যাত্রাবদল
গেঞ্জীটা বালতির জলে ডুবিয়ে না নিঙিয়েই উঠানে টাঙানো তারে মেলে দেয় মজিদ। ছরছর করে জল ঝরতে থাকে ভেজা গেঞ্জী থেকে। সেই দিকেই তাকিয়ে থাকলেও মজিদ ভাবছিল অন্য কথা। ঝরা জল ধীরে ধীরে সরু হয়ে ফোঁটা ফোঁটায় রূপান্তরিত হয়ে মাটিতে পড়তে শুরু করল। উঠানের এক কোণে দাঁড়িয়ে রেশমা চুপ করে দেখছিল মজিদের ক্রিয়া কলাপ। বুঝতে না’পেরে একরকম আঁতকেই ওঠে –“ একী কইরল্যা, বিয়া বাড়ি যাবা না, গেঞ্জী ভিজায়ে দিলে ক্যান ?’ চমক ভাঙ্গে মজিদের, ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল রেখে চাপা গলায় বলে –“ চুপ একটা কথা কবি না, খোকন আইলে, তুই কহবি ভুল কইর্যা ভিজায়ে দিছস , ও আমারে যহন ডাকতে আইবে, বাড়তি কথা একটাও কইবি না, তুই তো আবার খোকনরে দেইখলে গইলা যাস। মনে রাহিস তালাক দিলে অরে আর নিকায় বসনের লগে পাইবি না, হেডায় আজই নিকেশ হইয়া যাইবো ”।
“ কি কইছ কি? আমি তো কিসুই বুঝবার পারত্যাজি না না , রহমত চাচার বিটির সাদিতে তুমি যাবা না”।
“না , যাইলেও ঐ খোকনের সাথে না, এক সাথে যাওনের কথা ছিল, আজরাইল ব্যাটা কি কইর্যা টের পাইছে, পরশু আমারে কইয়া গেছে, আমি যেন খোকনরে একেলা পাঠাইয়া দি, অরা তিনকুনিয়া বটগাছের ধারে শ্যালো ঘরে লুকাইয়া থাকবো ”। রেশমা বিবির কান বার করা ঘোমটা খসে পড়ে যায়।
“ কও কি? তুমি কিছু কও নাই?”
“ আমি আজরাইল’রে কি কইব? পাগলা কুকুরে কামড়াইসে নাকি! শাসাইয়া গেছে, কথা যেন ফাঁস না হয়, আমারেই খালাস কইর্যাই দিবে। এখন খোকনের সাথে না যাওনের ছুতো তো একডা চাই, তাই গেঞ্জীটারে ভিজায় দিছি, শালা ভাদ্দরের রোদ খোকন আইতে আইতে শুকাইয়া না যায়”।
রেশমা আর কোন কথা বলে না। পাটকাঠি দিয়ে ঘেরা রান্নাঘরে ঢুকে যায়। ভয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে, “হায়রে খোকন’রে আজ খুন কইর্যা ফেইলবে। কি কইর্যাইই বা সে জানাইবে তারে, আজরাইল মস্ত দস্যু”। খোকনের কোন দোষ কিন্তু রেশমার চোখে পড়ে না কখনো । ওদের এই খুনোখুনি বাপের আমল থেকে চলে আসছে। রেশমা সবটা জানেও না, জানতেও সে চায় না। লুকিয়ে চুরিয়ে খোকনরে দেখে , কখন কখন ওর চওড়া বুকে মাথা রেখে , ওর শরীরের সাথে মিশে যেতে ইচ্ছা করে রেশমার।আজ নিজের বুকের তোলপাড়,হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসা কারেই বা বলবে সে কথা। পেতে রাখা পিঁড়িতে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, এখনো চোখ বুজলে খোকনের শরীরের গন্ধটাই সে পায় মাঝে মাঝেই। “সেই খোকন’রে আজ…হায় হায় চোখে জল আসে রেশমার। । খোকনের গলা কানে যেতেই ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ায় । সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করে বুকের দ্বিগুণ ধড়ফড়ানি।
