নেশা করলেও আমাদের বাড়ীতে ঢোকার আনুমানিক দেড়শ মিটার গলিপথটাকে কখনো রাজপথ বলে মনে হয়নি।অথচ আজকে এটাকেই আমার নিথর নিস্তেজ কাদা মাখা কুৎসিত মেছো কুমীর বলে মনে হচ্ছে। নেশা তো আজ করি নি এখনো। তবু কেন?… এই গলিপথটার অতীত বর্তমান সবই ছবির মত চোখের সামনে ভাসছে।
আশপাশে বাড়ী থাকলেও আমরা ছাড়া এই পথটা আর কেউ ব্যবহার করত না, আমাদের বাড়ীটাই ছিল একদম শেষে তাই এটা কানা গলি ।চারচাকার গাড়ী এই রাস্তায় ঢুকবে না, সেইজন্যেই মন্দিরা কে যখন গাঁটছড়া বাঁধে নিয়ে আসি, এই গলিপথটুকু তাকে হেঁটেই আসতে হয়েছিল।গলির মুখে একটা গেট তৈরী হয়েছিল বিয়ে উপলক্ষে, যেহেতু গলিটা বড় রাস্তার সংলগ্ন অস্থায়ী গেটটা কদিনের জন্যে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল, বিশেষতঃ সন্ধ্যের পর জ্বলানেভা আলোয় ফুটে উঠেছিল সলিল ওয়েডস্ মন্দিরা।চিরকাল তো ছেলেরাই মেয়েদের বিয়ে করে।এতে আর অবাক হবার কি আছে।
এই গলিতেই থান ইট সাজিয়ে উইকেট তৈরী করে ক্রিকেট খেলতাম কিশোর বয়েসে। মনে পড়ে একবার নবারুণ বোল্ড আউট হবার পর সাজানো ইটগুলো বলের ধাক্কায় পিছন দিকে না পড়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে ছিল নবারুণের বাঁপায়ের ওপর,ও বাঁহাতে ব্যাট করত। বুড়ো আঙ্গুলটা থেঁতলে গিয়েছিল। তারপর থেকে নবারুণ আর খেলতে আসত না। বেশ ক’দিন পর ওকে ডাকতে গেলে ওর মা আমাদের যা তা বলেছিল, অথচ আমাদের কিন্তু কোন দোষ ছিল। এখনকার ছেলেরা গলিতে ক্রিকেট খেলে না।তাই ফাঁকাই পড়ে থাকে। আমরা ছাড়া আর কেউ এই গলিতে আসে না।সেই সুবিধেটাই একদিন নিয়েছিলাম,বনিকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাই এই গলির মধ্যে।ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই এর একটা ল্যাম্প জ্বলে, গলির ঠিক মাঝামাঝি জায়গায়। যতবার ওখান দিয়ে যাতয়াত করি প্রতিবারই মনে পড়ে বনিকে ঠিক ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে চুমু খেয়েছিলাম।
বনি মন্দিরার সম্পর্কিত বোন, আমাদের বিয়ের পর দিন মন্দিরার সঙ্গে আমাদের বাড়ীতে এসেছিল, সেই সময় দিন চারেক ছিল। বনি মন্দিরার মতন সুন্দরী নয়, তবে ফিগারটা খুব সুন্দর, চিকন কোমর, চওড়া কাঁধ, মুখে সবসময় একটা দুষ্টু হাসি। মন্দিরার সঙ্গে আমার ভালবাসার বিয়ে, তাই বনির দিকে নজর দেবার খুব দরকার ছিল না। তার ওপর বিয়ের পরদিন বরকনে বিদায় হবার বেশ কিছুটা আগে,যখন বনি আমার কপালে চন্দন পরিয়ে দিচ্ছিল, সেই সময় ওর মুখে রাতজাগা বাসী নিশ্বাসের গন্ধ পেয়েছিলাম। আমদের বাড়ীতে এসে লক্ষ্য করলাম ওর একটু গায়ে পড়া স্বভাব আছে। পিছন থেকে চোখ টিপে ধরা, আঁচড়ানো মাথার চুল ঘেটে দেওয়া, খবরের কাগজ পড়াকালীন সেটা কেড়ে নিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে প্রশয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঝট করে ঘাড় ঘুরিয়ে নেওয়া, এই সব, এগুলো খুব হেলা ফেলা করার জিনিষ নয়,সে সমস্ত মেয়েরা এই বিষয়ে পারর্দশী, তারা জানে যে কোন পুরুষ মানুষের কাছে এটা কতখানি বিপদ্দজনক হয়ে উঠতে পারে। তবে বনিকে খুব একটা পাত্তা দিইনি, মনে করেছি শালীদের এইসমস্ত ঠাট্টা করা অধিকারের মধ্যে পড়ে।
