“কি বললেন? একটা আস্ত বাড়ী?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে মাটির তৈরী, একেবারে গ্রাম্য পরিবেশ। সঙ্গে ফল ফুলের বাগান। মাঝারি মাপের পুকুর, তাতে কাঁচের মতো জল। উঠোনে ধানের মরাই, অবশ্য ধান ভরা থাকবে না। শুধুমাত্র গ্রাম্য পরিবেশটা বজায় রাখার জন্য এই সব ব্যবস্থা।”
“মাটির বাড়ী!”
“নাক সিঁটকোবেন না। বললাম না পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য এই সব ব্যবস্থা। ভেতরে ঢুকলে বুঝতে পারবেন এনটায়ার মর্ডান ফেসিলিটিস্।”
“কিন্তু কেনই বা শোনাচ্ছেন এসব?”
“বাঃ! এটাই তো আমাদের লটারীর প্রথম পুরষ্কার। ন’শ বাহাত্তরজন ফ্ল্যাট ওনারদের মধ্যে আপনি সেই ভাগ্যবান মানুষ, সেইজন্যই তো ভূমিকা করছিলাম। অনিন্দিতা দেবী জানেন কনট্রাক্টের সময় বলেছিলাম একটা হিড্ন সারপ্রাইজ আছে।”
প্রিয়ব্রতর মনে হল সে যেন এফ. এম. রেডিওর কোনো আর.জে.র ভাষ্য শুনছে। কোনো লটারীর যে এই ধরণের প্রাইজ হতে পারে ভাবতেও পারেনি। নিজের অপছন্দটা জানিয়ে দিল সরাসরি-
“গ্রামের মধ্যে একটা মাটির বাড়ী নিয়ে করবই বা কি?”
“কেন? উইক এন্ডে গাড়ী নিয়ে চলে যাবেন। ফার ফ্রম দ্যা ম্যাডিং ক্রাউড, পলিউশন ফ্রী ফ্রেশ এয়ার। ফুসফুস দুটো বোঝাই করে নিয়ে ফিরে আসবেন রোববার রাত্তিরে।”
কথাগুলো সহজ হলেও প্রিয়ব্রতর কাছে দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে। কিছুটা হতভম্বের মতন দাঁড়িয়ে আছেন, ‘দিকচক্রবাল’ আবাসনের সদ্য উদ্বোধন হওয়া ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর্সের সামনে অস্থায়ী ছাউনির কাউন্টারে। সামনের লোকগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় না থাকলেও, জানেন এঁরাই এই বিশাল আবাসনের প্রোমোটার গোষ্ঠী। মৌখিক আলাপচারিতা এদের সঙ্গে এর আগে কখনো হয়নি। কারণ বুকিং থেকে শুরু করে আনুষাঙ্গিক যাবতীয় কথাবার্তা, পছন্দ অপছন্দ, ছোটোখাটো সমস্যা সবই সামলিয়েছে স্ত্রী অনিন্দিতা। প্রিয়ব্রত খালি টাকার যোগান দিয়ে গেছেন সময়মতো। এদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারে এই অভাবনীয় সংবাদে নিজেকে একটু অপ্রস্তুত মনে হল প্রিয়ব্রতর। সেটা এদের চোখে যেন ধরা না পড়ে, সেইজন্যই কর্মক্ষেত্রের পদমর্যাদার সুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে বললেন –
“দেখুন, এসব ব্যাপারে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই, কিসের কি লটারী, কবেই বা খেলা হল। আজ বলছেন আমি ফার্ষ্ট প্রাইজ পেয়েছি। কিছু মনে করবেন না। পুরোটাই আমার কাছে কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। আমি আসছি। নমষ্কার।”
“প্লিজ স্যার, প্লিজ।” সামনে বসে থাকা প্রোমোটার ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। এতক্ষন ধরে ভদ্রলোককে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজেদের বক্তব্য শোনানোটা সত্যিই সৌজন্যবিরোধী। সেটা উপলব্ধি করেই পাশে রাখা একটা চেয়ার দুহাতে তুলে কাউন্টারের ওপাশে প্রিয়ব্রতর সামনে নামিয়ে রেখে মুখে হাসি টেনে বললেন- “বসুন স্যার। সব বুঝিয়ে বলছি।”
