নীলাংশু চোখ মেলে জানলার সার্সির দিকে তাকাতেই দেখল ভোরের স্নিগ্ধ আলো ফুটছে। মনটা আনন্দে ভোরে উঠল।আজ আরো বেশীক্ষণ সে হাঁটা চলা করতে পারবে। বারো পার করে তেরোয় পা দিতে চলেছে সে, তাহলে হবে কি। গতকাল সে দ্বিতীয়বার হাঁটতে শিখেছে।প্রায় দশ এগারো মাস হাসপাতাল,নার্সিং হোম,বাড়ীর বিছানাতেই কেটে গেছে। কখনো চোখ খুলে দেখেছে সকাল, আবার চোখ বন্ধ করে কোন অতলে তলিয়ে গেছে,যখন চোখ খুলেছে তখন ইলেকট্রিক ল্যাম্প জ্বলছে।কিভাবে যে দিন গুলো কেটেছে সে নিজেও জানত না।অনেক চেষ্টার পর সে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। কিন্তু পায়ে তার তেমন জোর ছিল না। টলে পড়ে যেত,চলতে পারত না।ডাক্তারবাবু আশ্বাস দিতেন, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।মা ঠাকুমা বলত তোকে আমরা যমের মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছি।ভগবান যখন একবার সদয় হয়েছেন,তখন নিশ্চয়ই চলতে পারবি। সকাল বিকাল দিদি যেদিন যেদিন থাকত, ধরে ধরে হাঁটিয়ে বারান্দা পর্যন্ত নিয়ে যেত। সেখানে চেয়ার পেতে খানিকক্ষণ বসে আবার ফিরে আসত বিছানায়।এই ছিল তার নিত্যকার রুটিন।বাবার বদলীর চাকরী,দূরে থাকেন ফোনে ফোনেই খবর নেন যা কিছু।
আস্তে আস্তে ভোরের আলোয় ঘরের অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। নীলাংশু কাল দুপুরে এতদিন পরে হাঁটতে পারার কথাটা মনে করেই আনন্দ পাচ্ছিল।দিদি কুন্তলা চৌধুরী ক্রিকেট খেলে।লাস্ট সিজ্নে বেঙ্গল রিপ্রেজেন্ট করেছে। শুয়ে শুয়ে নীলাংশুর বুক গর্বে ভোরে উঠত।দিদি বলত, “তুইও খেলবি, সেরে ওঠ, আমি তোকে কোচিং দেব”। জানিস তো আমি বল ব্যাট দুটোই করতে পারি, অলরাউন্ডার।মনে মনেই নিজেকে মাঠে নিয়ে যেত নীলাংশু।দিদির কাছ থেকে শোনা ব্যাটিং এর নানান কায়দা কানুন প্রয়োগ করত জেগে জেগে স্বপ্নের মধ্যে। কারণ এছাড়া তো তার বিনোদন বলে কিছু ছিল না। ডাক্তারের নিষেধে বই বা খবরের কাগজ পড়তে দেওয়া হত না। এতে যে তার স্ট্রেন হবে তাই নয়, সামান্য উত্তেজনার ধকলও শরীর নিতে পারবে না হয়ত।টিভিও দ্যাখে খুব সামান্য সময়ের জন্যে।মা ঠাকুমার কড়া নজর ডাক্তারবাবুর নিষেধাজ্ঞার যেন এতটুকু হেরফের না হয়।
গতকাল দিদি সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে, প্র্যাকটিস আছে।ফলে হাঁটা হয়নি। মা একবার বাথরুমে নিয়ে গিয়েছিল।ব্যস ওই পর্যন্ত। এখন মাঝে মাঝে খবরের কাগজের হেড লাইন গুলোয় চোখ বোলায় বিশেষতঃ খেলার পাতায় । তাই একবার খবরের কাগজটা চাইছিল মায়ের কাছে। মা বলেছিলেন এখন নয়,পরে। সেই থেকে বিছানায় কখনো শুচ্ছে ,বসছে।এই ভাবেই সময় কাটানো যায়, দিদি থাকলে না হয় অনেক গল্প করে। খেলার গল্প।ব্যাট নিয়ে দিদি স্যাডো প্র্যাকটিশ করে,দেখায় কিভাবে কভার ড্রাইভ করতে হয়।স্কোয়ার কাট্, পুল আরো বিভিন্ন ধরনের স্ট্রোক এর সময় পায়ের পজিশন, ব্যাট কিভাবে চালানো হচ্ছে,কবজীর মোচড় আরো কত খুটিনাটি। হাঁ করে নীলাংশু দেখত দিদির স্যাডো প্র্যাকটিশ।কয়েকটা বইও দিদি এনে দিয়েছে সম্প্রতি। ক্রিকেট সংক্রান্ত,বিভিন্ন ধরনের বোলিং এর গ্রিপ, ব্যাটিং এর স্টান্স,পৃথিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত ক্রিকেটারদের ছবি।ডাক্তারবাবু ইদানীং এই ধরনের কিছু কিছু বই পড়ার অনুমতি দিয়েছেন।শুয়ে বসে উলটে পালটে দেখে,অল্পসল্প পড়ে।বইয়ের ছবির সঙ্গে দিদির স্যাডো প্র্যাকটিশের ভঙ্গীমা মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করে।