রেল লাইনের পাশের ঝুপড়ি থেকে একতারার সুরেলা টুংটাং সাথে খঞ্জনীর সঙ্গতে ভেসে এলো মায়াবী মহিলা কন্ঠ “ সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সবই দেখি তা না না না, জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা”। ঝুপড়ির ভেতরে নুলো বিস্টু আর চোখে দেখতে না পাওয়া শেফালী জোর কদমে অনুশীলন করছে , আজ যে বাংলাদেশ থেকে উরুশ উৎসবের স্পেশাল ট্রেন আসবে তীর্থ যাত্রীদের নিয়ে। দাঁড়াবেও বেশ খানিকক্ষণ।সেই উপলক্ষে স্টেশন চত্বরের আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেছে। স্বাধীনতার আগে এই লাইনে ঢাকা মেল চলত, এখন অবশ্য ডিএম ইউ কোচ চলে। যে কারনেই এখানকার মানুষজনের সঙ্গে রেললাইন আর ট্রেনের নিকট সম্পর্ক। ট্রেন আর রেল-লাইনকে ঘিরে অনেকের জীবন জীবিকা। স্টেশন ঘিরে যেসব লোক বসতি তার বেশীরভাগই হকার, বাদাম ভাজা, ঝালমুড়ি, আচার, সাবুর পাঁপড়, ফলের মধ্যে শসা আর কলা আপেল চলন্ত ট্রেনের কামরায় বিক্রী করে।
শীতকালের দুপুরে মাঝবয়সী মেয়েরা রেল লাইনে বসেই রোদ পোহায়,কেউ আবার উল বোনে।হাঁটুর সমস্যা যাদের তাদের অনেকেই মোড়ায় বসে জমিয়ে পরচর্চা করে। রেল লাইনের মাঝখানের কুলোর ওপর সাদা কাপড়ে সদ্য দেওয়া বড়ি, আচারের বয়াম, শুকনো হবে বলে লাল লঙ্কা,আরো কত কি রাখা থাকে, দুপুরের রোদে।কেউ কেউ রেল-লাইনে ঘসে ঘসে বঁটি কাটারি ছুরিতে শান দিয়ে থাকে। বাচ্ছারা হামা দিয়ে রেললাইনের পাশে নুড়ি পাথর নিয়ে খেলা করে।কেউ কেউ লুডো বিছিয়ে জুয়া খেলে, তবে কিছুটা দূরে, লোকচক্ষুর একটু আড়ালে। দূর থেকে ট্রেন আসা দেখামাত্রই হুটোপাটা পড়ে যায়।যে যার জিনিষ সরিয়ে লাইনের পাশে এসে দাঁড়ায়।ট্রেনের ড্রাইভারের এসব জানা, অনেক দূর থেকেই হুইসিলের তীব্র আওয়াজে সকলকে সজাগ করতে করতে এগিয়ে আসে ট্রেন মন্থর গতিতে । আগে ছিল কয়লার ইঞ্জিন,এখন ডিএম ইউ ট্রেনের গতি বেশি। তবে কোন অপঘাতের ঘটনা শোনা যায়নি কখনো। সদাই সতর্ক মানুষজনের সঙ্গে ট্রেনের আত্মিক সম্বন্ধ। এখন তো আর এই লাইন দিয়ে মেল এক্সপ্রেস চলে না।বছরে ওই একবারই বাংলাদেশের থেকে উরস্ তীর্থযাত্রীদের নিয়ে একটা স্পেশাল ট্রেন আসে আবার ফিরে যায় ,তার আগাম ঘোষণা থাকে, দু চারটে খাঁকি পোষাকের পুলিশ ডিউটি করে।