গালে হাত রেখে চেয়ারে বসে আছে বিকাশ, বিছানাপাতা চৌকির ধারে দেয়ালের ঠেসান দিয়ে অনেকক্ষণই দাঁড়িয়ে রয়েছে সবিতা, বিছানার মাঝখানে দীপিকা, বিকাশের মা, শূণ্য দৃষ্টিতে অন্যদিকের দিকে তাকিয়ে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল কেউ কারুর সঙ্গে কথা বলেনি,শুধুমাত্র দেয়াল ঘড়ির কাঁটা সরার একটা খসখস আওয়াজ এই নীরবতাকে বিঘ্নিত করে বয়ে যাওয়া সময় নির্দেশ করছে । “রাত কত হল”? বিকাশের জিজ্ঞাসায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে দীপিকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ,অস্ফূটস্বরে বললেন “ পৌনে এগারো’টা”।
“এবার তো তাহলে যেতে হয় মা”- গাল থেকে হাত নামিয়ে মাথা ঘুরিয়ে বিকাশ মায়ের দিকে ফিরে নিজের ইচ্ছে’টা প্রকাশ করল । “একলা তোমাকে ছাড়তে পারব না, সঙ্গে আমিও যাব”। দীপিকা বিছানা থেকে নামার উদ্যোগ নিলেন। “ তা কি করে হয় আমি তো সাইকেলে যাব, তুমি তো কেরিয়ারে বসতে পারবে না, তাছাড়া এত রাতে অন্য কিছুই পাওয়া যাবে না, অনেকটা পথ”। “দুজনে হেঁটেই যাব যত’টা পথই হোক, এছাড়া তো আর কোন উপায় নেই”। বিছানা থেকে নেমে দীপিকা পরনের শাড়ি ঠিকঠাক করে নিতে নিতে বললেন-“ চলো বসে থেকে আর কি হবে”।
“কিন্তু মা ওরা যে থানা পুলিশ করতে বারণ করে গেল”। কপালে ভাঁজ ফেলে সবিতার দিকে তাকালেন দীপিকা “ ওরা কি আমাদের ইচ্ছায় অশোক’কে উঠিয়ে নিয়ে গেছে, ওরা তো বলেছিল কিছুক্ষণের মধ্যে অশোক ফিরে আসবে, দু’ঘণ্টা হতে যাচ্ছে এলো কি? এরপরেও কি ওদের ভয়ে হাত পা গুটিয়ে চুপ করে বসে থাকব, কিছু একটা তো করতে হবে? চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে বিকাশ, “এর আগে যাদের যাদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তারা কি কেউ ফিরে এসেছিল, তুমি জানো না, আমরা থানা পুলিশ করি বা না করি কিছু এসে যায় না ওদের , এই হুমকি সব জায়গাতেই দেওয়া হয় ?” সবিতাও বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, -“ না মানে এখন তো অনেক রাত হয়ে গেছে রাস্তায় যদি কেউ দাঁড়িয়ে থাকে, কাল সকালে …….”।
“দাঁড়িয়ে থাকলে যা হবার তা হবে, তাবলে কি আমরা ঘরে থেকে বেরুব না, এমনিতেই দেরী হয়ে গেছে বৌমা”।
“ওদের কোন দায় নেই আমাদের গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখার, যে কাজ করার জন্যে ওরা এসেছিল সেটা করে চলে গেছে, দেরী না করে আমরা বেরিয়ে পড়ি রিকসা পাবো বলে মনে হয়না”। বিকাশ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, সবিতার দিকে ফিরে বলল, “ আমরা না ফেরা পর্যন্ত দরজা বন্ধ রাখবে, যেই ডাকুক না কে খুলবে না”।
