স্বর্ণ সন্ধান ও স্ত্রী মাকড়সা

নীল সমুদ্রের বুকে খেলনা জাহাজ ভাসায় গগন। সমুদ্র বলতে বিশ্ব মানচিত্রে বিস্তীর্ণ নীলরং’এর অংশটি যা সারা পৃথিবীর সাগর মহাসাগর রূপে চিহ্নিত। সেখানেই মেলা থেকে কিনে আনা খেলনা জাহাজ ভাসিয়ে সুষেণ হাজরার মুদিখানার লাগোয়া সংকীর্ণ পরিসর থেকে নিজেকে নিয়ে যেতে চায় পৃথিবীর নানান বন্দরে। দুপুরে যতক্ষণ মুদিখানা দোকান বন্ধ থাকে , চৌকিতে বিছিয়ে দেয় স্কুল থেকে চুরি করে আনা পৃথিবীর মানচিত্র। ভারতের যেকোন বন্দর থেকে জাহাজ রওনা করিয়ে দেয় সে। কখনো সুয়েজ পেরিয়ে কিংবা উত্তমাশা অন্তরীপ পাস কাটিয়ে ভাস্কো ডা গামার যাত্রাপথের বিপরীতগামী রেখা ধরে গগনের জাহাজ ভেসে চলে অনিদিষ্ট লক্ষ্যে।সারা মানচিত্রের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নাম না জানা বন্দরে নোঙর করায় তার প্রতীকী জাহাজটিকে। হয়ত মনুষ্যহীন দ্বীপে সন্ধান পেতে পারে অঢেল সোনার কিংবা ইনকাদের হারিয়ে যাওয়া রাজ্যপাট অথবা এল ডোরা ডো-র রাজপ্রসাদ। সেখানেই কাটিয়ে দিতে চায় বাকী জীবন, স্বেচ্ছাকৃত নির্বাসনে।
এমন অসম্ভব স্বপ্ন দেখা গগন সুষেণ হাজরার মুদিখানা দোকানে কাজে ঢুকেছিল তার কারবারের দু’নম্বরী খাতা লিখবে বলে। যে কাজটা আগে করত ধীরেন নন্দন। এখন দোকানের সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব তার ওপর। বেচাকেনা থেকে শুরু করে সন্ধ্যেবেলায় সুষেণকে হিসেব মিলিয়ে দেওয়া সব কাজই তাকে একার হাতে করতে হয়। তারই মধ্যে দুপুরটা একটু বিশ্রাম। সেটুকু বরদাস্ত করতেও রাজি নয় সে। সারা দুপুর জাহাজ চালায় আপন মনে।
ধীরেন নন্দন আতসপুরের লোক। তাই নিজের পরিবার ছেড়ে সুষেণ হাজরার দোকান পাহারা দেবার কাজটা মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। গগন আবার আতসপুরের ছেলে নয়। তিন চার ক্রোশ দূরে তার বাড়ি। ধীরেনের মতন তার কোন পিছু টান নেই।অভাবের তাড়নায় মা বাবা চায়নি গগন তার লেখাপড়া আরো এগিয়ে নিয়ে যাক। তার চেয়ে বরং রোজগারের ধান্দা করলে অভাবী সংসারে কিছুটা উপকার হয়। লেখা পড়া না শিখলে যে রোজগারের জগতে ক্রমশই পিছিয়ে পড়বে এই সত্যটা উপলব্ধি করে কিছুটা জেদের বশে দীর্ঘদিনের জমানো সামান্য কিছু টাকা পয়সার ভরসায় বাড়ির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করে আতসপুর ইস্কুলের বোডিংএ ভর্তি হয়ে গিয়েছিল মাস্টারমশাইদের আশ্বাসে। পড়াশুনোয় ভালো ছিল বলে স্যারেদের নেকনজরে ছিল। কিন্তু জমানো টাকা আর ক’দিন যায়, সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে আবার গ্রামে ফিরে যাবে কিনা এই ভাবনা যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, ঠিক তখনই ধীরেন নন্দনের সঙ্গে তার দেখা।