কৌতূহল যে প্রিয়ব্রতর মনে ছিল না তা নয়।এছাড়া একটা অজানা উত্তেজনা উঁকি মারছিল মনের মধ্যে। দেশের বাড়ী ছাড়ার পর ফ্ল্যাটের জীবনযাত্রা খুব একটা পছন্দ ছিল না প্রিয়ব্রতর। যদিও বর্তমান ফ্ল্যাটে প্রচুর জায়গা, দু’হাজার স্কোয়ার ফিটের ওপর, সর্বত্রই সুচারু পরিচর্যার ছাপ। তবু মাঝেমাঝে তাঁর মনে হয়, পায়ের তলায় পাওয়া যায় না মাটির ছোঁয়া। মাথার ওপর দেখা যায় না নীল আকাশ। পূব, দখিনের জানলা দিয়ে আসা রোদ যেন সীমিত সময়ের জন্য নির্ধারিত। চৈত্র মাসের শেষে সন্ধ্যেবেলা ফুরফুরে হাওয়ার সত্যি যেন আকাল। আশপাশের মাথা উঁচু করা বাড়ীগুলো যেন পাহারাদারের মতন খাড়া হয়ে আছে।
অথচ দ্বারিকাপুরে গরমকালের সন্ধ্যেবেলায় রজনীগন্ধার গন্ধে ম্ ম্ করতো উঠোনটা। চৌকিতে বসে বাবা মাকে উদ্দেশ্য করে বলতেন – “বিমলা, আজ আর আমাকে ঘরে যেতে বলো না, এখানেই একটা বালিশ এনে দাও, শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দি।”
শীতকালে বাড়ীর উঠানে মা মাদুর পেতে পিঠে রোদ লাগিয়ে উল কাঁটা নিয়ে বসতেন। একে একে যোগ দিত – শান্তনুর মা, প্রমীলা বৌদি, দীপ্তি কাকিমা, রেবাদি আসত সোয়েটারের প্যাটার্ন তুলতে। আর ছিল শান্তা, নির্জন দুপুরে ছুটোছুটি করার সাথী। চুরি করা আচারের সদ্গতি হতো পুকুর পাড়ে বসে।
তখন নতুন চাকরী, মা মারা যাবার পর দেশের বাড়ী, জমি জায়গা বিক্রী হয়ে গেলে প্রিয়ব্রত কতবার ভেবেছেন – ধন নয়, মান নয় একটুকু বাসা। ধন, মান সবই হয়েছে, হয়নি কেবল ধরণীর এককোণে একটি ছোট্ট বাড়ী। স্ত্রী, ছেলে মেয়েদের কতবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু একানে বাড়ীর প্ল্যান পাশ, বিদ্যুৎ সংযোগ, জল সরাবরাহের ব্যবস্থা এছাড়া আছে মিস্ত্রীদের খামখেয়ালীপনা, প্রতিনিয়তই মনে হবে কেউ যেন ঠকাচ্ছে ইত্যাদির কথা তুলে ফ্ল্যাটে বসবাসের সামগ্রিক সুবিধার কথাই জাহির করত অনিন্দিতা। এসব শুনে পরে প্রিয়ব্রতর নিজেরই মনে হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব পালন ক’রে, এই সমস্ত অসুবিধা মিটিয়ে প্রত্যেকটি ব্যাপারের যথাযথ ব্যবস্থা কি তিনি করে উঠতে পারবেন? মনে তো হয় না, তাই একান্ত অনুভূতি গোপন করে ফ্ল্যাটে বসবাসের পক্ষে সায় দিয়েছেন।
চেয়ারে বসে প্রোমোটারদের কাছ থেকে কিছু শোনার পরিবর্তে নিজেই প্রশ্ন করলেন প্রিয়ব্রত,
“এসব করে আপনাদের লাভ কি তা তো বুঝতে পারছি না।”
“সবসময় কি লাভ ক্ষতির হিসাব করে চলে স্যার! শুনলেই বুঝতে পারবেন আমাদের এই পরিকল্পনাটার পিছনে দুটো দিক আছে।”
প্রত্যেক ব্যবসাদারই নিজেদের সম্পর্কে লম্বা চওড়া কথা বলে। লাভ ছাড়া যে এই সমস্ত লোক এক পাও এগোবে না সেটা জানা সত্বেও ভদ্রতার খাতিরে প্রিয়ব্রত প্রশ্ন করলেন – “সেটা কি রকম?”