সেদিন মন্দিরার কথায় খুব আশ্চর্য হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম ও কি বলছে! মন্দিরা ওদের পৈত্রিক ব্যবসা সঙ্গে জড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে ওকে টুরিস্টদের নিয়ে বাইরে যেতে হয়। ট্র্যাভেলিং সংস্থার অফিসে গিয়ে বসতে হয়।এতে আমার আপত্তি করার কোন কারণ নেই। দু এক বার আমিও গেছি ওদের সঙ্গে, তবে জামাই হিসাবে কোন বাড়তি সুবিধে নিয়ে নয়, অন্যান্য যাত্রীদের মতই পাই পয়সা মিটিয়ে দিয়ে।আমি নিজে একজন ক্রিমিন্যাল ল’ইয়ার,ক্রিমিন্যালদের সুবিধার জন্যে আমার চেম্বারটা বড় রাস্তার ওপর। গলি মাড়িয়ে তারা আসুক আমি চাইনি।রোজগার পাতি খারাপ করি না, তাই বেড়াতে গিয়ে পয়সা খরচ করতে খারাপ লাগেনি আমার। যে মেয়েটি আমাদের বাড়ীতে রান্না করত, সে দেশে গেছে শ্বশুর মশাই মারা গেছেন বলে। এদিকে মন্দিরাও দিন দশেক থাকবে না।এসব নিয়ে আমার খুব একটা চিন্তা ছিল না। যাহোক ব্যবস্থা একটা কিছু হয়ে যাবে জানতাম। কিন্তু মন্দিরার প্রস্তাবটা একেবারে অভাবনীয়। যাবার দুদিন আগে আমাকে ডেকে বলল,-
“শোন আমি তো কয়েক দিন থাকব না, তুমি কটা দিন বনির ওখানেই খাওয়া দাওয়া করো”। মন্দিরার সঙ্গে বনির যেরকম সম্পর্ক, বনিও মন্দিরার ওপরে অনেক বিষয়েই নির্ভরশীল,মন্দিরা বনিকে এই প্রস্তাব দিতেই পারে। কলকাতা শহরে মোটর বাইক থাকলে, কোর্টে যাবার আগে বা ফেরার পর বনির বাড়ীতে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে গল্প গুজব করে ফেরার মধ্যে কোন অস্বাভাবিকত্ব নেই। মন্দিরার মুখে এটা শোনার পর মনে হল আমি যেন ধরা পড়ে গেলাম।
আমার বিয়ে পর তো অনেকগুলো বছর কেটে গেছে,কোন ইস্যু নেই। মন্দিরাও পুরানো হয়ে গেছে। আর্কষণের জোয়ার শেষ হয়ে গিয়ে এখন নিখাদ ভাটা। নিজের কাজ কর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকি। বনিরও বিয়ে হয়েছিল বিরাট বড় লোক বাড়ীতে,বছর দেড়েক হল ওর স্বামী মারা গেছে, কলকাতায় ডেঙ্গি তো এখন মহামারীর মতন। বিয়ের পর ওর আসা যাওয়া ছিল না বললেই চলে, স্বামী মারা যাবার পর প্রায়ই মন্দিরার কাছে আসা যাওয়া করে। বনি এখন আর ওর শ্বশুরবাড়ীতে থাকে না। স্বামী মারা যাবার পর আলাদা ফ্ল্যাট কিনেছে, সেখানে একলাই থাকে। একমাত্র ছেলে পুরুলিয়ার সৈনিক স্কুলে পড়ে বোডিং থেকে।মন্দিরার কাছে ধরা পড়ার কথা মনে হবার কারণ মনে মনে একটা অপরাধ বোধ তৈরী হয়ে গিয়েছিল অজান্তেই।