ফুটওয়ার্ক ব্যাপারটা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি নীলাংশু।দিদি বলেছে ওটা হাতে কলমে শিখতে হবে মাঠে গিয়ে।কোনদিন কি সে পারবে মাঠে যেতে?বইটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে এসব কথাই ভাবছিল নীলাংশু। হঠাৎই বইটা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। মাকে দু’একবার ডেকেছিল বইটা তুলে দেবার জন্যে।হয়ত স্নান করতে ঢুকেছে, কিংবা ঠাকুর ঘরে।ঠাকুমা নিজের ঘর থেকে কমই বার হন । তাছাড়া ডাকলেও শুনতে পাবেন না, বেশ কিছু দিন হল কানে কম শুনছেন।বিছানার ওপর উঠে বসেছিল নীলাংশু,পা দুটো ঝুলিয়ে দিয়ে নীচু হয়ে বইটা তোলার চেষ্টা করেছে কয়েকবার।কিন্তু নাগাল পায়নি।বসে বসেই দু’হাত দু পাশে ভর দিয়ে খাটের ধারে এসে ওই একই ভাবে চেষ্টা করতে গিয়ে হড়কে খাট থেকে নেমে পড়েছে। যার জন্যে সে এতটুকু প্রস্তুত ছিল না। পা দুটো মাটি ছুঁতেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।একটা অদ্ভুত শিহরণ সারা শরীর জুড়ে দেখা দিয়ে মিলিয়ে গিয়েছিলা তখনই নীলাংশু আবিষ্কার করল কারুর সাহায্য ছাড়া সে দিব্যি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে। আর পা ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে না। বই কুড়ানোর কথা মনে ছিল না সেই সময়।এক পা এক পা করে ঘর ছেড়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।মনে হচ্ছিল প্রথম উড়তে শেখা পাখীর মতন, সামনে অন্তত আকাশ, কোথায় থামবে সে জানে না।অনাবিল গতিতে ভর করে এগিয়ে চলেছে এক অফুরন্ত আনন্দে।
ঠিক সেই সময়ই মা বাথরুম থেকে মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বেরিয়ে আসছিলেন। নীলাংশুকে ওই অবস্থায় দেখে আর্ত চীৎকার করে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছিলেন। নীলাংশুর মুখে তখন একটাই কথা –“মা আমি হাঁটতে পারছি মা”। তাসত্ত্বেও তাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি। যে ঠাকুমা ঘর থেকে সাধারণতঃ বার হন না,চীৎকার চেঁচামেচি শুনে তিনিও বেরিয়ে এসে পিছন থেকে নীলাংশুকে ধরে ফেলেন। নীলাংশু তখন একই কথা বারে বারে বলে যাচ্ছিল, “আমাকে ছেড়ে দাও মা আমি হাঁটতে পারছি,আমাকে ছেড়ে দা্ও, এবার আমি একলা একলা বারান্দায় যেতে পারব।”।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে নীলাংশুর যখন ওই মুহুর্তটা মনে পড়ছিল, সারা শরীর জুড়ে একটা রোমাঞ্চ অনুভব করছিল সে। পাশের ঘরে এলার্ম ঘড়িটা বাজতে শুরু করেছে, তার মানে ছটা বাজে। না আজ আর শুয়ে থাকবে না।কাল মা,ঠাকুমা বারে বারে তাকে সাবধান করছিল, “ওরে বেশী হাঁটাহাঁটি করিস না,শরীর ধকল নিতে পারবেনা।কিন্তু নীলাংশু মনে হচ্ছিল, এত দিনের ঘোরাফেরা না করতে পারা সে একদিনে পুষিয়ে নেব।আজ ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আবাসনের মাঠটায় হাঁটতে যাবে দিদিকে নিয়ে। আজ আর সে প্র্যাকটিসে যাবে না। মা কাল ডাক্তারবাবুকে ফোন করেছিলেন।তিনি বলছেন- এটা হতই, টুডে অর টুমরো,বিকালে মা চা খেতে খেতে বলছিল। ডাক্তারবাবু নাকি আরো বলেছেন, ওকে যেন বাধা দেওয়া না হয়। নিজে নিজেই ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পাক। সত্যিই এখন তো তার কোন অসুখ নেই।শুধু মনে নয় শরীরেও সে পুরানো বল ফিরে পাচ্ছিল। রোদ ওঠার আগেই সে দিদিকে নিয়ে মাঠে যাবে। তাড়াতাড়ি মশারী গুটিয়ে বেরুতে যাচ্ছে মা ঘরে ঢুকলেন।
“কিরে ঘুম হয়েছিল রাতে”।
“হ্যাঁ। দারুন ফ্রেস লাগছে, দিদি কোথা মা , উঠেছে ?”