“আপনি জানেন নিশ্চয়ই ফরেনারদের মধ্যে একটা কালচার আছে, সারা সপ্তাহের খাটাখাটুনির পর তারা লং ড্রাইভে চলে যায় কোনো এক কাউন্টির নিজস্ব ফার্ম হাউসে। সারা সপ্তাহের গ্লানি কাটিয়ে ফ্রেস এনার্জি নিয়ে ফেরত আসে সামনের সপ্তাহে নতুন উদ্যমে কাজ করার মানসিকতা নিয়ে। আমরা চাইছি আপনাদের মতন মানুষদের মধ্যে এই রেওয়াজটা গড়ে উঠুক।”
“এটা তো বুঝলাম একটা দিক আর অন্যটা?”
“সেটা একেবারেই প্রফেশনাল। এটাকে আপনি এক ধরণের অ্যাডভারটাইসমেন্ট কাম ইনভেস্টমেন্ট বলতে পারেন। এই ধরুন উইক এন্ডে আউটিং এর হবিটা যদি একবার গ্রাব করে নেন….”
“তাহলে?”
“তখনই কিন্তু অনেকেই রুর্যালে এই ধরণের ফার্ম হাউসের জন্য রিকোয়েস্ট করবেন। সেরকম একটা চিন্তাধারা আমাদের মাথায় আছে, তাছাড়া নেক্সট্ প্রজেক্টে আমাদের গুডউইল কতখানি বেড়ে যাবে ভাবতে পারছেন!”
ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন প্রিয়ব্রত। না দিয়ে উপায়ই বা কি। পরিষ্কার বুঝতে পারছেন গ্রাম বাংলার চাষের জমিগুলোর ওপর এই সমস্ত শকুনগুলোর নজর পড়েছে। প্রিয়ব্রতকে করতে চাইছে অলিখিত বিজ্ঞাপনের মডেল। বলা যায় না, কাগজে পরবর্তী বিজ্ঞাপনের সময় প্রিয়ব্রতর হাসি মুখের ছবি ছাপতেই পারে। যাই হোক ব্যাপারটা আর একটু পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার বলে মনে হল। যদিও জিজ্ঞাসা করতে বাধো বাধো ঠেকছিল তবু না বলে পারলেন না –
“ আচ্ছা এতবড় সম্পত্তি সে রুর্যালেই হোক আর যেখানেই হোক, এমনি এমনি দিয়ে দেবেন, এটা বিশ্বাস করতে একটু অসুবিধাই হচ্ছে। আমার তরফে একেবারেই কি কোনো খরচ নেই?”
“একেবারেই নেই সেটা বলি কি করে স্যার, রেজিষ্ট্রেশনের খরচটা তো আপনাকে দিতেই হবে। না হলে মালিকানাটা কি করে বর্তাবে।”
“ওঃ। সেটাও তো কিছু কম নয়।”
নিঃশব্দে হাসলেন প্রোমোটার ভদ্রলোক। স্বভাবসুলভ ভঙ্গীমাতে প্রিয়ব্রতকে আশ্বস্ত করতে চাইলেন – “সেটা স্যার আপনার পক্ষে খুব একটা বার্ডেন হবে না। প্রায় দেড় একরের ওপর জায়গা, যতদিন যাবে ভ্যালুয়েশন বাড়বে। সুতরাং আপনার রাজী না হবার কোনো কারণ নেই।”
“আচ্ছা জায়গাটা কোথায়?”
“দ্বারিকাপুর।” চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন প্রিয়ব্রত। আবার বসে পড়লেন ধপ্ করে।
“কি বললেন?”
“দ্বারিকাপুর, কেন? চেনেন নাকি?”
