সুপ্রিয় যখন বাস থেকে নামল তখনই চারটে বেজে গেছে।শীতের ছোট বেলায় বিকেল ফুরিয়ে আসছে।তখনই বুকের মধ্যে গুরগুরু করে কাঁপুনি ধরছে ।গরমের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিল সুপ্রিয়।একটা সূতির উড়নি ছাড়া আর তো কোন পোষাক নেই চাদরের নীচে।গুরুদশা চলছে তার।দ্রুত পা চালালো সে।যদি শীতবোধ একটু কম হয়।এসব জায়গায় ঠান্ডা পড়েও বেশী।
মা মারা যাবার আগে তাঁর মুখে যেটুকু শুনেছিল সেই সুত্র ধরেই এখানে আসা।দুর্লভপুর পর্যন্ত কোন বাস চলে না,হরেকেষ্টপুর মোড়ে নেমে ব্রিক সোলিং রাস্তা ধরে দু’আড়াই কিলোমিটার হেঁটে দুর্লভপুর পৌঁছতে হয়।ভাগ্য ভাল হলে কখনো সখনো ভ্যান রিকশা পাওয়া যায়।নাহলে হাঁটা।এখানকার লোকজনেরা অবশ্য সাইকেল আর মোটরবাইকের ওপর নির্ভরশীল।পথে লোকজন চোখে পড়ছে না সুপ্রিয়র।একে শীতকাল তায় ছোট বেলা, অধিকাংশই আগে ভাগেই বাড়ীর দিকে রওনা দিয়েছে।রাস্তার দুধারে চাষের জমি অনেক দূর পর্যন্ত। ধান কাটা হয়ে যাওয়ায় ফাঁকা জমিগুলোর কালচে মাটিতে ফুরিয়ে আসা দিনের আলো আগেই মরে গেছে,আধো আলো আঁধা্রে ঢেকে যাওয়া বিস্তীর্ণ নির্জন মাঠের দিকে তাকিয়ে সুপ্রিয়র কেমন যেন নিজেকে একা মনে হল। বরং উল্টোদিকে তাকাতে কিছুটা ভরসা পেল সে, পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়া সূর্যের অল্প বিস্তর রঙ তখনো ছড়ানো, সেইদিকেই কয়েকটা জমিতে এখনো ধান কাটা হয়নি, তাই মরা আলোর প্রতিফলনে এদিকে যেন সামান্য হলেও প্রাণের স্পন্দন অনুভব করা যাচ্ছে। তবে আলো কমে যাওয়ার সাথে সাথে শীতও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।
সামান্য একটা পাতলা গরমের চাদর যে এই শীতের পক্ষে যথেষ্ট নয় সেটা বুঝতে পারছিল সুপ্রিয়, ভেবেছিল জোরে হাঁটলে শরীর গরম হয়ে যাবে, হাওয়াই চটি পায়ে এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় সেভাবে হাঁটতে পারছিল না। এর থেকে খালি পায়ে হাঁটলে ভাল ছিল, তবে আজকাল গুরুদশায় সবাই হাওয়াই চটি পরে, না হলে কোথায় কাঁটা ফুটবে না কি হবে বলা যায় না।যাইহোক চাদরটা খুলে আবার ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিল সে। ব্যগটা মাঝে মাঝেই কাঁধ থেকে খসে পড়ে যাচ্ছে জোরে চলতে গিয়ে।নজরে পড়ল,কিছুটা দূরে মাঠ পেরিয়ে একটা লোক রাস্তায় উঠছে,চাষের কাজ শেষ করে বাড়ী যাবে বোধহয়।তাকে দেখেই সুপ্রিয় জোরে পা চালালো।
“ও ভাই, দুর্লভপুর আর কতদূরে”।
“সবে আদ্দেক পথ এসেছেন,তা যাবেন কার বাড়ী?”
“সুরেশ্বর দত্ত,চেনেন?”
“না চিনলাম না দুর্লভপুর বড় গাঁ অনেক লোকের বাস”।আশ্চর্য হল সুপ্রিয়, মামারা তো দীর্ঘদিনের বাসিন্দা যেটুকু মায়ের মুখে শুনেছে তাহলে চিনলো না কেন।
“গত হলেন কে? মা না বাবা”?
