সহযাত্রী

রাজধানী এক্সপ্রেসের এসি ফাস্ট ক্লাসে উঠে সৌম্য দেখলো সে একেবারে একা। অন্য কোন যাত্রী নেই। সুটকেশটা সিটের নীচে ঢুকিয়ে দিয়ে ছোট্ট হ্যান্ড ব্যাগটা দুই সিটের মাঝখানে নির্ধারিত শেলফ্‌এর ওপর রেখে দিল। তেমন কিছু নেই ব্যাগে টুথপেষ্ট, ব্রাশ,সেভিংরেজার,ফোম, মোবাইল চার্জার, টুকিটাকি দু’একটা ওষুধ, আগাথা ক্রিষ্টির পেপারব্যক ডিটেকটিভ বই। ট্রেনে পার্শ্ববর্তী যাত্রীর সঙ্গে আলাপচারিতা সৌম্যর খুব পছন্দের নয়, একমনে বই পড়লে কেউ তেমন গায়ে পড়ে আলাপ করতে চাইবে না। সুটকেশটা আবার টেনে নিয়ে স্লিপিং সুট’টা বার করে রাখল, তার সঙ্গে সুটকেশের সাইডে রাখা হাওয়াই চপ্পলটাও। ট্রেন ছাড়লে গিয়ে চেঞ্জ করে আসবে, ঘড়িতে দেখল এখনো প্রায় ছ’মিনিট বাকী। কেউ না থাকতে একদিকে সুবিধে হয়েছে, ডিনার খেয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়বে , একেবারে নিজের ঘর। টিকিট চেক করার সময় জেনে নেবে মাঝ পথে আর কারুর ওঠার সম্ভবনা আছে কিনা।
প্যান্টিকারের একটা কম বয়সী ছেলে, জলের বোতল,আর অডিকোলনে ভেজা টাওয়েল দিয়ে গেল। মুখটা মুঝতে মুঝতেই ট্রেনটা ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গেই একটি সৌম্যর বয়সী একজন ট্রলি ব্যাগ টানতে টানতে ভিতরে এসে ঢুকল। সৌম্যর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই হাল্কা একটা হাসির রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। চমকে উঠল সৌম্য,হাসিটা কেমন যেন চেনা, তবে কি তার পরিচিত , না তা কি করে হবে। ফর্সা, বেশ লম্বা, দুধসাদা শার্টটা কালো প্যান্টে ইন করে পরা, ক্লিল সেভড্‌। তবে আফটারসেভ লোশনের গন্ধটা খুব চেনা মনে হচ্ছে। সৌম্য আফটার সেভ লোশন ব্যবহার করে না। তাহলে গন্ধটা তার চেনা মনে হচ্ছে কেন, তবে কি ন’বছর আগে পাওয়া গন্ধটাই কি এটা? এতদিন আগের গন্ধ কি কখনো মনে থাকে নাকি, সম্প্রতি কি এরকম কোন গন্ধ নাকে এসেছিল। মনে পড়ে না সৌম্যর।
হাল্কা মনটা আস্তে আস্তে ভারী হয়ে উঠছে।বারে বারে কেন একটা কথা মনে আসছে সৌম্যর ‘মিছরির ছুরি’ এমন কোন বস্তুর অস্তিত্ব নেই বাস্তবে এটা সবাই জানে, তবু কথাটা চালু আছে। ছেলেটার সুটকেশ টেনে ভেতরে ঢোকার সময়ের মুচকি হাসিটাই এই কথাটা বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে। এর তীক্ষ্মতার কথা ন’বছর আগেকার স্মৃতিকেই জানান দেয়।
কেউ না থাকায় যে স্বস্তি অনুভব করছিল তা একেবারেই নেই। স্লিপিং সুট হাতে নিয়ে সবে উঠে দাঁড়িয়েছে , প্যান্টিকারের একটা ছেলে ট্রেতে টিফিন সাজিয়ে নিয়ে শেলফে রাখতে গিয়ে দেখল সৌম্যর হ্যান্ড ব্যাগ রাখা রয়েছে। তাড়াতাড়ি সিটে বসে হ্যান্ড ব্যাগটা সরিয়ে নিল।
“দাঁড়ান স্যার আপনার জলের বোতল এনে দিচ্ছি”।সহযাত্রীর উদ্দেশ্যে কথাটা বলে ছেলেটি বেরিয়ে যেতে সৌম্য দরজার দিকেই তাকিয়ে ছিল। চমক ভাঙ্গল সহযাত্রীর কথায় – “ক’দূর? দিল্লী?