গোটা এলাকা জুড়ে তখন উৎসবের হিড়িক, ছেলে বুড়ো মেয়েদের সেকি উৎসাহ, হুল্লোড় গোটা স্টেশান চত্বরে, প্ল্যাটফরম জুড়ে তাদের জমায়েত। যাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ ট্রেন থেকে নেমে এদিক ওদিক দেখে , কেউ আবার এখানকার বাজারদর নিয়ে স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে। এদের সকলের বাপ ঠাকুরদা একসময়ে ওই দেশেই তো ছিল। ভিন্ন ধর্মী হলেও কোথায় যেন একটা অদৃশ্য টান অনুভব করে উভয়পক্ষেই। কারো বাড়ি যদি চেনা গাঁ’ঘরে হয়ে থাকে, খোঁজ খবর নেয় সেখানকার প্রতিবেশীদের-“ কোথায়? বরকত মন্ডলের বাড়ির কাছে, আছেন কেমন তিনি, ………………………হায় হায় হায় ইন্তেকাল হয়ে গেছে, তা তো হবেই, তখনই তো বয়স হয়েছিল ভালই। তারপর ট্রেন একসময় ছেড়ে চলে যায়, আলোচনা চলতে থাকে সপ্তাহ ভোর। রোজকারের একঘেয়ে জীবনে এ এক অভিনব বিনোদন। ঘোষনা হবার পর থেকেই প্রত্যেকের বাড়িতেই ভাজা বাদাম ছোট ছোট পলিথিন প্যাকেটে ভরে মোমবাতির আগুনে তার মুখ জুড়ছে ছেলেবুড়ো মেয়েরাও। কেউ তৈরী করছে তিলের তক্তি, সাবুর পাঁপড়, আরো কত কি ব্যস্ততার অন্ত নেই। বিগত বছরের অভিজ্ঞতায় দেড়া দামে বিক্রী হয়েছিল এসব । গতবারে ফিরিতি ট্রেনে গামছা, লুঙ্গী বিক্রির বহর দেখে রমেশ, ভুবন এবারে গেছে নবদ্বীপ। ট্রেনে ট্রেনে ভিক্ষে করা বিষ্টু শেফালীও সবার মত আশায় বুক বেঁধেছে গান শুনিয়ে যদি কিছু বাড়তি রোজগার হয়। শেফালীর গলায় যাদু আছে একবার শুরু করলেই হরির লুটের মত টাকা পয়সা পড়ে। তীর্থযাত্রীদের মধ্যে সাধু সন্ত’রা থাকে, লালনের গানের কদর হবে নিশ্চয়ই। নুলো বিষ্টুর হাতে খঞ্জনী বেঁধে দেয় শেফালী, নিজে তো বাঁধতে পারে না। গানের সঙ্গে খঞ্জনীর ঠেকা দেওয়া জরুরী। মাঝে মাঝে শেফালীর সঙ্গে গলা মেলায় বিষ্টু , কিন্তু তা আলাদা করে লোকের কানে ধরা পড়ে না। একদিন এই ট্রেনে ভিক্ষে করতে করতে শেফালীর দেখা পেয়েছিল বিস্টু, চোখে দেখতে পায়’না বলেই খঞ্জনীর সঙ্গতে অন্ধ চোখের নজর কেড়েছিল, তাই বোধহয় পছন্দ করেছিল বিস্টুকে। নিজের তো কালো মোষের মত চেহারাটা ছাড়া তার আছেই বা কি,তা দেখলে কি আর শেফালী পছন্দ করত বিস্টুকে । নুলো মানুষের সব কিছুতেই অসুবিধে, শেফালী থাকাতেই অনেকটাই সুরাহা হয়েছে তারপর দেখতে দেখতে তিন বছর হয়ে গেল ওদের ঘর করা । বিষ্টু ভেবেছিল বাচ্চা কাচ্চা একটা হবে ওদের, কোলে বাচ্ছা থাকলে ট্রেনের বাবুদের ইচ্ছে না থাকলেও পয়সা দেয়। কিন্তু প্ল্যাটফরম ঝাঁট দেয় বিহারী রুকমনি বিষ্টু কে একদিন গোপনে বলেছিল “ তোর ঘরওয়ালি শেয়ানা আছে রে বিষ্টু, আমাকে দিয়ে ওষুদের দোকান থেকে ট্যবলট আনায়”। বিষ্টু আর শেফালীকে এসব জিজ্ঞাসা করেনি- ভেবে দেখেছে বাচ্ছা হলেও তার হাজার ঝকমারি। তার চেয়ে বেশ আছে। শেফালী গেয়ে উঠল- বিষ্টু খঞ্জনী বাজাতে বাজতে মাথা নাড়ে। কার কি জাত নিয়ে কোন মাথাব্যাথা ছিল ওদের কোনদিনই, তাই তো প্রাণ খুলে গাইতে পারে-
আসবার কালে কি জাত ছিলে/এসে তুমি কি জাত নিলে।/কি জাত হবা যাবার কালে/সেই কথা ভেবে বলো না।।