“মা”।
“ও, তা আসছেন কোথ থেকে”?
“কলকাতা”। যদিও সুপ্রিয় থাকে ফলতার একটা গ্রামে,অচেনা লোকের কাছে কলকাতা বলাই ভাল।
“আমি এদিকের মাঠে নেমে যুগীপাড়া যাব, যান জোরে পা চালান দুর্লভপুর খুব বেশী দেরী হবে না ”।
কথাটা শুনে কিছুটা উৎসাহিত হল সুপ্রিয়,দ্রুতই পা চালাতে লাগলো।তবু দুর্লভপুর পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেল।ব্রিক সোলিং রাস্তা শেষ হয়েছে একটা বটতলায়।দুদিকে দুটো মাটির রাস্তা চলে গেছে।সুপ্রিয় দাঁড়িয়ে পড়ল কোন দিকে যাবে বুঝতে না পেরে।গোবর ও গরুর গায়ের গন্ধ পাচ্ছিল সে। তবে কি এটাই সেই ঘোষ পাড়া,দু একবার মায়ের মুখে শুনেছে।লোকজনের বাড়ী সেভাবে চোখে পড়ছিল না।কোন দিকে যাবে এবার কাউকে তো জিজ্ঞাসা করা দরকার। বাঁদিকেই মোড় নিল সুপ্রিয়,গ্রামে যখন ঢুকে পড়েছে,বাড়ী ঘরদোর নিশ্চয়ই চোখে পড়বে। বেশী দূর যেতে হল না তাকে,হারিকেন হাতে কেউ সামনের দিক থেকে এগিয়ে আসছে।কাছে আসতে দেখল একজন নয়,দুজন মাঝ বয়সী লোক হাঁটুর ওপর কাপড় পরা,গায়ে চাদর জড়ানো,দুজনেই দুটো গরু নিয়ে কোথাও যাচ্ছে।সুপ্রিয়কে দেখে দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়েছে।ঠান্ডায় প্রায় তার জমে যাবার অবস্থা,তারা কিছু প্রশ্ন করার আগেই সুপ্রিয় জিজ্ঞাসা করল “আচ্ছা সুরেশ্বর দত্তর বাড়ীটা কোথায় বলতে পারেন”?সুপ্রিয়কে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে তাদেরই একজন বলল, “সুরেশ্বর দত্ত বলে তো কেউ থাকে না,ঠিকানা কিছু বলেছে”?
“ঘোষপাড়ার কাছাকাছি এইটুকুই জানি”।
“না না, ও নামে তো ঘোষপাড়ায় কেউ থাকে না”।
“কিন্তু আমি তো জানি দত্তরা অনেক পুরানো বাসিন্দা”।
“পুরানো বাসিন্দা! আমরা চিনব না তাই কখনো হয়! এখানে বেশীরভাগ ঘোষেদের বাস,দু’এক ঘর নাপিত, ওদিকে নবীন কামার,আর কয়েক ঘর মাহিষ্যদের বাস।দত্ত? দত্ত না”।সুপ্রিয়র তখন শোচনীয় অবস্থা,এই প্রচন্ড ঠান্ডায় কোথায় যাবে।ফিরতে গেলেও কোথাও না কোথাও রাত্রিবাস করতে হবে।দুজনের মধ্যে একজন একটু বয়স্ক ছিল,সেই এবার অপর জনকে জিজ্ঞাসা করল, “রমেশ তোমার মনে থাকার কথা নয়, দত্তদের ভিটেটা চাঁদুঘোষেরা কিনেছিল না”।সে অনেক কালের কথা,না এখানে দত্তরা থাকে না”।
“এখন কোথায় থাকে কেউ বলতে পারবে না”?
“এ গ্রামে থাকে না,অন্য কোথাও থাকে কিনা চাঁদু ঘোষ বললেও বলতে পারে,সম্পত্তিটা তো ওরাই কিনেছিল”।
“ওদের বাড়ীটা কোন দিকে”?