কি বলবেন প্রিয়ব্রত? হ্যাঁ! তাহলেই তো অনেক প্রশ্ন এসে পড়বে। মনের চাঞ্চল্য যতটা সম্ভব সামলে স্বাভাবিক স্বরে বলার চেষ্টা করলেন – “ না, মানে শুনেছি আর কি।”
এরপর আর কথা বাড়াননি প্রিয়ব্রত। কি জানি কি প্রসঙ্গক্রমে কোনো কথা যদি বেড়িয়ে পড়ে। চাউর হতে দেরী হবে না। নমষ্কার জানিয়ে সোজা ডিপার্টমেণ্টাল ষ্টোর্স-এ ঢুকে পড়েছিলেন।
ফ্ল্যাটে ফিরে ডোরবেল বাজাতে স্ত্রী অনিন্দিতা দরজা খুলেই অপছন্দের স্বরে বললেন- “সেই টং টং করে বাজারে গেলে। নিজের স্ট্যাটাস্টা যদি না বোঝ।”
“কে বলল কে আমি বাজারে গিয়েছিলাম?”
“বলবে কে? বাজারে না গেলে এতো দেরী হয় নাকি, এই সামান্য ক’টা জিনিষ কিনতে?”
“বললাম তো আমি বাজারে যাইনি।” প্রিয়ব্রত একটু ঝাঁঝের সঙ্গে উত্তর দিয়ে ভেতরে ঢুকে এলেন।
“বললে আবার কখন? বাজারে যদি নাই গেলে এত দেরী হল কেন?”
অনিন্দিতার এই ঘ্যানঘ্যানানি পছন্দ হচ্ছিল না প্রিয়ব্রতর। কথার উত্তর না দিয়ে সরাসরি নিজের ঘরে ঢুকে এলেন। অদ্ভুত মহিলা। বাজারে গেলে যে দু’পয়সার সাশ্রয় হয় এটা বুঝতে চায় না কিছুতেই। তাতে নাকি স্ট্যাটাস্ নষ্ট হয়। যেহেতু ফ্ল্যাটের লোক বেশী দাম দিয়ে ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর্স থেকে কেনে, সুতরাং প্রিয়ব্রতকেও সেখান থেকেই কিনতে হবে। আজকে যে বাজারে না গিয়ে ওনার পছন্দের জায়গা থেকে জিনিষ কেনা হয়েছে সেটা বিশ্বাস করানো যাবে না দেরী হওয়ার দরুণ।
ওদিকে অনিন্দিতা ফাটা রেকর্ড বাজিয়েই চলেছে।
“যতই চুপ করে থাকো, আমার বুঝতে কিছু বাকী নেই। তোমার আর কি? অসুবিধে তো আমার, কারণ আমি একটা সোসাইটি মেনটেন করি। গেটের দারোয়ানগুলো যখন বলবে মিষ্টার সেনকে…”
“আঃ।” প্রিয়ব্রত একরকম ধমকেই থামাতে চাইল অনিন্দিতাকে।
“তোমার পছন্দের জায়গা থেকেই জিনিষ কিনে আনা হয়েছে।”
“তাই যদি হবে এত দেরী হল কেন?”
“সে কৈফিয়ত কি তোমাকে দিতে হবে নাকি?” প্রিয়ব্রতর গলা মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। পরক্ষনেই বুঝতে পারলেন সামান্য ব্যাপার নিয়ে এতটা উত্তেজিত না হলেও চলত। দ্বারিকাপুরের নামটা শোনার পর থেকেই মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা আনমনা করে রেখেছিল। তারপর ঘরে ঢোকার পর থেকেই অনিন্দিতার অসঙ্গত কথাবার্তা মেজাজ হারানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল।
পাশের ঘরে অন্বেষা ডেক্সটপে কাজ করছিল। বাবার উত্তেজিত গলার স্বর যে তার কানে যায়নি তা নয়। সেও চেয়ার ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
মেজাজ হারানো প্রিয়ব্রত গুম মেরে বসে আছেন নিজের ঘরে। অনিন্দিতা হয়তো আবার কিছু বলতেন, মেয়ের ইশারায় চুপ করে গেলেন। অন্বেষাই জিজ্ঞাসা করল-“বাবা, তোমার কি হয়েছে কি?”
মেয়ের কথায় তো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন না কখনোই, উপরন্তু মুখে ফুটে উঠল অনুশোচনার চিহ্ন। অন্বেষা বাবার কাঁধে হাত রাখল।
“তুমি তো এরকম করোনা বাবা। কেউ কিছু বলেছে?”