(২)
আজ স্টেশনে বেশীরভাগ ভিড় কিন্তু হকারদের। ট্রেনের খবর না হলেও যে যার সামগ্রী নিয়ে প্ল্যাটফরমে পায়চারী করছে হেঁকে হেঁকে। স্টেশন চত্বরে যেন মেলা বসেছে। কৌতুহলী কিছু মানুষ জড় হয়েছে বটে তাদের ওসব কেনার আগ্রহ নেই। কিন্তু নিজেদের মধ্যে কথাবার্তার বিরাম নেই, তাই সরগরম প্ল্যাটফরম চত্বর। স্টেশনের বাইরে রাস্তার ধারে প্রমথ’র পান, বিড়ি, সিগারেটের গুমটি। সেও পানের গোছা ছোট ছোট পাত্রে খয়ের চুন, সুপারি, জর্দা আরো অন্যান্য মশলাপাতি, সিগারেটের প্যাকেট, বিড়ির বান্ডিল, দেশলাই কাঠের ট্রেতে গলায় ঝুলিয়ে , হাঁকাহাঁকি ছাড়াই ডাটের মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। জানে নেশার বস্তুর টান পড়লে আপনা আপনি তার ডাক পড়বে। নবীনের একটা ঝুড়িতে বেশ কিছু জলের বোতল, বিকৃত গলায় সুর করে মাঝে মাঝে ডাক ছাড়ছে ‘মিনারেল ওয়াটার’। এখানে সবাই জানে ওগুলো মিনারেল ওয়াটার নয়, কলের জল বোতলে ভরে সিল করা।রেলযাত্রায় খাবার জল অপরিহার্য, তেষ্টা পেলে তখন কেউ আর বাছবিচার করবে না। মহেশ একধারে উনুন জ্বালিয়ে আলুর চপ, বেগুনি, পেঁয়াজি ভাজা শুরু করেছে, সঙ্গে বেশ কয়েকটা মুড়ির প্যাকেট।মহেশ ভাল করেই জানে শুধু ট্রেনের যাত্রী নয়, যারা জমায়েত হয়েছে তারাও মুখ চালাবে একটা সময়ের পর। এখনই দু,একজন ছোট ঠোঙায় মুড়ির সঙ্গে আলুর চপ নয় ফুলুরী খেয়ে সময় কাটাচ্ছে। প্ল্যাটফরমের এক কোণে নানান বয়সী মেয়েদের ভিড়, লতিকা, প্রতিমা, মেনকা , সদ্য বিয়ে হওয়া বনানী, কমবয়সী রূপালী, শিখা, মনুর মা। মেয়েদের তো একটা বয়সের পরে নাম থাকে না, মাসীমা, জেঠিমা কাকীমা, নয়তো ছেলেমেয়ের নামে মা, আসল নাম’টা ভুলেই যায় লোকে। এদের বকবকানির শেষ নেই, কি যে কথা হচ্ছে কে জানে , মাঝে মাঝেই হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ছে। চীৎকার চেঁচামেচিতে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে বিস্টু শেফালীর গান । হঠাৎই সবাই সচকিত হয়ে উঠল, স্টেশন অফিসের পাশে তার দিয়ে ঝোলানো একটা রেললাইন ভাঙ্গার টুকরো। কেউ একজন এসে একটা ডান্ডা দিয়ে বেশ কয়েক ঘা পিটিয়ে দিল। টং, টং , টং। তার মানে ট্রেন দর্শণা স্টেশন ছেড়ে ভারতে ঢুকছে এবার ।