“চলুন, আমরা যেদিকে যাচ্ছে সেইদিকেই, তিন চারটে বাড়ীর পরেই ,দত্তরা কে হয় আপনার”?
“ওটা আমার মামার বাড়ী”।
“মামাদের সাথে তেমন আসা যাওয়া ছিল না বোধহয়”।
“না। আমি এই প্রথম আসছি”।
“এই যে পাঁচিলঘেরা বাড়ীটা চাঁদু ঘোষদের…।।ও চাঁদুদা।চাঁদুদা, কপাটটা একবার খোল”।
“কে’?ভেতর থেকেই কেউ জানতে চাইল।
“আরে আমি ভজন, রমেশের সঙ্গে গরু রাখতে যাচ্ছি।এই ভদ্রলোক দত্তদের বাড়ী খুঁজছেন”।
এবার দরজা খুলে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক টর্চ হাতে বেরিয়ে এলেন। প্রায় ছ’ফুট লম্বা,সেইরকম স্বাস্থ্য, কে বলবে যে অত বয়স হয়েছে ।হাটুঁর ওপরে ধুতি থাকলেও গায়ে ফুল হাতা শার্ট, চাদরের ফাঁক দিয়ে সোয়েটার দেখা যাচ্ছিল।ইনিই যে চাঁদু ঘোষ সে ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ রইল না সুপ্রিয়র।
“কি হয়েছে ভজন”?
“এই ভদ্রলোক দত্তদের বাড়ী খুঁজছেন”।টর্চের আলো সুপ্রিয়র পায়ের কাছে ফেলে মুখটা দেখার চেষ্টা করলেন।
“কোথা থেকে আসছেন আপনি”?
“কলকাতা।সুরেশ্বর দত্তরা এখন কোথায় থাকে বলতে পারেন,উনি আমার বড়মামা”।
“বড়মামা মানে,তুমি ইন্দিরার ছেলে”?
“হ্যাঁ।মা মারা গেছেন,সেই খবরটা দিতেই এসেছি”।
“ তাই নাকি, ইসস্, শীতে একবারে কাহিল হয়ে গেছ দেখছি, এসো এসো ভেতরে এসো,ঠিক আছে ভজন তোমরা এসো পরে কথা হবে”।
চাঁদু ঘোষের পিছু পিছু সুপ্রিয় বাড়ীর ভেতরে ঢুকল।বিশাল উঠান,তার একদিকে দোতলা বাড়ী, একতলার ঘর সংলগ্ন লম্বা দালান।উঠানের অন্যদিকে টালীচালের কয়েকটা ঘর দেখা যাচ্ছে আবছা আলোয়। আর এক দিকে ধানের মরাই। সুপ্রিয়র মনে হল এটাই তার মামার বাড়ী ছিল।কি কারণে যে মা যোগাযোগ রাখেনি কে জানে,কখনো সখনো কথা উঠলে সে যে জিজ্ঞাসা করেনি তা নয়। ছোট থেকে তার কৌতুহল অনেক। বাবাকে সে চোখে দেখেনি,বাবার কথা উঠলে মা ধমক দিত, বিরক্ত হত আর মামার বাড়ীর প্রসঙ্গে মা চুপ করে থাকত, কখনো কখনো চোখের জল ফেলত।
একটা ইলেকট্রিকের বাল্ব জ্বলছিল দালানে টিম টিম করে,সেভাবে আলো হচ্ছিল না।এদিকে বোধহয় ভোল্টেজের সমস্যা আছে। সুপ্রিয় উঠানেই দাঁড়িয়ে ছিল,চাঁদু ঘোষ সিঁড়ি দিয়ে দালানে উঠে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, “দাঁড়িয়ে থাকলে কেন,এসো ঘরে এসো,ঠান্ডায় জমে গেছ দেখছি, ওরে চন্দ্রা ওপর থেকে একটা কম্বল এনে দে তো”।
সুপ্রিয় ঘরে ঢুকে একটা মোড়া ছিল তাতে বসতে যাচ্ছিল,চাঁদু ঘোষই তাড়াতাড়ি মোড়াটা টেনে নিজের দিকে নিয়ে বললেন, “তুমি খাটের ওপর আরাম করে বসো,কম্বলের আসনটা পেতে নিও”।