“না”। সংক্ষিপ্ত জবাবে কিন্তু মেজাজ হারানোর আসল কারণটা প্রকাশ পেলনা।
অন্বেষার স্বাভাবিক প্রশ্ন – “তবে?”
এরপর তো আর চুপ করে থাকা যায় না। বাধ্য হয়েই প্রিয়ব্রতকে বলতে হল “বোস, বলছি”।
দ্বারিকাপুরের কথাটা উহ্য রেখেই প্রিয়ব্রত বলতে শুরু করল সব কথা। শোনা শেষ হতেই অন্বেষা দুই হাতে তালি মেরে বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠল- “ গ্র্যান্ড বাবা। এ তো দারুণ খবর। আমি কিন্তু বন্ধুদের ট্রীট দেবো। এরজন্য তুমি টেনশন করছো। কেন?”
টেনশনের কারণটা আর প্রকাশ করলেন না মেয়ের কাছে। তবে খবরটা শোনার পর অনেষার উচ্ছ্বাসের ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না অনিন্দিতার মধ্যে। সেটা প্রকাশ পেল পরবর্তী কথায় – “দ্যাখো আমার মনে হয় এই প্রস্তাবে তোমার রাজী হওয়া উচিত নয়। কোথায় কোন ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে রেজিস্ট্রেশনের পিছনে একগাদা টাকা খরচ করে একটা মাটির বাড়ী দখল নিয়ে কি লাভ হবে তোমার। কলকাতার কাছে পিঠে হলেও না হয় কথা ছিল, জায়গাটা কোথায় কিছু বলেছে?”
“না, জিজ্ঞাসা করা হয়নি”।
“বাঃ, প্রাইজ পাবার আনন্দে এতই মশগুল ছিলে, জায়গাটা কোথায় সেটাই জিজ্ঞাসা করলে না!”
কথাটা হজম না করে প্রিয়ব্রত করবেনই বা কি, অনিন্দিতা বলেই চললেন- “সম্পত্তি তো পেলেই হল না, মেনটেনেন্সের খরচা নেই? ওদের পরিষ্কার বলে দাও এই পুরস্কারের ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই। পরিবর্তে ক্যাশ প্রাইজ তো দেওয়া উচিত, এটা যখন ফোরগো করেছি”।
“মা! কি বলছ কি? ছুটির দিনে একটা নতুন জায়গায় বেড়াতে যেতাম”।
“থাম তো। ভারতবর্ষে যেন আর বেড়াতে যাবার জায়গা নেই। ওসব জায়গায় না আছে কোনো সিকিউরিটি, না আছে মেডিক্যাল ফেসিলিটি”।
“ওখানে কি লোকজন থাকে না মা?”
“যারা থাকে, তারা থাকে। ওভাবে তুমি কখনোই মানুষ হওনি”। মেয়েকে চুপ করিয়ে প্রিয়ব্রতকে বললেন- “ তুমি কি ওদের কথা দিয়ে এসেছ নাকি?”
“না, না, সেরকম কিছু বলিনি”।
“ঠিক আছে, যা বলার আমি বলব”।
(২)
অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়েছিলেন প্রিয়ব্রত, সত্তর – বাহাত্তর কিলোমিটার রাস্তা, সব জায়গা তো সমান নয়। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে পার হয়ে যাবে আন্দাজ করে নিজে গাড়ী চালাবার ঝুঁকি নেননি। সেই কবে দ্বারিকাপুর ছেড়েছেন। মাঝখানে ছাব্বিশ বছরের ব্যবধান। তখন দ্বারিকাপুর যাওয়া মানে ছিল অভিযান।
বাবা মারা যাবার পর মা একলাই দেশের বাড়ী আগলে পড়ে আছেন। বারবার বলা সত্ত্বেও কলকাতায় আসতে চান না। প্রিয়ব্রতর কেরিয়ার তখন সবে গড়ে উঠছে। কলকাতায় না থাকলেই নয়। সেই সময় দেশের বাড়ী বিক্রি করে দেবার কথা একবার তুলেছিলেন। মা রাজী তো হননি, উপরন্তু অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কথাগুল এখনো মনে পড়ে প্রিয়ব্রতর।
“হ্যাঁরে প্রিয়, এতদিনের ভিটে মাটি বিক্রি করে দিবি, বললি কি করে কথাটা?”