বয়স হয়ে যাওয়ায় ধীরেন চোখে দেখত কম, যোগ বিয়োগে ভুল হত বিস্তর। ভুল ধরা পড়ায় মারতে বাকী রেখেছিল সুষেণ হাজরা। তাই সামান্য কিছু হাত খরচা দিয়ে বিকালে চা বিস্কুট খাইয়ে গগনকে দিয়ে হিসাব মেলাত ধীরেন।
কাজটা সুষেণের চোখ এড়িয়ে যায়নি। খুব ভাল চোখে দেখেনি এটা। কিন্তু ব্যবহারে বুঝতে দেয়নি ধীরেনকে। বরং অন্য মতলব তার মাথায় ঘুরছিল ধীরেনকে জব্দ করার জন্যে। যখন দেখল উৎসাহী গগন কয়েকদিনের মধ্যেই খাতাপত্তর উলটিয়ে দু’নম্বরী খাতা লেখার কূটকৌশল শিখে নিয়েছে তখন আর ভাবনা কি। আর হবে নাই বা কেন, ইস্কুলে সাধারণ মানের ছেলেদের থেকে অনেকখানি এগিয়ে ছিল সে। ধীরেন সহায়তায় মুদিখানা দোকানে থাকার একটা পাকাপোক্ত ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল। দোকান পাহারা দেবার কাজটা গগনের ঘাড়ে চাপিয়ে নিশ্চিন্তই ছিল ধীরেন। সব কিছু আড়াল থেকে লক্ষ্য রাখছিল সুষেণ, মুখে কিছু বলেনি। আপত্তি ছিল না গগনেরও। আনন্দেই থাকত,ইস্কুল ছুটি থাকলে দুপুরে জাহাজ ভাসায় নিজের মনে আর সন্ধ্যায় মোমবাতির আলোয় প্রস্তুতি নেয় চুড়ান্ত পরীক্ষার। আপত্তি করেনি সুষেণ বরং দোকান সংলগ্ন ছোট্ট পরিসরে ইলেকট্রিক ল্যাম্প জ্বলানোর জন্যে অনুমতি দিয়েছিল গগনকে। আপত্তির পরিবর্তে নীরবে উৎসাহ জুগিয়ে চলছিল সুষেণ হাজরা।
ধীরেন নন্দন চালটা ধরতে পারেনি। ধরতে পারল গগনের পরীক্ষা শেষ হবার পরদিন। সুষেণ হাজরা সরাসরি ধীরেনকে খারিজ করে বহাল করল গগনকে ।কারণ দুটো – প্রথমতঃ গগনকে অনায়াসে দুশো টাকার কমে বহাল করা গেল সঙ্গে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা। নয় নয় করে তিরিশটা পাত পড়ে সুষেণ হাজরার বাড়ীতে, একটা বাড়তি লোক খেলে খরচা খুব একটা বাড়বে না বলেই ধারণা ছিল তার। দ্বিতীয়তঃ গগন হিসেবপত্রে অনেক নির্ভরযোগ্য, এবং দোকান পাহারায় কোন গাফিনতি থাকবে না।
কারবার সুষেণের একটা নয়, মুদিখানা ছাড়াও তেল কল, গম ভাঙ্গানোর চাকি, খড় কাটা মেসিন কি নেই। সুষেণ অনেকদিন ধরেই এমন একজন লোক খুঁজছিল, যে শুধু খাতাপত্তরে লেখালিখি নয় ম্যানেজারীর কাজটাও করতে পারবে।
গগনের বয়স কম , মুদিখানা দোকানের কাজকর্ম সামলে অন্য কাজের ভার আস্তে আস্তে বাড়িয়ে গগনকে দায়িত্ববান করে তুলতে সাহায্য করবে সুষেণ। এটাই তার মনোবাসনা। এত কিছুর মাঝে প্রতিনিয়ত জাহাজ চালনাই তার একমাত্র বিলাস। যতই গোপনে এই অভ্যাস করুক তার যাবতীয় খোঁজখবর যে কী করে সুষেণ হাজরার মেয়ে মন্দোদরী ওরফে মন্দার কছে পৌঁছে গিয়েছিল তা গগন জানতে পারল আজকের দুপুরে।