“মামাবাবুকে খবর দিলে হত না, উনিও যদি সঙ্গে যেতেন”। দীপিকার এক দূর সম্পর্কিত দাদা শহরের অন্যপ্রান্তে থাকেন। সবিতা তার কথাই বলতে চাইছে, কারণ শাসক’দলের রাজনীতি করেন তিনি, বেশ হোমরা চোমরা অনেকের সাথে চেনা জানা। থানা পুলিশও গুরুত্ব দিত ওঁর কথায়।
“ ভূপতিদা বয়স্ক মানুষ, অনেক রাত হয়ে গেছে কাল সকালে দেখা যাবে,চলো বিকাশ”। ঘটনার অব্যবহিত পরে যে আতংক তিনজনের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছিল, ওরা থানার উদ্দেশ্যে রওনা দেবার পর এখন তা পুরোপুরি সবিতার একলার হয়ে গেল। এতক্ষণ যে ঘরে ছিল তারই আশে পাশে তাকাতে ভরসা পাচ্ছে না, মনে হচ্ছে কেউ যেন আড়াল থেকে লক্ষ্য করছে তাকে। এসব ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে কান্নার মাধ্যমে ভয় আটকানো একটা ব্যর্থ চেষ্টা, এতে কিছুটা সময় পেরিয়ে যায়, সবিতা সম্ভবতঃ এটাই চাইছিল।
(২)
সারাদিনের কর্মব্যস্ততা পর রাতের থানা কিছুটা নির্ঝুম, দূর থেকে বিকাশ ও দীপিকার তাই মনে হল। ঘণ্টা আড়াই আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কোন আঁচ এখানে পড়েছে বলে মনে হল না। থানার একটা সুবিধা হল রাত যতই হোক না কেন কথা বলার মত কাউকে না কাউকে পাওয়া যায়। এত রাতে দু’জন মানুষ’কে দেখে থানার সেন্ট্রির কোন কৌতুহলের উদ্রেক হল না বরং বিরক্ত সে হল। সেই চিহ্ন তার চোখে মুখে স্পষ্ট, সেটা বুঝতে পেরেও বিকাশ জিজ্ঞাসা করে “ওসি সাহেব আছেন?” সেন্ট্রি উত্তর না দিয়ে চোখের ইসারায় ওসির চেম্বার দেখিয়ে দিল । বিকাশ ঘুরে গিয়ে কয়েক পা এগিয়ে ওসির চেম্বারের পর্দা সরালো , কিন্তু ভেতরে কেউ নেই, একটা ডিম লাইট জ্বলছে। বিকাশ সেন্ট্রিকে কিছু বলবে বলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সে সরে গিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মাঝে মাঝে রাইফেল’টা অকারণ মেঝেতে ঠুকছে। স্পষ্টতঃ বুঝিয়ে দিচ্ছে কথা বলার অনিচ্ছা। এবার যে ঘরটায় আলো জ্বলছিল, সেইদিকে দীপিকা অনেকটাই এগিয়ে গেছে, বিকাশ মাকেই অনুসরণ করল। ঘরেতে আলো জ্বলচ্ছে ঠিকই, একজন পুলিশ অফিসার চেয়ারের মধ্যে নিজেকে যতটা সম্ভব গুটিয়ে রাখা যায় সেইভাবেই চোখ বুজে, হয়ত বা ঘুমাচ্ছে কিংবা একটা আচ্ছন্নতার মধ্যে বাদবাকি রাতটা কাটিয়ে দেবার কথা ভাবছে । সামনের টেবিলে দু,একটা রেজিস্টার,অন্যান্য কাগজ’পত্র অবিন্যস্তভাবে ছড়ানো। ঘরের মধ্যে দুজন নিঃশব্দে এলেও তাদের উপস্থিতিতেই পুলিশ অফিসার চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। এই অফিসারেরও চোখে মুখে সেন্ট্রির মতই বিরক্তির ছাপ। এবার দীপিকা প্রশ্ন করলেন, “ ওসি সাহেব আছেন?”
