এখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত আকাশ দেখা যায় না, গাছ গাছালির পিছনে সদ্য তৈরী হওয়া কোল্ড স্টরেজের ছাদের অংশ অনেখখানিই ঢেকে দিয়েছে।উঠানের শিউলি গাছটাও কেমন যেন নিস্তেজ, এখন শীতকাল সতেজ হবার কথা ওর নয়। তবু রতীন্দ্র চেয়ে থাকেন কিছু দেখার জন্যে নয় হয়ত, হঠাৎ করেই সম্বিৎ ফেরে, তাই তো এতক্ষণ মনটা পুরোপুরি চিন্তামুক্ত ছিল, দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিনের কৌটো থেকে একমুঠো গম ছড়িয়ে দেন উঠানের সিমেন্ট করা অংশে, রোজ সকালে পায়রাগুলো আসে, নিজস্ব ভাষায় নানান অঙ্গ ভঙ্গিতে রতীন্দ্রর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। শুধুমাত্র গমের দানাগুলির জন্যে। গোলা পায়রা তবু ভাল লাগে রতীন্দ্রর। মানুষের সংস্পর্শে এসে সহানুভূতি জাগানো কলা কৌশল কেমন করে শিখে নিয়েছে এরা। তাই দিনের শুরুতে এটা একটা কর্তব্য বলেই মনে হয় ওঁর । এরপর ইলেকট্রিক কেটলীতে জল দিয়ে সুইচ অন করে দেওয়া। জল ফুটলে গ্লাসে ঢেলে টি-ডিপ’র ছোট্ট প্যাকেট ডুবিয়ে দেওয়া।ব্যস, কয়েকবার নাড়ানাড়ি করলেই লিকার তৈরী। পঁচাত্তর বছর বয়েসে সুগারের আধিক্যে চায়ে চিনি সংযোজনের প্রয়োজন হয় না আর।
বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার পর রমা’ই চা করতে করতে এই কথাটা বলেছিল, “ কাকু এবার একটা ইলেকট্রিক কেটলী কিনে নিন, আমি তো আর আসতে পারব না”।
রহস্য করে রতীন্দ্র বলেছিলেন, “ তখন না হয় অনেক কিছুর সাথে চা খাওয়াটাই ছেড়ে দেব”।
“তা কেন। একটা ডিপ’এ র প্যাকেট কিনে নেবেন ছাঁকছাঁকির ঝামেলা থাকবে না”।
মেয়েটার বয়স কম হলে হবে কি সাংসারিক বুদ্ধি প্রখর। আজ ওর কথাতেই জীবনের বরাদ্দ বয়সের শেষের দিকটা এখানেই কাটাচ্ছেন রতীন্দ্র। বিনু মারা যাবার বছর তিনেকের মাথায় কথাচ্ছলে প্রায়ই বলত রমা, “ এখানে থেকে কি আর করবেন কাকাবাবু, চারদিকে বিনুর স্মৃতি, সারাদিন মন মরা হয়ে থাকেন, বিজুদার এখন নিজস্ব ফ্ল্যাটে, সে তো আর এখানে আসবে না কোন দিন, তার চেয়ে এটা বিক্রী করে দিলে গ্রামের দিকে আপনার থাকার মত জায়গা পেয়েও হাতে কিছু টাকা পয়সা থেকে যাবে”।
সেই রমার কথা মত আজ প্রায় পনেরো বছর হয়ে গেল এখানকার জীবন যাপন। তবে যে গ্রাম্য পরিবেশে তিনি এসেছিলেন, শহুরে অনুপ্রবেশে তা আর নেই, তখন ভোরে পাখি ডাকত, নির্জনতা যেন সঙ্গী, বড় উপভোগ করতেন সেই সময়টা। দিনে দিনে তো সবই পালটায়। এমনিতেই বৃদ্ধ মানুষের পরিচিতের গন্ডী কেন্দ্রীভূত হয়ে আসে। কয়েকজন ছাড়া আর কারুর সঙ্গে বাক্যালাপ তেমন একটা হয় না। তবে ভরসা একটাই এদের কাছে কবে কি বলেছিলেন সেই কথার সার্থক রূপায়ন হল কিনা তার দায়ভাগ নিজেকে নিতে হয় না। যেমনটা হয়েছিল বিনু মারা যাবার দুদিন পরেই। অমলেন্দুবাবু, বিমলবাবু, সুধীরবাবু, মুকুন্দ, পাড়ার আরো অনেকে এসেছিলেন সান্ত্বনা দিতে, অনেকদিনের পরিচিত এনারা, তাই তাদের পক্ষে খুব স্বাভাবিক।