“এ্যাঁ”। আপনা আপনি বেরিয়ে আসা কন্ঠস্বর নিজের বলে চিনতে পারল না সৌম্য, সামান্য কেশে গলাটা ঠিক করে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, দিল্লীই যাচ্ছি”। নিজের অপ্রতিভ ভাব যেন সহযাত্রী বুঝতে না পারে তাই প্রতিপ্রশ্ন করল,
“আপনি”?
“আমিও দিল্লী, ভালই হল একসাথে যাওয়া যাবে”। ভাল যে একেবারেই হয়নি সেটা প্রতি মুহুর্তেই বুঝতে পারছে সৌম্য। এই ভদ্রলোক আসার পর থেকেই একটা চরম অস্বস্তি, দাঁতের ফাঁকে কিছু একটা আটকে গেলে যেমনটা হয় আর কি, জিভটা সেখানেই ঘোরাঘুরি করে, সেই ন’বছর আগেকার ট্রেন জার্ণী ঘটনাটাকে ঘিরে মন পাক খাচ্ছে । বারে বারেই মনকে বোঝাতে চাইছে, চান্সেস আর ভেরী ভেরী রিমোট। এককোটি্তে একবার হবার সম্ভবনা আছে কিনা সন্দেহ। নিজেও কতবার ট্রেনে যাতয়াত করেছে, কই কখনো তো একই সহযাত্রীকে সে দ্বিতীয়বার মিট করেনি। অন্য কারুর কাছেও তো এরকম ঘটনা শোনা যায়নি। অনর্থকই ভাবছে সে।
স্লিপিং সুট’টা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল সৌম্য চেঞ্জ করবে বলে। বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে লাগল , এই চিন্তা থেকে মুক্ত হবার জন্যে। টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে গিয়ে মনে পড়ল আচ্ছা সেই ছেলেটার তো সরু গোঁফ ছিল না? এর তো দাড়ি গোঁফ সব কামানো। তবে ন’বছর পর তো যে কেউ দাড়ি গোঁফ কামিয়েই ফেলতে পারে, এর মধ্যে কোন অস্বাভাবিকত্ব নেই। পরিচয় গোপন রাখতে অনেকে অনেক কিছু করে, এ তো সামান্য সরু গোঁফের রেখা। তবে সেবারেও সেই ছেলেটা সুটকেশ নিয়ে ঢোকার সময় এই রকমই মুচকি হাসি হেসেছিল।
টয়লেট থেকে বেরুতেই প্যান্টীকারের সেই ছেলেটার সঙ্গে দেখা। একটু হেসে প্রশ্ন করল, “ ডিনারে কি কন্টিলেন্টাল দেব স্যার”। চমক ভাঙ্গল সৌম্যর। “ এ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে তাই দিও”। নিজের সিটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল এরা একটু গায়ে পড়া হয়, যাতে সবশেষে টিপস্‌’টা ভাল পায়, বেশী পাত্তা দেওয়া উচিত হবেনা।
মুখ মুছতে মুছতে ভেতরে ঢুকেই চমকে উঠল সৌম্য, একী! লোকটির পাশে রাখা একটা ভুজিয়ার প্যাকেট, কুড়কুড়ের প্যাকেট ছিঁড়ে খাচ্ছে। বুকের মধ্যে হৃদ্‌পিন্ডের রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যাওয়া টের পাচ্ছে সে। এসি চলাকালীনও স্লিপিং সুটের নীচে মিন মিন করে ঘাম দিচ্ছে সৌম্যর। সিটে বসতেই মুখোমুখি লোকটা সৌজন্য বশতঃই প্যাকেট’টা বাড়িয়ে ধরল তার দিকে। মুখে কোন উত্তর না দিয়ে ঘাড় নেড়েই প্রত্যাখান করল।
“সেকি? পছন্দ করেন না?” এবারও সৌম্য ঘাড় নাড়ল, “তাহলে এটা ট্রাই করে দেখতে পারেন”। বলেই ভুজিয়ার প্যাকেট’টা বাড়িয়ে দিল। এবার সৌম্যকে কথা বলতেই হল-“ না না থাক, আমার এখনো টিফিন খাওয়া হয়নি”।