গগনের খেলনা জাহাজ সবেমাত্র ট্যাঙ্গানাইকা ছুঁয়ে আরো দক্ষিণে এগিয়ে চলেছে , খুঁজছে কোন অজানা দ্বীপ । শীতের দক্ষিণের রোদ সঙ্গে নিয়ে দরজা ঠেলে মন্দা ঢুকে পড়ল অকস্মাৎ। নিচের ঠোঁট কামড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে বিরক্তিভরা মুখ নিয়ে। দরজা দিয়ে আসা শীতের মিঠে রোদ একমাত্র পরে থাকা নাইটির অন্তুজাল ভেদ করে মন্দার দুটি পায়ের অবস্থান এবং যতটা চোখে পড়া উচিত তার অপেক্ষা কিছুটা বেশীই গগনের চোখে ধরা পড়তে লাগল, মন্দাকে দূর থেকে দেখেছে অনেকবার কিন্তু এতটা নিকটে এভাবে দেখার অভিজ্ঞতা তার এই প্রথম। তাই চোখ দুটো আটকিয়ে গিয়েছিল মন্দার শরীরের নীচের অংশে।
“ আজ আবার ম্যাপ নিয়ে বসেছ”- এটা প্রশ্ন না অভিযোগ ঠিক বুঝতে পারল না গগন। বরং মন্দার পায়ের দিকে তাকিয়ে শারীরিক চাঞ্চল্য অনুভব করল সে। সেটা কতখানি সঙ্গত, সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন গগন মন্দার কথার জবার দিল না।
জবাব অবশ্য মন্দা আশাও করেনি। কারণ সে জানে এর কোন উত্তর হয়না। গগনের তাকিয়ে থাকা দেখে সে কিছুটা সচেতন এইবার-
“ কী দেখছ হাঁ করে”?
মন্দার প্রশ্নে সম্বিৎ ভাঙ্গল গগনের। কী দেখছে এই প্রশ্নেরও সঙ্গত উত্তর দেওয়া যায় না। গগন এটা জানে বলেই বলল “ কিছু না”। কিন্তু নারী সুলভ চেতনা মন্দাকে আগেই সতর্ক করেছিল।রোদ থেকে সরে আরো ঘরের ভেতরে ঢুকে এলো সে। ম্যাপের ওপর রাখা খেলনা জাহাজটা তুলে ছুড়ে ফেলে দিল ঘরের এক কোণে। গগন তাকাল সেই দিকে।
“ এই জাহাজের ভূত না ছাড়তে পারলে মানুষ হবে না তুমি। আজ রাতে দরজায় টোকা দিলে খুলে দিও। তারপর দেখব কতদিন থাকে তোমার জাহাজ চালানোর ভূত”।
মন্দার কথা বোধগম্য হওয়ার সাথে সাথে উত্তেজনা, ভয় সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল গগনের। মন্দার কৃপার দৃষ্টিতে সেও যে একজন তা ভাবতেই কেমন যেন দুর্বলতা অনুভব করল। মন্দার শারীরিক সম্পদ যে কতখানি আকর্ষণীয় এবং উত্তেজক আর সে ব্যাপারে বিধাতাপুরুষ যে কীরূপ অকৃপণ তা মন্দাকে এক নজরে দেখলেই বোঝা যায়।
মন্দা সম্বন্ধে নানান জনশ্রুতি গগনের কানে আসত। দূর থেকে কখনো কখনো তার কামনা ভরা কটাক্ষে নিজে নিজেই ধন্য হত গগন। আজ বুঝতে পারছে তার সম্পর্কে মন্দার মনোভাব, যা সে কল্পনা করত মনে মনে তা মোটেই ভুল নয়। আজ এই অভাবনীয় আবির্ভাব উপরন্তু এই প্রস্তাব সেদিনের কল্পনাটাকেই বাস্তবায়িত করে তোলে।
