আত্মজীবনী না আত্মপ্রচার

আমার কতিপয় শুভানুধ্যায়ীর মধ্যে কুচবিহার মাথাভাঙ্গার তিতির পত্রিকার সম্পাদক সঞ্জয় সাহা একজন। প্রায়শঃই তিনি আমাকে প্ররোচিত করেন আত্মজীবনী লেখার জন্যে। আত্মজীবনীর গুরুগম্ভীর ভারের কথা চিন্তা করেই এড়িয়ে গেছি। সবসময়ই মনে হয়েছে আমার মত মানুষ যারা, যাদের সাধারণের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়াই ভবিতব্য আত্মজীবনী লিখে ভার বৃদ্ধির কোন প্রয়োজন নেই। যেহেতু জীবনের সিংহ ভাগ কেটে গেছে পুলিশের চাকরীতে, সুযোগও থেকেছে কিছু কিছু বীরত্ব দেখাবার যদিও তার পরিসর খুব কম, সাধারণ মানুষ আবার সেই বাঘ মারার গল্প গুলিই জানতে চায় বেশী করে, ফলে সেটি আত্মজীবনীর নামে আত্মপ্রচার হয়ে উঠবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকে না। গুরুদেব যতই বলুন না কেন “ আপনারে যেন না করি প্রচার আমার আপন কাজে”। আমরা সকলেই নিজের প্রচার করতে উন্মুখ।যে যেমনি হই না কেন সুযোগ পেলেই তার সদ্‌ব্যবহার করে থাকি। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ছে, কোন এক গ্রামীণ থানায় যাত্রানুষ্ঠানে ডিউটি করছি, সঙ্গে কনেস্টেবল, হোমগার্ড, এনভিএফ সকলেই আছে। অনুষ্ঠান শুরু হয়নি, দর্শকরা আসতে শুরু করেছে। আমরা টিন দিয়ে ঘেরা দর্শক আসনের বাইরে। ইতিমধ্যে একটি মাঝবয়সী লোক নমষ্কার জানিয়ে কথা বলতে শুরু করল। চিনতে পারলাম, আগে যে থানায় কাজ করেছি, সেখানকার গ্রামের একজন। এখানে আত্মীয় বাড়ী, যাত্রা দেখে রাত্রিতে থেকে যাবেন। কথাবার্তা যখন চলছে, এক কনেস্টেবল এসে সরাসরি সেই লোকটিকে জিজ্ঞাসা করল “কি দাদা চিনতে পারছেন”। লোকটিও হেসে বলল “ আরে অমরবাবু আপনিও এখানে, যাক ভালই হয়েছে । জানা গেল কনেস্টবলটি ওই লোকটির বাড়ী যে গ্রামে সেখানকার ফাঁড়িতে বেশ কিছু দিন ছিল। ফলে স্থানীয় মানুষ অনেকেই তার পরিচিত। লোকটী কনেস্টেবলের সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে আমার সঙ্গেই কথা বলতে লাগল। কিন্তু কনেস্টবলটি তার কথার মাঝখানে নানান প্রশ্ন তুলছিল। সেই সব জিজ্ঞাসার প্রধানতঃ ওমুক ডাকাত এখন রাতে বাড়ীতে শোয় কিনা, তমুক চোর জেল থেকে ছাড়া পেল কিনা, সেই বিখ্যাত স্মাগলারটি এখন কি করছে, বর্ডারে তো খুব কড়া কড়া ইত্যাদি, লোকটি কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর দিতে খুব আগ্রহী নয়। যেহেতু সে গ্রামের ভদ্রমানুষ, এদের নাম শুনে থাকলেও কে কি করছে সে সমন্ধে তার কোন জ্ঞান নেই। বারে বারে কথার মাঝখানে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে, সে বলল, “ স্যার আমি ভেতরে ঢুকলাম, দেরী হলে ভাল জায়গা পাওয়া যাবে না”। লোকটি চলে যেতেই কনেস্টবলটি বলল, “ কতবড় বেইমান দেখলেন”। আমি আশ্চর্য হয়ে বলি, “ বেইমানের কাজ ও কি করল?” “ শুনলেন একবারও আমার কথা বল্ল”। “আপনার কথা আবার কি বলবে ? যাত্রা দেখতে এসে চিনতে পেরে দু’চারটে কথা বলে গেল”। “আপনি জানেন না স্যার, মনসুর ডাকাত ফাটিয়ে দিচ্ছিল ওদের অঞ্চলে একের পর এক ডাকাতি করে, ওসি ধরতে পারে না, সি আই ধরতে পারে না, সি আই ডির টিম এসে ঘুরে যায়। একদিন দেখি পদ্মমালার হাটে মুরগী কিনছে। পিছন থেকে গিয়ে ঘাড়টা চেপে ধরে মুন্ডুটা বগলের ফাঁকে নিয়ে এমন চাপ দিলাম, জিভ প্রায় বেরিয়েই যায়। ওই অবস্থায় টানতে টানতে প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তা নিয়ে গিয়ে ফাঁড়িতে ফেললাম। রাস্তার দুধারে লোক দাঁড়িয়ে পড়েছিল। একবারও বলল স্যার সে কথা”। মনে মনে হাসি পাচ্ছিল, হায়রে কবে কোন কালে ও ডাকাত ধরেছে, মনে মনে আশা আকবর বাদশার গৌরব গাথার মতন সেসব কথা লোকের মুখে মুখে ফিরবে। লোকটি সেসব কথা উল্লেখ না করায় ভীষণ আঘাত পেয়েছে। অনেক পরে মনে মনে ভেবেছে সত্যিই তো ওর কাজের তো আমরা কেউ মূল্যায়ন করি না। এই প্রত্যাশা তো আমরা সকলেই মনে মনে করি, নিজের সামান্য কৃতকর্মের কথা যেন সকলে আলোচনা করে। কবে কোন খবরের কাগজের পাতায় আমার ছবি বেরিয়েছে, কিংবা কোন পত্রিকায় আমার লেখা ছেপেছে, সেটা যখন নানান ভাবে সকলকে জানাতে চাই,মনে মনে এ ইচ্ছে তো থাকেই সকলে যেন সেটা নিয়ে মন্তব্য করে। তখন কি আর অমর কনেস্টেবলের মানসিকতার সঙ্গে নিজের কোন তফাৎ খুঁজে পাই না । জীবন একটা বড় সমুদ্র, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বিস্মরণের তাপে শুকতে শুকতে ঘোলা ডোবায় পরিনত হয়। আমাদের মতন লোকের আত্মজীবনী মানেই সেই ঘোলা জলে পাঁক ঘেঁটে যা সংগ্রহীত হয়নি সেই মণি মুক্তোর সন্ধান করা। শেষ পর্যন্ত রোমন্থনের আঁচে পাক হতে হতে যা পড়ে থাকবে তা শুধু আত্মপ্রচারের গাদ।

This Post Has One Comment

  1. amitava das

    ভালো লাগল । চলুক লেখাটা ।

Leave a Reply to amitava das Cancel reply