তবুও তাঁদের সান্ত্বনা দিতে আসাটা কেমন যেন নিয়ম মাফিক বলে মনে হয়েছিল। তাই সেদিন রতীন্দ্র তাঁদের বোঝাতে চেয়েছিলেন তিনি শোকগ্রস্থ নন,এসবের কোন প্রয়োজন নেই তাঁর কাছে। পরিবর্তে বড় মুখ করে বলেছিলেন “ আমি শহীদের বাবা, আমার ছেলে শহীদ হয়েছে, এতটুকু দুঃখ আমার নেই ,দেখবেন আপনারা বিনয়েন্দ্র চক্রর্বতীর মর্মর মূর্তি স্থাপন হবে। ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে বিনুর নাম জ্বলজ্বল করবে”। যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা কোন কথা বলেননি। হয়ত মনে হয়েছিল তাঁদের পুত্রশোকে তিনি উন্মাদ হয়ে গেছেন।
আসলে যে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, বিজন বিধান রমানাথ অজয় গভীর রাতে বিনুর মৃত্যুসংবাদ নিয়ে এসেছিল।তারাই বলেছিল, “ চিন্তা করবেন না মেশোমশাই আপনার ছেলে শহীদ হয়েছে, শহীদের রক্ত ব্যর্থ হবে না, একদিন আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ব। আমরা কথা দিয়ে যাচ্ছি বিনয়ের মর্মর মূর্তি আমরা এই মাঠে স্থাপন করব। কি জানি সেদিন রতীন্দ্রবাবু বিশ্বাস করেছিলেন কথাগুলো।বিনুর সঙ্গে যে আদর্শগত মতভেদ ছিল, তা এক নিমিষে বিলীন হয়ে গিয়েছিল বিনুর মৃত্যুর সাথে সাথে। যাবার সময় বিজন বলে গিয়েছিল “ মেশোমশাই আপনি মন শক্ত করুন, এটা একটা ফেক এনকাউন্টার, পুলিশ নিজেই বোম চার্জ করে বিনয়কে গুলি করে মেরেছে, আমরা মামলা করব, দোষী পুলিশের নিশ্চয়ই সাজা হবে আপনার জীবদ্দশাতেই দেখবেন শোষণমুক্ত সমাজ। কল্পনায় ভেসে উঠেছিল সেই সমাজে ছবি। যদিও সে সম্বন্ধে কোন ধারণা ছিল না তাঁর, তবুও ভাবতে ভাল লাগছিল হয়ত তিনি দেখে যাবেন কম বয়সী ছেলেদের গেঞ্জিতে বিনুর মুখের ছবি, দেয়ালে দেয়ালে আঁকা হবে বিনুর সাইড প্রোফাইল মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে তোলা। পরবর্তী কালে কিছুই হয়নি ওসব।