সে মন্দার প্রস্তাবে রাজি হবে কিনা এই সিদ্ধান্তে আসার আগেই মন্দা ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। জাহাজের ভূত সত্যিই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূল থেকে সোজা এসে পড়েছে সুষেণ হাজরার মুদিখানা দোকান সংলগ্ন ছোট্ট পরিসরে।
নির্জন শীতের দুপুরে ঘুঘুটা ডেকে ডেকে ফিরছে। শরীরী উত্তেজনা প্রশমিত হবার পর নানান ভাবনা আছড়ে পরতে লাগল মনের দোরগোড়ায়।মন্দার দুঃসাহসিক প্রস্তাবে নৈতিক মাপকাঠিতে মাপতে গেলে উদ্‌বেগের মাত্রা বেড়েই যায়।মালিকের মেয়ের সাথে শারীরিক নৈকট্য যে সুষেণ হাজরার কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না সে সম্বন্ধে একপ্রকার নিশ্চিত গগন। কিন্তু মন্দার অপ্রতিরোধ্য গতি রোধ করবে কী করে। নিজের গররাজির কথা জানালেই কি যথেষ্ঠ নাকি। মন্দার প্রবল তোড়ে খেলনার জাহাজের মত ভেসে যাবে অনিদিষ্ট লক্ষ্যে।
(২)
সময় যত এগোতে লাগল ভেতরের উত্তেজনা হাতে পায়ে টের পাচ্ছে গগন। তাই শুয়ে পড়লেও আলোটা জ্বালিয়ে রেখেছিল সাহস সঞ্চয়ের জন্যে। মন্দার আগমন মুহুর্ত আগাম কল্পনা করে নিষিদ্ধ আনন্দ উপলব্ধি হচ্ছিল। উত্তেজনার বেড়ার আড়াল থেকে মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছে গগন। অস্থির মনটা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে মন্দাকে ঘিরে। এখনো স্থির করে উঠতে পারছে না কী করবে সে।
থানার পেটা ঘড়িতে এগারোটা বাজল। গগন পাশ ফিরল। হাত বাড়িয়ে আলোটা নিভিয়ে দিতেই একরাশ অন্ধকারে গগন চাপা পড়ে গেল। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল নিজের অজান্তে।
ঘুম ভাঙ্গল দরজার আওয়াজে। গগন অপেক্ষা করতে লাগল দ্বিতীয়বার শোনার জন্যে। এটা তো দরজায় টোকা দেবার শব্দ নয়। কেউ যেন জোর পূর্বক খুলতে চাইছে, না খুললে ভেঙ্গেই ঢুকে পরবে বোধহয়। অধৈর্য মন্দা কী শেষ পর্যন্ত এই পথ বেছে নিল;। আর দেরি করা উচিত নয়। ঘরের আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলে দিল গগন।
সঙ্গে সঙ্গে দুজন মাঝবয়সী লোক দ্রুত ঢুকে পড়ল। তাদেরই একজন গগনের গলায় ছুরি ঠেকিয়ে দেয়ালে ঠেসে ধরেছে। দু্টো লোকই গগনের মুখ চেনা। ন্যাপা আর ভুটকা, বর্ডারে স্মাগলিং করে। এটুকু ওদের সম্বন্ধে জানা কিন্তু চুরি ডাকাতি করে বলে সে জানত না।
“শব্দ করলে পুরো মালটা গলায় ঢুকিয়ে দেব। বল শালা গুড়ের হাঁড়িটা কোথায়?