“ওঃ!তাও তো বটে”। সেবারেও সেই ছেলেটা হাওড়া স্টেশন থেকে ভুজিয়ার প্যাকেট কিনে নিয়ে ট্রেন উঠেছিল। মুখোমুখি বসে সেবারও ভুজিয়া অফার করেছিল। ট্রেনে অপরিচিত লোকের কাছে থেকে সৌম্য কখনোই কোন খাদ্যদ্রব্য নেয় না, এর থেকে যে কি কি বিপদ হতে পারে তা তার জানা ।সুতরাং আজকের মতন সেবারেও ঘাড় নেড়ে প্রত্যাখান করেছিল। অথচ অদ্রিজা সেই অপরিচিত ছেলেটার কাছ থেকে হাত পেতে ভুজিয়া নিয়ে মুখে পুরেছিল। সদ্য বিবাহিত কম বয়সী স্ত্রীর প্রগলভতার জন্যে কিছু মনে করলেও মুখে কিছু বলেনি সৌম্য। পরে সেটাই তার সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
“জানেন যতক্ষণ জেগে থাকি ততক্ষণই আমাকে মুখ চালাতে হয় কিছু না কিছু খেয়ে”। একথার কি কোন উত্তর হতে পারে, কেউ যদি মুঠো মূঠো ভুজিয়া বাদাম অশ্লীল ভাবে চিবতে থাকে। খষর খষর করে ভুজিয়া বাদাম, কুড়কুড়ে পেষাই হচ্চে মুখের ভেতর।এর থেকে খারাপ দৃশ্য আর কিছু হয় নাকি। একবার সহযাত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে “ ডিসগাসটীং” শব্দটা নিঃশব্দে উচ্চারণ করে টিফিনের ট্রে’টা টেনে নিল সৌম্য।
“এই ট্রেনগুলোর একটা অসুবিধে আছে”। অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল “অসুবিধে”?
“হ্যাঁ, বেশীরভাগ স্টেশনেই তো গাড়ীটা দাঁড়ায় না”।
“তাতে কি সুবিধে হত?”
“স্টেশনে নেমে কিছু না কিছু কিনে আনা যেত, প্রতি স্টেশনেই তাদের নিজস্ব কিছু খাবার দাবার থাকে, যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না”। কথাটা শুনেই ভেতরে ভেতরে চমকে উঠল সৌম্য, সেই ছেলেটা অবশ্য এই কথা গুলো বলেনি, কিন্তু প্রতি স্টেশনে নেমে কিছু না কিছু কিনে আনছিল। অভ্যেস যাবে কোথায়, এখানে সেটা হচ্ছে না বলেই অস্বস্তিতে প্রকাশ করে ফেলল।এটা চরিত্রের একটা লক্ষণ বটে। মনের মধ্যে ধীরে ঘনিয়ে আসা দুশ্চিন্তাযুক্ত উদ্‌বেগের আভাস যাতে সহযাত্রী টের না পায় তাই সৌম্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও উত্তর দিল, “চিন্তা করছেন কেন একটু পরেই সুপ দিয়ে যাবে”।
“দূর ও আমার পোষায় না, চিবিয়ে চিবিয়ে রসিয়ে না খেলে ঠিক জমে না বুঝলেন”। মনের মধ্যে যখন একটা সন্দেহের দানা বেঁধেছে বেশী আলাপ না জমানোই ভাল। কিন্তু যদি সেই ছেলেটাই হয়, কথাবার্তার মাধ্যমে তো অনেক কিছুই জানা যেতে পারে । সৌম্যকে তো আর সে চিনছে না। উলটোটাও তো হতে পারে।কথাটা মনে হতেই কপালটা ঘেমে উঠছে নাকি, বুকটা কেমন যেন ধড়ফড় করে উঠল না । যাকগে যাক। এক ঢোক জল খেল সৌম্য।
বালিশের ওপর ভাঁজ করা কম্বলটা রেখে ব্যাগ থেকে বইটা বার করল, শুয়ে শুয়ে বই পড়ার কথা মনে করেই সবে রিডিং লাইটটা জ্বালিয়েছে। চেকার ঢুকল ফলে আর শোয়া হল না। ফার্স্টক্লাস এসিতে টিকিট চেকিং নেহাতই ফরমালিটি। সহযাত্রীর আবার অন লাইনে টিকিট কাটা, আইডেন্টিফিকেশনের জন্যে কার্ডটা বার করে চেকারের হাতে দেবার সময় তারই হাতের ধাক্কায়, কার্ডটা ছিটকে এসে পড়ল, সৌম্যের পায়ের থেকে সামান্য দূরে, চেকার নিচু হয়ে কুড়িয়ে নেবার আগেই সৌম্য সেটা কুড়িয়ে নিয়ে চেকারের হাতে তুলে দিল। ল্যামিনেট করা আধার কার্ড, নামটাও এক ঝলক দেখে নিয়েছে, “রাহুল চ্যাটার্জি”। সঙ্গে সঙ্গে সৌম্যর পেটের ভেতর গুড় গুড় করে উঠল। ন’বছর আগে সেই ছেলেটার সুটকেশে চেটানো নাম ও পদবীর আদ্যাক্ষর ‘আর” এবং ‘সি’ সে যেন পুনরায় চোখের সামনে দেখতে পেল।
