মিনারেল ওয়াটার
বঙ্গভূমিতে সে বছর গরমের প্রাবল্য শুরু হয়ে গিয়েছিল ফেব্রুয়ারীর শেষাশেষি। বসন্তের প্রাক্কালে জৈষ্ঠ্যের নিদাঘের অনুভূতি তৎসহ প্রখর তপন তাপে সকলের অবস্থা তৃষিত চাতকের মতন। ম্যাঘ পানির জন্য আকূল প্রার্থনার ঠেলায় আল্লাও বোধহয় জেরবার।
এই সময় আমাদের মতন ডেলিপ্যাসেঞ্জারদের পক্ষে খুবই কষ্টকর। রোজ সকালে ট্রেন ধরে কলকাতায় আসি, চাকরির তাগিদে। ক্লান্ত শরীরে যখন ফিরে যাই তখন সন্ধ্যা অতিক্রান্ত।
এই গতিময় জীবন হঠাৎই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে লাগল আমার প্রমোশন হবার পর। চাকরীজীবিদের কাছে প্রমোশন একটা বিরাট পাওনা , আমারও তাই ধারণা ছিল, কিন্তু প্রমোশন হবার পরে দেখলাম অফিসে আমার আসার সময় নিদিষ্ট থাকলেও ফেরার সময় আর পূর্বনির্ধারিত থাকল না। সেই কারণেই ডেলিপ্যাসেঞ্জারী আর করা যাবে না বুঝে একটা বাসা নেব ঠিক করলাম।
সময়টা কখন বলব, মিনারেল ওয়াটার আসার আদি লগ্নে। যদিও সেটি বাজারে এলেও বাঙ্গালির সংসার অঙ্গন থেকে গ্লাস দূরীকরণের ক্ষেত্রে তখন সর্বগ্রাসী ভূমিকা নেয়নি। বোতল ব্যবহার তখনও সর্বাঙ্গীন হয়ে ওঠেনি। কারণ বিশুদ্ধতার হেতু এক বোতল জল কিনে খাওয়া তখন বাঙ্গালীর বিলাসিতা।
সেইজন্যেই হাওড়াএ বাসাটা যখন পছন্দ হল শুধুমাত্র ভাড়ার জন্যে পিছিয়ে আসছিলাম। সমস্যা হারাধনই মেটাল। হারাধন আমার অফিস কলিগ্। বয়সে অনেক ছোট, মেদনীপুরের কোন এক গ্রামে ওর দেশের বাড়ী। ব্রাম্ভণ সন্তান, পেটরোগা হোটেলের খাওয়া দাওয়া একদম সহ্য হচ্ছিল না
সেদিন টিফিনের সুপ্রকাশবাবুকে যখন সমস্যার কথা বলছিলাম হারাধন পাশেই ছিল, সুপ্রকাশবাবু কিছু মতামত দেবার আগেই হারাধন বলল, “ সুভাষদা যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা কথা বলি”।
“- আরে বলই না মনে করার কি আছে?”
“ আমি মানে যেখানে থাকি সেখানকার হোটেলের খাওয়া দাওয়া পোষাচ্ছে না, পেটের গন্ডগোল হচ্ছে। যদি আপনার অসুবিধে না হয়”।
“ না না অসুবিধে হবে কেন? আমি তো একজন কাউকে খুঁজছিলাম, তবে ব্যাপার কি জানো দুকামরার ঘর হাজার টাকা ভাড়া বলছে”।
“ সুভাষ দা যদি রাজি থাকেন তবে রোহিনীকেও বলতে পারি। ও আমার ওখানকার রুমমেট। ইউ বি আই এ আছে”।
“ আবার ভেজাল জোটাবে ?”