বনির স্বামী মারা যাবার পর ওকে কেমন যেন সস্তা মনে হল। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে এরকম একটা। বয়সের সাথে সাথে ওর চোখে দুষ্ট মিষ্টি দৃষ্টিটা ছিল না বটে, কথা বার্তায় একটা ইঙ্গিত লক্ষ্য করতাম। আজকালকার দিনে শোকের আয়ু খুব বেশী দিনের নয়। তার ওপর যে সমস্ত মেয়েরা স্বামী মারা যাবার পর বিপুল অর্থের মালিক হয়। তাই বনি খুব তাড়াতাড়িই স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর শোক কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা শুরু করে ছিল। বনির ইঙ্গিতপুর্ণ ইসারা আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হত। তারই সুত্র ধরে ঘুমন্ত মন্দিরার পাশে শুয়ে বনিকে জড়িয়ে সেক্স ফ্যান্টাসীতে অনেকটা সময় পার করে দিতাম। এটা একটা নিছক নির্দোষ আমোদ বলে মনে মনে হত।
আমাদের এই গলিটাতে একটা আলো আছে, সন্ধ্যের পর একেবারে অন্ধকার নয়। মাঝে মাঝে ল্যাম্প কেটে যেতে না তা নয়, তবে দু’এক দিনের মধ্যেই পালটানো হত। আমরা ছাড়া গলিতে তেমন কেউ ঢোকেও না। সুতরাং ভয় পাবার কোন কারণ নেই। ইদানীং বনি এলে ফিরে যাবার সময় গলিটা পার করে বাসে বা ট্যাক্সিতে তুলে দিতে বলত। অধিকাশং সময় আমি থাকতাম না। মন্দিরাই বনিকে এগিয়ে দিয়ে আসত। মাঝখানে একদিন মন্দিরা বলছিল, “ স্বামী মারা যাবার পর বনি যেন কেমন হয়ে গেছে সব কিছুতেই ভয়, কিসের এত ভয় জানি না”।
সেদিন কোর্ট থেকে ফিরে এসেছি,সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে বনি সাধারণতঃ এতটা দেরী করে না,মন্দিরা বলল, বনিকে এগিয়ে দিতে। গলিটা পার হবার সময় ঠিক যখন ল্যাম্পের নীচে এসেছি, সমস্ত আলো নিভে গেল, লোডশেডিং তো এখন কমই হয়, কি কারণে বলতে পারব না। একরাশ অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ল গলিটার মধ্যে। তখনই বনিকে কাছে টেনে নিয়ে অনেকটা সময় নিয়েই চুমু খেলাম। বনি কোন বাধা দিল না, আপত্তিও করল না। ছেড়ে দেবার পর শুধু বলেছিল, “এতদিনে সাহস হল তাহলে”। গরম লোহায় জল ঢেলে দিলে ‘ছ্যাঁক’করে যেমন ঠান্ডা হয়ে যায়, আমার মন এবং শরীরের অবস্থা সঙ্গে সঙ্গে সেইরকম হয়ে গেল। এতদিন বনির নানা রকম ইসারায় যে সাড়া দিইনি সেটা তাহলে আমার ভীরুতা।আমার সংযমের কোন মূল্য নেই ওর কাছে! সক্ষম পুরুষ মানুষকে একজন মেয়ে ভীতু বললে এর থেকে খারাপ লাগার আর কিছু নেই। আমি আর কিছু বলিনি, বনিকে ক্যাবে উঠিয়ে দিয়ে ওর স্পর্শ সুখ বুকে নিয়ে ফিরে এসেছিলাম।মনটা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। সুযোগ পেলে এই বদনাম ঘোচাতে হবে সেটা মনে করেই বনিকে নিয়ে নতুন করে সেক্স ফ্যানটাসীর চিত্রনাট্য তৈরী করছি রোজ রাতে। মন্দিরার মুখে ওই কথাটা শুনে চমকে উঠেছিলাম মনে মনে। তাহলে কি মন্দিরা কোনভাবে আঁচ করেছে? তাই একটা সুযোগ তৈরী করে দিতে চাইছে? বারান্দা থেকে আমাদের গলিটা দেখা যায় বটে, বনি চলে গেলে, অনেকসময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে মন্দিরা ওকে টা টা করে। কিন্তু সেদিন অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, আমিও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখিনি বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে ছিল কিনা। এই সাবধানতাটুকু নেওয়া দরকার ছিল। বেপরোয়া হতে গেলে কি আর এসব চিন্তা ভাবনা করলে হয়না, বনি ঠিক কথাই বলেছিল।খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম,-“ বনির সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে এই নিয়ে”।