“ আরে মজিদ ভাই তুমি খালি গায়ে বইস্যা আছ, যাবা কখন?”চমকে উঠে উঠানে পেতে রাখা খাটিয়া ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে মজিদ।
“ আর কইও না তোমার ভাবীরে লইয়া আর পারি না, সাত সকালেই আমার গেঞ্জীটারে জলে চুবাইয়া দিছে, হাঁই হাঁই কইর্যাব ছুইট্যা আইসতে না আইসতে কাম সারা। কি করি কও দেহি, রহমত চাচা আশা কইরা বইস্যা থাকবো। হেই খোকন আর মজিদ আইল বুঝি না কি আইল না। এক কাজ করো , তুমি আগাইয়া যাও , গেঞ্জীটা শুকাইলে আমি রওনা দিমু ”।
“ভাবী তো গেঞ্জীটারে ভাল কইর্যাম নিংঙায় নাই,”। খোকন ভেজা গেঞ্জীটা নিয়ে যত’টা পারা যায় দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে বেশ খানিকটা জল বার করে দিল। “ এইবার দেহো শুকাইতে কতক্ষণ লাগে, আমি বরং খাটিয়ায় বসি, শুকাইবার লাগলে একসাথেই রওনা হইবো, ভাবীরে একটু চা বানাইতে কও, ভাবীর হাতের চা বড় মিঠা”। মজিদ মনে মনে ছটফট করে। খোকনের ভাব গতিক ভাল ঠেকছে না। ওকে সঙ্গে নিলে আজরাইল, কালু , বসির দুটোরেই নিকেশ করে দেবে, সাক্ষী রাখবে না খুনের ।
“ আবার এখন চা খাইব্যা ক্যান , হক্কাল হক্কাল লালনগর পৌঁছাইলেই তো চা জলখাবার মিষ্টি, এলাহি আয়োজন”।
“জানি, কতদিন বাদে আইলাম বলতো, দু’চারটে কথা কইতে কইতেই গেঞ্জী শুকাইয়া যাইবে, ভাবনা কি”। বাধ্য হয়েই মজিদ খোকনের পাশে বসে, কিন্তু কথাবার্তা বলতে গিয়ে কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেলছে বারে বারে। কতক্ষণে যে খোকন’কে রওনা করাবে। নানান গল্প ফাঁদছে সে, মজিদের ওসব ভাল লাগছে না। উঠে একবার ঘরের ভেতরে যায় আবার বাইরে আসে। উঁকি মেরে এদিক সেদিক দেখে। আজরাইল বলে গেছে, খোকন রওনা হলে বোমা ফাটিয়ে যেন জানান দেয়। অনেকগুলি পটকা বোমা কিনে দিয়ে গেছে। খোকনকে বলতে হবে ওগুলো বিয়ে বাড়িতে মিয়া বিবি রাজীর সময় ফাটানো হবে। তাহলেই আর খোকন সন্দেহ করবে না।কিন্তু খোকন তো ওঠার নামই করে না। ইতিমধ্যে রেশমা চা নিয়ে হাজির হয়।
“কিগো ভাবী , আমি আইলাম তুমি তো একবারও রান্নাঘরের বেড়ার ফাঁকে উঁকি দিয়াও দেখো নাই। এতদিন পর খোকন আইলো শুধু চা, বিস্কুট ইস্কুট কিছুই নাই ঘরে। মজিদ ভাই তো আজ খাবা না, কি কালিয়া রাইন্ধবার লাগছো?” গা রি রি করে ওঠে মজিদের। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে না ।
এসব কথার কোন উত্তর না দিয়ে রেশমা মজিদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “ খাইয়্যা দেখো চায়ে মিষ্টি হইল কিনা”।
“চিন্তা কইরো না ভাবী তুমার হাতের চা বিনা চিনিতেই মিঠা হইবো”। হো হো করে হেসে ওঠে খোকন। এই জন্যেই খোকনের আসা মজিদ পছন্দ করে না। রেশমা’রে দেখলে চুলবুলাইয়া ওঠে। চা’য়ে চুমুক দিয়ে মনে মনে বলে ‘আর কি, কইয়্যা লও জন্মের শোধ,’ দাঁত কিড়মিড়িয়ে ওঠে।“ মাগীর’ও কুটকুটানি আছে, পাছায় লাথ মাইরা দূর কইর্যাল দিবো একদিন তেমন হইলে, বুঝবোখন ঠ্যালা ।