“এত রাতে একান্ত দরকার না থাকলে উনি থানায় থাকেন না, তার বদলে কেউ না কেউ থাকেন, আজ যেমন আমি আছি, বলুন কি দরকার”। শেষের কথাগুলো বললেন হাই তুলতে তুলতে।
“ আজ রাত ন’টা নাগাদ চার জন অপরিচিত লোক আমার ছোট ছেলে অশোক’কে জোর করে মোটর বাইকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে, সে ফেরেনি”। দীপিকা দাঁড়িয়ে আছেন দেখে পুলিশ অফিসার আবার সোজা হয়ে বসতে বসতে ইসারায় ওদেরকে টেবিলের সামনের বেঞ্চে বসতে বললেন।“জোর করে মানে আপনার ছেলে কি যেতে চাইছিল না”? প্রশ্নটা শুনে বিকাশ অবাক হয়ে তাকালো, লোকটা কি সত্যিই নিরেট নাকি ভান করছে, কথাটা মনে হলেও ধৈর্য না হারিয়ে বলল, “এরকম ঘটনা ঘটলে কেউ যেতে চায় নাকি , নিরুপায় হয়েই যায় ”। “ না মানে আমি বলতে চাইছি তারা কি জোরজবরদস্তি করেছিল, কোন আর্মস সো করেছিল? এবার দীপিকা কথা বললেন “ না আর্মস সো করেনি, জবরদস্তি বলতে যদি টানা হেঁচড়া বলেন সেটাও করেনি”।
“তাহলে ! তারা এলো আর আপনার ছেলে সুড়সুড় করে তাদের সঙ্গে চলে গেল, ওদের চিনত বুঝি”।
“ না অফিসার, কথাবার্তায় আচার আচরণে এমন একটা পরিবেশ তৈরী করা যায় তাতে আর্মস সো বা জবরদস্তি করার দরকার হয়না। কলিং বেলের আওয়াজ শোনার পর দরজা খোলা মাত্র, দরজার ফ্রেম ধরে একজন তার শরীর’টা অর্ধেক ঢুকিয়ে আমার মুখে কাছে মুখ এনে বলল, অশোক’কে ডাকুন , জরুরী দরকার আছে। মুখে তার মদের গন্ধ, তার পিছনে তিনজন মোটর সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি পিছিয়ে এসেছি”।
নির্বিকার পুলিশ অফিসার চেয়ারের ব্যাক রেস্টে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে বলল “ আপনার বাড়িতে কেউ মদ খায় নাকি?”কথাটা শুনে বিকাশ কিছু বলতে যাচ্ছিল,দীপিকা হাত তুলে ইসারায় বারণ করলেন। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে অফিসার আবার বললেন “মদের গন্ধ বুঝলেন কি করে” সেকথারও এরা দুজন উত্তর না দেওয়াতে প্রসঙ্গ পাল্টালেন “ আর কিকরে বা জানলেন এরা আপনার ছেলে বন্ধুস্থানীয় কেউ নয়”। এবার বিকাশ কার্যতঃই বিরক্ত হল, গলায় তার অপছন্দের ঝাঁঝ স্পষ্ট, “ কি বলতে চাইছেন আপনি? মদের গন্ধ বুঝতে গেলে বাড়িতে কারোর মদ খাওয়ার দরকার হয় নাকি ? ছেলেটার পিছু পিছু আর এক জন দরজার কাছে চলে এসেছে।তখনই মা আমাদের ডাকাডাকি করেন, আমরা সকলেই উপস্থিত হই, আমার ভাই অশোকও ছিল,। ওদের একজন যে মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিল, আর অন্য একজন আমার ভাইয়ের ঘাড়ে হাত রেখে প্রায় ঠেলতে ঠেলতে ওকে বাইরে নিয়ে গিয়ে কলার ধরে মোটর সাইকেলে তুলে দেয়”।
“আপনারা কেউ বাধা দেননি?
“ সাধারণ মানুষের পক্ষে মৌখিকভাবে চীৎকার চেঁচামেচি করে যতটা বাধা দেওয়া সম্ভব সেইটুকুই , তাতে কোন ফল হয়নি, ”।
“আপনাদের চেঁচামেচি শুনে আশপাশের লোকজন কেউ এসেছিল?”
