ষাটের দশকের শেষের দিকে ইউরি গেলারের কথা পড়েছিলাম,শুধুমাত্র চোখের দৃষ্টিতেই এমন সব অলৌকিক কাজ কর্ম করে থাকেন যা শুধু অবিশ্বাস্যই নয়, অসম্ভবও বটে। কিছু দিন আগে তিনি স্বীকার করেছেন কোন এক এলিয়েনের সংস্পর্শে এসে এই ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন।উরি গেলার কে আমি দেখিনি তাঁকে দেখে চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হবার সম্ভবনাও নেই।হয়ত তো তার পর থেকেই এই বিশ্বাস হয়েছে,এই যে পার্থিব জগৎ যাকে আমরা প্রতিনিয়ত হাটে মাঠে ঘাটে হাতের কাছে পাচ্ছি,তার বাইরের নিশ্চয় কিছু আছে,যা এই সাদা চোখে ধরা পড়ে না,এই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হল হাসিবুল কাজী কে দেখার পর।তার কথাই বলি।
সালটা ১৯৯৬,নবদ্বীপ থানায় টেবিল ডিউটি করছিলাম,সকাল বেলায় একটি লোক অভিযোগ জানাতে এল, নাম হাসিবুল কাজী,পরনে একটি লুঙ্গি, আধময়লা ফতুয়া, উসখো খুসকো চুল।গায়ের রঙ রোদে পোড়া,দেখে দরিদ্রশ্রেনির মানুষ বলেই মনে হয়। বাড়ী ইলামবাজার, বীরভূম।গত রাতে সে নবদ্বীপ থানার মহীশূরা গ্রামে এসেছিল,এক আত্মীয়ের বাড়ী, সেখানে দুজন লোক ওর দেড় হাজার টাকা ছিনতাই করে নিয়েছে।মহীশূরা মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম,মাঝে মাঝে যে এ রকম ঘটনা ঘটে না তা নয়।কিন্তু লোকটিকে দেখে মনে হয় না দেড় হাজার টাকা সঙ্গে করে আত্মীয়ের বাড়ী আসছিল।জিজ্ঞাসাবাদ করে কোন অসংগতি পাওয়া গেল না, নিজ বক্তব্য সে অটল,এও জানালো ছিনতাইকারীদের নাম সে জানে না, কিন্তু তাদের বাড়ী সে দেখে এসেছে।
আশ্চর্য সমাপতন সেই সময় এক অফিসার ওই গ্রামেই যাচ্ছিলেন অন্য এক তদন্তের কাজে।হাসিবুল কাজীকে পাঠিয়ে দিলাম ওদের সাথে ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্যে।বেশ কিছুক্ষণ পর সেই অফিসার ফিরলেন, ওই গ্রামেরই দুজনকে সঙ্গে নিয়ে।তারা নির্দ্ধিধায় স্বীকার করল, দেড় হাজারেরও কিছু বেশী টাকা তারা ওর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে।ওই গ্রামে সবেবরাত উপলক্ষে ছোটখাট একটা মেলা বসেছিল।সেই মেলায় ওই দুজন জুয়া খেলাচ্ছিল।গ্রামে এই ধরনের মেলায় কমিটির অনুমতিক্রমে জুয়া খেলার আসর বসে থাকে।লাভের একটা বখরা কমিটির ফান্ডে জমা পড়ে।বলা বাহুল্য মেলা বড় হলে,বা অনেকদিন ধরে চললে,পুলিশও এই অনৈতিকতায় জড়িয়ে থাকে। বখরা থেকে সেও বঞ্চিত হয় না।