কথা বাড়িয়ে মায়ের সাবেকী দৃষ্টিভঙ্গী বদলাবার চেষ্টা করেননি প্রিয়ব্রত। অল্প কিছুদিনের মধ্যে মা মারা যেতে নিছক সেন্টিমেন্টকে গুরুত্ব দিয়ে দেশের সম্পত্তি টিকিয়ে রাখার কোনো যুক্তি খুঁজে পাননি সেই সময়।
তাহলে আজ কিসের টানে চলেছেন দ্বারিকাপুরের উদ্দেশে? ফ্ল্যাট বাড়ীতে তো ভালোই আছেন। যদিও সীমিত পরিসরে হাঁটাচলা। হয়তো নেই মাটির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ, কিংবা পারেন না নিজের হাতে দু’টো চারা গাছ লাগাতে। তবে সেই অভাব তো মেটে যখন দেখেন বারান্দায় ঝুলে থাকা চিনেমাটির টবে অযত্নের অর্কিডগুলো জাহির করছে তাঁরই স্ট্যাটাস্ সিম্বল। গরমের সন্ধ্যায় নিজস্ব ঘরে এ.সি. চালিয়ে ওয়ের্স্টান মিউজিক শুনতে শুনতে অন দ্য রক্ স্কচ, হুইস্কিতে চুমুক দেওয়া কি যথেষ্ট ভালো থাকা নয়। তাহলে হল কি তাঁর? শুধুমাত্র প্রোমোটারের দেওয়া অভাবনীয় প্রস্তাব আর তার সঙ্গে প্রায় বিস্মরণ হওয়া একটা গ্রামের নামই কি যথেষ্ট এই গোপন যাত্রার স্বপক্ষের যুক্তি হিসাবে, কি পাবেন সেখানে? নাকি একবার খুঁজে দেখবেন শীতকালে ছেঁড়া কাঁথার তলায় লুকিয়ে থাকা ভালো থাকার ওম্। অন্ধকার ঘরের কোণে ভালোবাসার সরঞ্জামের তল্লাশ করে কি উঠতে পারবেন, জানেন না প্রিয়ব্রত।
মনের মধ্যে এক অদ্ভুত কৌতূহল নিয়ে শহর থেকে শহরতলী ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছেন। রাস্তার ধার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে হাওয়াই মিঠাইওলা। কাঁধে ঝোলানো কাঁচের বাক্সে তীব্র গোলাপি রঙের গোলাকার বস্তু। ইস্কুলের ছুটি হয়েছে। ছেলেমেয়েরা ভিড় করে ঘিরে রয়েছে এক ফেরিওয়ালাকে। দু এক জন ভিড় থেকে বেরিয়ে আসছে, শালপাতায় কাঠের চামচ দিয়ে কিছু খেতে খেতে। চলন্ত গাড়ী থেকে প্রিয়ব্রত ঠিকই দেখেছেন, আলুকাবলী। একবার মনে হল গাড়ীটা দাঁড় করিয়ে ড্রাইভারকে দিয়ে কিনিয়ে আনেন ছোটোবেলার অন্যতম প্রিয় বস্তুটি। না, হল না। মুখ ফুটে বলতে পারলেন না কথাটা। দ্রুতগতির গাড়ী অনেকটাই এগিয়ে চলে এসেছে। শরীরটা এলিয়ে দিলেন আরামদায়ক সীটে। সময় বড় নির্মম প্রিয়ব্রত, ফিরিয়ে দেয় না পুরোনো কিছু, দিলেও থাকে না অতীতের সুবাস।
চেনা বাসস্ট্যান্ডটা পার হবার পরেই পাকা রাস্তার ধারে গাড়ীটা দাঁড় করাতে বললেন। পায়ে হেঁটে খানিকটা কাঁচা রাস্তা অতিক্রম করতে হয়। শীতের বেলা পড়ে আসছে। বিকেলের রোদ তখন গাছের মাথায়। কি আশ্চর্য! উঠোনে এখনো মাদুর পাতা। মাদুর ছেড়ে ধুলোয় হামা দেবার চেষ্টা করছে একটা বাচ্চা ছেলে। আটপৌরে কাপড় পরা, সম্ভবতঃ ওর মা কি যেন সেলাই করছে ওই মাদুরে বসে। পায়ের শব্দ পেয়ে অবাক চোখে তাকাল সে প্রিয়ব্রত দিকে, স্যুট প্যান্ট পরা মানুষ দেখতে অভ্যস্ত নয়। তাই সমীহ বোধ করল কিছু জিজ্ঞাসা করতে। প্রিয়ব্রতও তার চোখের আড়ালে চলে যেতে চাইলেন। রোদ চলে গেলেও বসানো রয়েছে আচাড়ের বয়াম। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়া নিজের পুরাতন বাড়ীটা দেখতে দেখতে এগিয়ে চললেন বাগানের দিকে। অনেক গাছই কাটা পড়েছে। বাগানের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মেঠো রাস্তা ইঁট ফেলে মোরাম দেওয়া হয়েছে। সেই দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষন। ওদিকেই ছিল দক্ষিনপাড়া, শান্তাদের বাড়ী।
মুখের সামনে একটা বোলতা অনেকক্ষন ধরে উড়ছে। বারে বারে তাড়াতে চাইলেও আবার সেই মুখের সামনে। আতাগাছে বোলতার চাকটা আছে নাকি এখনো। ঘটনাটা মনে পড়তেই নিজে নিজেই লজ্জা পেলেন প্রিয়ব্রত।
এই আতাগাছটার নীচেই এক্কা দোক্কার ঘর কেটে ঘুঁটি চালছিল শান্তা। ঘুঁটি কুড়োবার সময় ফ্রকের গলার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়েছিল একটা বোলতা। বার করতে পারছিল না কিছুতেই। অহেতুক লাফালাফি করছিল। কোনো উপায় না দেখে ফ্রকের পিছনে আটকানো সেফটি পিনটা খুলে একটানে ফ্রকটা মাথার ওপর তুলে ধরেছিল প্রিয়ব্রত। বোলতাটা বেরিয়ে গিয়েছিল সহজেই। কিন্তু সেই সময় তার হাতে ছোঁয়া লেগেছিল সদ্য প্রস্ফূটিত হওয়া যৌথ নারীত্বে গর্বের একটিতে। কোমল পেলব স্পর্শ হাতে থেকে গিয়েছিল অনেকক্ষন। সেই প্রথম চোখে পড়েছিল শান্তার লুকানো সম্ভার।
প্রতিক্রিয়া হয়েছিল নিদারুণ। এর চেয়ে বোলতা কামড়ালে এত বিচলিত হত না শান্তা। তীব্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রিয়ব্রতর ওপর। কিল, ঘুঁসি, নখের আঁচড়ে বিব্রত প্রিয়ব্রতকে মাটিতে পেড়ে ফেলে উদ্যত হয়েছিল তার হাফপ্যান্টের বোতাম খুলে দিতে। নির্বিবাদে মার খেয়ে অপরিসীম লজ্জার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছিল কোনোক্রমে। শোধ তুলতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ী ফিরে গিয়েছিল শান্তা। শঙ্কিত ছিল প্রিয়ব্রত আরো কিছু অনর্থ ঘটার আশঙ্কায়। না, সেরকম কিছু ঘটেনি। বেশ কিছুদিন বাদে শান্তা আবার ফিরে এসেছিল। তবে, প্রিয়ব্রতর সঙ্গ ছেড়ে সে মায়ের কাছে মাদুরে বসে অন্যান্যদের সঙ্গে গল্প করত। প্রিয়ব্রতর মনে হয়েছিল শান্তা বড় হয়ে গেছে।
রাস্তা দিয়ে একটা লোক আখ বিক্রি করে ফিরছিল। অবশিষ্ট রয়ে গেছে কয়েকটা। হঠাৎ কি মনে করে ডাক দিলেন প্রিয়ব্রত- “ও ভাই”।
লোকটা চলতে চলতে ফিরে তাকাল। সাহেবী পোষাক পরা লোক তাকে ডাকবে! সন্দেহ হল,
“আমায় বলছেন?”
“হ্যাঁ, আখ কত করে?”