“না , খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঘটনাটি ঘটে যায়, চলে যাবার সময় হুমকি দিয়ে যায় আমরা যেন থানা পুলিশ না করি,তাতে পরিণতি আরো খারাপ হবে”।
“ তারপরেও তো আপনার থানায় এলেন”।
“ না এসেই বা উপায় কি ছিল বলুন, এরপর তো থানা, পুলিশই একমাত্র ভরসা। ডেকে নিয়ে যাবার পর কি হয় সেটা তো আমাদের জানা”। বিকাশের কথা শুনে অফিসার তির্ষকভাবে তাকালেন, এবার চোখ সরিয়ে দীপিকা’কে জিজ্ঞাসা করলেন, “ আপনার ছেলে যেটা বলছেন ভেবে বলছেন তো? কাউকে বাড়ি থেকে কিডন্যাপ করার পর কি হয় সেটা যদি উনি জানেন তাহলে এই ঘটনার অংশীদার হয়ে যাচ্ছেন নাকি”।
বিকাশ এবার সত্যিই ধৈর্য হারালো সেটা বোঝা গেল তার গলার স্বরে “ কি বলতে চাইছেন আপনি, আমি এই ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত আছি? পুলিশ অফিসার যেন ছিপে মাছ গেঁথে খেলাচ্ছেন –“ আমি কিছুই বলতে চাইছি না আমি যেটা বলছেন সেটার ব্যাখা করছি”।
“ এটা আমি কেন সবাই জানে, কেন আপনি জানেন না বিজন শিকদার, রতন হাওলাদার, সঞ্জীব রায়, মনোরঞ্জন বাগ এদের কি হয়েছিল বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যাবার পর, বিভিন্ন জায়গায় তাদের ঝুলন্ত দেহ পাওয়া যায়”। নির্বিকার অফিসার টেবিলের ওপর রেজিস্টারের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন – “ জানি তো এরা প্রত্যেকে আত্মহত্যা করেছে, সুইসাইড, এর সঙ্গে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই”।
“কি বলছেন আপনি?” বিকাশ যেন কিছুটা হতাশ পুলিশ অফিসারের কথায়।
“ ঠিকই বলছি, যেটা বলছি সরকারী রিপোর্ট অনুযায়ী বলছি, ময়না তদন্তের পর জানা গেছে, কেস অফ সুইসাইড। আমাদের যা বলতে হবে সরকারী তথ্য প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে বলতে হবে। গুজব ধারণা সন্দেহ এসব বললেই তো হবে না। যাকগে যাক অনেক রাত হয়েছে । বলুন যাকে পাওয়া যাচ্ছে না তার নাম বয়স, গায়ের রঙ, পরনে কি ছিল, শরীরে কোথাও কাটা ছেঁড়ার দাগ মানে আইডেন্টিফিকেশন মার্ক আছে কিনা”।
দীপিকা ও বিকাশ পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে দীপিকাই বললেন, “ একটা কাগজ দিন, আমরা লিখে দিচ্ছি”।
“ না না তার দরকার হবে না , আমি তো শুনে নিলাম কি হয়েছিল, এবার ইনফরমেশন গুলো ডায়রীতে নোট করে রাখব”।
বিকাশ আর থাকতে পারল না, পুলিশ অফিসারদের এই অদ্ভুত আচরণ সম্বন্ধে এতদিন ধরে যেটা শুনে এসেছে সেটাই এখন প্রত্যক্ষ করছে। “ আপনি কি একটা মিসিং ডায়রী করতে চাইছেন নাকি ?”