“হ্যাঁ। এক্সারসাইজ করছে”।
“মা দিদিকে বলো আমাকে নিয়ে মাঠে যাবে”।
“না না নীলু,কতদিন পর তুই হাঁটতে পেরেছিস, সব কিছু রয়ে সয়ে করতে হবে”।
“কতদিন বাইরে বেরুইনি বলো তো “।
“জানি তাবলে আজকেই নয়, ঘরের মধ্যেই হাঁটাহাঁটি কর, তারপর বাইরে তো নিশ্চয়ই যাবি”।মনটা খারাপ হয়ে গেল নীলাংশুর।কতদিন বাইরের মানুষজনের মুখ দেখেনি।আজ দিদির প্র্যাকটিশ ছিল না অনায়াসে ঘুরে আসতে পারত।কিন্তু মা বারণ করছে।
চোখ মুখ ধুয়ে দাঁত ব্রাশ করে দিদির ঘরে গিয়ে দেখলো, দিদির ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ শেষ করে মেঝেতে মাদুর পেতে যোগা করছে।নীলাংশু বিছানার ওপর গিয়ে বসল। দিদি একটা ব্যায়াম শেষ করে বলল,’-“জানিস মা কাল রাতে বাবাকে ফোন করেছিল।বাবা সামনের মাসের শেষের দিকে আসবে,তোর জন্যে একটা ক্রিকেট কিট্স কিনে দিতে বলব”।
“কি হবে কিনে মাঠেই যদি যেতে না পারি”।
“কে বলেছে কে মাঠে যেতে পারবি না”।
“এই তো মা বারণ করছে মাঠে যেতে”।
“চল না , মাকে বলেই নিয়ে যাব তোকে”।নীলাংশুর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।দিদি মাদুর গুটিয়ে রানিংশু পরতে পরতে গলা উচিয়ে বলল,-“মা ভাইকে নিয়ে আমি মাঠে যাচ্ছি”।কথাটা শুনেই মা তাড়াতাড়ি নীলাংশুর জন্যে হেলথ ড্রিকস্ এর গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকেই বললেন, “ না না সবেমাত্র কালকে দু’পা হেঁটেছে এতদিন পর, আজকেই ওর মাঠে যাবার দরকার নেই। আজ ও ঘরে থাকুক”।
“মা তুমি এরকম করছ কেন, ভাই একদম সেরে গেছে, এরকম করলে ও কনফিডেন্স ফিরে পাবে না, আমি জগিং করব, আর ও ধাপিতে বসে থাকবে কিচ্ছু হবেনা”।
“ঠিক আছে নিয়ে যা তবে,বেশী দেরী করিস না,এটা খেয়ে নিয়ে তবে যাবি”।নীলাংশুর আনন্দ দেখে কে। একচুমুকেই হেলথ ড্রিংকসের গ্লাস শেষ করে, কেটস্ জুতোটা পরতে গেল।
“ইসঃ! কি অবস্থা!ভেতরে ঝুল, নোংরা! মা আমার মোজা কোথায়”। দশ এগারো মাস এসব ব্যবহারের কোন প্রশ্নই ছিল না, হঠাৎ করে খুঁজে পাওয়া মুস্কিলই।কুন্তলা রেডি হয়ে এসে দেখে নীলাংশু ব্রাশ দিয়ে জুতো জোড়া পরিষ্কারের চেষ্টা করছে।
“ভাই তুই এসব রেখে দে তো, এসব করে যেতে গেলে দেরী হয়ে যাবে, এখনই রোদ উঠে গেছে, আজকে চটি পরেই চল,পরে আমি পরিষ্কার করে খড়ি লাগিয়ে দেব”।অনিচ্ছুক নীলাংশু পায়ে চটি গলাতে লাগল।