“ না সুভাষদা রোহিনী খুব ভাল ছেলে। আমারা আপনাকে পুরো একটা ঘর ছেড়ে দেব। অমত করবেন না প্লিজ”।
চারদিক বিবেচনা করে হারাধনের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। মাসের পয়লা তারিখ থেকেই হৈ হৈ করে শুরু হয়ে গেল আমাদের মেস জীবন। যদিও হায় হায় করে শুরু করা উচিত ছিল।কারণ মনুষ্যজীবন থেকে মেস(ষ) জীবন উন্নত তো নয়ই বরং চরম অবনমন। যদিও হারাধন আর রোহিনীর কল্যাণে তা বোঝার উপায় ছিল না।উত্সাহের অন্ত নেই ওদের। একটা ঘরে আমার জিনিষপত্র ওরাই গোছগাছ করে দিয়েছে। কোথা থেকে যোগাড় করে এনেছে সাদা কালো একটা টিভি সেট, চিলেকোঠার ছাদে উঠে এ্যান্টেনা ঠিক করে যতক্ষণ না ছবি আসে ততক্ষণ ওদের বিরাম নেই। রোহিনীকে না চেনায় কিছু বিরূপ মন্তব্য করে ফেলেছিলাম, আদতে ও হারাধনের দ্বিতীয় সংস্করণ, যেটুকু সংযুক্ত হয়েছে তা হল রোহিনীর সান্ধ্যকালীন সঙ্গীত চর্চা।
অফিস ফেরত চা জলখাবার খেয়ে হারমোনিয়াম নিয়ে শুরু করে নিরলস সংগীত সাধনা। যদিও আমি সংগীত রসিক ব্যক্তি নিই তবু মনে হয় রোহিনীর সংগীতচর্চায় সুরের চাইতে স্বরের প্রাধান্যই বেশী। প্রতি সন্ধ্যায় দু’তিনটি গানের ভুল সুরের পৌনঃপুনিক নিত্য পরিবেশন, সহ্যের সীমাকে যে একেবারে শেষ সীমায় নিয়ে গিয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নিরুপায় হয়ে একদিন বলেই ফেললাম “ রোহিনী তুমি ভাল মাস্টার রেখে গান শেখো না কেন? উত্তরে রোহিনী বলল-
“ গান তো মোটামুটি আমার শেখা হয়ে গেছে সুভাষদা, নতুন করে শেখার মধ্যে এই হারমোনিয়াম বাজানোটা সড়্গড় হচ্ছে না। সেই জন্যেই রেগুলার প্র্যাকটিশ করি। সামনে আবার সংগীত প্রভাকর পরীক্ষা”।
রোহিনীর উত্তর শুনে মনে হল আমারই কোথায় ভুল হচ্ছে। তাই পুনরায় এনিয়ে আর কোন মন্তব্য করলাম না। জানি না রোহিনীর সংগীত প্রভাকরত্ব প্রাপ্তির সাথে সাথে সংগীত সৌরকূলের কি অবস্থা হবে।
যাইহোক গদ্যময় মেস জীবনে রোহিনীই একমাত্র ছন্দ।অফিস থেকে ফেরার পর হারাধন আমারই ঘরে থাকে। খবরের কাগজের পাতা ওল্টায় টিভি দেখে কখনো কখনো দেশের বাড়ীর গল্প করে।
সেদিন সন্ধ্যে বেলায় চায়ের গ্লাস হাতে হারাধন আমার পাশে এসে বসল। লাজুক হেসে বলল, “ একটা কথা অনেকদিন ধরে বলব বলব ভাবছিলাম, বলা আর হয়ে উঠছে না।
“ তা এত সংকোচ করছ কেন খুলেই বলনা”।
“ মা বাবা বিয়ের জন্যে খুব চাপ দিচ্ছে”।
“ ভালোই তো করে ফেলো এটাই তো বিয়ের বয়স”- কাগজ মুড়ে পাশে রেখে সোজা হয়ে বসলাম।
ইতিমধ্যে কখন যে রোহিণীর সংগীত চর্চা থেমে গেছে, ও যে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা টের পাইনি। হঠাৎই রোহিনীর কন্ঠস্বরে আলোচনা মধ্যপথে থেমে গেল।
“পাঁচ মিনিট সুভাষদা, একটু আদা দিয়ে চা করে আনছি”।
বুঝলাম এই আলোচনায় রোহিনী সমান উৎসাহী। কিন্তু হঠাৎই সে মাঝখানে ঢুকে পড়ায় হারাধন একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে।
“ যাকগে যাকগে সুভাষদা পরে আলোচনা হবে”।
“ আরে তুমি লজ্জা পাচ্ছ কেন, রোহিনী থাকলেই বা। বল কি সমস্যা”।
সমস্যা বলতে সুভাষদা একটাই”- হারাধনের কথা শেষ হতেই রোহিনীর আবির্ভাব, তাকে হটানোর জন্যেই বললাম-“ চায়ের কি হল?”