“হ্যাঁ! এর মধ্যে ভুল কোথায়। উনি তো মিসিংই, কেউ ডাকতে এসেছিলেন উনি তাদের সঙ্গে বেরিয়ে গেছেন, অনেক রাত হয়ে গেছে এখনো ফিরে আসেন’নি, এই তো”।
“কিন্তু এতো পরিষ্কার কেস অফ কিডন্যাপিং”।
“ সেটা তো জানা যাবে আফটার ইনভেস্টিগেশন, তখন কিডন্যাপিং’এর কেস হবে, প্রলিমিনারী মিসিং কেসের তদন্ত হবে, বলুন যেগুলো জানতে চাইলাম। আর হ্যাঁ, সঙ্গে আপনার ফোন নাম্বার ও বলবেন।
(৩)
লেট হওয়া ট্রেনের মত তিনদিন ধরে সংসার চলছে একজন সদস্যের অনুপস্থিতিতে। সমবেদনা জানানোর অছিলায় অনেকেই আসছেন কৌতুহল নিবৃত্তি করতে, তারপর মনগড়া ধারনার সাহায্যে ঘটনার ব্যাখা নিজেরাই করে নিয়ে , সেই ধারনা নিজেদের মধ্যে বজায় রাখছেন যেমন অন্যান্য’দের বেলায় হয়েছিল, এক্ষেত্রেও তার কোন অন্যথা হয়নি।
ঘটনার পরদিন সকালে ভূপতি মামাকে বিকাশ ফোন করেছিল, তাঁর একটাই কথা অশোক কি কোন রাজনীতি করত ?ফোনে ‘করত’ কথাটা শুনে কয়েক সেকেন্ড কোন কথা বলেনি বিকাশ। করত- মানে অশোক কি অতীত হয়ে গেছে নাকি, ভূপতি মামা কি এরকম নিশ্চিত তার পরিণতি নিয়ে। পরক্ষণেই মনে হল রাজনীতি করা মানে কোন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশ নেওয়া, সেটা তো গনতান্ত্রিক দেশ অন্যায় নয়, অশোক যদিও কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত নয়, সেটা হলে যেন কিডন্যাপিং’এর একটা যুতসই কারণ পাওয়া যেত এই উদ্দেশ্যেই কি কথাটা বলেছিলেন ।ভূপতি মামা ফোনে আরো বলেছিলেন, “ দেখো তোমরা যেটা ভাবছ তা কিন্তু নয় অশোকের কিডন্যাপিং’এর পিছনে কোন রাজনীতি নেই, হয়ত কোন ব্যাক্তিগত আক্রোশ, অশোকই কি কোন প্রেম ট্রেম করত নাকি”? বিকাশ ভুপতিমামার জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে অনেক কিছুই বলতে পারত। সেসব না বলে দু’এক কথার পর ফোনটা ছেড়ে দিল। ভূপতি মামা নিশ্চিন্ত হতে চাইছেন তাঁর জিজ্ঞাসার কোন একটাও যদি হ্যাঁ হয়, তাহলেই অঙ্ক’টা মিলে যাবে। কিন্তু কিছু কিছু অঙ্কে তো ভাগশেষ থাকে, সেটা নিয়ে তাঁর কোন আগ্রহ নেই।
থানা তিনদিনে তিনটে বেওয়ারিশ লাশ দেখিয়েছে, অশোকের বয়স যদিও পঁচিশ,এর মধ্যে আজকের এক আন-আইন্ডেন্টিফায়েড লাশ’ও ছিল যার বয়স প্রায় সত্তর বছরের কাছাকাছি, সেটা দেখতেও বিকাশ কে ডাকা হয়েছিল। বিকাশ রেগেই গিয়েছিল, -“ আপনারা ধরেই নিয়েছেন অশোক আর জীবিত নেই, নাকি এই বয়স্ক লোকের মৃতদেহটাকেই অশোকের বলে চালাতে চাইছেন , একবার সরকারীভাবে মৃত বলে ঘোষিত হয়ে গেল আর কোন দায় থাকল না আপনাদের”। থানা অফিসার সেকথার কোন উত্তর দেন’নি, তার বদলে জানালেন “ আমরা যেটা করে থাকি সবটাই হুকুম মোতাবেক,সনাক্তকরণের জন্যে আপনাকে ডেকে মৃতদেহ দেখানো সেটাও হুকুমের মধ্যেই পড়ে। আমরা নিজেরা কোন সিদ্ধান্ত নিই’না”।