আকস্মিকতা এমন পর্যায়ে যে স্বাভাবিক চিন্তাভাবনারহিত গগন মন্ত্রমুগ্ধের মতন দেখিয়ে দেয় চৌকির ওপরে রাখা খেজুর গুড়ের কলসী যাতে একটা হাতা ঢোকানো আছে গুড় বার করার জন্যে। দেখানো মাত্রই একজন হাতাটা নামিয়ে পুরো একটা হাতটা ঢুকিয়ে দেয় গুড়ের কলসীতে। অপেক্ষা করতে নারাজ অন্যজন , গগনকে ছেড়ে পাশে পড়ে থাকা হাতাটা দিয়ে ঘা মারে কলসীর গায়ে, এক ঘায়েই কলসী ভেঙ্গে সমস্ত গুড় ছড়িয়ে পড়ল চৌকির ওপর, তারপর গড়িয়ে মাটিতে।
“একী করলে ভুটকাদা”। কলসির কানাটা তখনো ন্যাপার ডান হাতে আটকে আছে।
“ অত সময় নেই ভাল করে চটকিয়ে দেখ কোথায় রেখেছে মালটা।
এতক্ষণে গগন বুঝতে পারল এরা কিছু একটা খুঁজতে এসেছে। আটকে থাকা কলসির কানা বার করে ন্যাপা গুড়ের মধ্যে খুঁজতে লাগল সেই ঈস্পিত বস্তুটি। অন্যদিকে ছুরি হাতে গগনকে পাহারা দিতে লাগল ভুটকা। যদিও তার প্রয়োজন নেই। চিত্রবৎ দেয়ালে সেঁটে ন্যাপার কান্ডকারখানা দেখতে লাগল বিস্ফোরিত চোখে। কীসের আশায় স্মাগলার দুটো দোকানে ঢুকেছে তা বোধগম্য হচ্ছে না গগনের।
“না ভুটকাদা কোথাও কিছু নেই”।
“এই ছোঁড়া আর কোথায় তোদের গুড়ের কলসী রেখেছিস”।
“তিনটে নাগরি চৌকির নীচে রাখা আছে”।গগনের কথা শেষ হবার আগেই ভুটকা নিচু হয়ে নাগরিগুলো চৌকির নীচ থেকে বার করে দড়াদুম শব্দে ভাঙ্গতে লাগল। রাতের নিস্তব্দ অন্ধকারে নাগরি ভাঙ্গার শব্দ যতই হোক না কেন, দোতলা বাড়ীর অভ্যন্তরে সুষেণ হাজরার কানে যাবে না এ বিষয়ে ওরা নিশ্চিত। ন্যাপা দ্রুত হাতে খুঁজতে লাগল গড়িয়ে যাওয়া গুড়ের মধ্যে সন্ধানকৃত বস্তুর অস্তিত্ব। প্রায় মিনিট কুড়ির চেষ্টায় খুঁজে না পেয়ে উঠে দাঁড়ায় ন্যাপা, ছেঁড়া গামছায় হাত মুঝে আঙ্গুলের ডগাগুলো চুষে চুষে পরিষ্কার করতে লাগল।
“না ভুটকাদা পাওয়া গেল না। একটা আধটা নয়, পাঁচ পাঁচটা থাকার কথা।

ব্যর্থমনোরথ ভুটকা আবার ছুরি উঁচিয়ে ধরে গগনের দিকে। গগন নষ্ট হয়ে যাওয়া ঝোলা গুড়ের গতিবিধি লক্ষ্য করছিল।চমকিয়ে আবার তাকায় ছুরির ডগার দিকে।
“এই শালা তুই কিছু জানিস? দুনম্বরী খাতা লিখিস আর সোনার বিস্কুটের খোঁজ জানিস না, তাই কি হয়?”
“সোনার বিস্কুট!”জিজ্ঞাসা অপেক্ষা বিস্ময়ই যেন অধিক গগনের গলায়। এতক্ষণে সে বুঝতে পারে দুই মক্কেলের আগমনের হেতু।
“সোনার বিস্কুট!” আবার উচ্চারণ করল গগন,-“ সেগুলো কি গুড়ের কলসীতে থাকার কথা। কই আমি তো কিছু জানি না”।
তাছাড়া এই সমস্ত কাজ কারবারের খবর গগনের মতন নাবালকের কাছে ফাঁস করবে না, যতই সে দুনম্বরী খাতা লিখুক আর যতই আস্থাবান হোক সে।
“তাহলে গুরু পুরো প্ল্যানটাই বানচাল”। ন্যাপা তখনও নখের কোণের লেগে থাকা গুড়ের মিষ্টতা চেখে দেখছে।
“কোথাও একটা গড়বড় হচ্ছে। ধীরেনকে আবার পাকড়াও করতে হবে। ফালতু খবর দেবার লোক তো ও নয়। ও ব্যাটারও স্বার্থ আছে। অ্যাই কী নাম তোর?”