রাস্তার ধারে একটা শহীদ বেদী তৈরী হয়েছিল বিনয়ের নামে, কাঁচা অবস্থাতেই পুলিশ লাথি মেরে ভেঙ্গে দিয়ে যায়। সেটা তৈরি করার আর কেউ উদ্যোগ নেয়নি। বিজন বিধান এদেরও দেখা পেতেন না সবাই নাকি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে।পরে নিজের চোখেই রতীন্দ্র দেখেছিলেন, একে একে সকলেই একদিন পাড়ায় ফিরে এসেছিল,আসেনি শুধু বিনু, আসার কথাও তার নয়। বিজন বিধান ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ত, দুজনেই বিদেশ চলে গিয়েছিল।এদের কথাতেই বিশ্বাস করে প্রতিবেশীদের সান্ত্বনা বাক্যের অমর্যাদা করেছিলেন সেদিন। তাঁরা হয়ত আড়ালে হাসাহাসি করে, বিনুকে বিপ্লবী ভাবতে পারে না। পরে আর তাঁদের মুখের দিকে তাকাতে পারতেন না, রাস্তায় দেখা হলেও কথা বলতেন না। রমার কথাই ঠিক, এইসব প্রতিবেশীদের নিয়ে কিকরে বাস করবেন এখানে, যারা মনে মনে হয়ত ভাবে তিনি একজন উগ্রপন্থীর বাবা, পুলিশকে বোমা মারতে গিয়ে তাঁর ছেলে মারা গেছে। ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়নি, সব ছেড়ে চলে এলেও স্মৃতি তো আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে রয়েই গেল। পাড়ার রাস্তা, বড় পুকুর ধার , বিনুর পড়ার ঘর, বিনুর মা শিপ্রাকে নিয়ে ঘর বাঁধার সেই সব দিনগুলো। শিপ্রার আগে চলে যাওয়া একদিকে মঙ্গলই হয়েছিল , পুত্রশোক সইতে হয়নি, যা তাঁর একলার হয়ে গেছে। সেই সব ছবি কবেই মিলিয়ে গেছে, থেকে গেছে একটা বিশ্বাস, না বিনু কোন ভুল করেনি।
কিন্তু কি আশ্চর্য অথচ বিনুদের এই আন্দোলন সংক্রান্ত কার্যকলাপ এক দিনও মেনে নিতে পারেননি তিনি , সস্তার নিউজপ্রিন্টে ছাপা ট্যাবলয়েড খবরের কাগজগুলো নিয়ে এসে জমা করত বিনু নিজের পড়ার ঘরে।এমনি তার ভাষা , পড়লে মনে হত ছ’টা চৌদ্দ্’র গাড়ীতে বিপ্লব এসে উপস্থিত হবে, দরজায় কড়া নেড়ে। সেগুলো উল্টে পালটে দেখে তাই মনে হয়েছিল রতীন্দ্র, কিভাবে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে উঠতি যুবকদের। বার বার সাবধান করেছিলেন ছেলে, “ওরে তোরা আগুন নিয়ে খেলছিস, ভারতবর্ষ নানা ভাষা নানা মতের বিশাল দেশ, তোদের কথা সব লোককে বোঝাতে পারবি না, রাষ্ট্র শক্তি এত সহজে তোদের ছেড়ে দেবে না, মনে রাখিস আমার কথা গুলো”। ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেছিল সে, “ভারতবর্ষ কি চীনের থেকেও বড় দেশ নাকি, সেখানে যদি বিপ্লব সফল হতে পারে এখানে হবে না কেন”। তারপর ঝাড়া পনেরো কুড়ি মিনিট ধরে বাবাকে বোঝাতে চেয়েছিল এমন সব কথা যা তিনি জীবনে শোনেনি,চারু মজুমদারের ঐতিহাসিক আট দলিল, রেডবুক যার নাম শুনলেও তার ভেতরে কি আছে জানতেন না, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার কথা দেয়ালে দেয়ালে লেখা হত, তাকে বাস্তবায়িত করার পরিকল্পনার কথা কখনো ভেবেও দেখেননি, অথচ… অবাক হয়ে গিয়েছিলেন রতীন্দ্র