কয়েকজন সাংবাদিক থানায় এসেছিলেন অন্যকোন সংবাদের সুত্র ধরে। তাদেরই একজন পুলিশ অফিসার’কে জিজ্ঞাসা করলেন “ কি হয়েছে?” নির্বিকারভাবে পুলিশ অফিসার উত্তর দিলেন, “ ওর ভাই দিন তিনেক হল নিখোঁজ”। বিকাশ নিজেকে স্থির রাখতে পারল না –“ নিখোঁজ কেন বলছেন, তাকে বাড়ি থেকে কিডন্যাপ করা হয়েছে”।
“তদন্ত করে এখনো সেটা জানা যায়নি, যতক্ষণ সেটা জানা না যায় সরকারীভাবে তিনি নিখোঁজ’। অফিসার একটা রেজিস্টার টেনে নিয়ে লিখতে শুরু করলেন। বিকাশ বুঝতে পারল তাকে চলে যেতে বলা হচ্ছে। থানার ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগেই সাংবাদিকদের একজন বলল, “ আপনি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়ান আপনার সঙ্গে কথা আছে”।
“ মাঝ রাতে টেলিফোন পেয়ে থানায় এসেছিলাম, তিনদিন হল আমার ভাইকে আমাদের বাড়ি থেকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। প্রায় ঘন্টা চারেক বসে থাকার পর এক বয়স্ক মানুষের মৃতদেহ দেখানো হল,এরপর আপনাদের সঙ্গে কথা বলার মত শারীরিক মানসিক অবস্থা আমার এখন নেই, আমি ভীষণ ক্লান্ত। বিকাশ জানে এরা যে মিডিয়া হাঊসের সঙ্গে জড়িত থাকুক না কেন, সেই কতৃপক্ষ যেটুকু বলতে বলবে তার বাইরে এরা কিছুই বলবে না। সুতরাং এদের সঙ্গে সময় নষ্ট করা অনর্থক।
(৪)
বিকাশ বাড়ি ফিরে এসে দেখল এর আগে যারা নিখোঁজ হয়েছিল, পরে তাদের ঝুলন্ত মৃতদেহ পাওয়া যায়, সেইসব বাড়ির ও পাড়ার লোকজন সকলেই এসেছিল ওদের বাড়িতে। প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব মত জানিয়েছে, কিন্তু অশোক’কে খুঁজে পাওয়া নিয়ে কোন সদর্থক পথ দেখাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয় সকলে মিলে সম্ভাব্য জায়গাগুলিতে খুঁজতে যাবে। এতবড় শহরে কোন কিছু না জেনে এধরনের উদ্যোগ নেওয়া কখনোই বাস্তবসম্মত নয়। বিকাশ জিজ্ঞাসা করল –“ কোথায় খুঁজতে যাবেন বলছেন আপনারা ?” এই প্রশ্নের কি উত্তর হতে পারে সে বিষয়ে কিন্তু সংশয় সকলের মনে। তারই মধ্যে একজন বয়স্ক মানুষ বললেন-,” আমি মনোরঞ্জনের বাবা, আমার ছেলেকে খুন করে যেখানে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার আশে পাশে, দরকার হলে আমিও তোমার সঙ্গে যাব”। বিকাশ বুঝতে পারল অশোক’কে খোঁজার অছিলায় মনোরঞ্জনের হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থল আর একবার দেখার মধ্যে চাপা পড়া শোক পুনরুজ্জীবিত করতে চাইছেন । যা মাঝে মাঝে এরকম অসহায়দের তৃপ্তি দেয়। বিকাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“ না সেখানে কিছু পাবার সম্ভবনা নেই, হলে স্থানীয় লোকজনেরা থানায় খবর দিত”।বিকাশের মনে হল মনোরঞ্জনের বাবা একটু হতাশ হলেন। সেই সময়ে তার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। অচেনা নাম্বার দেখে ধরতে একটু দেরী হল বিকাশের।
“হ্যালো”।
“বিকাশ বলছ?” “মামাবাবু, এই নাম্বার’টা তো আমার কাছে নেই, তাই………”।
“থাকার কথাও নয়, এটা অন্য একজনের নম্বর,তুমি কি একবার আসতে পারবে?”