উত্তেজনাপূর্ণ দুরু দুরু বুকে নীলাংশু যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাইরে এল, জানুয়ারী মাসের সকালটা যেন অনেক চকচকে মনে হচ্ছিল তার।ঘাসে পা দিয়ে মনে হল কী ভীষণ নরম, চটির ফাঁক দিয়ে ঘাসে জমে থাকা শিশিরে ভিজে যাচ্ছিল তার পায়ের পাতা।
“জুতো পরে এলেই ভাল করতিস, পায়ে ঠান্ডা লাগছে তো”। দিদির কথায় নীলাংশু হাসল, “নারে দিদি, আমার ভালো খুব লাগছে”।
“সে তো লাগবেই এত দিন ঘরে বন্দী হয়ে ছিলি, ঠান্ডা লেগে গেলে মা কিন্তু আমাকে আস্ত রাখবে না”।
“তুই দেখে নিস আমার কিচ্ছু হবে না”।
বেশ, ধাপিতে গিয়ে চটি খুলে পা গুটিয়ে বসবি”।
আবাসনের পার্ক সংলগ্ন মাঠটা বেশ বড়, মাঠের ধারে ধারে কংক্রীটের বসার ব্যবস্থা আছে।বয়স্করা মর্নিং ওয়াক করেন মাঠের ধারের রাস্তা দিয়ে।কেউ কেউ এক্সারসাইজও করে । কুন্তলা যেদিন প্র্যাকটিশে যায় না। এখানেই জগিং করে, ছোট দুরত্বে দ্রুত ছোটছুটি করে নিজের দক্ষতা ঝালাই করে নেয় ।নীলাংশু জিজ্ঞাসা করে,-“দিদি তুই প্রথমেই তো গোটা মাঠে ছুটে এলি, আবার কেন এই ভাবে দৌড়দৌড়ি করছিস”।
“এটা করছি রানিং বিটুইন উইকেট ভাল হবার জন্যে, যাতে দ্রুত রান নিয়ে জায়গা বদল করে নিতে পারি”।
নীলাংশুর চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল সবুজ গোলাকার মাঠ, তারই মাঝে তার দিদি ব্যাট করছে। এই উইকেট থেকে ওই উইকেটে তুরতুর করে ছুটে ছুটে বাড়িয়ে নিচ্ছে নিজের রান।
“দিদি তুই তো বলেছিলি আমাকে খেলা দেখতে নিয়ে যাবি”।
“যাব তো, যেদিন ইডেন গার্ডেনে খেলব সেই দিন”।
“সে তো গতবার থেকে বলে আসছিস,নিয়ে গেলি না তো”।
“গতবার তোর কিরকম অসুখ, কি করে নিয়ে যাব”।
“না দিদি এবারে আমি তোর লীগের খেলাই দেখতে যাব”।
“দূর! ও খেলা দেখে আনন্দ পাবি না, তার চেয়ে ঘেরা মাঠে চারদিকে গ্যালারী, কত লোক বসে খেলা দেখছে। একটা বাউন্ডারী হলে গোটা মাঠ জুড়ে হাততালি”। নীলাংশু যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল মাঠের ছবিটা।
“বাংলার হয়ে লাস্ট ম্যাচে কত রান করেছিলি যেন”।
“আঃ! কতবার বলব তোকে এই কথাটা। থাট্টিসিক্স”।
“আজ আবার বলবি খেলার গল্পটা,শুনতে আমার ভারী ভাল লাগে”।
“হেরে যাওয়া খেলার গল্প বলতে কারুর ভাল লাগে?”