“গোটা নেবেন?”
“হ্যাঁ গোটাই নেব, টুকরো করে দেবে তো। দাম কত পড়বে বল?”
“পনেরো টাকা দেবেন”।
পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে একটা কুড়ি টাকার নোট ধরিয়ে দিলেন।
“পাঁচ টাকা খুচরো নেই যে”।
“ঠিক আছে, তুমি পুরোটাই নাও, একটা টুকরো আমায় দিয়ে বাদবাকী গুলো বড় রাস্তায় আমার গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে, ড্রাইভারের হাতে দিয়ে দিও”।
আখের টুকরোটা দাঁত দিয়ে ছুলতে ছুলতে নির্জন বাগানের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চললেন প্রিয়ব্রত পশ্চিমদিকের পুকুর পাড়ে। কলমী শাকের ঝাড়ের পরিবর্তে সবুজ কুচো পানায় ভর্তি পুকুরের জল। ঘাটের সিঁড়ির অনেকগুলোই ভেঙ্গে গেছে। দেখেই বোঝা যায় ব্যবহার হয় না পুকুরটা। সিঁড়িরই একটা ধাপিতে ধুলো ঝেড়ে বসলেন বহুবছর পর।
শীতকালে দিনের আলো বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে আসে। হাঁসগুলো জল থেকে উঠে পাখা ঝাড়তে ঝাড়তে রওনা দিচ্ছে আস্তানার উদ্দেশে। অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে দূরের ঘরগুলোয় আলো জ্বলে উঠছে। কোনকালে দেখা কাঁচা বাড়ীগুলো আর নেই, সকলেরই রূপ পরিবর্তন করে নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব জাহির করছে। ইলেক্ট্রিক এসে গেছে প্রায় সর্বত্র। শোনা যাচ্ছে দু’একটা শাঁখের আওয়াজ। উঠোনের তুলসী মঞ্চে বিকেলে দেখা বউটি হয়তো জ্বালিয়ে দিচ্ছে সন্ধ্যা প্রদীপ, যেমনটি তার মা দিত শাড়ীর আঁচল গলায় জড়িয়ে।
দু’টো কস ছড়ে গেছে প্রিয়ব্রতর। দাঁতে বোধহয় আর সেই জোর নেই। আসল কথা অভ্যেসটাই চলে গেছে। আধ খাওয়া আখটা ছুঁড়ে ফেললেন পুকুরের জলে। দেখা গেল না, কোথায় পড়ল। রুমাল বার করে মুখ মুছলেন প্রিয়ব্রত।
অন্ধকার আরো ঘন হয়ে এসেছে। ঠান্ডা বাড়ছে আস্তে আস্তে। শোনা যাচ্ছে একটানা ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। কারুর জন্য কি প্রতীক্ষা করার কথা ছিল, না তা তো নয়। একটা ঘোরের মধ্যে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সামনের অন্ধকারের দিকে। কোথায় সেই ফেলে আসা ভালো থাকা। হয়ত সর্বত্রই কিংবা নেই, বৃথাই তার সন্ধান এখন।
“স্যার, আপনি এখানে?”
চমক ভাঙল প্রিয়ব্রতর। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালেন। পিছন ফিরতেই চোখে পড়ল দাঁড়িয়ে থাকা সন্তোষ ড্রাইভারের হাতে জ্বলতে থাকা টর্চের আলো।
“রাত হয়ে যাচ্ছে স্যার। আমাদের ফিরতে হবে”।
“হ্যাঁ চলো”।
জোনাকী পোকার জ্বলা-নেভা অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে প্রিয়ব্রত ফিরে চললেন শহরের আলোকোজ্জ্বল আবাসনের উদ্দেশে।
পড়লাম । সুন্দর গল্প । একটা সরলতা ছুঁয়ে থাকে আপনার লেখা । ছবির মতো ভেসে ওঠে চমৎকার সব দৃশ্যকল্প । এই রকম কত প্রিয়ব্রত আছে নাগরিক জীবন থেকে মুক্তি পেতে চান অথচ পারেন না । শেষটা ভালো হয়েছে । পাঠকের ভাবার জন্য অনেকটা স্পেস রেখেছেন ।
খুব ভালো লেখা