“ভিজতে দিয়ে এসেছি”। বুঝলাম রোহিনীর আড়ালে এই আলোচনা অসম্ভব। তাই মূল সুত্র ফিরে যেতে চাইলাম- “ হ্যাঁ হারাধন কি বলছিলে না”।
“ কি আর বলব সুভাষদা যে পয়সা মাইনে পাই তাতে কি আর বিয়ে করা সম্ভব”।
“ দেখো মাইনের কথা যদি চিন্তা করো তাহলে বিয়ে কোনদিনই করতে পারবে না। তোমার চেয়ে ঢের কম মাইনে পেয়ে লোকে দিব্যি ঘর সংসার করছে”।
“বলছেন সুভাষদা”।
“বলছি মানে অবশ্যই বলছি”।
“তাহলে রাজী হয়ে যাই কি বলেন”।
“নিশ্চয়ই”।
হারাধন চৌকি ছেড়ে উঠে পড়তেই রোহিনী এবার আমাকে পাকড়াও করল।
“ আমার বোনটার জন্যে বলছিলাম, বিএ তে একটা পেপারে ব্যক পেয়ে আর পড়ল না।দেখতে শুনতে মন্দ নয়। আমরা কায়স্থ, তবে বাবা বলছে ছেলে ভাল হলে অসবর্ণে আপত্তি নেই”।
বুঝলাম অনূঢ়া বোনই রোহিনীর ইচ্ছাপূরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। সান্ত্বনা দিয়ে বলি “ চিন্তা করো না তোমার বৌদিকে বলব। ও তো নানান জায়গায় ঘোরাঘূরি করে। পারলে তোমার বোনের একটা ছবি দিও”।
“ ঠিক আছে সুভাষদা পেয়ে যাবেন”।
এরপর বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে, হারাধন নিজের থেকে আর কিছু বলে না। আমিও কৌতুহল দেখাই না। সেদিন টিফিনের পর হাত ধুচ্ছি, হারাধন প্রায় ফিস ফিস করে কানের গোড়াতে বলল, “ উলুবেড়িয়া থেকে একটা সম্বন্ধ এসেছে, মা বলছিলেন আপনাকে নিয়ে মেয়েটা দেখে আসতে”।
আমাকে কেন রোহিনীকে নিয়ে যাও। বন্ধু বান্ধব নিয়ে যাওয়াই তো ভালো”।
“ না না সুভাষদা এখুনি পাঁচ কান করতে চাইনা”।
“ঠিক আছে কবে যাবে জানিও বোস সাহেবকে বলে তিনটের পর এখান থেকে ডাইরেক্ট বেরিয়ে যাবো”।
“ খুব ভালো হয় সুভাষদা মোটামুটি পরশুই দিন ঠিক করে ফেলেছি”।
“ করেই যখন ফেলেছে আর বলার কিছু নেই, পরশুই ফাইন্যাল”।
সেদিন ছিল শুক্রবার , সকাল থেকেই হারাধন কেমন যেন টেনশনে ছিল। টিফিনের পরই আমি আর হারাধন বেরিয়ে পড়লাম গ্রীষ্মের দাবদাহ উপেক্ষা করে। হাওড়া স্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখনই মধ্য দিনের রক্ত নয়ন অন্ধ হয়ে গেছে।আকশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ কেমন যেন জমাট বেঁধেছে, একদম হাওয়া নেই, গুম মেরে আছে চারপাশ।
অফিস টাইম তখন শুরু হয়নি, তার ওপর উলুবেড়িয়া লোকাল গাড়িতে একদম ভিড় নেই। পছন্দ মত জানলার ধারে বসে রুমাল দিয়ে পথশ্রম জনিত ঘাম মুছতে মুছতে বললাম “ যাইহোক বৃষ্টি হলে তবু একটু ঠান্ডা হবে, যা গরম পড়েছে।
আমার কথায় হারাধন দেখি চিন্তায় পড়ছে- “ প্রথম দিনই কাকভেজা হয়ে মেয়ে দেখতে গেলে ব্যাপারটা কি ভালো হবে সুভাষদা”।
অভয় দিয়ে বলি “ অত চিন্তা করছ কেন, উলুবেড়িয়ায় পৌঁছে দেখবে ওখানে ঝড় জলের লেশমাত্র নেই তাছাড়া এতো কালবৈশাখী বই তো নয়।, ঘন্টা খানেকের মধ্যে আকাশ একেবারে পরিষ্কার হয়ে যাবে। সেই সময়টা আমরা ট্রেনে কাটিয়ে দেব’>
উলুবেড়িয়া স্টেশনে যখন নামলাম আবহাওয়ার বিশেষ কোন পরিবর্তন নেই, বরং আকাশ মেঘে মেঘে ছেয়ে গেছে। থম থম করছে পরিবেশ। দ্রুত পা চালিয়ে স্টেশন রোড থেকে একটা রিকশা ধরে নিলাম।
কিন্তু মিনিট খানেক যাবারপরেই যাঁর আগমনের আশংকা করছিলাম সেই প্রভঞ্জন আত্মপ্রকাশ করলেন প্রবলভাবে। যাবতীয় ধুলো আকাশে উড়িয়ে ঝড় উঠল , দুমদাম করে দরজা জানলার কপাট দোকানের পাল্লা পড়তেশুরু করল। চোখমুখ যতই ঢাকার চেষ্টা করি না কেন মুহুর্তেই ধূলি ধূসরিত হয়ে গেলাম দুজনেই। বাহাদুর রিকশাওলা কিন্তু গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিল তার মধ্যে দিয়েই।