“তাতে কি তুই তো ভাল খেলছিলি,নট আউট ছিলি, কেউ সাপোর্ট দিলে বাংলা হয়ত জিতে যেত।তুই তো বলেছিলি আমার অসুখের সময়, মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে। শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম।ভাল করে শোনা হত না। আজ কিন্তু আবার শুনবো”।
“দূর পাগল। চল তো এখন বাড়ী, দেরী হয়ে যাচ্ছে , এরপর মা রাগ করবে”।
(২)
নীলাংশু বাবা এবার এসে প্রায় পনেরো দিন ছিলেন।কিন্তু ক্রিকেট কিটস্ কিনে দেন নি, বলেছিলেন, একবছর পড়া শুনা বন্ধ, সেটা আগে ভাল করে শুরু করো, পরের বছর দেখা যাবে”। খুবই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল নীলাংশুর। হয়ত সেটা বুঝতে পেরে সাদা ফুল প্যান্ট, জামা আর কেডস্ কিনে দিয়ে বলেছেন লেখা পড়াটা কিন্তু ভাল ভাবে করতে হবে।
সত্যি তো, সবে মাত্র সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছিল। তারপরেই অসুখে পড়ে গেল। স্কুলের বন্ধুদের কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়ে নীলাংশুর। রাজীব, অরুণোদয়, সব্যসাচী, সায়ন্তনী, মেঘলা, অন্বেষা আরো কত বন্ধু বান্ধবী ছিল। তারা কেউ আর যোগাযোগ রাখে না। সবাই ক্লাস এইটে উঠে গেছে। অসুখের সময় সায়ন্তনী আর তার মা এসেছিল একদিন ,ওকে দেখতে। সেকথা নীলাংশু জানে না, মায়ের মুখে শুনেছে।সেভেনের বইগুলোর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।স্কুলে কথা হয়েছে, তার আগে বাড়ীতে মাস্টারমশাই আসছেন, ক্লাস সেভেনের পড়াগুলো মন দিয়েই পড়ছে। তাবলে তাকে ক্লাস এইটে তুলে দেওয়া হবে না। সেই জন্যেই নীলাংশু চেয়েছিল, স্কুলটা পালটে ফেলতে। মা বাবা কেউ রাজি হননি। তার অসুবিধের কথাটা কেউ বুঝতে চাইল না, আবার পুরানো বন্ধুদের সাথে দেখা হবে,যারা সকলেই উঁচু ক্লাসে পড়ছে , নীলাংশুর সঙ্গে হয়ত তারা কথাই বলবে না।একমাত্র দিদি তার অসুবিধেটা বোঝে। সব কথা তাকেই বলা যায়। সেদিন বলতে গিয়ে সে কেঁদে ফেলেছিল দিদির কাছে। মাথার চুল ঘেটে দিয়ে দিদি বলেছিল, “তুই একদম ছেলেমানুষ, তাতে কি হয়েছে এই ক্লাসেও তোর নতুন বন্ধু হবে, তুইও পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলবি না। এরপর তোর যখন খেলায় নাম হবে দেখবি ওই পুরানো বন্ধুরাই আবার নতুন করে ভাব জমাতে আসবে, ক্রিকেটটা তোকে ভাল করে খেলতেই হবে”।
যেদিন দিদি বাড়ী থাকে, নীলাংশুকে আবাসনের মাঠে নিয়ে যায়।কখনো কখনো সে সাদা প্যান্ট, শার্টটা পরে নেয়। দিদির ছোঁড়া বলে ব্যাট দিয়ে ডিফেন্সিভ ফরোয়ার্ড খেলে, দিদির শিখিয়ে দেওয়া মতো বলের লাইনে পা, মাথা নিয়ে গিয়ে হাল্কা স্ট্রোক, বলটা যেন ‘ভি’র মধ্যে থাকে অর্থাৎ মিড অফ মিড অনের দিকে রাখার চেষ্টা করে।দিদি তাকে পাখী পড়ানোর মত বোঝায়।সাদা প্যান্ট শার্টে তাকে দারুন দেখায়। কয়েক জন দাঁড়িয়ে দঁড়িয়ে ওদের প্র্যাকটিশ দেখে। সেদিন তো একজন মন্তব্যই করল,”কেমন দিদির ভাই দেখতে হবে তো”।