দুজনের কাছ থেকেই জানা গেল, এই হাসিবুল কাজী পাঁচ টাকা দিয়ে জুয়া খেলা শুরু করেছিল।প্রতিবারেই সে যে বাজীটা ধরে তাতেই সে জেতে। শেষে সে পুরো টাকাটাই বাজী ধরে, জিতলে পাঁচ গুণ টাকা ওদের ফেরত দিতে হবে।ওরা আর ঝুঁকি নেয়নি, ওকে মারধোর করে টাকাটা কেড়ে নেয়।হাসিবুলের কিন্তু টাকা ছিনতাইএর জন্যে তেমন দুঃখ নেই, তাকে মারধোর করা হল কেন। টাকা তো ফেরত চাইলেই সে দিয়েই দিত, মারল কেন। লোক দুটিকে হাজতে দিয়ে দেওয়া হল।হাসিবুলকে বলা হল, লিখিত অভি্যোগ দিতে কিন্তু সে লিখতে পারে না। একথা জানার পর বাধ্য হয়েই বললাম, “তুমি খাওয়া দাওয়া করে এস, কোর্টের কোন মুহুরী এলে তাকে দিয়ে তোমার অভি্যোগ লিখিয়ে দেব”।হাসিবুল হেসে বলল,- “ না বাবু আমার খাওয়া দাওয়া করা লাগবেনা,আপনি আমার জন্যে এত কিছু করলেন, আপনাকেই আমার মিষ্টি খাওয়াতে হয়”।
বললাম,-“ তুমি তো চৌখস লোক হে,পুলিশকে মিষ্টি খাওয়াতে চাইছ,তোমার তো দেড় হাজার টাকা ছিনতাই হয়ে গেছে, মিষ্টি খাওয়াবে কোথ থেকে,তাছাড়া আমি এখন কোয়াটারে খেতে যাব”।
“মিষ্টি খাওয়াতে আমার টাকা লাগে না বাবু,মিষ্টি কেন আপনি যা খেতে চাইবেন, আমি তাই খাওয়াতে পারি। কোনো টাকা পয়সা লাগবে না”।হাসিবুল লোকটা একটু অদ্ভুত ধরনের, তা বলে এসব কথা বিশ্বাস হবার কোন কারণ নেই।এখন লোকটাকে আমার ধড়িবাজ মনে হচ্ছে।পুলিশকে দিয়ে অনৈতিক কোন কাজ করিয়ে নেবার জন্যে কিছু দালাল শ্রেনীর লোক জন আছে থানায় যারা প্রায়শই আসা যাওয়া করে তাদের মুখে এই ধরনের কথা বার্তা শোনা যায়।যতই হোক লোকটা অভিযোগ দিতে এসেছে, এবং তার সারবত্তাও কিছুটা আছে। তাই বেশী কিছু না বলে ঠাট্টা করেই বললাম,-“তোমার এখানে শ্বশুর বাড়ী নাকি,যে আমার জন্যে তারা খাসি মারবে”।
“আমি বিয়েই করিনি শ্বশুর বাড়ী হবে কোথা থেকে”।কথাটা শুনে অবাকই হলাম, মুসলিমদের মধ্যে অবিবাহিত্ সংখ্যা নেই বললেই চলে।অথচ মাঝবয়সী একটা লোক বিয়ে করে নি। সেই প্রসঙ্গে না গিয়ে বললাম,-“ বাঃ তোমার কাছে টাকা পয়সা নেই, এখানে তোমার আত্মীয় স্বজন কেউ নেই, অথচ খাওয়াতে চাইচ্ছ, খাবার দাবার কি আকাশ থেকে উড়ে উড়ে আসবে নাকি”।
“আমার কথা আপনাদের বিশ্বাস হচ্ছে না!” মনে হল সে যেন একটু দুঃখ পেয়েছে।
“বেশ বাবু, আমাকে যে কোন একটা ঘরে একলা থাকতে দিন, বেশীক্ষণ নয় পাঁচ দশ মিনিট,দরজা বন্ধ করে দেবেন কেউ উঁকি ঝুঁকি মারবেন,বড় ক্ষতি হয়ে যাবে”।