“বিড়ি রাইখ্যা দ্যাও, সিগরেট খাও”। খোকন পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে।
“দ্যাও একখান, খোকন ভাই তুমি বরং আগুইয়্যা যাও, আমিও খানিক বাদে আসতেছি, তোমার দেরী কইর্যাক লাভ কি বলো”।
“ আরে খাওন দাওন সেই বিকাল চারটায়, বিয়া না হইলে তো কিছু হইব না, এদিকে তোমার গেঞ্জীও শুকাইয়া আইলো, দেরী হয় নাই এমন কিছু”। খোকনের গড়িমসি দেখে অন্য মতলব ভাঁজে।
“ কইছ বটে,কিন্তু চা’টা খাওনের পর আমার প্যাট’টা ক্যামন যেন করে, তুমি আগাও আমি মাঠ সাইর্যা আইসো”। দাওয়ায় রাখা বদনায় জল ভরে নেয় মজিদ।
“ তুমি মাঠ সাইর্যা এসো আমি বরং সিগরেটে সুখ টান দি”। বদনা হাতে মজিদ জমির আল ধরে এগোতে থাকে। গেঞ্জী তো শুকাইয়া আইলো, মাঠ সারার বাহানা খোকন বোঝে নাই বইলাই মনে হয়। কিন্তু ও শালার তো যাওনের কোন ইচ্ছাই নাই । আজরাইল যদি আমারেই সন্দেহ করে, বিশ্বাস নাই, গুলি কইর্যাই বুক ফুটা কইর্যাল দিবে। সিগারেট ধরিয়ে ঝোপের আড়ালে বসে পড়ে মজিদ।
এদিকে সিগারেট মাটিতে ফেলে পায়ে পিষে গুটি গুটি পায়ে এগোয় রান্নাঘরে দিকে। রেশমা মাটিতে বসে একমনে আলুর ছোকা মাখছে। পিছন থেকে চোখ টিপে ধরে খোকন। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ায় রেশমা। তাকে বুকে টেনে নিয়ে পাগলের মত গালে ঠোঁটে, বুকে চুমু খেতে থাকে।
“ আঃ! ছাড়ো , ও আইয়া পড়বো অহনি, মাঠ সাইরতে যায় নাই, আশ পাশেই আছে”।
“ তোমারে কে কইলো?”
“ শুনে তোমার কাজ নাই, তুমি পালাও আজরাইল থানা গাড়ছে, তিনকুনিয়ার স্যালো ঘরে, ও তোমারে পাঠাইয়া দিতে চায় আগে আগে, তাই বাহানা করতেছে”।
“ জামসেদ আমারে জানাইছে, তুমার ভয় নাই, দেখো না, আজরাইলের কি হাল হয় জাইন্তে পারবা দু’ একদিনের ভিতর”।
“ তুমি পালাও, আমার বুক কাঁপত্যাছে।
“তাই, দেহি কোনখানটা কাঁপত্যাছে ”। বলেই হাত ঢুকিয়ে দেয় বুকে । ছিটকে সরে যায় রেশমা।
“ কিজইন্যে বইস্যা আছো বলো দেহি”?
“ এই চাঁদমুখটা দেইখবার লগে”। খোকন রান্নাঘরে থেকে বেরিয়ে খাটিয়ায় বসল, রেশমাও পিছু পিছু বেরিয়ে আসে “ আচ্ছা তুমার কি মরণেরও ভয় ডর নাই, আবার বইসলে ক্যান”।
“মজিদ ভাই’রে আরো কত খেলাই দ্যাহো না, খোকন মার্ডার হইলে রেশমা বিবিরে লইয়া মজিদ ভাই’এর আর কোন চিন্তা থাকে না। তাই আজরাইলের দোসর হইছে, কত বাহানা খোকনরে পাঠাইতে”। দূর থেকে মজিদ’কে দেখা যায় বদনা হাতে।
“ ওই আসতিছে, আমি যাই”। রেশমা রান্না ঘরে ঢুকে গেল, কিছুক্ষণের মধ্যেই মজিদ ফিরে এসে দাওয়ায় বদনা রাখতে রাখতে বলল, “ খোকন ভাই তুমি যাও, আমার আর যাওয়া হইবো না,”।
“ ক্যানে কি হইল আবার, গেঞ্জী তো শুকাইয়া গেছে”।
“ প্যাট নামছে, শরীল ঠিক নাই, কখন বলতে কখন কি’হয় কে জানে, তুমি আর বইস্যা বইস্যা কি করবা”। চ্যাটাই পেতে দাওয়াতে শুয়ে পড়তে যায় মজিদ। ভাব গতিক দেখে মনে মনে হাসি পায় খোকনের।