বিরাট তিন তলা বাড়ীর সামনে যখন রিকশা থামল, তখন দু’এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বাড়ির অভ্যন্তরবাসীরা বোধহয় আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। তাড়াটাড়ি দরজা খুলে দেওয়ায় বৃষ্টি হাত থেকে বাঁচলাম।
গৃহকর্তা অভ্যর্থনা করতে এগিয়ে এলেন। সম্ভবতঃ আমাদের জন্যেই এমন ধোপদুরস্ত। আমাদের অবস্থা দেখে কম্বয়সী ছেলেটিকে বললেন, “ রবি এনাদের বাথরুম’টা দেখিয়ে দাও। সঙ্গে একটা তোয়ালে দিয়ে দিও। অসময়ে কি ঝড় জল শুরু হল বলুন দেখি।
“না না এতো কাল্বৈশাখীর সময় , আপনি ব্যস্ত হবেন না আমরা ফ্রেস হয়ে নিচ্ছি”।
বাইরে তখন ঝড় জলের তান্ডব চলেছে। বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে বসার ঘরে ঢোকা মাত্র সমস্ত আলো নিভে গেল। গৃহকর্তা পড়লেন আরো আতান্তরে।বার বার ব্যস্ত না হওয়ার অনুরোধ সত্ত্বেও ভদ্রলোক ধৈর্য রাখতে পারছেন না।বারে বারে পর্দা ঠেলে ভিতরে যাচ্ছেন।চাপা গলায় কাকে কি নির্দেশ দিচ্ছেন। ফিরে এসে হাসিমুখে দুএকটা কথা বলতে না বলতেই আবার কি মনে পড়ে যাচ্ছে।পর্দা ঠেলে ভিতরে ঢুকে মনে পড়ে যাওয়া কথা বলতে গিয়ে দেখলেন পূর্বনির্দেশিত কাজটি তখন সম্পন্ন হয়নি।উত্তেজনায় গলা তখন আর চাপা থাকছে না। পরক্ষণেই আমাদের কথা মনে পড়তেই পর্দা ঠেলে হাসি মুখে আমাদের সামাল দিচ্ছেন। মনে মনে ভাবছি কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার কি অবস্থা। কখনো তিনি রূপালী পর্দার উৎপল দত্ত, আবার কখনো কমল মিত্র।
বাইরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্যে ঘরের আলোর অপ্রতুলতা। ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক করেও তার অভাব দূর করতে পারছেন না। এরই মধ্যে উৎপল দত্ত সদৃশ ভাষনে যেটুকু শুনেছিতার সার মর্ম-একসময় সরকারী চাকুরে ছিলেন, দু’মাস হল রিটায়ার করেছেন, এটি ছোট মেয়ে বি এ পাশ করেছে সবে। একমাত্র ছেলে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ছে শিবপুরে।
আর নির্দেশিত কার্যাবলী যথাযথ পালন না হওয়ায় কমল মিত্র স্বরূপ কন্ঠস্বর, এটুকু কর্ণগোচর হয়েছে, তা হল- হারিকেনে কেন তেল ভরা হয়নি, মোমবাতি মোটেই পর্যাপ্ত নয়, নোনটা খাবার কেন আনা হয়নি, এতগুলো কাজের লোক রাখা অনর্থক আজকের পরেই তাদের বরখাস্ত অনিবার্য। সবকিছুর মূলে নাকি ওনার স্ত্রীর অপরিনামদর্শিতা।
ভদ্রলোকের অবস্থা দেখে আমরাও অপ্রস্তুত। তবু তারই মাঝে যেটুকু তথ্য সংগৃহীত হল, দু ভায়ের যৌথ পরিবার। ছোটভাই সঞ্জয়বাবু পারিবারিক ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা দেখাশুনা করেন। বড়ভাই ধনঞ্জয়বাবু অবসর নিলেও দিব্যি শক্ত সমর্থ আছেন। বাড়ী পুরুষানুক্রমে হলেও তার আধুনিক করণের পিছনে দুভাইএর অবদান রয়েছে। তথ্য সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিচয়ো হারাধন সম্বন্ধে যাবতীয় জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়েছি বাহুল্য ছাড়া। ধনঞ্জয়বাবারু একটাই চিন্তা সেবা যত্নের ত্রুটি থেকে যাচ্ছে।ইলেকট্রিসিটি না থাকার জন্যে বারে বারে আক্ষেপ করছেন।কারণ হারিকেন বা মোমবাতির আলোয় মেয়ে দেখাতে চাইছেন না।এদিকে আমরা ভাবছি দুর্যোগের মধ্যে ফিরব কিকরে।ইতিমধ্যে ধনঞ্জয়বাবুর ছোটভাই সঞ্জয়বাবু ফিরলেন কাকভেজা হয়ে। তার মুখ থেকে যা শুনলাম তা মোটেই আশাপ্রদ নয়। ওভারহেড লাইনের তার ছিঁড়ে সমস্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ। রাতে চালু হবার সম্ভবনা খুব কম। তিন চারটে ইলেক্ট্রিক্যাল পোল ভেঙ্গে গেছে ঝড়ের দাপটে। আগামীকাল দুপুরের আগে কারেন্ট আসা অসম্ভব। ফিরতে হলে বাস, সেও এই দুর্যোগের মধ্যে ছাড়বে কিনা সন্দেহ।