বালিশে মাথা দিয়ে বইটা চোখের সামনে খুলেছে বটে, কিন্তু এক লাইনও পড়তে পারছে না। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত টানাপোড়েন, তাকে ঘিরেই অসংলগ্ন চিন্তা মাকুর মত এদিক থেকে ওদিক দৌড়োদৌড়ি করছে। ট্রেন চলার সাথে শরীর জোড়া একটা কম্পন যেন ধীরে ধীরে মাথায় এসে জমা হচ্ছে। কতক্ষণ কেটেছে খেয়াল নেই।
“আচ্ছা আপনাকে কি এর আগে কখনো মিট করেছি”। আর কোন সংশয় রইল না। ধড়মড় করে উঠে বসল সৌম্য, তাহলে এতক্ষণ যা ভাবছিল……। “না মানে খুব চেনা লাগছে, আপনার নামটা কি বলুন তো”।
“ কেন কেন? আমার নাম? চেনা লাগবে কি করে? আপনি কোথায় থাকেন?” কথাগুলো এত দ্রুত বলছিল সৌম্য যে জড়িয়ে যাচ্ছিল।
“আমি তো পাটনায় থাকি, আমার কাজটাই এই,আজ কলকাতা কাল দিল্লী, পারলে আগামীকাল রাতেই ট্রেন ধরব, মুখটা খুব চেনা লাগছিল তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম,” সৌম্যকে ভালভাবে নিরীক্ষণ করে জিজ্ঞাসা করল, “ আপনার শরীর কি খারাপ লাগছে?”
সৌম্য বেশ বুঝতে পারছে মনের মধ্যে উৎকন্ঠা চোখে মুখে ছাপ ফেলছে। নামটা বললে ন’বছর আগের ঘটনার সঙ্গে যদি সত্যিই মিল থেকে থাকে, বর্তমানে সৌম্যকে ঘিরে ওর মনে যেটুকু সন্দেহের দোলাচল রয়েছে তা হয়ত একেবারেই নিরসন হয়ে যাবে, তখন তো নিজের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে। আবার নামটা না বললেও সন্দেহ আরো ঘনীভূত হবে । তাড়াতাড়ি বোতল থেকে আবার দুঢোক জল খেয়ে রুমাল বার করে মুখটা মুছে নিল সৌম্য। দু’বার কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করে একটু জোর গলায় বলল, “না না শরীর খারাপ লাগবে কেন? এই তো বেশ আছি, হ্যাঁ হ্যাঁ কি যেন জিজ্ঞাসা করছিলেন নাম, আমার নাম সৌম্যময় চাকলাদার”।
‘ওঃ! তাই আমার নাম রাহুল চ্যাটার্জি, চেনা লাগছিল কেন এবার বুঝতে পেরেছিল, আমার একজন চেনা, টাইমস্‌ অফ ইন্ডিয়ার সাংবাদিক দিল্লীতেই থাকে,অরুণময় চাকলাদার একসময় আমাদের সঙ্গে কলেজে পড়ত, এখন খুব নাম ডাক, তার সঙ্গে আপনার মুখের অনেকটা মিল আছে। আপনাদের কেউ হয় নাকি?”
“ না না কত চাকলাদার আছে, সকলেই কি আত্মীয় হয় নাকি”। এসব লোকটার চালাকি নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছে। খুব ভুল হয়ে গেছে, তখন ভুজিয়ার প্যাকেট’টা নিলেই হত। সিলড্‌ প্যাকেটে তো আর কিছু মেশাতে পারবে না। মানুষের চেহারা ভুলে গেলেও স্বভাব কিন্তু মনে থেকে যায়, বিশেষতঃ সেই স্বভাব যদি অন্য কারো মত না হয়। না লোকটাকেও বুঝিয়ে দেওয়া দরকার সন্দেহটা সৌম্যর তরফ থেকেও রয়েছে।
“আপনি কি এই রাজধানী এক্সপ্রেসেই যাওয়া আসা করেন নাকি?”
