তবু অনন্ত জাগে

চোখের সামনে একটা লাল রেখা টেনে দ্রুতগতিতে বেরিয়ে গেল রাজধানী এক্সপ্রেস। অনিরুদ্ধদের বাড়ীর কাছেই কর্ড লাইনের রেলওয়ে ট্র্যাক।দিনে রাতে আপ ও ডাউন কত ট্রেন যে যাওয়া আসা করে, কখনো কখনো তার কম্পনও টের পাওয়া যায় বারান্দায় দাঁড়ালে। অনিরুদ্ধ সচেতনভাবেই এই সময়ে ছাদে আসে না। অনেকগুলো বছর কেটে গেছে,মানসিক ক্ষত সারাতে সময়ের চেয়ে ভাল বৈদ্য আর কেউ নেই। তবুও স্মৃতির আঁচড়ে আবার সেই জায়গাটা রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। বুক খালি করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল অনিরুদ্ধর। নয় নয় করে প্রায় সতের বছর কেটে গেছে, একসময় মনের মধ্যে একটা আশা ছিল। এখন সেটাও ফিকে হয়ে প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে। টুম্পাও অনেক বড় হয়ে গেছে, সব কিছুই বুঝতে শিখেছে।এখন তো আর সেই ছেলেমানুষি করবে না, ছাদে উঠে রোজকার মত কাগজের ফুল নাড়িয়ে তার দাদাকে টা-টা করবেনা।
(২)
সেদিন যখন টুম্পাকে আদর করে বাবা বেরিয়ে যাচ্ছিলেন,বাবার গলা জড়িয়ে হাম্পি খেয়ে বলেছিল “ আমি ছাদে উঠে কাগজের ফুল নাড়িয়ে টা-টা করব, জানলা দিয়ে তুমি কিন্তু এই দিকে তাকিয়ে থাকবে ”।বাবার সঙ্গে হেসেছিল অনিরুদ্ধও। দূরপাল্লার ট্রেনে চড়ে যতবার এখান দিয়ে গেছে ততবারই ভেবেছে নিজেদের বাড়ীটা লক্ষ্য করবে, কিন্তু দ্রুতগতির ট্রেনের মধ্যে নানান ঘরবাড়ীর ভিড়ের ভেতরে সেটা কখনোই সম্ভব হয়নি। বাবা কিন্তু টুম্পাকে নিরাশ করেননি। “ হ্যাঁ দিদিভাই নিশ্চয়ই দেখব তুমি টা-টা করবে আর দেখব না তাই কখনো হয়, দেখো না তোমার জন্যে কি নিয়ে আসি”। না ফিরে আসা হয়নি বাবার রফিগঞ্জে সেই ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায়।
খবরটা পাবার পর কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না অনিরুদ্ধ। হাওড়াস্টেশন, জিআরপি আপৎকালীন টেলিফোন নাম্বরের যোগাযোগের চেষ্টা, কোনটাই ফলপ্রসূ হয়নি, শেষকালে স্পেশাল ট্রেন ধরে চলে যাওয়া। হাজার হাজার উদ্বিগ্ন মানুষের ভিড়, পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ, সাংবাদিক ফোটোগ্রাফার, কতই বা বয়স তখন অনিরুদ্ধর, কি করবে স্থির করতে পারছিল না। এক বাঙ্গালী ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়, সেই বলে “চলুন আগে হাসপাতালে যাওয়া যাক”। না আহতদের মধ্যে পাওয়া যায়নি অনুতোষবাবুকে। অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পে গিয়ে রিপোর্ট করেছিল টিকিটের পিএনআর জানিয়ে। তাদের সাহায্যে অসনাক্ত মৃতদেহগুলি দেখতে শুরু করেছিল সেই পচনধরা দুর্গন্ধের মধ্যে। মৃতদেহগুলো এমনই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল মুখ দেখে চেনার উপায় ছিল না। হঠাৎই চোখে পড়েছিল গোল্ডক্যাপ পার্কার কলমটা