কৃষ্ণসমাচার

অফিস থেকে ফিরতে নীপা খবরটা দিল, “শুনেছো, সঞ্জীব মারা গেছে”। সঞ্জীব নীপার পুরানো প্রেমিক, কি কারণে ওদের ব্রেক আপ হয়ে গিয়েছিল জানি না, আমার সঙ্গে বছর দুই কোর্টশিপের পর বিয়ে হয়। সেও প্রায় তিন বছর হয়ে গেল। সঞ্জীবকে আমিও চিনতাম। হঠাৎ যে কোন লোকের মৃত্যু সংবাদ শুনলে আশ্চর্যই হতে হয়, বিশেষ করে সঞ্জীব একেবারেই কম বয়সী যুবক। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “সে কী! কি হয়েছিল কি”? নীপা খুব একটা দুঃখ পেয়েছে বলে মনে হল না, খুব নির্বিকার ভাবেই উত্তর দিল, “সে সব আমি জানি না, পার্লারে গিয়ে শুনলাম। সেখানেই দুই মহিলা আলোচনা্ করছিল, কৌতুহল দেখালে যদি আবার কিছু মনে করে, তাই আর জিজ্ঞাসা করিনি”। “একবার ফোন করা তো উচিত ছিল তোমার”। “দূর সে সব নম্বর আর আছে নাকি কবেই ডিলিট করে দিয়েছি”। 1. সেদিন ছিল রবিবার, দাড়ি কামাতে কামাতে এফ এম রেডিওতে সানডে সাসপেন্স শুনছি, নীপা ঢুকেছিল বাথরুমে স্নান করতে হঠাৎ চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এল। চিৎকার শুনে আমিও এগিয়ে গিয়েছি বাথরুমের দিকে। নীপা উদভ্রান্তের মতন ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার বুকে। স্বল্প বসনে সিক্তা রমণী পরস্ত্রী হলে তো যে কোন পুরুষের কাছেই লোভনীয়,তবুও নীপা কে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলাম “কি হয়েছে কি? ভয় পেয়েছ কেন”? “বাথরুমের জানলা দিয়ে কে একজন উঁকি দিচ্ছিল”। “পাগল নাকি? তিনতলার বাথরুমের জানলা দিয়ে কে আবার উঁকি দেবে”। বুকের ওপর থেকে মুখ তুলে নীপা বলল “সঞ্জীব।আমি স্পষ্ট দেখেছি”। “ধুর, ও তোমার মনের ভুল।” “না গো ও নিশ্চয় আমার কোন ক্ষতি করবে”। বুকে মুখ গুঁজে নীপা কাঁদতে শুরু করল। যতই বোঝাই না কেন ও কোন কিছু শোনার পাত্রী নয়। সাড়ে ন’শ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটের যেখানে সেখানেই নীপা সঞ্জীবের ভূত দেখতে লাগল। মহা মুস্কিলে পড়লাম, মাঝখান থেকে আমার অফিস যাওয়া বন্ধ। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে কাঁদছে। যখন তখন চেঁচিয়ে উঠছে। শাশুড়ী মাকে এসে থাকতে বললাম ক’দিন। কিন্তু তাঁরও তো সংসার আছে। পশ এরিয়ায় ওঝা ডাকলেই বা লোকে কি বলবে। অফিসের কলিগের কাছ থেকে এক সাইকিয়াট্রিস্টের সন্ধান পেলাম। মনোযোগ দিয়েই তিনি দেখলেন নীপাকে। প্রিভিয়াশ হিষ্ট্রিও শুনলেন, বললেন “ভয়ের কোন কারণ নেই, সাব কনসাসের একটা এপ্রিহেনশনই হ্যলুশিনেশন হিসাবে দেখা দিচ্ছে। কমপ্লিট রেস্টের প্রয়োজন। কয়েকটা কাউন্সিলিং করে দেখুন, ইমপ্রুভ করবে”। ডাক্তাররা তো এসব বলেই থাকে। তা বলে তো পিছিয়ে আসা যায় না, মাস খানেক ধরে চলল নানান প্রক্রিয়া, তেমন কোন উন্নতি চোখে পড়ল না। দিনের বেলায় জন্যে একটা আয়া রাখতে হয়েছে। উপায়ই বা কি। কেউ না থাকলে নীপা ভয়েই মরে যাবে। ডাক্তারকে সময় মতো রির্পোট দিচ্ছি, কখনো কখনো ওষুধ পালটে দিচ্ছেন। সেদিন একটা ওষুধের খোঁজে ধর্মতলায় গিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি সঞ্জীব ট্যাক্সি থেকে নামছে, চমকে ওঠার আগে ও-ই আমাকে দেখতে পেয়ে ডাকল “আরে, প্রবীরদা আপনি এখানে”! এগিয়ে গিয়ে বললাম “কি ব্যাপার কি? তোমাকে তো আর দেখতেই পাই না”। “আমি তো আর এখানে থাকিই না, নয়ডাতে একটা মাল্টিন্যাশান্যাল কোম্পানীতে জয়েন করেছি, বাড়ীর সব খবর ভালতো?” বাড়ীর খবর বলতে ও কিন্তু নীপার কথাই জানতে চাইছে। “হ্যাঁ চলে যাচ্ছে,নীপা সেদিন তোমার কথা বলছিল, তোমার ফোন নাম্বারটা ও হারিয়ে ফেলেছে”। “ও তাই। আপনার নাম্বারটা বলুন রিং করে দিচ্ছি”। বুঝলাম সঞ্জীব খুশীই হয়েছে। ওষুধটা আর কিনলাম না, বাড়ী ফিরে নীপাকে খবরটা দিতে বিশ্বাসই করছিল না। ফোন নাম্বারটা দেখাতে কিছুটা আশ্বস্ত হল। কিছু না বলে ফোন নাম্বারটা সেভ করে নিল ওর মোবাইলে। এরপর থেকেই নীপা আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল ওষুধ ছাড়াই। আমি জানি নীপা এখন মাঝে মাঝেই রাতের দিকে সঞ্জীবকে ফোন করে কথা বলে। জেনেও না জানার ভান করি।কিন্তু বাথরুমের ওই পশ্চিম দিকের জানলা, সেই ভয়টা বোধহয় এখনো কাটেনি নীপার। অন্ধকারে রাস্তা পার হবার সময় যেমন কিছু মানুষ শিস দেয়, নীপাও এখন বাথরুমে ঢুকলে তিন চারটে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, সেদিন গাইছিল “দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে”। কেউ না বলে দিলেও জানি ‘তুমি’-টি কে, রাধা তো আয়ান ঘোষের ছিল না কোনদিনই।

Leave a Reply