“ না না কলকাতা থেকে পাটনা এলে পাঞ্জাব মেলেই আসি, অনেক ভোরে পৌঁছে দেয়, সারাটা দিন কাজ করার জন্যে হাতে থাকে”। বলেই সে দুই কানে প্লাগ গুঁজে মোবাইল ফোনের সঙ্গে জুড়ে দিল। এই এক হয়েছে আজকাল।
আচ্ছা পাঞ্জাব মেল মানে অমৃতসর মেল!! সবই তো মিলে যাচ্ছে। ন’বছর আগে এই অমৃতসর মেলেই বিয়ের সাতদিনের মাথায় অদ্রিজাকে নিয়ে বেরিয়ে ছিল হনিমুনে, লখনৌ হয়ে নৈনিতাল যাবে। সেবার ছিল এসি দু’টায়ার কম্পার্টমেন্ট, ট্রেন ছাড়ার কয়েক মিনিট আগেই একটা সুটকেশ নিয়ে এসেছিল ছেলেটা, তখনই সুটকেশের চেটানো নাম ও পদবী আদ্যাক্ষর আর, সি চোখে পড়েছিল। কিছুই মনে হয়নি তখন। সৌম্যর ছিল আপার বাংক, অদ্রিজা লোয়ারে, পাশের লোয়ারে এক বয়স্ক মহিলা। ট্রেন এক ঘন্টার ওপর লেট চলছিল, লখনৌ সকালের দিকেই ঢোকার কথা, তাই ভোরে সৌম্যর ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল তাড়াতাড়ি, লোয়ার বাংকে অদ্রিজাকে না দেখতে পেয়ে মনে হয়েছিল বোধহয় টয়লেটে গেছে, নিদিষ্ট সময় অপেক্ষা করার পর অদ্রিজা ফিরছে না দেখে নিজেই খোঁজ করতে যায়, না পেয়ে ফিরে এসে নজর পড়ে সীটের নীচে অদ্রিজার সুটকেশটা নেই, ধড়াস করে উঠেছিল বুকটা, তার মানে তাকে না জানিয়ে অদ্রিজা কোথাও নেমে গেছে। আপার বাংকে ছেলেটি না থাকায় মনে হয়েছিল, দুজনে একসঙ্গে নেমে যায়নি তো।আগের দিন সন্ধ্যায় ট্রেন ছাড়ার পর সহযাত্রী ছেলেটির কাছ থেকে হাত পেতে ভুজিয়া চেয়ে নেওয়া কেমন যেন ইঙ্গিতপূর্ণ বলেই মনে হচ্ছিল তার। মুখে একটা আলগা হাসির ভাব সবসময়ই থাকত অদ্রিজার , সেইরকমই হাসি লক্ষ্য করেছিল হাত পেতে নেবার সময় যেন অনেকদিনের চেনা । তাহলে কি কোন যোগসাজস ছিল। বয়স্ক মহিলা তখনো ঘুমাচ্ছিলেন, বাধ্য হয়েই তাকে জাগায়, কিন্তু তিনি কিছুই বলতে পারেন না।
লখনৌয় নেমে থানায় একটা ডায়রী করেছিল সৌম্য। তাতে অবশ্য সমস্যা মেটেনি, অদ্রিজার বাপের বাড়ীর তরফ থেকে ক্রিমিন্যাল কেস করা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। তারপর থানা পুলিশ জেল হাজত কোর্ট কাছারি করে পাঁচ বছর পর বেকসুর খালাস হয়, শুধুমাত্র মনের মধ্যে থাকা যে সন্দেহের কাঁটা’টা খচখচ করছিল, আর্গুমেন্টের সময় তার পক্ষের ল’ইয়ার সেই সন্দেহের বীজটাই বিচারকের মনে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিল, কারণ পুলিশ সেই সহযাত্রী সম্পর্কে কোন তদন্ত করেনি। ফলে সন্দেহের অবকাশে সৌম্য ছাড়া পেয়ে যায়। তবে অদ্রিজার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ডিনার করে রাহুল শুয়ে পড়ার আগে আলো নেভাবে কিনা সৌম্যকে জিজ্ঞাসা করায় আপত্তি করেনি।শুয়ে পড়েছিল দুজনেই, সৌম্য কিন্তু রিডিং লাইট’টা জ্বালিয়ে রেখেছিল বইটা নিয়ে নাড়াচাড়া করলেও পড়া হচ্ছিল না এক লাইনও।ডিটেকটিভ বইএর গোয়েন্দা সত্ত্বা নিজের মধ্যে সঞ্চারিত করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে কোন ফল হচ্ছিল না সৌম্যর। আজকের রাহুল চ্যাটার্জি কি সেদিনের আর, সি? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর কিভাবে জানা যাবে।