এত কথা বিনু কবেই বা জানল , তবু নিজের মত করে বোঝাতে চেয়েছিলেন সেদিন “ শোন বিনু তোর বয়স কম, চীনের বিপ্লব নিয়ে আমার খুব বেশী জানা নেই, তবে এটুকু জানি এখানকার সাধারণ মানুষ নিজেকে শোষিত মনে করে না,চীনে শুধু শোষণ নয়, অত্যাচারিত, নিপীড়িত হয়েছিল অধিকাংশ মানুষ। এখানকার সাধারণ মানুষ আটপৌরে জীবন যাপন করে, যেমনি হোক একটা চাকরী করেও মেয়ের বিয়ে দেয়, ছোটখাট একটা বাড়ী তৈরি করে, যেমনটা তোর বাবা করেছে। তাবলে কি শোষণ নেই, নিশ্চয়ই আছে তোর কথাগুলো মিথ্যে নয়। কিন্তু তাদের সংঘবদ্ধ করতে পারবি না, আস্তে আস্তে তোরাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবি, লোকে তোদের দেখলে ভয় পাবে, সমাজবিরোধী মনে করবে। আমার কথা শোন বিনু, এসব ছেড়ে দে, মন দিয়ে লেখাপড়া কর”। উলটে দোষ দিয়েছিল তার বাবাকে। তাঁদের মতন মানুষগুলো জন্যেই নাকি ভারতবর্ষে সর্বাত্মক বিপ্লব সম্ভব হচ্ছে না,সাধারণ মানুষকে বোঝানোর ক্ষেত্রে এইসব শ্রেণীশত্রুরাই নাকি সবচেয়ে বড় অন্তরায়। এখন ওদের প্রথম কাজ এই সমস্ত শ্রেণী শত্রুদের চিহ্নিত করে তাদের নিশ্চিহ্ন করা। অজান্তেই নিজের বুকটা কেঁপে ঊঠেছিল রতীন্দ্রবাবুর, তিনিও কি তাহলে ওই দলে? কিন্তু এর পরিণাম যে কি ভয়ংকর তা সহজেই অনুমান করতে পারেন। চিন্তা করতে ভয় হয়।
বিনু যে রাতে মারা গেল, পাড়ার এক প্রতিবেশীর মেয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রিত ছিলেন তিনি, আকাশ কাঁপানো বোমার আওয়াজ শুনে খাওয়া ছেড়ে উঠে এসেছিলেন, অজান্তেই বুকটা কেঁপে উঠেছিল, বাড়ি এসে দেখেন বড় ছেলে বিজু শুয়ে পড়েছিল নিজের মত। ভাইএর সাথে বাক্যালাপ তার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অনেকদিন।বিনু বাড়ি ফেরেনি, দুশ্চিন্তায় উদ্বেগে সেই দীর্ঘরাতে্র প্রতিটি পল অনুপল আজও রতীন্দ্রর স্মরণে দগদগে ক্ষতের মতন রক্তাক্ত ।
ভোরবেলা রমা এসেছিল।বিনুর সঙ্গে একই কোচিং’এ পড়ত, পাড়ার মেয়ে, বিনুর মা বেঁচে থাকতে খুবই আসা যাওয়া ছিল একসময়।তার প্রতি বিনুর কোন দুর্বলতা ছিল বলে মনে হয়নি কখনো বরং উল্টোটাই মনে হত, সেই ভোরে অনেকক্ষণ ধরে কেঁদে ছিলেন দুজনে। কেউ কাউকে সান্ত্বনা দেননি। যাবার সময় বলে গিয়েছিল, “কাকাবাবু বিনুর পড়ার ঘরে হয়ত অনেক কাগজপত্র থাকবে, সেগুলো পুড়িয়ে ফেলুন, আজ কালের মধ্যেই বাড়ী সার্চ হবে। পুলিশ ওগুলো হাতে পেলে আপনাকেও বিপদে ফেলতে পারে”। না পুড়িয়ে ফেলতে পারেননি, লুকিয়ে রেখে দিয়েছিলেন বিনুর শেষ বিশ্বাস। আজও মাঝে মাঝে নাড়াচাড়া করলে বিনুর স্পর্শ পান বলে মনে করেন।সেই রাত থেকেই নিজের বিশ্বাসও পালটে যাচ্ছিল, বিনু যেটা উপলব্দি করেছিল, নিজের এতখানি বয়সেও সেই বোধ তাঁর আসেনি।সময়ের থেকে যারা এগিয়ে থাকে তাদের তো মূল্য দিতেই হয়।