ব্যস চীৎকার চেঁচামেচি সোরগোল শুরু হয়ে গেল নিমেষেই। স্টেশন অফিসের সামনের দিকে বাড়ানো টিনের চালে একটা ফিঙ্গে পাখি বসেছিল, হৈচৈ চীৎকার চেঁচামেচিতে সেও উড়ে গেল সীমান্তের দিকের মুক্ত আকাশে। ওর তো সীমান্ত পার হওয়ায় কোন বিধি নিষেধ নেই। অনেকেই প্ল্যাটফরমের কিনারায় দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়েছে ট্রেন আসছে কিনা দেখার জন্যে । এইমাত্র ওখানকার স্টেশন ছাড়লেই যে এখানে এক্ষুনি দেখা যাবে তার কোন মানে নেই। লোকজনের ব্যস্ততা কৌতুহলের তো শেষ নেই। অনেকেরই ধারণা দর্শণা আর এমন কি দূর। কারণ বাংলাদেশ যেতে হলে , গেদে আই সি পিতে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র দেখিয়ে লিখিত অনুমতি হাতে নিয়ে রেল লাইন ধরেই হেঁটে দর্শনায় গিয়ে স্টেশনে উঠতে হয় । মালপত্র বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে কুলি মজুর পাওয়া যায়। সেখান থেকে বাংলাদেশের ট্রেন। তাই হেঁটে যখন যাওয়া যায় তাহলে দূর তেমন কিছু নয়। সময় চলে যায়, তখনও ট্রেনের দেখা নেই। লোকজনের ছটফটানি বাড়ে সঙ্গে হাসি ঠাট্টা বজায় থাকে । এমনিতেই ট্রেন অনেক লেটে আসছে। অতি উৎসাহী অনেকেই ওভারব্রিজে উঠে পড়েছে, সেখান থেকেই অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়।রেল লাইন সোজা চলে গেছে ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে, শুনে শুনে সকলেই জেনে গেছে ওই দূরে লাইনের ধারের জমিতে যে একটা পাকুড় গাছ সেটা পার হলেই বাংলাদেশের জমি। বেশ কয়েকজন বিএসএফ জোয়ান সমীহ জাগানো ভঙ্গিতে প্ল্যাটফরম ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর ওভারব্রিজের ওপরে যারা ঊঠেছিল হৈ হৈ করে নেমে আসছে সিঁড়ি দিয়ে দুড়দুড় করে। তার মানে ট্রেন দেখা গেছে । আর তো ওপরে থাকার কোন মানে হয় না। নীচের লোকজন ঝুঁকে দেখতে চাইছে আর কত দূরে। পুলিশ প্ল্যাটফরমের ধার থেকে লোকজনদের নিরাপদ দুরত্বে সরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। জমায়েত হওয়া লোকের বিচারে পুলিশের সংখ্যা নেহাতই নগণ্য। পঞ্চায়েত মেম্বার রসিদ আলি নিজেকে প্রশাসনের একজন মনে করে, সেও পুলিশের দলে ভিড়েছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় তারও যে একটা ভূমিকা আছে, সেটা প্রমাণ করতে লেকচার দেওয়ার ভঙ্গিতে বোঝাতে চেষ্টা করছে জড় হওয়া লোকজনদের । অধিকাংশই সেসব কথার বড় একটা কান দিচ্ছে না, কেউ কেউ এমন মন্তব্য করতেও দ্বিধা করছে না এ তো আর গাঁয়ে ঘরের কাজিয়া নয়,এখানে তোমার মাতব্বরী কে শুনবে, বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টায় বিরক্ত হয়ে ক্ষান্ত দেয় রসিদ আলি। বিজবিজ করে জমায়েত লোকজনের উদ্দেশ্যে বিষ ওগরাতে ওগরাতে সেও হয়ে যায় জনগনের একজন। এরপরেই কিন্তু শুঁয়োপোকার চলনের মত গুড়গুড় করে অনেক দূর থেকে এগিয়ে আসা ট্রেনের ইঞ্জিন দেখা যায়। হকারদের সোরগোলের মধ্যেই এবার কিন্তু শোনা গেল শেফালী গান “ জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারকারখানা” সঙ্গে বিস্টু নুলো হাতে খঞ্জনী থাবড়ে চলেছে।তারপরেই সব কিছুই ঢাকা পড়ে গেল ইঞ্জিনের বিকট ঘসঘস শব্দে স্টেশনে ঢুকে পড়ায়। এতটা এসে ইঞ্জিন’টা তখনো দম ছাড়ছে।