অল্প অল্প নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে, পাশের সীট থেকে। সেবারেও কি এরকম শব্দ শোনা গিয়েছিল পাশের বাংক থেকে, মনে করতে পারে না সৌম্য।রিডিং লাইটের আলো সেভাবেও না ছড়ালেও দ্রুত গতিতে ট্রেন চলার সাথে সাথে পাশ ফিরে শুয়ে থাকা রাহুল চ্যাটার্জির গোটা শরীরটা যেভাবে একটা নিদিষ্ট তালে নড়ছিল সেটা কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল। সেবারেও একই দৃশ্য পাশের বাংকে মনে পড়ে গেল সৌম্যর। কিন্তু এটা দিয়ে তো কাউকে সনাক্ত করা যায় না। একটা অস্বস্তি হচ্ছিল শরীর জুড়ে ফলে কিছুতেই ঘুম আসছিল। ঘুমাতেও ভরসা পাচ্ছে না। কোন এক চাকলাদারের সঙ্গে তার নাকি মিল খুঁজে পেয়েছে। নাকি ন’বছর আগে সৌম্য চাকলাদারকে সেও চিনতে পেরেছে।তাহলে কোন বড় রকমের ঘটনা ঘটিয়ে নেমে যায় যদি, তৃতীয় কোন যাত্রীও নেই। কিন্তু এত নিশ্চিন্তে ও ঘুমাচ্ছে কি করে? তাহলে সৌম্য যা ভাবছে সবটাই অবান্তর।
কারুর ঠেলায় সৌম্যর ঘুম ভেঙ্গে চমকে উঠেছিল, চোখ চেয়ে দেখে রাহুল দাঁড়িয়ে আছে পাশে। “দেখেছেন তো রিডিং ল্যাম্পটা জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, বই পড়ুয়াদের এই হয়। আমি একটু টয়লেটে যাচ্ছি, একেবারে ফ্রেস হয়ে নেব, সারাদিনে আর সময় পাব না, তাই আপনাকে জাগিয়ে দিয়ে গেলাম সরি কিছু মনে করবেন না”। উঠে বসল সৌম্য, বোতল থেকে জল খাবার পর ঘুমের ঘোর অনেকটাই কেটে গেছে। ভোরের আলোয় বেশ পরিস্কার হয়ে আসছে আশপাশ, জানলা দিয়ে দ্রুত সরে যাওয়া ঘর বাড়ী, গাছ পালা চোখে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে কি মনের অন্ধকার’টাও কেটে গেছে অনেকটা। পুরানো কথাগুলো আর ভাবতে চাইছিল না সৌম্য, মনকে বোঝাতে চাইছিল নিজের অমূলক সন্দেহের কথা। ঝড় শেষ হবার পরও তার কিছু না কিছু চিহ্ন থেকেই যায়। তারই প্রভাবে এই সব দুশ্চিন্তা। যাক আর বেশী দেরি নেই। তখনই একটা মোবাইল ফোন বাজতে শুরু করল, না কোন ভুল নেই এতো সেই পুরানো সিনেমার স্বর্ণযুগের গান “তুমি না হয় রহিতে কাছে কিছুক্ষণ আরো নাহয় রহিবে কাছে ”। ন’বছর আগে শোনা সেই একই রিং টোন। বেজেই চলেছে,গানের কথাগুলো যেন নুড়ি পাথরের মত ছিটকে ছিটকে আঘাত করছে,কিন্তু কোথায় বাজচ্ছে , রাহুলের সীটে, তার চাদরের নীচে নাকি বালিশের তলায়, নাকি অন্য কোথাও, কোথাও তো নেই। তবু সৌম্য খুঁজেই চলেছে উদ্‌ভ্রান্তের মত, ন’বছর আগে পাশের বাংক থেকে যা তার কানে এসেছিল।

Leave a Reply