মায়ের হারমোনিয়াম

ভাড়া বাড়ীর দুটো ঘরে আমাদের জীবন যাপন/বাবা তখন সবে ভাল চাকরীর ভাল মাইনে পেতে শুরু করেছেন/ বৈভব ধরাছোঁয়ার মধ্যে না এলেও/ সুস্পষ্ট তার ইঙ্গিত-/তখনো ভাড়াবাড়ীর দুটো ঘরে নেই বিলাসবহুল জিনিষের বাহুল্য/ শুধুমাত্র মায়ের সিঙ্গল রিডের হারমোনিয়াম/
বাবা যখন বরের বন্ধু সেজে / মাকে দেখতে গিয়েছিল পিসেমশাই’এর সঙ্গে / ওই হারমোনিয়াম বাজিয়েই মা শুনিয়ে ছিলেন “ শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে”।
আমাদের বাড়ীতে গানের চল ছিল না/ সে হিসাবে আমার মামার বাড়ী অনেক আধুনিকতায় ভরা,/তৎকালীন যুগে মা মাস্টারমশাইয়ের কাছে গান শিখতেন,/ মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো গানের খাতা-/ পাতা ভর্তি গানের স্বরলিপি আর গানের কলি/ গায়িকা হিসাবে স্বীকৃতি না পেলেও/ মায়ের গলা ছিল বেশ রেওয়াজি/ প্রশংসিত হত সকলের কাছে/কিন্তু সেই যোগ্যতার যথাযথ মুল্যায়ন হল না আমাদের সংসারে।/
ফলে গানের খাতা টিনের সুটকেশে/ হারমোনিয়াম তক্তপোষের তলায়।/কোনও কোন দিন দুপুরবেলা/ পাড়ার কমবয়সী মেয়েদের নিয়ে মা গানের আসর বসাতেন/ আর বিরক্তি ভরা মুখে ঠাকুমা পাশের ঘরে/ আপনমনে গজগজ করতেন,/ দিবানিদ্রায় ব্যাঘাত হওয়ার দরুণ।/ তখন থেকেই সুরের সঙ্গে আমার পরিচয়/ গানের সঙ্গে সখ্য/তাই অন্যদের বেসুরো গান শুনে যখন মুখ টিপে হাসতাম/ চোখ বড় বড় করে মা নীরব বকুনি দিতেন/ তারপর- সবার শেষে মায়ের গলায় যখন শুনতাম -/ “কেন জলে ভিজিয়ে দিলেম না শুকনো ধুলো যত-/ মনে হত ফেলে আসা দিনগুলোকে/ মা কেমন করে আঁকড়ে ধরতে চাইছে/বিকালের সোনালির রোদ ভেন্টিলেটারের ভেতর দিয়ে/ তিরের মতন মায়ের বেলো করা হাতে এসে পড়ত/অনুভবে বুঝতে অসুবিধা হত না/ ওই রোদ্দুরের ধারা বেয়ে মায়ের গান ভেসে যাচ্ছে-/ দূর আকাশে মেঘবালিকার দেশে/
আমার বোনটা তখন খুব ছোট।/ থেকে থেকেই মা বলত হারমোনিয়ামটা নাকি ওর/ আমাকে হাত দিতে দিত না/ একটা ভাঙা রিড দেখিয়ে রাগত স্বরের বলত-/ ‘এই যে এটা তোর দাদা ভেঙ্গে দিল সারানো হল আর।/তাই আমার গলার সুর হারমোনিয়ামের আশ্রয় ছাড়াই/ মায়ের গাওয়া গানগুলোকে বয়ে নিয়ে চলত/ ভোরের বেলা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে/আমার মুক্তি হত আলোয় আলোয়/ নাই বা থাকল শোনার মত কেউ/ আমার উত্তরণ তখন বিচিত্ররূপে, কখনো ঝড়ের রাতে/ কালবৈশাখীর পূর্বাহ্নে, থমকে যাওয়া বাতাবরণে/ কখনো গোধুলি গগনের মেঘ / আকাশের তারাকেই আড়াল করত।/
মা আর পুরানো অভ্যাস ঝালায় না/ পিছনে ফেরার সেতুটা বুঝি ভেঙ্গে গেছে অজান্তে/মা তখন বোনের ভুল সুরে গাওয়া গানগুলির মধ্যে/ খুঁজে পেতে চাইছে নিজের অতীত।/