বুকপকেটে তখনও রয়ে গিয়েছে। যেটা বাবা কোনদিন কাছছাড়া করত না। ট্রেন দুর্ঘটনার পর লুটতরাজ করার কিছু লোক তো থাকেই। হয়েও থাকে সেটা। দু’হাজার দুই সালে কলম যে মূল্যবান বস্তু হতে পারে লুটেরাদের জানার কথা নয়, তার ওপর রাতের অন্ধকারে । কি ভাগ্যি বুকপকেটে পেনটা ছিল বলেই না অনিরুদ্ধ চিনতে পেরেছিল মৃতদেহটি বাবার বলে। স্বাভাবিকভাবেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল, নিজের তাগিদেই শক্ত থাকতে হয়েছিল আনুষাঙ্গিক কাজকর্মের জন্যে। হাওড়া স্টেশনে ফেরার পর সাংবাদিকরা ঘিরে ধরেছিল ক্যামেরা নিয়ে। অনেকেই কাঁদতে কাঁদতে বাইট দিচ্ছিল, পরে আবার টিভিতে দেখবে বোধহয় সেই মনোভাব নিয়ে।তবে অনিরুদ্ধর মনে হয়েছিল, এই শোক তার সম্পূর্ণ নিজের। টিভি ক্যামেরার সামনে বিলাপ করে সস্তা করতে চাইছিল না এতবড় ঘটনাটাকে। যথা সম্ভব তাদের এড়িয়ে চলে এসেছিল সেদিন।
আসল ঘটনা ঘটল শ্রাদ্ধের দিন, দু’এক জন নিকট আত্মীয় স্বজন ছাড়া তেমন কেউ আসেননি। পাড়া প্রতিবেশী অনেকেই এসেছিলেন খবর পেয়ে, তবে তাদের আলাদা করে নেমন্তন্ন করার কোন অর্থ হয় না এই রকম শোকগ্রস্থের বাড়ীতে।পারলৌকিক কাজের যোগাড়যন্ত্র হচ্ছে, অনিরুদ্ধ নিজের ঘরে একলাই বসেছিল। নন্দিতা ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করেছিল, “ বাবার পকেট থেকে কলমটা তুমি নিয়ে এসেছিলে? বিরক্ত হয়েছিল অনিরুদ্ধ, “কি বলছ কি সেটা সম্ভব ছিল কখনো অন্ততঃ সেই পরিস্থিততে”।
“তাহলে এই কলমটা কার”। মুখে কোন কথা সরেনি অনিরুদ্ধর। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল গোল্ডক্যাপ পার্কার কলমটার দিকে তারপর প্রায় স্বগতোক্তির মত বলেছিল-“বাবা কলমটা নিয়ে যাননি!”
“নিয়ে গেলে বাবার কলমটা ওনার টেবিলের ওপর এল কোত্থেকে”।ততক্ষণে একটা অপরাধ বোধ অনিরুদ্ধকে গ্রাস করেছে। তবে কি সে ভুল করল। বেরুবার সময় বাবার বুকপকেটে কলমটা দেখেছিল বলেই মনে হয়।
“ কিন্তু কি করে সম্ভব, আজ পর্যন্ত কলম ছাড়া তো বাবাকে কখনো অফিসের কাজে যান না , দিল্লী তো যাচ্ছিলেন সেই অফিসের কাজেই। তাহলে?”
“ সেটাই তো জিজ্ঞাসা করছি, তুমি তো বলছ কলমটা তুমি ফেরত আনোনি”।
“সেটা কি সম্ভব ছিল নন্দিতা। মৃতদেহ সনাক্ত করার পর কমপ্লেন লজ করা, পোস্ট মর্টেমের ব্যবস্থা করা, পোস্ট মর্টেমের পর বডি নিয়ে তার ক্রিমিয়েশন, দ্বিতীয় কোন লোক নেই, তুমি ভাবতে পারবে না নন্দিতা সেই কটা দিন ঘুম নেই, খাওয়া নেই। জল খাওয়ার পর বমি হয়ে যাচ্ছিল। সেই কলমের জন্যে আমি কার কাছে বলব, কেই বা শুনবে, আর যেখানে মানুষটাই চলে গেছে”।
“ সব বুঝতে পারছি, কিন্তু তুমি তো বাবার মুখ দেখে তো চিনতে পারোনি বুক পকেটে কলমটা দেখে মনে হয়েছিল এটাই বাবার মৃতদেহ, এমনকি তুমি কলমটাও ভাল করে দেখোনি সত্যিই সেটা গোল্ড ক্যাপ পার্কার কিনা”।
“না তা দেখিনি”।
“তবে?”