দুদিন আগে রমা ফোন করেছিল, ওর স্বামী অনিমেষের এই ব্লকেই বিডিও হিসাব পোস্টিং হয়েছে, দুজনেই আসবে, একদিন থেকে এখান থেকেই জয়েন করতে যাবে, বিডিও রা তো স্টেশন লিভ করার অনুমতি পাননা, ব্লকেই থাকতে হয়। কোয়াটার পাওয়া বা কোন ভাড়া বাড়ীতেই থাকার ব্যবস্থা করা, সবই হয়ে যায় ধীরে ধীরে একটু সময় লাগে, যেহেতু রতীন্দ্র এখানে আছেন তাই হয়ত দু’চার দিন থেকেই যাবে ওরা।অসুবিধে তো নেই শোবার ঘরের খাটটা বেশ বড়, পুরানো বাড়ী থেকেই নিয়ে এসেছিলেন ঐ ঘরটা ওদের ছেড়ে দিয়ে বসার ঘরে চৌকিতে অনায়াসে রাত কাটিয়ে দেবেন।অনেকদিন চেনা লোকের মুখ তো দেখা হয়নি । কতদিন পর ওরা আসবে ভাল লাগছে মনে মনে। রমার ওপর একটা স্নেহের টান আছে, হয়ত সে বিনুকে ভালবাসত। কাজের মেয়েটাকে বলেছেন, শোবার ঘরে খাটের বিছানায় তোষক জাজিম রোদে দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখতে। মেয়েটি ভাল, রান্না বান্না মন্দ করে না। একটা মানুষের কাজই বা কি। লুঙ্গি, আন্ডারপ্যান্ট , রুমাল নিজেই কেচে নেন রতীন্দ্র।
চায়ের জলটা ফুটে গিয়েছিল, লিকার তৈরী করে গ্লাসে ঢেলে মুখে তুললে প্রতিদিনের মত সেই দুঃসহ স্মৃতি জেগে ওঠে। একবার ভেবেছিলেন চা খাওয়া ছেড়ে দেবেন, তাহলে হয়ত ভুলে যেতে পারবেন সেদিনের কথা। তাই কি হয় কবে সেই গল্প শুনেছিলেন, বিখ্যাত ট্রয় যুদ্ধে হেক্টরের পিতা প্রিয়ামের কথা। তিনিও রাতের অন্ধকারে আপন পুত্র হন্তাকারী এ্যাকিলিসের কাছে গিয়েছিলেন বীর পুত্রের মৃতদেহ হস্তান্তকরণের দাবি নিয়ে। তিনিও বিনুর মামা আর রমাকে সাথে করে নিয়ে থানায় গিয়েছিলেন, বিনুর মৃতদেহের যথাযথ সৎকারের দাবি নিয়ে। সনাক্ত করতে হয়েছিল মৃত পুত্রের দেহ, গোটা মুখটা শুকনো রক্তে কালো হয়ে গিয়েছিল,পরনের জামা প্যান্ট রক্তে কাদায় এতই বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল বোঝা যাচ্ছিল না কিছুই, চেনা যাচ্ছিল না বিনু বলে। মনের মধ্যে একটা আশার ঢেউ উথলে উঠেছিল, তাহলে কি ও বিনু নয়, অন্য কেউ। পরক্ষেণেই কানের পাশে জরুলটা দেখার পর মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। সময়মত আশপাশের লোকজন ধরে না ফেললে পড়েই যেতেন । ধরাধরি করে থানায় ডিউটি অফিসারের টেবিলের সামনের বেঞ্চে বসিয়ে দিয়েছিল সকলে। সেই সময় একটা লোক সকলকে চা দিচ্ছিল মাটির ভাঁড়ে। ডিউটি