ধড়ে যেন প্রাণ এল সুপ্রিয়র।জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাটের ওপর উঠে বসল। এ ঘরেও একটা ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বলছিল,কিন্তু আলো তেমন নয়।ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরটা দেখতে দেখতে তার মনে হচ্ছিল এই ঘরটা হয়ত তার মায়ের ছিল একসময়।ঘরটা বেশ পুরানো বলেই এসব কথা তার মনে হচ্ছিল। দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে, হুনুমান বুক চিঁরে রাম সীতা দেখাচ্ছে,অন্য দিকে আলোর নীচে ফ্রেমে বাঁধানো কালো কাপড়ের ওপর লাল উল বা সুতো দিয়ে আঁকা পাখীর বাসায় পাখীর ছানা আর তার মা পাখী, নীচে লেখা ‘সংসার সুন্দর হয় রমণীরগুণে”। ফলতার বাড়ীতে দেয়ালেতে ফ্রেমে বাঁধানো একই রকম ছবি টাঙ্গানো আছে,কোন দিন মাকে জিজ্ঞাসাও করেনি সে ওটার বিষয়ে, আজ এটা দেখার পর মনটাও কেমন যেন ভার হয়ে গেল মায়ের জন্যে।
“তুমি তো ইন্দিরার ছেলে বললে না,কি হয়েছিল ইন্দিরার,বয়স তো খুব বেশী হবে না তোমার মায়ের”।
“মায়ের ক্যানসার হয়েছিল, সেভাবে তো চিকিৎসা করাতে পারিনি”।
“তোমার বাবা কোথায়”?
উত্তর দেবার আগেই একটি মেয়ে, কিশোরীই বলা চলে,একটা কম্বল নিয়ে ঘরে ঢুকল।বিছানার ওপর সেটা রাখতেই বৃদ্ধ বললেন, “ ওটা গায়ে দিয়ে ভাল করে বসো”
“হাত মুখটা ধুয়ে এসে নাহয়……”
“হ্যাঁ, ঠিকই।চন্দ্রা হারিকেনটা নিয়ে কলঘরটা দেখিয়ে দে। নতুন মানুষ,আর ওপরে গিয়ে মাকে বল একটু বেশী দুধ দিয়ে চা করে দিতে,ঠান্ডায় একেবারে জমে গেছে।অশৌচ চলছে খাবেই বা কি”।
সুপ্রিয় খাট থেকে নামতেই মেয়েটি বলল “আসুন”।মেয়েটি বারান্দায় রাখা একটা হারিকেন তুলে নিল।আলোটা কমানো ছিল,সেটা একটু বাড়িয়ে নিয়ে মেয়েটি এগিয়ে চলল,সুপ্রিয় তার পিছু পিছু গিয়ে পৌঁছাল উঠানের এক কোণে পাঁচীল দিয়ে ঘেরা মাথা খোলা টিনের দরজা লাগানো কলঘর।
“ভেতরে টিউব ওয়েল আছে বালতি মগ সব পাবেন,দরজাটা বন্ধ করে দিন আমি বরং হারিকেনটা পাঁচীলের ওপর বসিয়ে দিচ্ছি,তাতেই আলো হবে”।
সুপ্রিয় কোন কথা না বলে ভেতরে ঢুকে গেল।চোখে মুখে খানিকটা জলের ঝাপটা দিল। শীত করলেও পাম্প করে বেশ খানিকটা জল খেল। টিউব ওয়েলের জল তত ঠান্ডা নয়।কলঘর থেকে বেরিয়ে দেখল মেয়েটি তখনও দাঁড়িয়ে আছে হারিকেনটা নেবার জন্যে।যথারীতি সে আবার আলো দেখিয়ে ঘরে পৌঁছে দিল।চাঁদু ঘোষ তখনও অপেক্ষা করছেন।
“গায়ে কম্বলটা জড়িয়ে ভালো করে বসো”। বিছানায় উঠে কম্বলটা টেনে নিল সুপ্রিয়।চোখ জড়িয়ে আসছিল সাময়িক আরামে।অনেকক্ষণ পরে স্বস্তি অনুভব করল সে।
“এটা তোমার মামাদেরই ভিটে।পরে আমরা দোতলায় দুটো ঘর করেছি ডাকাতির ভয়ে। তোমার মামাদের আমলে ওসব ছিল না, প্রায় কুড়ি বছর হল ওরা চলে গেছে,এক দিকে ভালই করেছে”।
“কোথায় গেছেন আমার মামারা”।
“শুনেছিলাম বহরমপুর,ঠিকানা জানি না।চলে যাওয়ার পর কে কার খোঁজ রাখে বলো দেখি।তাছাড়া আমরা হলাম গয়লা ঘোষ,তোমার মামারা ছিলেন বেনে,রবিচন্দ্রপুরে এক ঘর বেনেরা থাকে,শুনেছিলাম তোমার মামাদের সাথে তাদের লতায় পাতায় আত্মীয়তা আছে,তারাও বলতে পারবে বলে মনে হয় না,অনেকদিনের কথা।তুমি যদি যেতে চাও আমি কারোর মোটরসাইকেল করে পৌঁছে দিতে পারি তবে খুব লাভ হবে না। তোমার মা কি কিছুই জানত না ”?