ইতিমধ্যে থানার বেশ কিছু কর্মী, অফিসার হাজির হয়ে শুনছিল ওর কথা। কৌতুহল এমনি জিনিষ, তাকে উপেক্ষা করি কি করে,সকলের সঙ্গে আমিও উদ্যোগী হলাম ওর কথার সত্য মিথ্যা যাচাই করার জন্যে। সেই সময় আইসি থানা ছিলেন না, ওনার চেম্বারটা এক প্রান্তে, কোন জানলা নেই একটি মাত্র দরজা।হাসিবুল কে ওখানেই ঢুকিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হবে।সেও রাজী হয়ে গেল। শুধু যে কোন একটা বড় পাত্র চেয়ে নিল,ঘরে ঢোকার সময় আবার সাবধান করে দিল-দরজা খুলতে না বলা পর্যন্ত আমরা কেউ যেন না খুলি। থানায় তো অত্যুৎসাহী দের অভাব নেই,বার বার ওই কথা বলায় আমি আর কোন ঝুঁকি নিলাম না।দরজার কড়ায় হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে চাবিটা নিজের কাছে রাখলাম।হাসিবুলকে আমার আর তখন সাধারণ মানুষ বলে মনে হচ্ছিল না।পাঁচ টাকা নিয়ে শুরু করে যে দেড় হাজার টাকা জিততে পারে।সবটাই কপালের জোরে হয়েছে বলে মনে হল না,নিশ্চয়ই এর পিছনে কোন রহস্য আছে।
যাই হোক দশ মিনিটও অপেক্ষা করতে হয়নি। ভেতর থেকে খুট খুট আওয়াজের সংকেত পাওয়া মাত্র দরজা খুলে দিলাম। একটা বড় স্টিলের পাত্র দেওয়া হয়েছিল। সেই পাত্র ভর্তি রসগোল্লা।অবিশ্বাস্য!!!সকলে হৈ হৈ করে উঠল।যারা এদিকে ওদিকে ছিল তারাও এসে জড় হয়েছে। রসগোল্লাগুলো খুব ভাল করে দেখলাম। না নবদ্বীপের কোন মিষ্টির দোকানে এই ধরনের রসগোল্লা বানানো হয় না।মোটা রসের তৈরী, সাইজ বেশ বড় কিন্তু সাদা ধবধবে নয়।চিনির গাদ তুলে ফেলা হয়নি বলেই একটু ময়লা ।গ্রাম গঞ্জে এই রকম মোটা রসের মিষ্টি বানানো হয়।কয়েক জন রসগোল্লা খাওয়া শুরু করল, স্বাদে কোন তফাৎ নেই, একটু বেশী মিষ্টি।সেটা রসগোল্লা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।আমি অতিরিক্ত মিষ্টি রসগোল্লা খাই না, আমার জন্যে স্পঞ্জ রসগোল্লা আনতে পারবে কিনা জিজ্ঞাসা করিনি।ইতিমধ্যে এক নেপালী অফিসার ফরমাস করে বসল,কাজু বাদামের।কোন অন্যথা হল না এবারো, মিনিট দশেকের মধ্যেই প্রায় কেজি খানেক কাজু বাদাম। উৎসাহ এবং ফরমাশের কোন শেষ নেই। একটা কাজু বাদাম খেয়ে দেখলাম, না কোন তফাৎ নেই। হাসিবুলকে নিয়ে থানার অফিস রুমে বসিয়ে রাখলাম, সকলকেই বলে দিলাম ওকে যেন বিরক্ত না করে।