অফিসার একটি ইয়ং ছেলে, এক ভাঁড় চা রতীন্দ্রবাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। “নিন চা’টা খেয়ে নিন স্টেডি লাগবে ”। চা’টা মুখে তুলতে গিয়ে আবার তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল হেক্টরের পিতা প্রিয়ামের কথা। এ্যাকিলিস সেদিন তার হাতে সুরার পাত্র ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল,বীর হেক্টরের মৃত্যুকে মহিমান্বিত করতে আসুন দুজনে মদ্যপান করি। এই পুলিশটাই কি বিনুকে গুলি করে মেরেছে।তার দেওয়া গরম চায়ে চুমুক দিচ্ছেন তিনি!, অজান্তেই একটা হেঁচকি উঠেছিল। কোনক্রমে কাঁপা কাঁপা হাতে সনাক্তকারী হিসাবে সই করে উঠে চলে এসেছিলেন রতীন্দ্র। এক চুমুক দেবার পর বাদ বাকী চা’টা মাটির ভাঁড়েই পড়েছিল। আজকের চা’টাও বড্ড তেতো হয়ে গেছে, সেটাও একচুমুক খাওয়ার পর বাকীটা পড়েই রইল গ্লাসে।সেই সময় বাইরের দরজায় কে কড়া নাড়ল, উর্মিলা এল নিশ্চয়, এই সময়েই তো আসে মেয়েটা।
(২)
দরজা খুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন রতীন্দ্রবাবু , সত্যিই তো রমা, কোন মিল নেই আগেকার সঙ্গে। মুখশ্রী তো পালটায় না, পুরানো সৌন্দর্যের সাথে স্বাস্থ্যের পরিবর্তন গায়ের ময়লা রঙটাকে অনেকটাই ফিকে করে দিয়েছে । সঙ্গে আর একটি কমবয়সী মেয়ে। আশ্চর্য হওয়ায় খানিকটা সময় নিয়ে ফেললেন রতীন্দ্র।
“রমা! কত বছর পর তোকে দেখছি, তোর তো আগামী কাল আসার কথা ছিল, আয় আয় ভেতরে আয়, অনিমেষ কোথায়?”
“হ্যাঁ, সেই রকমই কথা ছিল, ডিএম সাহেব বললেন আজকেই জয়েন করতে হবে”। ওদের পিছন পিছন উর্মিলা এসে ঢুকল।
“দেখ দেখি কত দেরী করলি, দিদিরা চলে এসেছে, তাড়াতাড়ি একটু চা কর”।
“না না থাক, একটু পরে আমিই চা করব, এ আমার ছোট ননদ,জয়শ্রী শান্তিনিকেতনে হস্টেলে থাকে, গ্রাজুয়েশন করছে”। রমার প্রণাম করার সাথে সাথে সেও প্রণাম করল। শেষ কে কবে প্রণাম করেছিল মনে পড়ে না রতীন্দ্রর । সাত সকালে একটা ভাল লাগা যেন ছুঁয়ে গেল। দুজনের মাথায় হাত ছোঁয়ালেন।
“হ্যাঁরে এলি কিসে, অনেক ভোরে বেরিয়েছিস নিশ্চয়”।
“এসেছি ওর অফিসের গাড়ীতে, বাস রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে অনিমেষ চলে গেল, তারপরেই হল মুস্কিল, আপনার তো আর ফোন নেই ।
“কি আর হবে ওসব বখেড়া বাড়িয়ে, তারপর এলি কিকরে?”
“যেমন ডিরেকশন দিয়েছিলেন, রিকসায় উঠে একে তাকে জিজ্ঞাসা করতে করতে”।
“এখানে তো আমাকে খুব একটা বেশী লোক চেনে না, মেলামেশাও করিনা কারুর সঙ্গে। যাই হোক ঠিক ঠাক এসে পড়েছিস, হ্যাঁরে তোর ননদ গেল কোথায়?”