“না,মা বুঝতে পেরেছিল বাঁচবে না,তখনই বলেছিল আমি মরে গেলে মামাদের একটা খবর দিস”।
“তোমার বাবা এখন কোথায়”?
“জানি না”। বন্ধ দরজা ঠেলে চন্দ্রা ঢুকল চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে।গ্লাসটা বেশ বড়সড়,চায়ের চেয়ে দুধের আধিক্য বেশী।ছোট একটা টুল খাটের নীচ থেকে বার করে তার ওপর চায়ের গ্লাস রেখে সুপ্রিয়র হাতে দুটো বিস্কুট ধরিয়ে দিল।
“ও আমার নাতনী, ক্লাস নাইনে পড়ে,ওর বাবা এখানে থাকে না,মার্চেন্ট নেভিতে কাজ করে, জাহাজে জাহাজে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। মাস তিনেকের জন্যে আসে”।চন্দ্রা চলে যেতেই বৃদ্ধ বললেন, “নাও চা খেয়ে নাও,বহুক্ষণ কিছু খাওয়া হয়নি তো।সুপ্রিয় চায়ের গ্লাসটা তুলে নিল।চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে মনে হল,উনি সুপ্রিয়র বাবার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন।কিন্তু সুপ্রিয়ই তো কিছু জানে না তার বাবার কথা। সত্যিই তো এই সময় সকলেই তো বাবার কথা জিজ্ঞাসা করবে। সুপ্রিয়কে গ্লাস নিয়ে বসে থাকতে দেখে বৃদ্ধ আবার অনুরোধ করলেন,
“কি হল খুব গরম?আস্তে আস্তে খাও,কি খেয়েছ আজকে”।
“তেমন কিছু খাওয়া হয়নি,আজ তো হবিষ্যি করতে পারিনি”।
“কলকাতায় থাকো বলছিলে না,বেরিয়েছ কখন”?
“ঠিক কলকাতায় থাকি না ডায়মন্ডহারবারের কাছে ফলতার একটা গ্রামে”।
“তোমার বাবা তাহলে ওখানেই কাজকর্ম করেন”।
“জ্ঞান হওয়া অবধি আমি আমার বাবাকে কখনো দেখিনি, মা-ও বিরক্ত হতেন জিজ্ঞাসা করলে”।
“তাহলে”?
“যা কিছু করার মা করতেন,ওখানকারর অঙ্গনওয়াড়ী কর্মী ছিলেন,রাতে ব্লাউজ কারখানা থেকে ছিট নিয়ে এসে কাটিং করতেন, ছুটির দিনে গঙ্গায় নেমে মীন ধরতেন, আমিও মাকে সাহায্য করতাম”।
“মীন ধরা মানে মাছ ধরা”?
“অনেকটা তাই,তবে কোন বড় মাছ নয়,গঙ্গায় নেমে জাল দিয়ে ছোট ছোট চিড়িংর বাচ্ছা ধরাকে মীন ধরা বলে,সরু নখের মতো দেখতে। অনেক লোক ধরে,এক একটা দুটাকা আড়াই টাকায় বিক্রী হয়”।
এইভাবেই তোমাদের সংসার চলত!”