যে কাজের জন্যে এসেছি তাই এখনো সারা হল না।বাধ্য হয়েই বললাম “ আমরা আর দেরী করব না ধনঞ্জয়বাবু, পনেরো কুড়ি মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ব।আপনি মেয়ে নিয়ে আসুন”।
“তা না হয় নিয়ে আসছি কিন্তু এরকম দুর্যোগ, তাছাড়া খাওয়া দাওয়া না করিয়ে ছাড়ি কি করে। আজকের রাতটা বরং এখানে থেকে যান”।
“না না তা হয় না ধনঞ্জয়বাবু, কাল আমাদের অফিস আছে। এখুনি বেরুলে বরং পৌঁছতে পারব। দেরী হলে সে সম্ভবনা থাকবে না”। জামা কাপড় পালটে সঞ্জয়বাবু ততক্ষণে এসেও পড়েছেন-“ এখুনি বেরুলেই যে পৌছতে পারবেন তার কিন্তু নিশ্চয়তা নেই, ভোরে আমাদের লরী যাবে কলকাতায়, সাতটার আগে পৌঁছে যাবেন। অযথা রিস্ক নিয়ে লাভ নেই”।
কথার মধ্যে যথেষ্ঠ যুক্তি আছে, জোর করতে পারছি না। বাধ্য হয়েই হারাধনকে জিজ্ঞাসা করলাম,” কি হারাধন কি করবে বলো”।
“আপনি যা বলেন”। হারাধন এই প্রথম কথা বলল।
“ঠিক আছে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে যদি বৃষ্টি ছাড়ে তাহলে একটা চেষ্টা করা যাবে।
মেয়ে দেখার পর্ব ওই হারিকেনের আলোতেই সমাধা করতে হল আড়ম্বরহীন ভাবে।মেয়ে অপছন্দের কোন কারণ নেই। তাছাড়া এদের আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
কিন্তু রাত সাড়ে ন’টা নাগাদও বৃষ্টি ছাড়ার কোন লক্ষণ নেই। যার ফলে ধনঞ্জয়বাবুর প্রস্তাবে রাজি না হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।কিছুক্ষণের মধ্যে ধনঞ্জয়বাবু জানালেন খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।
সে এক এলাহি আয়োজন। মিষ্টি চা জলখাবার খাওয়া হয়েছে। এখন নানান পদের আয়োজন দেখে চক্ষু চড়কগাছ। তবু ধনঞ্জয়বাবুর মতে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কিছুই করতে পারেননি।এত আয়োজনের মাঝখানে আশ্চর্যজনক ভাবে চোখে পড়ল তা হল মিনারেল ওয়াটারের বোতল। সুস্মিতা অর্থাৎ ধনঞ্জয়বাবুর ছোট মেয়ে হবু পাত্রী অন্যান্যদের সঙ্গে পরিবেশন করছে। ধনঞ্জয়বাবু, সঞ্জয়বাবু দুজনেই দেখভাল করছিলেন যাতে আমরা যত্নবান হই।
খাওয়া দাওয়া শেষ হলে তিন তলার একটি ঘরে আমাদের শোবার ব্যবস্থা হল। টর্চ মোমবাতি, দেশলাই দুটি মিনারেল ওয়াটারের বোতল দিয়ে জানতে চাওয়া হল আর কিছু লাগবে কিনা।
মিনারেল ওয়াটারের বোতলের প্রাচূর্য দেখে ধনঞ্জয়বাবুদের সচ্ছলতার পরিমাণ আন্দাজ করা যায়। যাই হোক সকলকে শুভ রাত্রি জানিয়ে শুতে গেলাম।সত্যি অতিথি সৎকারের তুলনা হয় না।
তিনতলা ঘরটিও সুন্দর, প্রশস্ত বিছানা দক্ষিণমুখী জানলা। মশারী লাগানো রয়েছে। তিনতলাতেই বাথরুম, রান্নাঘর, সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা রয়েছে। কোন অবস্থাতেই নীচে নামার দরকার নেই। বৃষ্টি কমে এসেছে, জানলা খুলে দিতেই ঠান্ডা হাওয়ায় ঘর ভোরে গেল।
সারাদিনের ক্লান্তি, অনেকদিন বাদে ঝড়, বৃষ্টি হওয়ায় আবহাওয়া ঠান্ডা হয়েছে। তাই ঘুমিয়ে পড়তে দেরী হল না। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা হঠাৎ মশারীর মধ্যে টর্চের আলোর চমক দেখে বলে মনে হল। সহসা ঘুম ভাঙ্গলে বুঝতে একটু সময় লাগেকোথায় শুয়ে আছি, সেই সময়টুকু পার হতেই বুঝতে পারলাম এটা মেসবাড়ী নয়। পাশে শোওয়া হারাধন টর্চ জ্বালজ্বালি করছে। রাতদুপুরে এরকম আচরণের কোন যুক্তি না পেয়ে প্রশ্ন করি, “ কি হল কি? টর্চ জ্বালছ কেন?”
অত্যন্ত ক্ষীণ গলায় জানালো ,” পেটটা কেমন করছে সুভাষদা”।
“মরেছে, বাজে কটা”।
“দেড়টা”।
“ঠিক আছে ঘুরে এসো আমার ওঠার দরকার আছে?”
“না না আপনি ঘুমান”।
ঘটনার গুরুত্ব না দিয়ে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, এবারে কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না, হারাধনের চঞ্চলতা আবার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল।
“ কি হল আবার”।
“পেটটা গন্ডগোল হয়েছে বলে মনে হচ্ছে”।
“কাউকে ডাকব”।
“না না তার দরকার নেই প্রায় মরিয়া হয়ে উত্তর দিল, হারাধনের আপত্তি খুব সঙ্গত। হবু জামাইএর এরকম বেসামাল অবস্থা সর্বসমক্ষে আনাটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। এরপর আর ঘুম আসতে চায় না। উঠে বসে ঘড়ি দেখতে চাইলাম, কিন্তু টর্চটা হারাধনের কাছে, বাধ্য হয়ে সিগারেট ধরালাম। সেই আলোতেই ঘড়ি দেখেনিলাম দুটো চল্লিশ।
মেঘ কেটে যাওয়ায় আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। মশার উপদ্রব খুব একটা টের পাচ্ছি না। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে সিগারেট শেষ হওয়া মাত্র মনে হল তাইতো হারাধন তো অনেকক্ষণ গেছে,এখনো ফিরছে না কেন?
মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করলাম, বাথরুমের মধ্যে কি অসুস্থ হয়ে পড়ল। এক মুহুর্ত দেরী না করে মোমবাতি জ্বালালাম। ঘর থেকে বেরিয়ে দালান পেরিয়ে বাথরূম।বন্ধ দরজার সামনে চাপা গলায় ডাকলাম “হারাধন”, কোন শব্দ নেই।আবার ডাকলাম সঙ্গে দরজায় টোকা। ভেতর থেকে ক্ষীণ কন্ঠে উত্তর এল-“বড় বিপদে পড়েছি সুভাষদা”।
“ কি হয়েছে, অসুস্থ হয়ে পড়েছ”।
“ না বাথরুমে আর এক ফোঁটা জল নেই”।
হারাধনের বিপদটা অনুধবন করতে একটু সময় লাগল, ধনঞ্জয়বাবুর বাড়ীতে ইলেকট্রিক পাম্পে জল ওঠে, সন্ধ্যে থেকে কারেন্ট না থাকায় ট্যাঙ্কের সীমিত জল হারাধনের কল্যানে খরচ হয়ে গেছে। প্রকৃতির আহ্বানের প্রাবল্যে আগাম হুঁশিয়ার হতে পারেনি, বেচারা হারাধন।
কিন্তু এখন যে বিপদে পড়েছে তার থেকে উদ্ধারের উপায় কি? বিপদে চিরদিনই আমার মাথা ঠান্ডা, কাজও করে চটপট। তখনই মনে পড়ল একতলার বাথরুমের কথা, তার অবস্থানটা একবার মনে মনে ভেবে নিলাম। সেখানে একটা বড় চৌবাচ্চা দেখেছিলাম। আর কোন রকম চিন্তা না করে হারাধনকে বললাম, এক কাজ করো একতা বালতি বার করে দাও, টর্চটা আমাকে দিয়ে এই মোমবাতিটা বরং রাখো। হারাধন তখন সিদ্ধান্ত নেবার সমস্ত ক্ষমতা হারিয়েছে, সম্পূর্ণ আমার ওপর নির্ভরশীল।
আমার কথা মত টর্চ আর একটা প্ল্যাস্টিকের বালতি বার করে দিয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যে উদ্ধার পাবে এই আশায়।
আমি টর্চ আর বালতি নিয়ে রওনা দিয়েছি পরিকল্পিত লক্ষ্যের দিকে।সেই বিখ্যাত আপ্তবাক্য পৃথিবীর সর্বত্র সবরকম পরিবেশে কি ভয়ানক রকমের সত্য। “ম্যান প্রপোজেস, গড ডিসপোজেস”, কোথায় কোথায় যে ভগবান তাঁর লীলা প্রকট করে রাখেন তা আজো মানুষের অজানা। তিনি সহায় না হলে সহজ কাজও দুরূহ হয়, এক্ষেত্রেও হল তাই, দোতলা থেকে একতলা নামবার মুখে সিঁড়ির মুখে বন্ধ কোলাপ্সিব্যাল গেটে তালা দেওয়া। যার অর্থ খুব পরিষ্কার। দোতলা থেকে একতলায় যাবার পথ বন্ধ। হারাধনের বিপদের গভীরতা বোঝা গেল।যত সহজে হারাধন উদ্ধার পাবে ভেবেছিলাম আদতে তা হবার নয়। ফিরে গিয়ে হারাধনকে ব্যর্থতার কথা জানাব না বালতি হাতে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব, ভেবে পাচ্ছি না।