ট্রেন এসে দাঁড়ানো মাত্র, কিছু যাত্রী নামতে চায়, হকার’রাও উঠতে চায়, একপ্রস্থ ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি মুহুর্তেই শুরু হয়ে গেল । কেউ কেউ চীৎকার করছে, “ এটা ইস্পিশাল ট্রেন কোন হকারভাই উঠবে না মানা আছে । নিষেধাজ্ঞা জারী করলেই তো আর হয় না,সেটা কার্যকর করার কেউ না’থাকায় মানছে আর কে। বিভিন্ন কামরায় যে যার মত উঠে পড়ল হকার,রা সেই নিয়ে সুরু হয়ে গেল একদফা ঝগড়াঝাঁটি। তবে তার স্থায়ীত্বকাল বেশীক্ষণ নয়। কারণ ঝগড়া চলাকালীন তীর্থ যাত্রীদের মধ্যেই কেউ সাবুর পাপড় কিনে ফেলল। কেউ ঝালমুড়ির অর্ডার দিয়ে নারকেলের ’টুকরো যেন দুটো দেওয়া হয় বলে দেখতে লাগল মুড়ি মাখার তরিকা । এবারে বাদাম পাটালী পাওয়া যাচ্ছে না খেজুর গাছ তো তোমাদের এখানে বিস্তর। নানান প্রশ্নোত্তরে পারস্পরিক ব্যবসায়িক লেনদেনের গভীরতার মধ্যে হকারদের ট্রেনে উঠতে না দেওয়ার নিষেধাজ্ঞার ওপর আর কোন গুরুত্ব থাকল’না।
কেউ কেউ প্ল্যাটফরমে নেমে চায়ের খোঁজ করে, গলা ভেজানো দরকার বলে। মাটির খুরি আর চায়ের কেটলী নিয়ে বিশু তো হাজির। কেউ আবার স্থানীয়দের কাছে খোঁজ নেয়-“ আদাব বড়ভাই, মন্ডলপাড়া কোনদিকে বইলতে পারেন? “ মন্ডলপাড়া? সে তো গাঁয়ের ভিতর, ইস্টিসন লাগোয়া নয়। কেন কি হইছে ?” “ রফিকুল, আমার বিবির মামাতো ভাই, ছাতা সারাই করে, আইসছে নাকি এহানে ?’ “ জানা নাই,ওরা শহরের দিকে ঘুরে বেড়ায়”। “ দেখা হয়”। “ মাঝে মাঝে হয় বৈকি”। “ কইবেন না আসলাম ভাই উরুসে যাওন কালে খোঁজ করছিল”।
ট্রেনের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বোরখা ঢাকা মহিলা কাউকে লক্ষ্য করে বলে “ ওঃ!শুইনছ চইল্ল্যে কুথা টেরেন ছাইড়া দিবা”। প্ল্যাটফরমে একজন “ ওঃ মকবুল চাচা তোমার বিবি কি কয়”। সে কথা উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করে না মকবুল চাচা। তবে তার চেহারা’টা এমনই, সকলের নজর কাড়ে। রোগা তেঢ্যাঙ্গা লম্বা, সবলোকের মাথা ছাড়িয়ে তাকে দেখা যায়, মাথায় কলপ করা চুল অর্ধেক হলদেটে হয়ে গেছে, চিবুকে ছোট্ট নূর, বগলে জলের বোতল, পরনে সাদা লম্বা আলখাল্লা যার ঝুল পায়ের গোড়ালি অবধি, লুঙীর সরু পাড় খালি দেখা যাচ্ছে। ট্রেন থেকে নেমে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে চলেছে প্ল্যাটফরমের শেষপ্রান্তের দিকে। মেয়েরা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল একটু ফাঁকা জায়গায়। তাদের সামনে পার হয়ে যেতেই বনানী চাপা গলায় বলল- “লোকটার তো লুঙ্গী না পরলেও চলত কি বলিস প্রতিমা”। প্রতিমা লুঙ্গী না পরলে কি হত সেই কথা বলতেই সকলেই হেসে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ল। তখনই মকবুল চাচা মেয়েদের হাসির কারণ অনুমান করে বিষ নজর হেনে খানিকটা দূর থেকে একটা মাটির ঢেলা কুড়িয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে প্ল্যাটফরম থেকে নেমেগেল । রেললাইন ধরে কিছুটা এগিয়ে যায় ঝোপ জঙ্গলের ধারে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে পড়ল হাল্কা হতে । মেয়েরা সেইদিকেই তাকিয়ে ছিল। ঢেলা কুড়ানো রহস্য অনেকের কাছে পরিষ্কার না হওয়ায় মনুর মা ব্যাখা করল সবিস্তারে। তখন হাসি আর থামতে চায় না ওদের মধ্যে। ইতিমধ্যে ভিড় ঠেলে শেফালী উঠে পড়ছে একটা কামরায়, উঠেই গান শুরু করে দিয়েছে । “ ব্রাহ্মণ, চন্ডাল , চামার , মুচি, এক জলে হয় সব গো শুচি, দেখে শুনে হয় না রুচি যমে তো কাউকে ছাড়বে না।নুলো বিস্টু হাতল ধরতে পারে না , অনেক কষ্টে কামরায় ওঠার চেষ্টা করে কিন্তু ভিড়ে আটকে পড়েছে,কেউ আর জায়গা ছাড়চ্ছে না।হকার আর তীর্থযাত্রীদের ভিড়ে দরজা জ্যাম। শেফালী একে অন্ধ তায় মেয়েমানুষ গান শুনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনগুলো সরে গিয়ে ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু ট্রেনের দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনকে ঠেলে ভেতরে যাবার ক্ষমতা তার নেই বিস্টুর । কাতর মুখে বলে “ একটু জায়গা দ্যান না ভাই, আমার পরিবার গান করছে”। নুলো ভিখিরির কথা কেই বা কান দেয়, কোনক্রমে বিস্টু ভেতরে ঢোকে বটে কিন্তু সেখানে জমাট ভিড়ে আটকে যায়। তবে শেফালী ভেতরে যখন একবার ঢুকতে পেরেছে তার আর কোন দ্বিধা নেই। জানলার ধারে বসেছিল কমবয়সী আউল বাউল গোছের একজন, পরনে কালো আলখাল্লা,তারও ফরসা চিবুকে ছোট্ট নূর, বড় বড় চোখে জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিল। খেয়াল করেনি শেফালীকে, গানের সুর কানে যেতেই দোতারা হাতে উঠে দাঁড়িয়েছে। দোতারা সুর ধরতেই শেফালী গান থেমে যায় , এমন তো হবার কথা ছিল না। কোথায় বিস্টু?