বিকালের দিকে মহীশূরা গ্রামের বেশ কিছু লোক জন থানায় এলেন, তার মধ্যে শাসক দলের নেতা, পার্টি কর্মী, আর এক বৃদ্ধ চাচা, দলমত নির্বিশেষে সালিসী করে থাকেন।একটাই অনুরোধ যাদের ধরে আনা হয়েছে তাদের যেন ছেড়ে দেওয়া হয়,মামলা মোকদ্দমা না করে, এই সব আবদার তো আর নতুন নয়।থানা অফিসার হিসাবে এই সব চাপ সামলাতেই হয়। যেহেতু ধৃত লোক দুটি তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে, তাই গ্রামের মাতব্বরা তাদের সপক্ষে খুব একটা সওয়াল করতে পারছিলেন না, শেষ বৃদ্ধ চাচা হাসিবুলের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি চাইলেন।হাসিবুল সরল মানুষ, মধ্যস্থতায় রাজী হয়ে গেল, কারণ টাকা চলে যাওয়াতে তার কোন খেদ নেই।শুধু মার খাওয়ার বিচার চাইতে এসেছিল।ঠিক হল ছিনতাই হওয়া দেড় হাজার টাকার মধ্যে সাড়ে আটশো টাকা ফেরত দেবে, হাসিবুলের কাছে ক্ষমা চাইবে।বিনিময়ে হাসিবুল থানায় কোন অভিযোগ দায়ের করবে না।তবে টাকাটা সে ওদের হাত থেকে নেবে না, থানার যে কোন অফিসারের হাত থেকে নেবে। জুয়ার টাকা নানান খুচরোয় হয়ে থাকে, এক্ষেত্রেও তাই।ডি আই বি র এক সাবইন্সপেক্টর টাকাটা নিয়ে হাসিবুল কে দিতে গেলে, হাসিবুল গুনতে বলল। আশ্চর্য সাড়ে আটশো টাকা দেবার কথা,গোনার পর দেখা গেল ন’শবারো টাকা।তখনই গ্রামের এক ছুটকো নেতা বলে উঠল, “তাহলে বেশী দেওয়া হয়ে গেছে”। হাত বাড়িয়ে ফেরত নিতে যাবে হাসিবুল বাধা দিল। “দাঁড়ান, আগে বলতে হবে কত টাকা বেশী দিয়েছেন”। টাকাটা এবারেও হাসিবুল নিল না , টাকাটা আর একজন কে গুনতে বলল,এবার হাজার আশী।তৃতীয় বার গোনার সময় বারোশো টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সেই টাকাটাই হাসিবুলের হাতে জোর করে ধরিয়ে দেওয়া হল। হাসতে হাসতে হাসিবুল বলল, “না বাবু সব ঠিক আছে, ওইজন্যেই তো জিজ্ঞাসা করছিলাম, ওরা কত টাকা বেশী দিয়েছেন ।
বৃদ্ধচাচা উঠে এসে হাসিবুলের হাঁটু ছুঁইয়ে প্রনাম করল, আমাকে বললেন, “স্যার ও সাধারণ মানুষ নয়, ওর জিন বাঁধা আছে”।মনে হল গুপী গাইনে ভূতের রাজা তাহলে কল্পনা নয়, বাস্তবেও তার দেখা মেলে।
হাসিবুল সে রাতে থানায় থেকে গেল,অনেক গল্প গুজব করলাম ওর সঙ্গে।কিন্তু কি করে এই সব অলৌকিক ক্রিয়া কলাপ ঘটছে, সে সম্পর্কে একটা কথাও বলল না।আট ন’বছর বয়স থেকেই সে এসব করতে পারে, কি করে হয় নিজেও জানে না।জিজ্ঞাসা করলাম, “টাকা নিয়ে কি করবে হাসিবুল’।
“কি আর করব, আমার তো টাকা কাজে লাগে না,যদি দেখি কোন গরীব দুঃখীর দরকার আছে দিয়ে দেব”। পরদিন সকালে হাসিবুল চলে গেল। আর কখনো তার সাথে যোগাযোগ হয়নি।
আরিব্বাস– অবাক করা কাহিনি । চমকে উঠতে হয় । তবে এমন হয় হয়ত । ভালো লাগল । টানটান লেখাটা ।