বিপদে চটপট বুদ্ধি খেলে এরকম একটা বিশ্বাস মনে মনে পোষণ করতাম। সেটা এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। কাউকে ডাকাডাকি করা মনে হারাধনকে ভবিষ্যতের জন্যে হাসির খোরাক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা। তখন হারাধন এখানে বিয়ে করতেই রাজী হবে না।কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটাও তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।হঠাৎ মনে হল দোতলায় কোন বাথরুম থাকবে না এটা হতে পারে না।তিনতলার বাথরুমের অবস্থান মনে মনে ছকে নিয়ে দোতলার সেই জায়গার উদ্দেশ্যে পা টিপে টিপে অগ্রসর হলাম। অজানা ঘুমন্ত পুরীতে জলের সন্ধান যেকোন দুর্গম অভিযানের থেকে কঠিন কাজ, কারো ঘুম ভেঙ্গে গেলে টর্চ বালতি হাতে আমাকে দেখাটা মোটেই অভিপ্রেত হবে না।
তবু আন্দাজের ওপর নির্ভর করে এগোতে লাগলাম বাথরুম আবিষ্কারের জন্যে। আশংকা যে মনে একেবারে নেই তা নয় যে সেই বাথরুমে জল পাব এমন নিশ্চয়তা কোথায়, তখন তো সর্বাত্মক পরিশ্রমটাই মাটী।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে একটা বন্ধ দরজা দেখে করে ঠেলা দিলাম। কিন্তু একি এতো বাথরুম নয় কে যেন মশারী খাটিয়ে শুয়ে আছে। অন্যত্র অনুসন্ধান করার উদ্দেশ্যে বাঁদিক ধরে কিছুটা এগোতেই এঁটো বাসনে পা দিয়ে ফেললাম। ব্যস ধাতব শব্দে রাতের যাবতীয় নিস্তব্দতা ভেঙ্গে গেল। মশারীর ভেতর থেকে কে –এ-এ –এ। এ’টিকে কিছুটা প্রলম্বিত করে রাত্রিকালীন সেই অপ্রাকৃত শব্দের উৎস সন্ধানে পৌঁছতে চাইলেন। বহু দিন আগে কলেজ স্ট্রীটে বইপাড়ার ফুটপাতে পুরানো পুস্তক সম্ভারের মাঝে জনৈক “ রঘুবীর তস্কর”প্রণীত একটি বইয়ের সন্ধান পেয়েছিলাম, “চুরি বিদ্যা সহায়িকা”। জনৈক তস্কর এই ধরনের বিপদে চোর কে বিড়ালের ডাক বা ম্যাঁও শব্দ করার কথা বলেছিলেন। এই বিড়ালের ডাক দুই তিন বার কিছুটা ব্যবধান রেখে ডাকতে হবে। গৃহস্থ বিড়াল মনে করে ঘুমিয়ে পড়লে চোর তার পরর্বতী মর্মে ব্রতী হবে।
কিন্তু সেই অজানা ঘুমন্তপুরীর অন্ধকার নিশীথে প্রায় আপৎকালীন অবস্থায় আধিত বিদ্যা প্রয়োগ করতে পারলাম না। ‘কে’- ডাকের সাথে সাথে শরীরের এক তীব্র জৈবিক তাড়নায় ফিরে যেতে চাইলাম পুরানো অবস্থানের দিকে। এর ফলে তিনতলার পাশের দেয়ালের সঙ্গে হাতে থাকা বালতিটির প্রচন্ড সংঘর্ষ হল। হ্যান্ডেল থেকে বালতিটি বিচ্যূত হয়ে ছিটকে পড়ল বেশ কিছুটা দূরে।রাতের নিস্তব্ধতার সাথে অন্যান্যদের ঘুম ভাঙ্গাতে যে শব্দের প্রয়োজন তার আর বাকী থাকল না।এরপর জিজ্ঞাসা বা অনুসন্ধানমূলক ডাক হতে পারে না।হঠাৎ জেগে ওঠা মানুষগুলি নিশ্চিত আগমনকারীর পরিচয় সম্পর্কে। ডাক তখন চীৎকারে রূপান্তরিত – “চোর , চোর”।এসব ক্ষেত্রে রঘুবীর তস্কর উক্ত পুস্তকে চোরকে পলায়নের কথাই বলেছিলেন। সেই উপদেশই গ্রহণ করলাম।