“না হওয়ার কি আছে, বনি এমনিতে খুব ভাল মেয়ে, তাছাড়া ও তোমাকেও খুব পছন্দ করে”। বুকের মধ্যে রক্ত ছলাৎ করে উঠল। আমি আর কোন কথা না বলে ঘরে চলে গেলাম।
(২)
কাল রাতে মন্দিরা চলে গেছে। সকাল থেকে বুকের মধ্যে একটা গুর গুর করা কাঁপুনি শুনতে পাচ্ছিলাম। সাহসী আমাকে হতেই হবে, মনের মধ্যে নানান সম্ভবনার কথা যে আসছিল না তা নয়। ভীতু মানুষের এসব হয়। কোর্টে আজ তেমন কোন কাজ ছিল না। সেকেন্ড হাফে একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়লাম, বাইক নিয়ে একেবারে সোজা বনির ফ্ল্যাটে। দরজা খুলে বনি যে একটু চমকে ওঠেনি তা নয়। হাসি মুখেই অভ্যর্থনা করল, “ আরে সলিলদা তুমি আসবে জানতাম,মন্দিরাদি কালকেই ফোনে বলেছে। তবে এত সকাল সকাল আশা করিনি”। খোলা বারান্দা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম, সত্যিই বিকেল তিনটেয় বাইরে ঝকঝকে শরৎকালের রোদ। সকাল সকালই বটে। “বসো সলিলদা, কোর্ট থেকে ফিরছ, আমি তোমার জন্যে জলখাবার বানিয়ে আনি”।
“না না বনি ওসব কিচ্ছু করতে হবে, আমি কোর্টের ক্যান্টিনে টিফিন করেছি, তুমি বরং একটু চা খাওয়াও”।
“সে তো করবই”।বলে বনি চলে গেল। বনির ফ্ল্যাটে এলে ওদের দক্ষিণের খোলা বারান্দায় বসি।ফুরফুর করে হাওয়া দেয়, ভারী ভাল লাগে। দুটো বেতের চেয়ার পাতাই থাকে।বনি চা নিয়ে এলে দুজনে পাশাপাশি বসে চা খাব। বারান্দায় ঢুকে মাথায় কিছু একটা ছুঁয়ে যাওয়া ওপর দিকে তাকিয়ে দেখি একটা দড়ি টাঙ্গানো রয়েছে, তাতে একটা জেন্টস্ আন্ডার গারমেন্ট শুকতে দেওয়া হয়েছিল, সেটাই আমার মাথা ছুঁয়ে গেছে। মাথায় হাত বুলিয়ে চুলটা ঠিক করে চেয়ারে বসলাম বটে, গলায় মাছের কাঁটা আটকানোর অনুভূতি তখন মনের মধ্যে। বনির ছেলে যদি এসেও থাকে, ওটা তো তার হতে পারে না,এত মোটা হয়ে গেছে নাকি? না না এটা কোন মাঝ বয়সী পুরুষ মানুষের।
ঠিক সেই সময় বাইরে বেল বাজলো। দরজা খুলে বনি যেন কার সঙ্গে চাপা গলায় কথা বলছে।কৌতুহলী হয়ে চেয়ারে বসেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। শার্ট প্যান্ট পরা বেশ মোটা বেটে একটা লোক, ছিপছিপে বনির উচ্চতাও লোকটিকে ছাড়িয়ে গেছে। হয়ত আমার সম্বন্ধেই কিছু বলছে। তারপরেই দেখলাম লোকটিকে নিয়ে বনি বারান্দাতেই এগিয়ে আসছে। ওরা দুজন বারান্দায় ঢুকতেই আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।
“ জীবন আমি তোমাকে বলেছিলাম আমার ল’ইয়ার জামাইবাবুর কথা ইনিই সলিল চক্রবর্তী, সলিলদা আমার বন্ধু জীবন শ্রীবাস্তব,গড়িয়াহাটায় নিউ লুক বলে গারমেন্টের দোকানটা ওদের, পাশেই ইভনিং ডিউ রেস্টুরেন্ট কাম বার, ওটাও ওর”। শ্রীবাস্তব বাবু নমষ্কার জানাতে জানাতে আমার পাশের চেয়ারে বসলেন-