গর্বে নীলাংশুর বুকটা ভরে উঠেছিল। তবে তার মনে হয় প্র্যাকটিশের সময়টা বড়ই অল্প। আর্ধেক দিন দিদির নেট প্র্যাকটিশ থাকে, নয়ত লীগের ম্যাচ। দিদি না থাকলে একলা একলা তো প্র্যাকটিশ করতে পারে না।তাও দিদি একটা অন্য উপায় বলে দিয়েছিল। ডিউস বলটা রুমালে জড়িয়ে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দিবি মাঠের বার পোস্টের সাথে,এবার ব্যাট দিয়ে মারলেই বলটা নিজের গতিতেই আবার ব্যাটে চলে আসবে। ডন ব্র্যাডম্যান নাকি ছেলেবেলায় এই ভাবেই একলা একলা প্র্যাকটিশ করতেন।
এবার বাংলার প্রথম খেলা উড়িষ্যার সঙ্গে, দিদি ডাক পায়নি। মনটা বড়ই খারাপ। তাহলে কি তার খেলা দেখা হবে না। দিদিও আর কিছুতেই সেই খেলার গল্পটা বলতে চায় না।
খবরের কাগজে খেলার পাতায় ছবি সহ প্রতিবেদন। ভারতের মহিলা ক্রিকেটে উল্লেখযোগ্য নাম,বিহারের নন্দিনী মালহোত্রা। মুগ্ধ হয়ে দেখছে নীলাংশু, মাটি থেকে কতটা উঁচু লাফিয়ে ডেলিভারী করছে ।দিদিকে ডাক দেয় সে।“ হ্যাঁরে দিদি, নন্দিনী মালহোত্রার বিরুদ্ধে তুই খেলেছিলি না”। দিদি চুপ করে নিজের কাজ করে যায়, নীলাংশুর কথার জবাব দেয় না।
“তুই বলেছিলি না খুব জোরে আউটসুইং বল করে, তুই তো ওর বলে খেলেছিস, বল না দিদি সেই খেলার গল্পটা”।
“আঃ!বিরক্ত করিস না তো,”।নীলাংশু চুপ করে যায়। বুঝতে পারে দিদির মন মেজাজ ভাল নেই। বাংলার টিমে দিদি নেই এবার, এটা ভাবতেই তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তাহলে কি তার দিদির খেলা দেখা হবে না। দিদি কি তাহলে ঘেরা মাঠে খেলবে না কোন দিন।এসব কথা জিজ্ঞাসা করতে ভরসা হয়না তার। সেদিন মায়ের সঙ্গে বোধহয় এইসব নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। নীলাংশু ঘরে ঢুকতেই দুজনেই চুপ করে যায়। শেষ কথা যেটা তার কানে গিয়েছিল,-“ঠাকুর ঠাকুর করে যদি রেলের চাকরীটা হয়ে যায়”।
দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ যখন কথা বলল না, ঘর ছেড়ে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসেছিল সে। একটা বই টেনে নিয়ে পাতা ওল্টালেও সেদিকে তার ধ্যান ছিল না।একটা কথা বারে বারেই তার মনে হচ্ছিল, খেলা ছেড়ে দিয়ে দিদি যদি চাকরী করতে চলে যায় তাহলে তার ক্রিকেট খেলার কি হবে।
(৩)
ইদানীং দিদির কেমন যেন আগ্রহ নেই।পুরানো খেলার কথা কিছুতেই বলতে চায় না,বাংলা দল থেকে বাদ পড়ার পর থেকেই। নীলাংশু আর কিবা করবে, স্কুলে যায়, মন দিয়ে পড়া শুনা করছে, ভাল রেজাল্ট তাকে করতেই হবে।রেজাল্ট ভাল হলে তবেই না বাবাকে বলতে পারবে, কোন একটা ভাল ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পে ভর্তি করে দেবার জন্যে।
আজ শনিবার। দিদির বালীগঞ্জ ইউনাইটেডের সঙ্গে খেলা। নীলাংশু ঠিক করে রেখেছে লুকিয়ে লুকিয়ে দিদির খেলা দেখতে যাবে। যদিও জানে না কোন মাঠে খেলা, তা হোক ময়দানের দিকে গেলে কাউকে জিজ্ঞাসা করলে নিশ্চয় সে বলে দেবে। সাদা প্যান্ট শার্ট কেডস্ পরে নিয়েছে। এই পোষাক না হলে সে যে কুন্তলা চৌধুরীর ভাই সেটা লোকে মানবে কেন। দিদি হয়ত প্রথমে একটু ঘাবড়ে যাবে, বকবেও হয়ত। তা হোক মনে মনে খুশী হবে।