“আপনার বাড়িতে? কেন পারবো না। কোন খবর আছে?”
“আরে তুমি এসোই না”। বিকাশ একটু ব্যস্ত হয়ে পড়ল, “ আচ্ছা আপনার আসুন আমাকে এখনই একটু বেরুতে হবে”।
কেউ একজন প্রশ্ন করল- “ অশোকের কোন খবর আছে?”
“বলতে পারবো না তবে মামাবাবু যখন ডেকেছেন, মা মা”। দীপিকাকে ডাকতে ডাকতে বিকাশ ঘরে ঢুকে গেল উত্তেজিত হয়ে।
(৫)
ভূপতিবাবুর সদর ঘরটি পরিকল্পিতভাবে সাজানো,দেয়ালে সার দেওয়া খান কুড়ি চেয়ার সোফা সেট, সামনে গদি আঁটা রিভলবিং চেয়ার, কাঁচের সেন্টার টেবিল ছাড়া অন্য কোন আসবাবপত্র নেই। যেকোন সময়ে বেশ কিছু লোকের উপস্থিতিতে জরুরী সমস্যা নিয়ে ঘরোয়া মিটিং হতেই পারে, মূলতঃ ঘর’টি সেই উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হয় বলেই বিকাশের মনে হল। এর আগে সে যখন ভূপতিমামার বাড়িতে খুব কমই এসেছে, প্রতিবারই এই ঘরটাতে মোটা ঝুলন্ত পর্দার আড়ালে বন্ধ দরজা দেখেছে। আজই প্রথম এই ঘরে ঢুকল। ভূপতিমামা একলাই থাকেন, স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে অনেকদিন। একমাত্র ছেলে বিদেশে। ওখানে পৌঁছেই বিকাশ দেখল ভূপতি মামা বছর ত্রিশেকের এক যুবকের সঙ্গে কথা বলছিলেন,বিকাশ’কে দেখে তাকে বললেন “ তুমি তাহলে এসো এখন”। বিকাশ বুঝতে পারল যে প্রসঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল সেটা বিকাশের সামনে হবার নয়। লোকটি চেয়ার ছেড়ে উঠে বেরিয়ে যাবার আগে বিকাশ’কের দিকে তাকিয়ে দাঁত বার করে হাসল। বিকাশের কেমন যেন চেনা মনে হল তাকে।
“আরে এসো এসো বিকাশ, তুমি একটু বসো,সামান্য একটু কাজ সেরে আমি এখুনি আসছি, ততক্ষণ অপেক্ষা করো, খাবে কিছু”। বিকাশ ঘাড় নেড়ে অনিচ্ছা প্রকাশ করল। চেয়ারে বসতে গিয়েই বিকাশের মনে হল অশোকের কোন খবর পেয়েছেন কিনা জিজ্ঞাসা করা হল না। একলা বসে থাকলেও মনের মধ্যে একটা আশার আলো দেখতে পেল। ভূপতিমামা নিশ্চয় খবর পেয়েছেন কিছু , তাই তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে একজন অপরিচিত লোক ঘরে ঢুকে চেয়ার দখল করে বসল। বিকাশকে দেখে কোন কৌতুহল প্রকাশ করল না। কয়েক মিনিটের তফাতে তফাতে একজন একজন করে আসার ফলে গোটা ঘরটাই প্রায় ভর্তি হয়ে গেল। ভূপতি মামা তখনো আসেন’নি। যারা এসেছে তারা নিজেদের মধ্যে চাপা স্বরে কথা বলছে, বিকাশ’কে নিয়ে কারুর কোন উৎসাহ নেই কেউ কোন কথা তার সঙ্গে বলছে না। । এতগুলো লোক ঘরে থাকায় তাদের মৃদুস্বরে কথা বলায় গুমগুম করে শব্দ হচ্ছে। বিকাশ একবার ঘড়ির দিকে তাকালো , দেড়’টা বেজে গেছে। মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠে থানায় গিয়েছিল। এসেও কিছু খাওয়া হয়নি। যারা এসেছে তারা ভূপতি মামার জন্যে অপেক্ষা করছে বলেই মনে হল বিকাশের। বেশ কিছুক্ষণ পরে ভূপতিমামা সাফারী সুট পরা প্রায় ফুট ছ’য়েক লম্বা একজনকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বেশ ব্যক্তিত্বময় চেহারা। তাকে দেখে সকলেই নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। প্রথমাবস্থায় বিকাশ কিন্তু বসেই ছিল, সকলের উঠে দাঁড়ানো দেখে সেও তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। ততক্ষণে সেই ব্যক্তি হাতের ইসারায় সকলকে বসতে বলছেন। বসে পড়তেও বিকাশের একটু দেরী হল। বসে পড়ে মনে হল সেও কি এদের দলভুক্ত হয়ে গেল নাকি, তার তো উঠে দাঁড়াবার কথা নয়। সে তো জানেই না উনি কে। হয়ত দলের কোন উচ্চস্থানীয় নেতা হবেন তাতে বিকাশের কি আসে যায়।ও তো এসেছে অশোকের যদি কোন খবর পাওয়া যায়। তবে এই লোকটি যে একজন কেউকাটা সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না। গদি লাগানো রিভলবিং চেয়ারে বসে যেভাবে তিনি দুলছিলেন, মুখে একটা প্রচ্ছন্ন হাসির রেখা রেখে সেটা দেখেই বিকাশ বুঝতে পারচ্ছিল কেউ কেউ এর মাধ্যমেই নিজেদের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা জানান দেন অন্যদের কাছে। ভূপতিমামা উঠে দাঁড়িয়ে আজকের জমায়েতের উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু বলতে শুরু করলেন। সেখানে অশোকের কোন প্রসঙ্গ উত্থাপিত হল না। বিকাশ একটু হতাশ হল। সবার পিছনে সে দেয়াল ঘেঁসে বসেছিল। সে বুঝতে পারছিল না এখানে তার কি ভূমিকা। ধীরে ধীরে পার্টির বিভিন্ন কার্যাবলী ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল। সভার মধ্যমণি হিসাবে ভদ্রলোক বিশেষ কথা বলছিলেন না। অন্যদের কথা শুনছিলেন ধৈর্য সহকারে। বিকাশ অপেক্ষা করে রয়েছে অশোকের প্রসঙ্গ কখন উঠবে। কিন্তু সেরকম কোন সম্ভবনা দেখা যাচ্ছিল না। এক একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা বেশ দীর্ঘায়িত হচ্ছিল। বিকাশের খুবই একঘেয়ে মনে হচ্ছিল সেই সব কথাবার্তায়।তবুও নিরুপায় হয়ে বসেছিল কিছুটা আশা নিয়ে। সেইসময় তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল । তাকিয়ে থাকতে পারছে না। সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে হচ্ছে এখানে ঘুমিয়ে যাওয়া মোটেই কাঙ্খিত নয়। নিজের অজান্তে বেশ কয়েকবার তার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল ।তাকে কেউ লক্ষ্য করছে না ভেবেই পিছনের দেয়ালে মাথাটা এলিয়ে দিল।
(৫)
আজ আর চেয়ারে কেউ বসে নেই। সবিতা বিছানা পাতা চৌকির ধারে সেদিনের মত দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ । বিকাশের মা বিছানা বসে আছেন শূণ্যদৃষ্টি সম্বল করে। সেকেন্ডের কাঁটার সরার আওয়াজ নির্দেশ করছে চলে যাওয়া সময়। দীর্ঘক্ষণের নীরবতা ভেঙ্গে সবিতা জিজ্ঞাসা করল “ রাত কত হল মা ? দীপিকা মুখ ফিরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন “ পৌনে এগারোটা”।