“নমোসকার নমোসকার সলিলবাবু, ভাল লাগলো আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে”। কথায় অবাঙ্গালী একসেন্ট স্পষ্ট। “আমার অনেক ল’ইয়ারের সঙ্গে পরিচয় আছে,আপনার সঙ্গে ভি হয়ে গেল। আমাকে নন-বেঙ্গলী ভাববেন না,নন-বেঙ্গলী বলে হেট করবেন না”।
“না না ও কথা ভাবছেন কেন আমারও কত মক্কেল নন-বেঙ্গলী, সবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভাল”।
“বুঝলেন সলিলবাবু,আমিও অনেক দিন আছি কলকাতা,আমিও আপনাদের মত বাঙ্গালী হয়ে গেছি, বাংলা আমি খুব ভাল জানি বনি সে কথা বলে, বনি তো আমার খুব ভাল বন্ধু আছে ”।প্রথম দর্শণে লোকটাকে আমার ভাল লাগল না, না লাগার অনেক কারণ আছে, তবুও ভদ্রতার খাতিরে আমড়াগাছি করতেই হয়। লোকটির চেহারা মোটেই আকর্শনীয় নয়। মোটা ঠোঁট, ভারী গাল, দাঁতে পানের ছোপ, চোখ দুটো ছোট ছোট।আঙ্গুলে নানান পাথরের আংটি। সেগুলির জেল্লা দেখে বোঝা যাচ্ছে মোটেই খেলো নয়। আর হবেই বা কেন, বনির মুখে যেটুকু শুনলাম যথেষ্ঠই পয়সাওলা মানুষ।ওই সব নামী দামী পাথরই বোধহয় অহরহ লোকটার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে চলেছে। দুপুরেই মদ্য পান করে এসেছে । কথা বলার সময় গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বনি চা দিয়ে গেছে, ভদ্রলোক আমার পাশে বসেই চায়ের কাপ হাত বাড়িয়ে নিল । চায়ে চুমুক দিয়ে কেমন যেন বিস্বাদ লাগল।আমি চুপ করে বসে আছি দেখেই লোকটা আবার শুরু করল,-
“বুঝলেন সলিলবাবু,যে কথা বলছিলাম, আপনারা তো বাঙ্গালী, বাঙ্গালীদেরও আপনারা সেভাবে লাইক করেন না। মানে আপনাদের একতা বড় কম,আমি কিন্তু বাঙ্গালীদের খুব পচ্ছন্দ করি।”বুঝলাম লোকটা সারাক্ষণ তার বাঙ্গালী প্রীতি যে কতখানি সেই নিয়েই লেকচার দিয়ে যাবে। পাশে বসা কেউ এভাবে বলে গেলে কোন না কোন উত্তর দিতেই হয়, তবু আমি এতক্ষন চুপ করেই শুনে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সেটা বড়ই অভদ্রতা। একটা দুটো কথা বলতেই হয় মাঝে মাঝে।আসলে বলতে তো ইচ্ছে করছিল-“দূর বাঞ্চোত, থামবি তুই আমার মুডটাই নষ্ট করে দিয়েছিস”। কিন্তু সে কথা তো বলা যায় না, কথার সমর্থন করেই বললাম,-“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, আমরা বড় সেলফ কন্সাস, নিজেদের ছাড়া আর অন্য কারো কথা ভাবি না”। কোনক্রমে চা শেষ করে কাপটা নামিয়ে রাখলাম।লোকটার বাজে কথার শেষ নেই, আস্তে আস্তে মাথা ধরে যাচ্ছে।
“এই দেখুন না আপনি তবু আমার কথা বুঝতে পারছেন, অনেকেই আমার সঙ্গে তর্ক করে”। সে ইচ্ছে আমার একেবারেই নেই। “কি বলে জানেন”। শোনার ইচ্ছে একদম নেই তবু শুনতে হবে।
“বলে কি জানেন, অবাঙ্গালী হয়ে আমাদের বাঙ্গালীর ভাল কি বুঝবেন, আরে ভাই আমি আপনাদের ভালোর জন্যেই তো বলছি, আমিও তো আপনাদের মত বাঙ্গালী হয়ে গেছি, না কি বলেন হে হে হে। কি আর বলব, ওর অশ্লীল হাসির সঙ্গ দিতে দেঁতো হেসে বলতেই হল “সে তো বটেই”।
“আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করে,কিন্তু সব জায়গায় বাঙ্গালীদের কেমন করে প্ল্যানড্ ওয়েতে সাপ্রেস করা হচ্ছে বলুন”। উলটো দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
বিকালের আলো কমে আসছিল, দিন ছোট হতে শুরু হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। এসব মানুষদের সঙ্গে কি যে কথা বলব, চুপ করে থাকলে আমার অস্বস্তি যদি ধরা পড়ে যায়, সেটা তো আর মিথ্যে নয়, কতক্ষণ আর এইসব ননসেন্স কথায় এইভাবে ঠেকা দেওয়া যায়। লোকটাকে যে আমি পছন্দ করছি না, সেটা যে কোন বুদ্ধিমান লোকই বুঝতে পারত। পয়সা থাকতে পারে কিন্তু যেসব বস্তু থাকলে এসব বোঝা যায়, সেই পদার্থ মগজে আছে বলে মনে হয় না। বনি যে কোথায় গেল, এই লোকটাকে আমার পাশে বসিয়ে দিয়ে গেল তো গেল।
“কি করবেন এখানে বসে, চলেন ঘরে যাই, এবার মশা কামড়াবে”।
“ না আমি আর বসব না, এবার উঠব”।
“আরে কোথায় যাবেন, বনি আমাকে সব কিছু বলেছে, আপনি ওর দাদার মতন, খুব ভালবাসেন ওকে” । বলেই আমার হাত ধরে চেয়ার থেকে উঠিয়ে নিলো। সঙ্গে সঙ্গে সেই শুকতে দেওয়া আন্ডারওয়্যার আবার আমার মাথা ছুঁয়ে গেল। ভদ্রলোক তখন ঘরে ঢুকে এসেছে। আমার নজর তখন ওর পাছার দিকে, হ্যাঁ, একেবারে সাইজমত, মানানসই দড়িতে ঝোলা আন্ডার ওয়্যারের সঙ্গে। ইচ্ছে করেই গলা তুলে ডাক দিলাম, “বনি এবার আমি বেরিয়ে যাব”। ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে আমার হাত ধরে টানতে টানতে ঘরেতে নিয়ে চলল,হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম,-“বনি কাল বলছিল আমাকে ফোনে,আপনার বাড়ীতে এখন মিসেস্ নেই,আপনি এখানেই খাওয়া দাওয়া করবেন, তাহলে, এর মধ্যে কোথায় যাবেন, চলুন ঘরে বসি, কি খাবেন বলুন, প্রথম পরিচয় হল”। ভদ্রলোকের ইঙ্গিত স্পষ্ট, এই লোকের সঙ্গে বসে মাল খাওয়া আমার রুচিতে বাধবে। তবুও পিছন পিছন ঘরে ঢুকলাম। বনি এসে দরজার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছে। “আমার খুব দেরী নেই সলিলদা, একেবারে খাওয়া দাওয়া করে গেলেই ভাল নয়?”
“না না পেটটা ভার হয়ে আছে দুপুরের খাওয়াটা ঠিক মত হজম হয়নি ”।
“ঘাবড়াবেন না সলিল বাবু, বনির কাছে ওষুধ আছে, কি বলে যেন গ্যাসো ফাস্ট না নাকি,? কপাল কুঁচকে বনির দিকে তাকালাম, আমার বিরক্তিটা ওকে বোঝাবার জন্যে। বনির না বোঝার কোন কারণ ছিল না।
“ঠিক আছে সলিলদা পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমি একটা টিফিন কৌটোয় খাবার ভরে দিয়ে দিচ্ছি। সারা রাত না খেয়ে কেউ থাকে নাকি , খানিক পরে নিশ্চয়ই খিদে হবে”। বাধ্য হয়েই আবার সোফার ওপর বসলাম। আমার সামনেই লোকটা জামাকাপড় ছাড়তে শুরু করল, লুঙ্গিটা মাথা গলিয়ে দাঁতে চিপে ধরে প্যান্টের বোতাম খুলছে। শুধু তাই নয়, লুঙ্গিটা দাঁতে চিপে ধরেই দু’একটা কথা বলছে,প্যান্টটা বোধহয় আটকে রয়েছে,লুঙ্গির ভেতর হাত ঢুকিয়ে সেটা আলগা করে কোমর নাড়াতেই খুলে পায়ের কাছে জড় হল, এবার একইভাবে খসে পড়ল লাল রঙের জাঙ্গিয়া, যেটা মাথায় ঠেকেছিল সেটা নীল, চট করে চোখ সরিয়ে নিলাম।