“আমিও দুটো টিউশানী করি,ডায়মন্ডহারবার কলেজে বিএসসি পড়ি,পয়সার অভাবে মায়ের চিকিৎসাটা করতে পারলাম না,ঠাকুরপুকুর হাসপাতালে দিয়েছিলাম,কিছু হল না।”
“কালরোগ। কি আর করবে”।বৃদ্ধ মোড়া ছেড়ে উঠে পড়লেন।
“এখন একটু বিশ্রাম করো,তোমার রাতে খাওয়ার কি ব্যবস্থা করা যায় দেখি”।
“আমি রাতে আর কিছু খাব না”।
“তাই কখনো হয়,ঘোষেদের বাড়ী যখন এসেছ, দুধ, ছানাটুকু তো পাবে”।
(২)
সারাদিনের ক্লান্তিতে গভীর ভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিল সুপ্রিয়।কতক্ষণ ঘুমিয়েছে তাও জানে না।ঘুম ভাঙ্গল দরজায় দুম দুম শব্দে,ঘুম ভেঙ্গে প্রথমে বুঝতেই পারছিল না সে কোথায় আছে।ফলে খানিকটা সময় চলেই যাচ্ছিল দরজা খুলতে,কিন্তু অপর প্রান্তে ডাকের কোন বিরাম নেই।সম্বিত ফিরতে মনে হল কোন মেয়ের গলা-“শিগগির উঠে দরজাটা খুলুন”।তার সঙ্গে রয়েছে দরজায় ধাক্কা।সুপ্রিয় ঘুম চোখে দরজা খুলে ভাল দেখতে পেল না,কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে চন্দ্রাই ডাকছিল এতক্ষণ ধরে সেটা বুঝতে পারলো। চোখ রগড়াতে রগড়াতে জিজ্ঞাসা করল “কি? কি হয়েছে?
“শিগগির ওপরে চলুন খুব বিপদ ,গ্রামে ডাকাত পড়েছে যে কোনসময়ে আমাদের এখানেও আসতে পারে,চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে শুনতে পাচ্ছেন না ”।
“ওপরে কেন”?
“আঃ! বড্ড কথা বলেন ,তাড়াতাড়ি ওপরে আসুন, পরে সব বলছি,টর্চ থাকলে নিয়ে আসুন তবে খুব দরকার না হলে আলো জ্বালাবেন না”।
“কোন দিকে যাব,অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছি না,”
“আমার হাতটা ধরুন”।খুব কাছেই বোমা বা গুলির শব্দ হল।
“ওই দেখুন, খুব কাছেই মনে হচ্ছে, তাড়াতাড়ি চলুন”। সুপ্রিয়কে একরকম টানতে টানতে চন্দ্রা ওপরে উঠতে থাকে।কিছুই বুঝতে পারছিল না সুপ্রিয়,তবু প্রশ্ন করে “ওপরে উঠলে কি সুবিধে হবে”।
“আমরা ওপরে উঠলেই দাদু ঝাঁপ দরজা ফেলে দেবে”।
“ঝাঁপ দরজা কি”?অনেক কিছুই জানে না সুপ্রিয়,এখন তার প্রশ্নের উত্তর দেবারও সময় নয় তাই সে কথার আর উত্তর দিল না চন্দ্রা।ওপরে মাথা ঢাকা বারান্দায় সুপ্রিয়কে ছেড়ে দেওয়া মাত্র দুম করে ঝাঁপ দরজা পড়া শব্দ হল।অন্ধকারের মধ্যেই চাঁদু ঘোষের বিশাল শরীরটার শশব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকতে যাবার আগে সুপ্রিয়কে উদ্দেশ্য করে বলল-“একটু সর্তক থাকো,তবে বারান্দার রেলিং এর কাছে বেশী যেও না, আমাদের আর তত ভয় নেই, ডাকাত দল ওপরে উঠতে পারবে না, ওদের লক্ষ্য খালি গরু মোষ । অনেক সময় নীচের থেকে গুলি চালায়,আমি বন্দুকটা লোড করে নি।
ঘরের মধ্যে তখন ইলেকট্রিকের আলো না জ্বালিয়ে হারিকেন জ্বালানো হয়েছে।কম্বলটা ভালো করে জড়িয়ে সুপ্রিয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। অন্ধকার পক্ষের রাত্রি,দূরে কয়েকটা গাছের মাথা ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না,এই সময় উঠানে কেউ ঢুকলে দেখতে পাওয়া মুস্কিল।কিন্তু তার কি করণীয় সেটা বুঝতে পারছিল না।
“এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি করবেন,পাশের ঘরটা দাদুর,ওখানে একটা চৌকি আছে, যান গিয়ে শুয়ে পড়ুন দাদু অবশ্য জেগে থাকবে”। সুপ্রিয় যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার সামনের ঘরের ভেতর হারিকেনের সামান্য আলো চন্দ্রার গায়ে পড়েছে।এবার সেও হয়ত সেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেবে।
“দাদুই একটু সর্তক থাকতে বললেন,এখানে কি এরকম ডাকাতি প্রায়ই হয় নাকি”।
“প্রায়ই হয়,শুধু এখানে নয় আশপাশের সব গ্রামেই, এরা সব বাংলাদেশের ডাকাত”।
“পুলিশ আসে না”।
“আমাদের গ্রামে তো পুলিশ ক্যাম্পই আছে”।
“তাহলে”?
“তারা আর কি করবে তাদের তো মোটে চারটে লোক,ক্যাম্পের পাশে বড় গোয়াল করা আছে,গ্রামের সব লোক গরু মোষ রেখে আসে সেখানে,ওরা ওটাই পাহারা দেয়”।
“ও! সেইজন্যেই যখন আসছিলাম দুজন গরু নিয়ে যাচ্ছিল,তারাই এই বাড়ী চিনিয়ে দিল, এ বাড়ীর গরুও কি সেখানে রাখা আছে?
“হ্যাঁ।
“তাহলে এত ব্যস্ততা এত ভয় কেন”?
“গরু মোষ না পেলে ডাকাতরা গুলি করে মেরে দিয়ে যায়,মাস খানেক আগে তরজাপুরে একটা মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেছে, কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি”।
“সেকি এভাবে মানুষ বাস করে কি করে”।
“চন্দ্রা”।ঘরের ভেতর থেকে কেউ একজন ডাকলো।
“মা ডাকছে,আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন”।
চন্দ্রা ঘরে ঢুকতেই চাপা গলায় ধমক দেওয়া হল।
“কি বকবক করছিস ছেলেটার সঙ্গে, জানিস না ও মুসলমান”।
কথাটা কানে যাওয়া মাত্র সুপ্রিয় চমকে উঠল, কি বলছে এরা সব।তখনই চন্দ্রার গলা পেল।
“কি যা তা বলছ মা,এটা ওর মামার বাড়ী ছিল,ও মুসলমান হতে যাবে কেন”।
“চুপ কর তর্ক করিস না, ধমক দিতে গিয়ে চন্দ্রার মায়ের গলা আর খুব চাপা থাকছে না, “ এ গ্রামের সবাই জানে ওর মা একটা মুসলমান কাঠ মিস্ত্রীর সঙ্গে পালিয়েছিল”।
“মা ও বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে,শুনতে পাবে”।
“পাবে ,পাবে,কখন বিদেয় হবে কে জানে,তোমার দাদুর যত সব আধিক্যেতা”।
রাতের নিস্তব্ধতায় আর কিছু শোনা যেত সে ইচ্ছে সুপ্রিয়র থাকল না, দূরে রাতের শুনশান ভেঙ্গে কিছু মানুষের হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। সেটাও কোনো কৌতুহল জাগালো না,বুকের ভেতরটা কেমন যেন খালি হয়ে গেছে, কিসের ভারই বা সে এতদিন বইছিল জানে না,বারান্দা একবারে শেষপ্রান্তে চলে গিয়ে, অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ।পাতলা সরের মত কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আশপাশ, সেই চাপা দমবন্ধ হওয়া একটা তীব্র কষ্ট বোধে সে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে,অথচ মা মারা যেতেও এই অসহনীয় যন্ত্রনা সে অনুভব করেনি কারণ তার একটা প্রস্তুতি ছিল,এটা শোনার পর আকস্মিক আঘাতে ভেতরটা যেন ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে যাচ্ছে।একটা কিসের দলা যেন গলার কাছে আটকে রয়েছে বলে মনে হল।সুপ্রিয় মাথা উঁচু করে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকালো হয়ত কোনো সহানুভুতির খোঁজে, কিন্তু মিট মিট করা ক্ষীণ দু’একটি তারার আলো কোনো প্রভাব ফেলতে পারলো না তার ওপর। বেশীক্ষণ এই দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ,চেপে রাখা সেই অনিবার্য কান্না তার সারা শরীর কাঁপিয়ে হু হু করে নেমে এল।
(৩)
পরদিন ঘুম ভাঙ্গতে অনেক দেরী হয়ে গেল সুপ্রিয়র,নিজেরই কেমন লজ্জা করছিল এতক্ষণ শুয়েছিল বলে।গত রাতের কথা মনে হতেই আবার সেই হীনমন্যতাবোধ তাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল।।আর দেরী করা যাবে না, নীচে নেমে এসে,দ্রুত তৈরী হয়ে নিল চলে যাবার জন্যে। চলে যাবার আগে বলে যাওয়া দরকার,কিন্তু চোখে পড়ছে না কাউকে।পরক্ষণেই মনে হল,তার কি খুব দরকার আছে।শীতের রাতে সুষ্ঠু আশ্রয় পাওয়ার জন্যে সে অবশ্যই কৃতজ্ঞ। কিন্তু তার মানসিক পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যে এক মূহুর্ত ওখানে আর থাকতে চাইছিল না।তবু এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিল সুপ্রিয় যদি কারুর সঙ্গে দেখা হয় সৌজন্যটুকু বজায় থাকবে।রাতে ওই কথা গুলো শোনার পর যে সংশয় তৈরী হয়েছে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে তারপর সব কিছুই অনর্থক মনে হচ্ছে তার। মা, বাবা মামার বাড়ী সবকিছুর থেকে সে যেন অনেক দূরে চলে গেছে। না এভাবে তো বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না,উঠানে নেমে আসে সুপ্রিয়।
“একি আপনি চলে যাচ্ছেন,দাদু তো বলছিল আপনার হবিষ্যির যোগাড় করতে হবে”।তখনই উঠানের অপরপ্রান্তে রান্নাঘরের দাওয়ায় চন্দ্রাকে দেখতে পেল, ইস্কুল যাবার জন্যেই সবুজ পাড় শাড়ী পরেছে সে।
“না, আমাকে এখনই যেতে হবে, দাদু কোথায় ?
“একটু বেরিয়েছেন ওপাড়ার দিকে,যেখানে কাল রাতে ডাকাতি হচ্ছিল।”
“আর বাড়ীর কেউ নেই,”
“মা রান্না করছে, ঠাকুমা পুজো করছে”।
“ঠিক আছে বলে দিও আমি চলে গেছি”।যাবার আগে আর এক বার বাড়ীটা দেখতে চাইল সুপ্রিয় ,জমাট বাঁধা একটা দীর্ঘশ্বাস বুক ফাঁকা করে বেরিয়ে এলো। আর দেরী নয়, উঠান পেরিয়ে দরজা খুলে রাস্তায় নেমে পড়ল, তখনও খেয়াল করে নি সে চন্দ্রাও আসছিল ওর পিছন পিছন।
“শুনুন”,চন্দ্রার ডাকে ঘুরে দাঁড়ায় সুপ্রিয়।“ কাল রাতে মা যেটা বলেছিল সেটা ঠিক নয়, আমি সকালে দাদুকে জিজ্ঞাসা করেছি”।
চন্দ্রার দিকে তাকিতে রইল সুপ্রিয়- অদ্ভুত দৃষ্টিতে, অপলক।
ভালো লাগলো