোমে খেলা শুরু করল, তেমন কিছু ঘটার আগেই রেফারী হাফ টাইমের বাঁশি বাজিয়ে দিল।
সহ খেলোয়াড়ের সঙ্গে মাঠের বাইরে চলে গেলেও প্রদীপ কিন্তু খুঁজতে লাগল, সেই গেরুয়া পোষাকধারী সন্ন্যাসীকে। জমাট দর্শকের ভিড় ফাঁকা হয়ে মাঠের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। এত লোকের মধ্যে কাউকে খুঁজে বার করা সত্যিই কঠিন, ভরসা একটাই গেরুয়া পোষাক পরে তো আর কেউ থাকবে না । ফলে প্রদীপের চোখে পড়তে দেরী হল না। দুই সন্ন্যাসী ভিড় ছেড়ে কিছুটা দূরে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছে নীচে দাঁড়িয়ে আছে। উৎসুক চোখে প্রদীপ এগিয়ে গেল। সামনে গিয়ে ইংরিজিতেই প্রশ্ন করল, “ আর ইউ ফরেনার ফ্রম হুইচ কান্ট্রি?” “ইয়েস। আয়াম”। এরপরের কথাটা শুনে প্রদীপ অবাকই হল না তার অবিশ্বাস্য মনে হল। “বাট আই নো বেঙ্গলী লাইক ইউ”। “আপনি বাংলা জানেন?” “অবশ্যই, আমার নাম স্মরণানন্দ প্রভু, আমি ইস্কনের সন্ন্যাসী, ইনি কৃপামৃত প্রভু বাঙ্গালী”। হাত জোড় করে নমস্কার করল প্রদীপ। প্রত্যুত্তরে দুজনেই বলল, “হরে কৃষ্ণ”। প্রদীপের মুখ দিয়েও হরে কৃষ্ণ শব্দটা আপনাআপনি বেরিয়ে এল। “আপনি ফুটবলার ছিলেন?’ কথা শুনে স্মরণানন্দ প্রভু হাসলেও কৃপামৃত প্রভু বললেন, “আরে ওর দেশটাই তো ফুটবলের, উনি ব্রাজিল থেকে এসেছেন”। প্রদীপের একবার মনে হল নীচু হয়ে পায়ের ধুলো নেয়। নিজেকে সংযত করল। কি বলবে কি বলবে না ভেবে পাচ্ছিল না। সেই মুহুর্তেই রেফারীর বাঁশি দ্বিতীয় অর্ধের খেলা শুরু হতে চলেছে। “ আপনি যাবেন না খেলার শেষে আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে , কাইন্ডলি থাকবেন খানিকক্ষণ”। “ যে ছকে খেলছ তাতে হেরে যাবে, গোল শোধ করতে পারবে না”। মরিয়া হয়ে প্রদীপ জিজ্ঞাসা করল “তাহলে” “ফরোয়ার্ডে রাইট পজিশন থেকে একজনকে হাফে নামিয়ে দাও, রাইট ব্যাক কে ওভারল্যাপ করতে বলো বল ডিস্ট্রিবিউশন ভাল হবে, ওদের লেফট ইয়ং এ যে প্লেয়ারটা খেলছে ওকে মার্কিং করো”।
কোন রকম প্রশ্ন না করে ওই সন্ন্যাসীর কথামত দ্বিতীয় অর্ধে খেলা শুরু করে দিল বাস্তুহারা স্পোটিং ক্লাব,মিনিট পনেরোর মধ্যেই সকলে বুঝতে পারল প্রথম অর্ধের খেলার সঙ্গে দ্বিতীয় অর্ধের খেলার তফাৎ। রঞ্জিত একটু সক্রিয় হলে এক্ষুণি গোল শোধ হয়ে যেত। নিজে মারবে না ওসমানকে দেবে এই সিদ্ধান্ত নিতে যে সামান্য দেরী হল তাতেই ওদের রাইট ব্যক বলটা ক্লিয়ার করে দিল। যেহেতু তারা একগোলে জিতছে, তাই নিজেদের রক্ষণ ভাগে খেলোয়াড় বাড়িয়ে চলল, ফলে প্রদীপের দলে যাবতীয় আক্রমণ বারে বারেই প্রতিহত হয়ে ফিরে আসছিল। কোন অবস্থাতেই তারা এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে চাইছে না। সময় যত চলে যাচ্ছে নিজেদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। আক্রমণ ভাগের প্রতিটি খেলোয়াড়কেই কেউ না কেউ মার্কিং করে রেখেছে। গোলের মুখে জটলা হচ্ছে, কিন্তু গোল হচ্ছে না। খেলা শেষ হতে খুব একটা বাকী নেই। প্রদীপ প্রথম থেকেই একটু নেমে খেলছিল। বলটা ধরে রাইট ব্যাক কে পাস করে হাতের ইসারায় ওভার ল্যাপ করতে বলল,নিজেও ওর সঙ্গে মাঝ মাঠ দিয়ে দৌড়তে শুরু করল। যেহেতু বল রয়েছে ডান দিকের সাইড লাইনে সকলের চোখ সেই দিকে। প্রায় কর্ণার ফ্ল্যাগের কাছাকাছি গিয়ে মাইনাস করল নবেন্দু, ঠিক গোলের মাঝখানে নয় একটু আগে, ওদের একজন খেলোয়াড় উঁচু হয়ে আসা বলটা লক্ষ্য করছিল, প্রদীপকে সে দেখেনি। দুরন্ত গতিতে লাফিয়ে বলটা কপালের মাঝখান দিয়ে সামান্য ঘুরিয়ে দিল গোলের দিকে। গোলকীপারের বুঝতে সেকেন্ডের কয়েক ভগ্নাংশ দেরী হয়েছিল, তবু সে একটা সর্বাত্মক চেষ্টা করে। বলটা হতে লেগে গোলে ঢুকে যায়। নিজেরা কোন্রকম সেলিব্রেট করল না। সামান্য দু’একটা হাততালি। সেন্টার হবার দু’মিনিটের মধ্যেই খেলা শেষের বাঁশি বেজে গেল।
মানসিক ভাবে প্রদীপরা প্রস্তুতই ছিল অতিরিক্ত সময় খেলার জন্যে। এইভাবেই সহ খেলোয়াড়দের নির্দেশ দিচ্ছিল পরর্বতী সময়ে কি করতে হবে। হঠাৎ চমক ভাঙ্গল খেলা সুরু হতে দেরী হচ্ছে। এর পরের ঘোষণা হল কোন অতিরিক্ত সময় খেলা হবে, উভয় দলকে যুগ্ম বিজয়ী ঘোষণা করা হল। যেহেতু স্থানীয় দল টুর্নামেন্ট কমিটি কোন রকম ঝুঁকি নিল না, যুগ্ম বিজয়ী ঘোষণা করে দিল। দ্বিতীয়ার্ধে প্রদীপদের খেলা দেখে হয়ত মনে হয়েছিল স্থানীয় দল হেরে যেতে পারে।তাই এই সিদ্ধান্ত। পুরস্কার বিতরণী সভা কিছুক্ষণের মধ্যেই আরম্ভ হবে। প্রদীপের আর কোন উৎসাহ নেই, সহঃঅধিনায়ক বিজয়কে বলে দিল পুরস্কার নিতে। উৎসুক চোখে ভেঙ্গে যাওয়া ভিড়ের মধ্যে খুঁজে বেড়াতে লাগল সেই গেরুয়া ধারী দুই সন্ন্যাসীদের

( ক্রমশঃ )

This Post Has 3 Comments

  1. দারুন লাগলো। পরবর্তী অংশের অপেক্ষায় রইলাম।

  2. Namami

    আগ্রহ বাড়ছে। চলুক

  3. Debabrata Basu

    ঝরঝরে গতিশীল লেখা, যদিও অতি পরিচিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এই মুহূর্তে কিছু বলার নেই কারণ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে। পাঠকরা তো জানে না “পথের শেষ কোথায় কি আছে শেষে”… তাই সেখানেও ক্রমশ।

Leave a Reply