“গগন”।
“ হ্যাঁ। শোন মালিককে বলবি কাল রাতে দোকানে ভাম ঢুকেছিল”।বলেই ভুটকা ছুরি দিয়ে গগনের হাতের নীচটা চিরে দেয়। যন্ত্রণায় চীৎকার করতে গিয়েও থমকে যায় গগন।
“ আর বলবি ভামে আঁচড়িয়ে দিয়েছে”। চালাকি করার চেষ্টা করলে তোর বেওয়ারিশ লাশটা বাংলাদেশে পড়ে থাকবে”। কথাটা বলেই ছুরিটা নামিয়ে নেয় ভুটকা।
“এ্যাই এক প্যাকেট সিগারেট দে। খেতে খেতে চলে যাই”।
গগন দেখিয়ে দেওয়া মাত্র সবচেয়ে দামী সিগারেটের প্যাকেট উঠিয়ে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে যায় দুজনে।
স্বাভাবিক হতে গগনের একটু সময় লাগে। মন্দার ভাবনা অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে মাথা থেকে। মগজের ফাঁকা জায়গাটা ভরে দিয়ে গেছে ছোট্ট দুটো কথা- “সোনার বিস্কুট”। যার খোঁজে এসেছিল দুজনা। ধীরেন নন্দনই খবর দিয়েছে গুড়ের কলসীতে থাকার কথা।এই কারবার তার মানে অনেকদিনের। ধীরেন কানাঘুসোয় শুনেছিল কারো কাছ থেকে। চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে এখন শোধ তুলতে চাইছে।
ঘরে ভাম ঢোকার কথা কখনোই বিশ্বাস করবেনা সুষেণ হাজরা । লোক ঢোকার কথা বললে বিপদ একটা থেকেই যায়। অজানা লোককে রাতের বেলায় দোকানের দরজাই বা খুলে দিল কেন। ঘটনার পরম্পরায় নিজেকে সন্দেহের বাইরে রাখবে কেমন করে। অথচ মন্দা এসেছিল ভেবেই তো দরজা খুলে দিয়েছিল সে। শুধু গুড়ের কলসী ভাঙা দেখলেই ধুরন্ধর সুষেণ হাজরা সন্দেহ করবে, লুকান বস্তু খোঁজার জন্যেই গুড়ের কলসী ভাঙা হয়েছে। গুপ্ত খবর যেভাবেই হোক গগনের কানে পৌঁছেছে। ভামের গল্পটা নেহাতই ভাঁওতা। যতই হাতে থাক মিথ্যে ভামের আঁচড়। রক্ত শুকিয়ে গেলেও জ্বালা আছে এখনো। সেটার চেয়ে বেশী চিন্তা গগনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার।
ভামের গল্প মিথ্যে প্রমাণ হয়ে গেলেই শুধু যে চাকরীটা চলে যাবে তা নয়, কত রকম হেনস্তার মুখোমুখি হতে হবে ভেবেই শিউরে ওঠে গগন।কারণ সুষেণ হাজরাকে সে ভালভাবেই চেনে। এখন এই ঘটনাটাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে হলে অন্যান্য জিনিষপত্রো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। সরষের তেলের টিনটাও উলটে দিতে হবে গড়িয়ে যাওয়া গুড়ের ওপর। ডালের জায়গাটা কাত হয়ে পড়ে থাকবে চৌকির তলায়। কিছুটা ডাল ছড়িয়ে দিতে হবে ইতঃস্তত। তাকের ওপর রাখা কৌটো, শিশি, ডেওডাকনা উল্টে ফেলতে হবে, ভামের গল্প বিশ্বাসযোগ্য করতে আর সেটা তাড়াতেই দরজা খুলে দিয়েছিল গগন। নিজের বুদ্ধির তারিফ না করে পারেনা সে।
নিপুন হাতে অকুস্থল সাজাতে সাজাতে মনে হল ন্যাপা এমনভাবে গুড়ের কলসীগুলো ভেঙ্গেছে, ভামের অত্যাচার বললে কতখানি বিশ্বাসযোগ্য হবে কে জানে। তবু এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই গগনের। কিছুটা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে তাকের ওপর থেকে কৌটো শিশি নামাতে থাকে।, হঠাৎ নজরে পড়ে মাকড়সার জালের আড়ালে রাখা পাটালি গুড়ের বয়াম। সুষেণ হাজরা তাকে জিজ্ঞাসা না করে পাটালি গুড় বিক্রী করতে মানা করেছিল। বিদ্যুৎ চমকে ওঠে গগনের মগজে। আর এক মুহুর্ত দেরী না করে পাটালি গুড়গুলো ভাঙ্গতে লাগল গগন। কয়েকটা ভাঙ্গার পরই নীল সেলোটেপ জড়ানো বিস্কুটের আকৃতির একটা জিনিষ বেরিয়ে পড়ল। নিশ্চিত হবার জন্যে সেলোটেপ সরাতেই হলুদ রঙ ঝিলিক মেরে উঠল। গগনের মুখ দিয়ে স্বগতোক্তি্র মতন বেরিয়ে এল, “ সোনার বিস্কুট”। একটা আধটা নয়, ন্যাপা্ ঠিকই বলেছিল পাঁচ পাঁচটা সোনার বিস্কুট, আরো কয়েকটা পাটালী গুড়ের মধ্যে।