“ঘুরে ঘুরে দেখছে হয়ত আশপাশ, জায়গাটা কিন্তু বেশ”।
“ভালই তো দুজনে একসঙ্গে সংসার পাতবি, সে আসবে কখন রান্নাবান্না ব্যবস্থা করতে হবে তো, দোকান বাজার কিছুই করা নেই”।
“চিন্তা করছেন কেন সব ঠিক হয়ে যাবে”।
“আরে সে তো জানি, আমি বরং বাজারের দিকে যাই, উর্মিলাকে বলি লুচি আর আলু চচ্চড়ি করতে, অনিমেষ কখন আসবে বলতো”।
“ ও আসবে না কাকাবাবু”।
“কেনরে?কী হয়েছে?”
“অনিমেষ যখন এই ব্লকে বদলী হল তখন আপনার কথা বলেছিলাম, গতকাল কথা প্রসঙ্গে বিনুর কথার উঠল , তখনই একটু গম্ভীর হয়ে গেল, শেষে বলল তোমরা যাচ্ছ যাও দেখা করে এসো আমার যাওয়া চলবে না, সরকারী চাকরি, গুরুত্বপূর্ণ পদ জানাজানি হলে মুস্কিল হতে পারে”।
“ কি বলছিস কি রমা সে তো কবেকার কথা, এখানে আমার সম্বন্ধে কেউ কিছুই জানে না। সেসব মামলা মোকদ্দমা কবেই তামাদি হয়ে গেছে, আজও কি আমি বিনুর বাবা হিসাবে বেঁচে থাকব? আমার নিজস্ব কোন আইডেনটিটি নেই”। ধপ করে চেয়ারের ওপর বসে পড়লেন রতীন্দ্র। রমাও মুখ নিচু করে বসেছিল, এই কথার কোন উত্তর হয়না। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে রমা ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল,-
“জানি কাকাবাবু, আপনি যে কথাগুলো বলছেন সব সত্যি, আমি কোনদিনই তা মনে করিনা, তাহলে এত বছর পর আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসতাম না।, অনিমেষের কথাগুলো আমার হলে অন্য কোন ওজর দেখিয়ে গোপন করে যেতাম। আজ এত বছর …………”।
“ইসস্ কে কি পড়চ্ছে, ঘরটা ধোঁয়ায় ভরে গেল”।
“ কাগজ মনে হয়”। তাড়াতাড়ি করে রতীন্দ্রবাবু বাইরে বেরিয়ে এলেন, পিছনে রমা। উঠানে উর্মিলা তোষক রোদে দিয়েছে, জাজিমটা ঘাড়ে করে এনে একটা টেবিলে রাখল, জয়শ্রী একটা লম্বা শুকনো গাছের ডাল নিয়ে উড়ে যাওয়া খবরের কাগজগুলো আগুনে ফেলছে”।
“কি পোড়াচ্ছিস ওগুলো?”
বিছানার নীচে অনেক পুরানো কাগজ ছিল সেগুলো।– উর্মিলার নির্বিকার উত্তর।
“ যা! কী সর্বনাশ করলি বলত, কবেকার জিনিষ, একবার জিজ্ঞেস করবি না”। ।অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে আছে জয়শ্রীও।
“কি ছিল কাকাবাবু ওগুলো”।পোড়া ছাই থেকে মিলিয়ে যাওয়া ধোঁয়ার দিকেই অপলকভাবে তাকিয়ে ছিলেন রতীন্দ্রবাবু।
“ সেই সময়কার আন্দোলনের ট্যাবলয়েড কাগজগুলো, বিনুর পড়ার ঘরে পেয়েছিলাম। প্রাণ ধরে ফেলতে পারিনি যত্ন করে বিছানার নীচে জমিয়ে রেখে দিয়েছিলাম বিনুর স্বপ্ন, পাছে কারুর চোখে পড়ে ”।