ময়দানে পৌঁছে দেখলো অনেক মাঠেই খেলা আরম্ভের তোড়জোড় চলছে।কিন্তু মেয়েদের খেলা কোথায় হবে। জিজ্ঞাসা না করলে তো হবে না। মাঠের ধারে প্র্যাকটিশ চলছে।অনেক খেলোয়াড়ই দাঁড়িয়ে আছে, তাদেরই একজনকে জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা বলতে পারেন, মিলন সম্মিলনীর সঙ্গে বালিগঞ্জ ইউনাইটেডের খেলাটা কোন মাঠে হচ্ছে”।
“বালীগঞ্জ ইউনাইটেড! কই সেরকম কোন খেলা তো এখানে নেই,তুমি কাদের খেলার কথা জানতে চাইচ্ছ”।
“লীগের খেলা, মেয়েদের ক্রিকেট লীগ”।
“ওঃ! সে তো এখানে নয় বালীগঞ্জ ইউনাইটেডের মাঠে, হঠাৎ মেয়েদের ক্রিকেট খেলা নিয়ে জানতে চাইচ্ছ কেন”।
“বাঃ! আমার দিদি মিলন সম্মিলনীতে খেলে না, আমার দিদির খেলা দেখতে এসেছি”।
“তোমার দিদি ক্রিকেট খেলে? কি নাম তোমার দিদির”।
“কুন্তলা চৌধুরী”। বুকটা সামান্য ফুলিয়েই বলতে চেয়েছিল নীলাংশু, কিন্তু খেলোয়াড়টি মাথা উঁচু করে আকাশ বাতাসে নামটা খুঁজে বেড়াচ্ছে।একটু বিরক্তই হল নীলাংশু, -“সে কি আপনি আমার দিদি কে চেনেন না, গত সিজ্নে বেঙ্গল খেলেছে”।
“বেঙ্গল খেলেছে, কি নাম বললে?’ নীলাংশু আবার নামটা বলে।
“ওহো এবার মনে পড়েছে, হ্যাঁহ্যাঁ একটা ম্যাচে টুয়েলভ্ ওম্যান ছিল”।
“টুয়েলভ্ওম্যান!”
“হ্যাঁ।তুমি জানো না, এবার চান্স পাইনি। আমি তোমার দিদির খেলা দেখিনি, তবে শুনেছি খারাপ খেলে না”।
তখনই আর একজন প্লেয়ার এসে জানালো,-“ শুনেছিস বিশু , নবারূন আসতে পারবে না, ফোনে জানিয়েছে, কিই অসুবিধে আছে”।
“ফেন্ডলি ম্যাচ হলে এই অবস্থাই হয়, ঠিক আছে,কোন চিন্তা নেই, এই কি নাম তোর”।
“নীলাংশু চৌধুরী”।
“এর নামটা নোট করে নে, কুন্তলা চৌধুরীর ভাই, কিরে ক্রিকেট খেলিস তো , তোর দিদি যখন খেলে তুই তো নিশ্চয়ই খেলিস”।
কি ঘটতে যাচ্ছে সেটা নীলাংশুর মাথাত ঢুকছে না, একটা কথা মনে মধ্যে তোলপাড় করছে, টুয়েলভ ওম্যান” থাট্টিসিক্স নট আউট!!!তাহলে মিথ্যে খেলার গল্পটা ওটা !
“শোন আজকে তালতলার সঙ্গে আমাদের মানে টাউন ক্লাবের ফ্রেন্ডলি ম্যাচ।ক্রিকেটের পোষাক যখন পরেই আছিস, কোন চিন্তা নেই। তবু ক্ষীণ আপত্তি তুলল।–“না মানে খেলি ঠিকই কিন্তু এত বড় মাঠে তো কখনো খেলি নি”।
“আরে ঘাবড়াচ্ছিস কেন, সবাই কেই তো একদিন না একদিন বড় মাঠে প্রথম খেলতে হয়।দেখি না তোর পারফরমেন্স, তারপর না হয় আমাদের ক্লাবেই প্র্যাকটিশ করবি, নে ওয়ার্ম আপ করে নে ”।
(৪)
একদম লং অনে ক্যাপ্টেন দাঁড় করিয়ে দিয়েছে নীলাংশুকে। এখন বুঝতে পেরেছে প্রথমে যার সঙ্গে কথা বলেছে সেইই টাউন ক্লাবের ক্যাপ্টেন বিশুদা ।ফিল্ডিং প্র্যাকটিশ তো কোন দিন করেনি সে, তাছাড়া মনের মধ্যে সেই কথাটা পাক খাচ্ছিল তার, দিদি বেঙ্গল টিমে টুয়েলভ্ওম্যান, মোটেই সে ছত্রিশ রান করেনি সবটাই মিথ্যে। এর ফলে মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। দুটো বল ছাড়া হয়ে বাউন্ডারী হয়ে গেছে।খারাপ লাগছিল নিজেরই। যাইহোক কিছুটা পুষিয়ে দিতে পেরেছে একটা ক্যাচ ধরে। বলটা উঁচু হয়ে একেবারে বুকের সোজাসুজি নেমে আসছিল।দুই হাত জড় করে জমিয়ে ফেলতে পেরেছিল কোনক্রমে। যারা খেলা দেখছিল অনেকেই হাততালি দিয়েছে, ক্যাপ্টেন এসে পিঠ চাপড়ে দিয়ে গেল, বোলার হ্যান্ডসেক করল।