“কিন্তু এখন তো আর বলতে পারব না, যে ওটা বাবার মৃতদেহ নয় আমি ভুল করেছি, তাছাড়া যদি অন্য কোন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকেন এর মধ্যে কি খবর পেতাম না”।
“ট্রেন দুর্ঘটনায় মানুষের স্মৃতি ভ্রমও হয়, এরকম ঘটনা তো হতেও পারে”।
“প্লিজ নন্দিতা তোমার ওই সিনেমা দেখা অভিজ্ঞতা বাদ দাও”।
“ সে না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু যেটার ওপর নির্ভর করে তুমি সিদ্ধান্তে পৌঁছালে সেটাই তো মিথ্যে হয়ে গেল”।
“বেশ তাহলে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বলো”। ইতিমধ্যে নন্দিতার বাবা সুরঞ্জনবাবু ঘরে এসে ঢুকলেন “কি হল কি? আজকের দিনে তোমরা ঝগড়া ঝাটি শুরু করলে”
“না বাবা ঝগড়া করিনি”। নন্দিতা ঘর থেকে চলে যাচ্ছিল, “যেও না বাবাকে সব কথা বলে যাও, আর গোপন করে লাভ নেই”।
সব ঘটনা শোনার পর সুরঞ্জনবাবু যতই হাইকোর্টের পুরানো আইনজীবি হোন না কেন সিদ্ধান্তহীনতায় বেশ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে নিলেন । তারপর অনিরুদ্ধকে বললেন
“সকলকে এই কথাটা বলার দরকার নেই”।
“হ্যাঁ বাবা, আমি তোমাকেও বলতে চাইছিলামনা , ব্যাপারটা আমাদের দুজনের মধ্যেই রাখতে চেয়েছিলাম”। নন্দিতার কথার উত্তরে সুরঞ্জনবাবু জানালেন-“না আমাকে বলে ভালই করেছিস”। এবার অনিরুদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ একটা কথা বলতো তুমি ওখানকার পুলিশকে কি বলেছিলে বাবার কলমটা দেখে তুমি আইডেন্টিফাই করেছ?”
“না সেটা বলার কোন স্কোপ ছিল না এতই ভেঙ্গে পড়েছিলাম ডিজাসটার ম্যানেজমেন্টের লোকেরা ধরে পুলিশের কছে নিয়ে গিয়েছিল, চীৎকার চেঁচামেচিতে কারুর কথা শোনার মত পরিস্থিতি ছিল না”।
“স্বাভাবিক”।
“বডি আইডেন্টিফাই করার সাথে সাথে বডির গলায় একটা প্ল্যাকেট ঝুলিয়ে দিয়েছিল নামটা লিখে, একটা সাদা কাগজ আমার হাতে দিয়ে টিকিটের পিএনআর নাম্বর উল্লেখ করে কমপ্লেন লিখে দিতে বলেছিল”।
“ শোন তোমরা দুজনেই আছো , যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে এসব কথা উল্লেখ করা চলবে না। উল্লেখ করলে মিসিং বলতে হবে, সাত বছর মুখ বুজে বসে থাকতে হবে ,তার আগে তো কোন টাকা কড়ি পাবে না, কোন রকম এ্যাক্সিডেন্ট্যাল বেনিফিট পাবেই না , কারণ ট্রেন দুর্ঘটনা যে তোমার বাবা ,মারা গেছেন এটা প্রমান করতে পারবে না।কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে বাবার স্মৃতি হিসাবে কলমটা তুমি নিয়ে এসেছিলে। যাও শ্রাদ্ধে বসে যাও”। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল অনিরুদ্ধ”।

ছাদ থেকে নামার সময় কলিং বেলের আওয়াজ শুনতে পেল অনিরুদ্ধ। ওদের বাড়ীতে পুরানো দিনের কলিং বেল, মনে হল একটানা অনেকক্ষণ ধরে বাজছে, কলিংবেলসুইচ কয়েক সেকেন্ড টিপে ধরে রাখা বাবার অনেকগুলো অভ্যাসের মধ্যে একটা ছিল।

Leave a Reply