চিরদিনই কোনো অজ্ঞাত কারণে / সংসারে আমি বড় অপাংক্তেয়,/ অকারণ অবিচারের শিকার/ তখন গ্রুপ থিয়েটার করি/ বিজন ভট্টাচার্যের “মরা চাঁদ”,/ রিহার্সাল জোর কদমে/ সঙ্গে গানের মহলা/তুমিতো নও অরূপরতন শিবসনাতন/ আমি তোমায় চিনি গো, জানি গো/গানের টিচার বললেন যাদের বাড়ীতে হারমোনিয়াম আছে/ তারা যেন গলা মেলায়/পরদিন দুপুরে সেই চেষ্টায় করছি/ মা আর বোন হা হা করে তেড়ে এল/ নানান অভিযোগের মধ্যে যে নির্যাসটুকু পড়ে রইল,/ যা আমার নয়, হিংসার বশবর্তী হয়ে সেই হারমোনিয়ামের / অধিকার পেতে চাইছি/হারমোনিয়াম ছেড়ে উঠে পড়েছিলাম/ মরা চাঁদ’এর গানের স্কোয়াড থেকে / আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছি।/
যাকগে সেসব কথা/ বাদ দেওয়া যাক ও সব তুচ্ছতা/ সংসারের বঞ্চনা অবিচারের কথা তো বলতে বসিনি।/বয়স বাড়ার সাথে সাথে ভাটা পড়েছে অনেক কিছুর/ আমি তো ব্যতিক্রমী নই।/ অনভ্যাসে গলা হারাল পেলবতা/ সুর করতে লাগল প্রতারণা/সংসারের দাবিতে আমি তখন উপার্জনের মেসিন/গানের ধারা মরু পথে হারিয়ে গেছে জ্ঞাতসারেই।/
বিশ্বায়নের পৃথিবী ভোলায় তাড়াতাড়ি/ সময় নামক মলমে মিশিয়ে দিয়েছে অত্যাধুনিক এ্যান্টিবায়োটিক/ তবু স্মরণ করার মাইক্রোভের সচলতা/ ধরা পড়ে মনের অন্তর্দৃষ্টিতে/ তাই বোধহয় যে কথা বলার নয়/ সেই কথাই বললাম মা সাতকাহন করে।/
ক্ষমা করো মা তুমি চলে গেছ ধরাছোঁয়ার বাইরে/ শতেক চেষ্টায় তোমার পদচারণা আর সমৃদ্ধ হবে না/ সেদিন পূর্ণিমার আগের রাত/আষাঢ়ের আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ,/ চন্দ্রশোভা বলে দিচ্ছে বৃষ্টি আসন্ন/শ্মশানের মাথা ঢাকা চাতালে বসে আছি অনেকের সাথে।/ তোমার চিতা জ্বলছে/ দুইকান হাত দিয়ে চাপলে তো শোনা যায় / রাবণের চিতা জ্বলার হু হু শব্দ/ কিন্তু মা তুমি তো নিঃশব্দে জ্বলছ/ মরা চাঁদের আলোয়/শব্দবিহীন শ্মশানে কোনো এক শবযাত্রীর / পকেট ট্রানজিস্টারের এফ এম সেন্টারে বেজে চলেছে/ “ যে রাতে মোর দুয়ার গুলি ভাঙ্গল ঝড়ে/ বিশ্বাস করো মা আবার সেই উত্তরণ অনুভব করলাম/ বহু পুরানো এক আলোড়নের কম্পন,/জ্বলন্ত অগ্নিরথে তুমি ভেসে যাচ্ছ দূরে আরোও দূরে/ চোখের সামনে তোমার চিতার আগুন শুধু/ আর কিছুর অস্তিত্ব নেই এই পার্থিব জগতের/শুধুমাত্র যোগসুত্র ভেসে আসা গানের সুর/ সকালবেলায় চেয়ে দেখি দাঁড়িয়ে আছ তুমি এ কি/ ঘরভরা মোর শূণ্যতারই বুকের পরে/ আবার অনেকদিন পর ভাঙ্গাগলায় সুর খোঁজার চেষ্টা করলাম/ দুর্ণিবার কান্না আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল/

তিনতলা বাড়ীর একতলার এক কোণে/ অনেক পরিত্যক্ত জিনিষের সঙ্গে / মায়ের সেই সাধের হারমোনিয়াম/ সাদা রিডগুলো কঙ্কালের দাঁতের মত লাগছে/আমার ভাগনীর পাবার কথা ছিল ওটা/সিঙ্গল রিডের অচল হারমোনিয়াম সে নেয়নি/আজ আবার অনেকদিন পর হারমোনিয়ামে হাত দিলাম/ খোলা বেলোটা বন্ধ করতেই/ ছোট ছোট কয়েকটা আরশোলা ফাটা দিয়ে বেরিয়ে এল দ্রুত/ অজানা ভাষায় নিরুপদ্রব জীবনে বাধাদানকারীর উদ্দেশ্যে / বোধহয় একই কথা বলল/ যা আমার নয় সেই হারমোনিয়ামের অধিকার ফেরত পেতে চাইছি।/

Leave a Reply