এবার ওদের ব্যাটিং এর পালা, মাথা ঢাকা শামিয়ানার মধ্যে একটা চেয়ারে এসে বসল নীলাংশু।ক্যাপ্টেন বিশুদা এসে জানিয়ে গেল ওকে ব্যাট করতে হবেনা।একান্তই যদি ব্যাট করতে হয় তো একদম শেষে। তালতলার একটা ছেলে বাঁ হাতে পেস বল করছিল।বেশ জোর আছে। এরা কেউ খেলতেই পারছে না। নীলাংশুর যে ভয় ভয় করছিল না তা নয়। ফ্রেন্ডলি ম্যাচ বলেই হয়ত কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না।বিশুদা একদিকটা ধরে রেখেছে।রান বেশী ওঠেনি টাউন ক্লাব যে হারবে নিশ্চিত।
জল খেয়ে সবে বোতলটা চেয়ারের পাশে নামিয়ে রেখেছে নীলাংশু। একজন এসে বলল, “এই তুমি প্যাড পরে নাও, আট উইকেট পড়ে গেছে,এ্যাবডমিন্যাল গার্ড পরতে জানো তো “।নীলাংশু মাথা নাড়ে, সেইই দেখিয়ে দেয়। সব কিছু পরার পর নিজেকে একবার আয়নার সামনে দেখতে ইচ্ছে করছিল তার।সেই সময়ই অষ্টম উইকেট পড়ল।মাঠে নামতে যাচ্ছে সেইসময় পিছন থেকে কে যেন বলল, “হেলমেটটা নিয়ে যাও”।
ক্যাপ্টেন এগিয়ে এসে ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছিল, বেশ নার্ভাস লাগছে নীলাংশুর।
“মাত্র দুটো বল আছে এই ওভারে, মারতে যাস না বুঝলি”।এসব কথা নীলাংশু কানে যাচ্ছিল না। উত্তেজনা কাটতেই তাড়াতাড়ি লেগ মিড্ল গার্ড নিয়ে দাঁড়ল , যেমনটি দিদি দেখিয়ে দিয়েছে।সেই বাঁহাতি বোলারটা।ওভারের পঞ্চম বলটা, লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে পড়ে কিছুটা ঢুকছিল, বলের লাইনে পা মাথা নিয়ে গিয়ে ডিফেন্স করবেই ভেবেছিল,বলটা ব্যাটে লাগা মাত্রই ঘুরিয়ে দিল লেগের দিকে । সেটা সজ্ঞানে, না বলের জোরেই ব্যাটটা ঘুরে গেল কিনা বুঝতে পারল না নীলাংশু।যেহেতু ব্যাকওয়ার্ড স্কোয়ারলেগ ছিলনা , ডিপ ফাইন লেগের অনেক দূর দিয়েই বাউন্ডারী লাইন পেরিয়ে গেল। সারা মাঠ জুড়ে হাততালি। ক্যাপ্টেনও এগিয়ে এসে পিঠ চাপড়েদিয়ে বল্ল “ বাঃ! ভারী সুন্দর গ্লান্স করেছিস, চালিয়ে যা”।পরের বলটা অফ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরে।খেলার কোন চেষ্টাই করল না। । কিন্তু নীলাংশু আর ব্যাট করার সু্যোগই পেল না। পরের ওভারেই বিশুদা আউট হয়ে গেল।
প্রশংশায় ভেসে যাচ্ছে নীলাংশু।মনের মধ্যে থেকে কখন হারিয়ে গেছে টুয়েলভওম্যান শব্দটা।তাড়াতাড়ি সব কিছু খুলে, আবার খানিকটা জল খেল।ছুটে প্যাভেলিয়ান থেকে বেরিয়ে যাবার মুখে বিশুদা ডাক দিল, “এ্যাই নীলাংশু যাবি না ক্লাব টেন্টে চল খাওয়া দাওয়া আছে। না আজ আর তার সময় নেই , কোনক্রমে ঘাড় নেড়ে নিজের অনিচ্ছা প্রকাশ করে এক ছুটে মাঠ ছাড়তে চাইল সে । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে বাড়ী ফিরে দিদির কাছে বলতে হবে একটা সত্যি খেলার গল্প।