এক হাতে টর্চ অন্য হাতে বালতির হ্যাণ্ডেল নিয়ে কোনোক্রমে তিনতলার শয়নকক্ষে।এতক্ষণ যারা ঘুম থেকে ওঠেনি তারাও উঠে পড়েছেন বাড়ীর অন্য সকলের সমবেত চীৎকারে।জানলা দিয়ে প্রতিবেশীদের ঘরে দীপশিখা জ্বলে উঠতে দেখলাম।কেউ কেউ হুশিয়ার করার জন্যে শঙ্খ ধ্বনি করছেন।ধনঞ্জয়বাবু তখন একলাই কমল মিত্র ও উৎপল দত্তের দ্বৈত্ত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে চীৎকার করে চলেছেন সমানে। লাঠি বাঁশ মশাল আনার হুকুম দেওয়া হচ্ছে তারস্বরে।ধনঞ্জয়বাবুর বাড়ীর পিছনে বিশাল বাগান সেটিকেই চোরের আপাতত গা ঢাকা দেবার স্থান মনে করে চাকর বাকরদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধনঞ্জয়বাবু তাঁর সতর্কবাণীর মধ্যে দিয়ে না দেখা চোরকে আত্মসমার্পণ করার সদুপদেশ দিচ্ছেন, অন্যথায় তার পরিনাম যে ভয়ংকর হবে তার উদাহরণস্বরূপ দোনলা বন্দুক থেকে ভগবানের উদ্দেশ্যে ছররা বর্ষনের মাধ্যমেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
এই পরিস্থিতিতে ঘুমিয়ে থাকব তা তো হতে পারে না, তাই তিন তলার সিঁড়ির মুখে টর্চ জ্বালিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছি।নীচ থেকে সঞ্জয়বাবুর গলা পেলাম,-“ভয় নেই সুভাষবাবু আমি যাচ্ছি ব্যাটাচ্ছেলে বোধহয় তিনতলাতেই লুকিয়েছে। নাহলে বাথরুমের বালতিটা এখানে এলো কিকরে। তিনতলার বাথরুমটা একবার দেখা দরকার।
হায় কি সর্বনাশ! সঞ্জয়বাবুর যে এমন গোয়েন্দাসুলভ মন হবে কে জানত। পড়ে থাকা বালতির সুত্র ধরে আসতে চাইছেন সেই অকুস্থলে যেখানে নিরাপরাধ হারাধনের বেসামাল অবস্থান। তিনতলায় ওঠার আগেই সঞ্জয়বাবুকে আটকাতে হবে। সাত আটটা সিঁড়ি নেমে ঘুরতেই সঞ্জয়বাবুর মুখোমুখি।
“চলুন তো বাথরুমটা একবার দেখে আসি”।গলার স্বর যথাসম্ভব স্থির রেখে বললাম
“আমি এই মাত্র বাথরুম থেকে ঘুরে এলাম”।
“অন্যান্য ঘর গুলো?”
“সমস্ত চেক করেছি কেউ কোথাও নেই”।
সঞ্জয় বাবু একটু হতাশই হলেন, ‘ কিন্তু গেল কোথায়?’ এ প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে গেলে নিজের অবস্থানের কথাই বলতে হয়।সুতরাং নীরবতাই শ্রেয়।
“ যান গিয়ে শুয়ে পড়ুন, হারাধনের ঘুম ভাঙ্গেনি বোধহয়”।
“ না ক্লান্ত তো”।সঞ্জয়বাবু নীচে নেমে গেলেন। মনে হল বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেল। হঠাৎ খেয়াল হল সঞ্জয়বাবুর সাথে কথা চলাকালীন আনমনে আমার বাঁ’হাতে ধরা ছিল,বালতি বিচ্যূত সেই হ্যান্ডেল, কি সর্বনাশ অন্ধকারের কল্যাণে কারুর দৃষ্টিগোচর হয়নি।এর পর জলের সন্ধানে আর কোন অভিযান চলতে পারে না।পেট রোগা হারাধন থাকুক আরো কিছুক্ষণ, কি আর করব সিগারেট ধ্বংস করি। টেবিলের ওপর প্যাকেটটা রেখেছিলাম।সেটা নিতে গিয়েই কিছু একটার সঙ্গে হাতের ছোঁয়া লাগল।টর্চ জ্বালতেই মাথায় বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল, “ মিনারেল ওয়াটার”-একটার সিল ভেঙ্গে কয়েক ঢোক জল খেয়ে বাদবাকি বোতল দুটো,বুকে করে সোজা বাথরুমে। দরজায় টোকা দিতেই হারাধনের ক্ষীণ কন্ঠস্বর, “সুভাষদা”।
‘হ্যাঁ’- গলার মধ্যে আশ্চর্য আত্মপ্রত্যয়। “ দরজা খুলে এগুলো ধরো আপাততঃ এই দিয়েই সমস্যা মিটিয়ে নাও”।
নীচের চিৎকার চেঁচামেচি স্থিমিত হয়ে এসেছে, হাল্কা মনে সিগারেট ধরালাম, ঘড়িতে ঢং ঢং করে চারটে বাজল।
দুর্দান্ত গল্প । হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাচ্ছে আমার । মনে হয় সত্য ঘটনা । কমল মিত্র স্বরূপ লেখকের ভিতর এত হাস্যরস আছে , আজ জানা গেল 👌👌
দারুণ.. দারুণ! সব থেকে ভালো লাগল কমল মিত্র আর উৎপল দত্তের দ্বৈত চরিত্র। চরিত্রগুলো ছবির মতো দেখতে পেলাম যেন।
দারুণ দারুণ! সব থেকে ভালো লাগল কমল মিত্র আর উৎপল দত্তের দ্বৈত চরিত্র ।চরিত্রগুলো ছবির মতো দেখতে পেলাম ।