সে লোকজনের ভিড়ে এগোতে পারছে না। গান থামতেই দোতারা বাজিয়ে শেফালীর উদ্দেশ্যে বলে “ আরে আরে থামলে কেন গাও গাও, এহানে বসো”। এদিকে দোতারার সুরেলা বাজনা সাথে শেফালীর গান সুরু হতেই মুহুর্তেই পরিবেশ’টাকেই পালটে যায়। ভিড়ও বাড়ল ওদের ঘিরে। খঞ্জনী বাঁধা হাতে বিস্টুর কানে আসে দোতারার মীঠে সুরেলা আওয়াজের সাথে শেফালীর গান। সে ওখানেই খঞ্জনী বাজাতে চেষ্টা করে নুলো হাতে ভিড়ের ঠেলায় তাল রাখতে পারে না, স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না ধাক্কাধাক্কিতে। ভিড় করে থাকা লোকগুলো তাকে কিছুতেই ভেতরে যেতে দিচ্ছে না। কামরা অন্য প্রান্তে শুরু হয়ে গেছে চেঁচামেচি। ভিড় ট্রেনে কারো নাকি মোবাইল ফোন আর মানিব্যগ খোয়া গেছে। দুটো মুশকো লোক বিস্টুকে দেখেই বলে “ এই লোকটাই তো কিছুক্ষণ আগে ঘুর ঘুর করছিল “। বিস্টুর কিছু বলার আগেই তার মুখে একটা ঘুসি মারে, বাধা দেবার আগেই মারতে মারতে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয়। প্ল্যাটফরমে ঝামেলা শুরু হতেই স্থানীয় আশপাশের লোকজন ছুটে আসে, “ আরে আরে করেন কি মারেন কেন ওরে ?” “ পকেটমারি হয়ে গেছে মোবাইল ফোন, মানিব্যগ”। আশাপাশের লোকজন হৈ হৈ করে ওঠে- “ একটা নুলো লোক পকেটমারতে পারে ইন্ডিয়ায় ঢুকে যা ইচ্ছা করবা নাকি কি ভেবেছ কি তোমরা ছেড়ে দেব আমরা। এতক্ষণ যারা মারধোর করছিল থমকে যায়, বিস্টুকে ভাল করে লক্ষ্য করা হয়নি ।বেগতিক দেখে দেরী না করে সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনের কামরায় উঠে ভিড়ে মিশে যেতে চায় লোকগুলো। বিস্টুর ঠোঁট দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিল। দু’একজন তাকে ধরে নিয়ে স্টেশনের বেঞ্চে বসায়, কেউ আবার ঠোঁটে জল থাবড়ে ব্যাথা কমানোর চেষ্টা করে। ঠিক তখনই ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দেয়। “ শেফালী শেফালী” বলে চিৎকার করে ছুটে যায় বিস্টু ট্রেনের কামরা লক্ষ্য করে। কিন্তু বিকলাঙ্গ হাতে ট্রেনের হাতল ধরতে পারে না, ট্রেন গতি নিয়ে নেয়। পিছন থেকে কে যেন বলে বারণ করে। নিজের অক্ষমতা জানে বলেই দাঁড়িয়ে পড়ে বিস্টু, ট্রেন’টা ধীরে ধীরে তার দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। স্টেশন প্ল্যাটফরমের এতক্ষণের যে হৈচৈ চেঁচামেচি মুহুর্তেই যেন কেমন ঝিমিয়ে পড়ে। ভিড় হাল্কা করে যে যার ফিরে যাচ্ছে ঘরে। বিষ্টু দাঁড়িয়ে আছে দূরের দিকে তাকিয়ে।
বিকালের আলো আস্তে আস্তে মরে যাচ্ছে, স্টেশনের অফিসঘরের বাইরে একটা পুরানো মিটমিট করা আলো জ্বলে উঠল, সেই ক্ষীণ আলোর বৃত্তে এখন বিস্টু ছাড়া আর কেউ নেই প্ল্যাটফরমে, বেশ কিছুটা দূরে রুকমণি ঝাঁট দিয়ে কাগজের কাপ, ছেঁড়া ঠোঙা, গাছের পাতা জড় করছে। বিস্টুর কাছে আসে পায়ে পায়ে, নুলো হাতে বাঁধা খঞ্জনী খুলে তার কাঁধের ঝোলায় রেখে দেয়। “ যা ঘরে যা বিস্টু তোর ঘরওয়ালি শেফালী ঠিক ফিরে আসবে”। সংশয় থেকে যায় বিস্টুর –
“ বলছিস! কিন্তু ওর গানের সঙ্গে যে একজন দোতারা বাজাচ্ছিল ।