না আর দেরী নয়, তিনটে পঁয়তাল্লিশের প্রথম বাসটা তাকে ধরতেই হবে। নিশ্চিত ভবিষ্যতের উজ্জ্বল ছবি যেন স্পষ্ট দেখতে পায় গগন, ওই সোনার বিস্কুটগুলোর মধ্যে।
পড়ে থাক সুষেণ হাজরার এলোমেলো দোকান ঘর।নিজের প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রগুলো দ্রুত গুছিয়ে নিতে থাকে, রোল করা মানচিত্রটা নিতে গিয়েই থমকে যায়। তার পাশে প্ল্যাস্টিকের খেলনা জাহাজ। বেঢপ মানচিত্রটা প্রয়োজনীয় জিনিষগুলোর সাথে বড়ই বেমানান। উপরন্ত লোকের চোখ টানবে সহজেই। সঙ্গে নেওয়া যাবে না তার প্রিয় জিনিষটা । তাইতো শেষবারের মতন ম্যাপটা বিছিয়ে দেয় চৌকির ওপর। খেলনা জাহাজ ভাসায় শুকনো নীল সমুদ্রে। বোঝাই করে সোনার বিস্কুট খেলনা জাহাজে। যেন কোন এক অনাবিষ্কৃত দ্বীপ থেকে সংগ্রহ করে জাহাজ ভর্তি করেছে তাল তাল সোনা।
নীল সমুদ্রের স্রোতের বিপরীতে জাহাজ এগিয়ে চলেছে, নরম কুয়াশার আস্তরণ সরিয়ে বিশাল সমুদ্রে মোচার খোলার মতন ভাসছে গগনের খেলনা জাহাজ। দূর আকাশ কালপুরুষ চিনেও চিনতে পারে না গগন। সব তারাই যেন বড় ম্রিয়মাণ। উদভ্রান্তের মতো চেনা তারা খুঁজতে থাকে সে। কম্পাসের ওপর ভরসা নেই তার। দিক্‌নির্ণয় যদি ভুল হয় তবে কি সে পথ হারিয়ে অনন্তকাল ভেসে বেড়াবে সমুদ্রের বুকে। কত অক্ষাংশ কত দ্রাঘিমা নীরবে পার হয়ে যায়। ধীর গতিতে জাহাজ এগিয়ে চলে পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্যে। আর কিছুটা পথ রাতের আকাশ তো এত তাড়াতাড়ি ফ্যাকাশে হয়ে আসবে না। তাহলে দূরের তটভূমি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কি করে, ওই লক্ষ্যেই কি নিয়ে যেতে হবে সোনা বোঝাই জাহাজটাকে।
মশগুল গগন জাহাজ চালানোয় এতটাই নিবিষ্ট বহির্বিশ্বের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্কের যোগসুত্র হারিয়ে ফেলেছে মুহুর্তকাল ব্যাপী। সেই সুযোগে হঠাৎ একটা হাত মানচিত্রের ওপর থেকে জাহাজটা তুলে নেয়। চোখ তুলে তাকাতেই গগনের ঘোর ভাঙ্গে- মন্দা! সোনার বিস্কুটগুলো ব্লাউজের মধ্যে ঢুকিয়ে খেলনা জাহাজটা ছুড়ে ফেলে দেয়।
লুন্ঠিত নাবিকের মতন তাকিয়ে থাকে গগন। প্রত্যাঘাটের সুযোগ না দিয়ে মন্দা ঝাঁপিয়ে পড়ে গগনের ওপর। গগন শেষ চেষ্টা করে – তার অতুলনীয় বক্ষ সম্পদে স্বর্ণ সন্ধানের, কিন্তু অতলে তলিয়ে যেতে থাকে সে। কে যেন নীল সমুদ্রে ডুবিয়ে মারছে তাকে।
আর সেই তাক সংলগ্ন দেয়ালের পাশে মাকড়সার জালে তখন তীব্র আন্দোলন। হয়ত কোনো রতিতৃপ্ত স্ত্রী মাকড়সা ভক্ষণ করছে খানিক আগের পুরুষ সঙ্গীকে।

This Post Has 2 Comments

  1. amitava das

    কিছু বলার নেই । অসামান্য ভালো গল্প ।

  2. Debabrata Basu

    বাঃ, বেশ ভালো লাগলো। গগনের টানটান উত্তেজনা পাঠকের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। কল্পনা ও বাস্তবের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে হয়তো গগন অনুভব করে যে সে শেষের গানের রেশ নিয়ে কানে চ’লে এসেছে।

Leave a Reply