“জানেন সলিল বাবু প্যান্ট শার্ট পরে বেশীক্ষণ থাকতে পারি না,বড় গরম করে, আজ একটা মিটিং ছিল আমাদের এ্যাসোশিয়েশানের। তাই আর কি, না হলে লুঙ্গি পাঞ্জাবীই আমার ফেভারিট ড্রেস”।অসহ্য লাগছে, মনে মনে ছটফট করছি কতক্ষণে এখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হব। এই লোকটা এখন বনির চোখে সাহসী, যে একেবারে বেডরুমে ঢুকে লুঙ্গি দাঁতে চিপে প্যান্ট ছাড়ছে, তাও আমার সামনে আর আমি, শালা থার্ড পারসন, সিঙ্গুলার নাম্বার। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।
“চললেন সলিলবাবু তাহলে একদিন আমরা সেলিব্রেট করব, দিন ঠিক করবেন আপনি এ্যারেঞ্জমেন্ট আমার”। কোন উত্তর নাদিয়ে চলে আসছিলাম। তার আগেই বনি একটা ছোট টিফিন কৌটো হাতে ধরিয়ে দিল।
“কিছু মনে করবেন না সলিলদা আপনাকে এন্টারটেন্ড করতে পারলাম না,একদিন আমি যাব আপনাদের বাড়ীতে”। অবাক হয়নি বনির আপনি বলায়, জীবনের সামনে ও জানাতে চায় না তুমি সম্বোধনে ওর আর কেউ আছে”।
(৩)
ফেরার পথে বাইকটা গেল বিগড়ে, প্রায় দেড় কিলোমিটার ঠেলতে ঠেলতে চেনা গ্যারেজে ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি।বাকী রাস্তাটুকু অনেকটা হলেও হেঁটেই চলে এলাম।কিন্তু আমাদের গলিতে তো কেউ কখনো ঢোকে না,দরকারও তো পড়ে না, তবু আজ একজনকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম। অপরিচিত, চোর ছ্যাঁচড় বলে মনে হল না,জিজ্ঞাসাও করা হল না। কিছুটা এগিয়ে আসতেই বুঝতে পারলাম গলিতে ঢোকার উদ্দেশ্য, নাকে তীব্র পেচ্ছাবে গন্ধ এল, আপনাআপনি মুখ দিয়ে একটা খারাপ গালাগাল বেরিয়ে এল স্বগতোক্তির মতন। ল্যাম্পের নীচে গলির সেই বিশেষ জায়গাটা যাওয়া আসার সময় প্রতিবারই বনিকে মনে পড়ত, সেখানে কে একটা স্যানেটারী ন্যাপকিন ফেলে গেছে। আরো অনেক ভাবনা আসতে চাইছিল স্যানেটারী ন্যাপকিনটাকে ঘিরে, একদলা থুথু গলার ভেতর থেকে আপনাআপনিই বেরিয়ে এল সমস্ত ভাবনাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে।লাথি মেরে স্যানেটারী ন্যাপকিনটা ফেলতে গিয়ে একটা থান ইটে ধাক্কা খেলাম ,বুট জুতো তো নয় এই ধরনের জুতোয় পায়ের আঙ্গুল গুলো সামনের দিকে বেরিয়ে থাকে, বুড়ো আঙ্গুলটা ঝনঝনিয়ে উঠল। মনে হল বোল্ড আউট হয়ে সব কটা থান ইট পায়ের ওপর পড়েছে। যন্ত্রণার মধ্যেই মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল,বনির ফোন, লাইনটা কেটে দিলাম।তখনই মনে পড়ল টিফিন কৌটোটা মোটর বাইকের ডিকিতে ফেলে এসেছি।
ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ঘুরে বাড়ীর দিকে যেতে যাব নাকে একটা আঁশটে গন্ধ ভেসে এল, চিড়িয়া খানা গিয়ে ঘড়িয়াল দেখা সময় এই রকম গন্ধ পেয়েছিলাম,নেশা না করলেও তখনই গলিটা কে কাদা মাখা একটা কুৎসিত মেছো কুমীর বলে মনে হতে লাগল।