“ তবে আর কি, হইল্যা গেল, ভাবী মজিদ ভাই’রে নুন চিনির জল কইরা দ্যাও আর দু মুঠো চাল নাহয় বেশীই ফুটাও , আমিও বরং এখানেই খাইয়া খাটিয়ায় শুইয়া পড়ি”। শুয়ে পাশ ফিরতে গিয়ে উঠে বসে মজিদ “ না না খোকন ভাই আজ আর রান্নার পাট নাই , চাড্ডি পান্তা আছে, রেশমা ওই খাইয়া লইবে, তুমি বরং এগোও বিয়া বাড়ির খাওন বলে কথা”। কিছুক্ষণ আগে রেশমাকে আলুর চোকা মাখতে দেখছে খোকন, খাটিয়া শরীর এলিয়ে দেন, -“ ওঃ ভাবী, এক আধ গরাসও কি হৈবে না, দেখো না পান্তার হাঁড়ির ঢাকা খুইল্যা, আলুর চোকা দিয়া পান্তা ভাতের কথা মনে আইলেই জিভে জল আসে”। উলটো দিকে মুখ করে শুয়ে মজিদ দাঁত কিড়মিড় করে, “ একটু বাদেই তোরে পান্তা ভাত খাওনের স্বাদ মিটাইবে আজরাইল ”। রেশমা খোকনের কথার উত্তর দেয় না।
ভাদ্রের আকাশ, কখনো রোদ কখনো ছায়া, মাঝে মাঝে হাওয়া দেয়। দূরে কোথায় ঘুঘু পাখি ডাকে। মজিদ খোকনের দিকে পিছন ফিরেই শুয়ে থাকে, সাড়া শব্দ করে না । মনে মনে ভাবে, একসময় না এক সময় খোকন ঠিক উঠে যাবে। কিন্তু খোকনের কোন তাড়া নেই। মাঝে মাঝে ডাক ছাড়ে-“ কি হইল ভাবী কথা কও না যে”। রাগে মজিদের শরীরে কেমন যেন জ্বালা করে।ছটফট করতে গিয়েও চুপ করে শোয়, সন্দেহ হয়-“ মাগীটা আবার ওরে জানায়ে দেয়নি তো, ”।
এবার রেশমা উত্তর দেয়-“ পান্তা ভাত দুজনারে কুলাইবে না, অন্যদিন আসেন খায়াইবো অখন ।
“ আর অন্যদিন আইতে হৈব্য না, মাগীর সোহাগ দেইখ্যা গা জ্বইল্যা যায়, খ্যাংরা দিয়া বিষ ঝাইড়লেও রাগ মেটে না। মনের রাগ মেটাতে চাপা গলায় বলে মজিদ।
“ আর কি হৈবে ভাবী, সকালে নাস্তা হয় নাই খিদা লাগছে, এক বাটি মুড়িই দ্যাও পিঁয়াজ লঙ্কা দিয়ে খাইয়া লই”। খাটিয়ায় চিত হয়ে শুয়ে পড়ে খোকন।
মুখ ফিরিয়েই মজিদ উত্তর দেয়-“ তিন চার দিন হৈল্য মুড়ি বাড়ন্ত, খিদা লাগছে যখন তাড়াতাড়ি পৌঁছাইলেই তো হয় দেরী কইর্যাত লাভ কি ”।
“ ঠিকই কইছ মজিদ ভাই,উঠে বসে খোকন, “ তুমার তো প্যাটের অসুখ তুমি তো আর যাইবা না, আমি তবে হাঁটা লাগাই ”। কথাটা শুনে স্ফুতি আর ধরে না মজিদের,সটান উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে “ হ্যাঁ হ্যাঁ অনেক দেরী হইয়া গেছে, যাও যাও, তাড়াতাড়ি আর ও হ্যাঁ এইগুলো লইয়া যাও”।
“ কি ওই গুলান?”
“আরে বিয়া বাড়িতে একটু ফূর্তি আহ্লাদ করবা না, এই বোমা পটকাগুলান লইয়া যাও, ফাটাইবে”। দাওয়া থেকে নেমে আসে মজিদ। উঠানে দাঁড়িয়ে দেশলাই জ্বালিয়ে একটা বোমের পলতে আগুন ধরিয়ে ছুঁড়ে দেয় দূরে। সশব্দে ফাটার পর কিছু কাক কা কা করে উড়ে যায় আকাশে।
“ বাঃ তেজী আওয়াজ, দ্যাও দেহি শলাই’টা”।
“ কি করবা?”
“ আর আমি একটা ফাটাইয়া দেহি কিরকম আওয়াজ হয়, তুমি তো বোম ফাটাইয়া সিগনালে জানাইয়া দিলে খোকন যাইতেছে, এইবার আমি জানাইয়া দি খোকন আর ঐ পথে যাইবা না”